অনিন্দিতা মণ্ডল

মাতৃতন্ত্র
পর্ব ২

সিন্ধু জনগোষ্ঠী যে মাতৃকুলভিত্তিক ছিল তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় হরপ্পার সমাধিক্ষেত্র থেকে। সমাধিক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায় নারীদের মাতৃকুল অনুযায়ী সমাধিস্থ করা হয়েছিল। একই পরিবারের নারীদের সম্ভবত একই ক্ষেত্রে সমাধি দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি গৃহে মাতৃদেবীর কাদামাটির মূর্তি ছিল। একটি অনুমান এ থেকে করা সম্ভব যে নারীর অবস্থান থেকেই পরিবারের অবস্থান সুচিত হতো। কিন্তু তাই বলে নারী এখানে সম্মানজনক অবস্থানে থাকতনা। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে হরপ্পার কঙ্কালগুলোর দন্তসংক্রান্ত গবেষণায়। দেখা গেছে নারীদের তুলনামূলক ভাবে অনেক কম যত্ন নেওয়া হতো। তাদের খাদ্যে মাংসের পরিমাণ অনেক কম ছিল। তাহলে মাতৃতান্ত্রিক বলব কেন? কারণ এসবই সিন্ধুর সম্পন্ন সময়ের কথা। যখন সভ্যতার উৎকর্ষ ভীষণ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তখন সমাজে নারীর অবস্থান পুরুষের ক্ষমতার আওতায় এসে পড়েছে। এর আগে, গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে নারীই ছিল প্রধানা। কৃষিক্ষেত্রে, শিল্প উৎপাদনে তার ভূমিকা ছিল প্রধান। পুরুষ তখন উদ্বৃত্ত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে, জলধারার রক্ষণে ব্যস্ত। সভ্য নগর গড়ে ওঠার আগে গ্রামগুলির চারিদিকের বন্য এলাকার থেকে বাঁচতে পুরুষের পেশী শক্তি কাজে লেগেছিল। নারী তখনও সৃষ্টিশক্তি। কি কৃষিতে কি সন্তান প্রসবে। কিন্তু ধীরে ধীরে নগর গড়ে উঠল। উদ্বৃত্ত সম্পদের প্রাচুর্য বৈদেশিক বানিজ্যে প্রেরণা দিলো। পুরুষ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হল। কারণ বৈদেশিক বানিজ্যে নারীর ভূমিকা ছিল নগণ্য। তার প্রধান ভূমিকা ছিল নিজের ক্ষেত্রে। ফলে, বানিজ্যে উদ্ভুত সম্পদ গেলো পুরুষের হাতে। এলো বণিক সম্প্রদায়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে এলো পুরোহিত সম্প্রদায়। তারা তখনও নারীকে মাতৃকা মূর্তিতে পূজা করে চলেছে। কারণ সৃষ্টিরহস্যে নারীর অবিসংবাদী ভূমিকা তারা অস্বীকার করতে পারছেনা। কিন্তু অন্যদিকে তারা নারী নির্যাতনের বিভিন্ন পন্থা খুঁজে বার করছে। এই বণিক সম্প্রদায় ও পুরোহিত সম্প্রদায় মিলেই যে একটি শক্তিশালী সিন্ধু রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল সে একদিন প্রমাণ হবে। আপাতত সিন্ধুতে নারীর অবস্থানের দুয়েকটি প্রমাণ দিই। নৌশেরা থেকে পাওয়া গিয়েছে একটি কাদামাটির প্লেট। তাইতে একজন নারী একটি চ্যাপ্টা পাথরের ওপর বেলন দিয়ে শস্যদানা চূর্ণ করছে। সিন্ধুর বাসভবনে পাওয়া অসংখ্য তকলি থেকে অনুমান করা যায় ঘরে ঘরে নারীরাই সুতো কাটত। ঘূর্ণমান হস্তচালিত জাঁতা এবং চরকার উদ্ভাবন তখনও হয়নি। সুতরাং উভয় প্রকার কাজই পরিশ্রমসাধ্য ছিল। পুরুষ এসব কাজে নিযুক্ত হয়েছে সে প্রমাণ কোনও চিত্রেও পাওয়া যায়নি।

একেবারে অন্য একটি দিক উত্থাপন করি। সিন্ধুর নানা ভাস্কর্যর মধ্যে একটি নৃত্যরতা নারীমূর্তির কথা সর্বজনবিদিত। নারীটি নগ্নিকা। দুই বাহু অলঙ্কারে ভূষিত। এমন নগ্নিকা মূর্তি যে দেবীমূর্তি নয় তা বলাই বাহুল্য। তবে এ কিসের মূর্তি? কোনও নগরনটীর কি? নারীর সেই আদিম ব্যবহার! কোনও মুগ্ধ সেবাক্রেতা অতঃপর ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন! মাতৃকৌলিক হোক বা মাতৃতান্ত্রিক হোক, কেন্দ্রীভুত ক্ষমতার মধ্যে রাষ্ট্রের উদ্ভবের মধ্যে নারীর মনুষ্যত্ব চিরকাল পদদলিত। 

চোখ ফেরাই আরেকটু অর্বাচীন কালে। দেখে নিই একটি অন্য প্রেক্ষিত । দক্ষিণ ভারতে অনার্য যে মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, তার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে গীতি থাডানির দুটি বইতে। Sakiyani: Lesbian Desire in Ancient and Modern India এবং Mobius Trip বই দুটিতে তার গবেষণার কথা জানাচ্ছেন গীতি। গীতি স্বনামধন্য। তিনি একজন শিক্ষাবিদ। কারোর অস্তিত্বের সঙ্গে ‘সমকামী’ শব্দবন্ধ জুড়ে দেওয়ার যে রেওয়াজ থেকে আমরা এখনও মুক্ত হতে পারিনি, গীতির পরিচয় খুঁজলে তার উদাহরণ মিলবে। যাই হোক, তিনি তার বইতে লিখছেন, ভারতের, বিশেষত দক্ষিণ ভারতের উপকূল জুড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছিল যোগিনী মন্দির। যোগিনী বৌদ্ধ ধর্মে ব্যবহৃত ডাকিনী শব্দটির সঙ্গে প্রায় সমার্থক। এই মন্দিরগুলো আর্য মন্দিরের মতো নয়। এগুলি বৃত্তাকার। মাথায় কোনও ছাদ নেই। উন্মুক্ত। পরিধি জুড়ে যে প্রাচীর, তার কুলুঙ্গিতে থাকত দেবদেবীর মূর্তি। মাঝের বৃত্তাকার চত্বরে একটি বৃহৎ যোনিপ্রস্তর। গীতি জানাচ্ছেন, এইসব তথাকথিত যোগিনীরা, (যাদের আমরা একসময়ের শক্তিময়ী নারী ভাবতেই পারি) ছিলেন সর্বৈব স্বাধীন। তাদের  মন্দির চত্বরে সম্ভবত কৌল চক্রের মতো চক্র বসত। সেখানে নারীই প্রধানা। সক্রিয়। পুরুষ খানিক নিষ্ক্রিয়। কিন্তু চক্রে স্ত্রী পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত চর্চার কথা তো সকলেই জানেন। আর্যরাই ধর্মাচরণকে সম্পূর্ণ স্ত্রীমুক্ত করে। তাদের তৈরি শাস্ত্রই বিশাল তালিকা তৈরি করেছে যুগে যুগে। নারীর কিসে কিসে অধিকার নেই, সেই তালিকা দাখিল করতে গেলে, মৈনাক পর্বত যদি কলম হয়, আর সাত সমুদ্র যদি কালি হয় , তাও বোধ হয় লিখে শেষ করা যাবেনা।

গীতির লেখার মধ্যে প্রকটরূপে বর্তমান, প্রাচীন ভারতে নারী সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল। তার অবস্থান পুরুষের মতোই সমান মর্যাদাপূর্ণ ছিল। অতএব সিন্ধুপরবর্তী সময়ে ধর্মের হাত ধরে নারী আবার স্বমহিমায় উপস্থিত। 
এবার ফিরে দেখব, ভারতীয় পুরাণের দিকে। পুরাণ রামায়ন ও মহাভারতের কাল। একটি কাহিনী শোনাবো। এ কাহিনী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষ্যে লিখিত।

বৈবস্বত মনুর কন্যা ইলা। ইক্ষ্বাকুর ভগ্নী। যদিও বায়ুপুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে ইলাকে মেয়েই বলেছে, বিষ্ণুপুরাণ কিন্তু জানাচ্ছে, ইলা প্রথমে পুরুষ হয়েই জন্মেছিলেন। পরে নারী হন। বা কিম্পুরুষ। যার নাম সুদ্যুম্ন। এই সুদ্যুম্ন চন্দ্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রতিষ্ঠিত বংশ ঐল বংশ নামেও পরিচিত। রামায়ণে আছে, ইলা নাকি মৃগয়াতে গিয়ে ভুলবশত সহ্যাদ্রি পর্বতে অবস্থিত পার্বতীর শরবনকুঞ্জে ঢুকে পড়েছিলেন। সেখানে শিব ছাড়া অন্য পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তাই পার্বতীর অভিশাপে তিনি নারী হয়ে যান। ওই কুঞ্জে নাকি বৃক্ষলতা পর্যন্ত নারী। এই অভিশাপের ফলে ইলার সঙ্গের পারিষদেরাও নারী হয়ে যান। বা কিম্পুরুষ। ইলা বাধ্য হয়েই বনে রয়ে গেলেন। এখন নারী ইলাকে দেখে বনে তপস্যারত চন্দ্রপুত্র বুধ মোহিত হয়ে পড়েন। তিনি নাকি প্রগাঢ় তপস্বী। তবুও সংযমের বাঁধ ভাঙছে। তিনি ইলাকে প্রেম নিবেদন করলেন। সম্ভবত ইলারও এছাড়া কোনও উপায় ছিলনা সমাজে ফেরবার। তাই তিনি বিবাহ করলেন বুধকে। এরপর নাকি একমাস অন্তর অন্তর ইলার লিঙ্গ পরিবর্তিত হতে থাকে। যেসব মাসে তিনি নারী সেসব মাসে তিনি বুধের সঙ্গে দাম্পত্যে মেতে থাকতেন। আর যখন তিনি পুরুষ তখন তিনি ব্রহ্মচর্যে কাল কাটাতেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলনা। কিম্পুরুষ রূপে ইলার অস্তিত্ব সিদ্ধ হলনা। কারণ ন মাস পর তার একটি পুত্র হল। নাম পুরুরবা।

স্কন্দপুরাণ কিন্তু বলছে ইলা নাকি মেয়ে হতেই চেয়েছিল। স্বেচ্ছায় সে নারী হবার জন্যেই শরবনে প্রবেশ করে। ইলার পুত্রসন্তান হতে একটি প্রত্যক্ষ ফল এই, যে, ইলার পিতা তাকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। কারণ তিনি নারী। সম্পত্তি পান পুরুরবা। মানে কিম্পুরুষ ইলার সন্তান। কারণ তিনি পুরুষ।

এই কাহিনীটি অবশ্যই রূপকধর্মী। শিবপার্বতীর গোপন মিলনস্থলে ঢুকে পড়ে তিনি অপরাধ করেছিলেন। কেন? তন্ত্রের স্রষ্টা শিব ও তন্ত্রের প্রধান দেবী পার্বতীর মিলন তো স্বর্গীয়! তাহলে তা দেখা অপরাধ কেন? যৌনতার ওপরে বিধিনিয়ম? নাকি শিব ও পার্বতীর বৈদিক দেবতারূপে উত্তরণের ফল? এবং শাস্তি হিসেবে ইলা কিম্পুরুষে পরিবর্তিত হলেন। একই অঙ্গে নারী ও পুরুষের চিহ্ন ধারণ করলেন। মানে তার স্বাভাবিক চিহ্ন বিলোপ করা হলো। ভয়ংকর! প্রাচীন ধর্মীয় আচারকে গিলে ফেলে তাইতে বৈদিক শিলমোহর লাগানর কাজ শুরু হয়েছে তো আগেই। তাই শিব পার্বতী এখন আর লোকায়ত দেবতা নন। তারা এখন বৈদিক দেবদেবী। ইলার সঙ্গে সঙ্গে তার অনুচরবর্গও কিম্পুরুষে  পরিবর্তিত হলো।

বুধ যে তাকে বিবাহ করলেন সেও বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে। হয়ত তিনি অনুধাবন করতে পারেননি যে ইলা কি নিদারুন শাস্তি পেয়েছেন।

এ পর্যন্ত সব ঠিক। কিন্তু এরপরে ইলা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। পুরুরবা। কেমন যেন মনে পড়ল চিত্রাঙ্গদার কথা। তবে কি ইলা মেয়ে হয়েই জন্মেছিল? পিতা কন্যারূপ গোপন করে ইলাকে সুদ্যুম্ন সাজিয়ে জগতে পেশ করেছিলেন? যাতে কোনভাবেই সম্পত্তি অন্য বংশে না যায়? আর সুদ্যুম্নবেশী ইলা গভীর অরন্যে মিলিত হলেন বুধের সঙ্গে! ঠিক যেমন পুরুষবেশী চিত্রাঙ্গদা ব্রহ্মচারী অর্জুনের প্রেমে পড়েছিল। প্রেমের সঙ্গে কারই বা যুদ্ধ চলে! তিনি নিশ্চয় নিজের কথা খুলে বলেছিলেন বুধকে। অরন্যেই তারা ঘর বাঁধলেন। পিতার মিথ্যাকে সত্য প্রমাণিত করতে ইলা একমাস অন্তর নিজেকে পুরুষরূপে পেশ করতেন। তবু শেষরক্ষা হলনা। তিনি সন্তানের জন্ম দিলেন। আর পিতাও দৌহিত্রকেই সম্পত্তি প্রদান করলেন। ইলা বঞ্চিত হলেন সম্পত্তি থেকে। কারণ তিনি নারী। নারী হয়ে সম্পত্তির অংশ পেলে সে সম্পত্তি জামাতার হবে। ইলার এই মিথকে ভাঙলে এই তো চোখে পড়ে!


(ক্রমশ) 
 anindita.gangopadhyaya@gmail.com  



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.