কালিম্পং এর পথে
একটুকরো উড়ো মেঘ বিদায় জানিয়ে চলে যেতেই আমাদের গাড়ি ছুটতে শুরু করলো। পিছন ফিরে বিদায় জানালাম ল্যাপচাজগৎকে। পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাওয়া, বাঁপাশে বয়ে চলা তিস্তার সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ছোটো ছোটো জনপদকে পিছনে ফেলে গাড়ি এসে দাঁড়ালো একটা ছোট্ট জনপদের মাঝে। রাস্তার এধারে ওধারে গুটি কয়েক বাড়ি, দোকান। ডানদিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা সবুজ ঘাসের টিলার উপর সুন্দর সাজানো বাগান। রকমারি ফুলের বাহারে চমক লেগে যায়। এটাই ‘লামাহাটা’। টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করলাম। সুন্দর পরিবেশ। নরম সবুজ ঘাস দেখলে মনে হবে নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দেওয়া যেতে পারে। বেশ ঘন্টাখানেক সময় যেন কোথা দিয়ে বয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আবার শুরু হলো পথচলা। নির্জন পাহাড়ি পথের উপর পড়ে থাকা শুকনো পাতারও যে এতো রূপ থাকে তা যেন এই প্রথম অনুভব করলাম। পথচলা আর পথচলা সারি সারি গাছের মাঝদিয়ে। কখনও চোখে পড়েছে টুকরি নিয়ে হেঁটে চলেছে পাহাড়ি মেয়ে। কার্সিয়াং এর কাছাকাছি আসতেই বদলে গেল প্রকৃতি। আরোও সবুজ, আরও তাজা কালচে সবুজ পাইনের বুকে মেঘ ভেসে চলেছে। সরু ছোটো রেলপথে ছুটে চলেছে ছোট্ট ট্রেন পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। মন চাই এখানেই থেকে যাই অনন্তকাল।
ঠিক একটা হবে তখন। আমরা পৌঁছালাম কালিম্পং। একেবারে শহরের মাঝে। ভিড়ে ঠাসা কালিম্পং কেমন যেন হতাশ করলো। এখানে কোনো হোটেল ঠিক করা নেই, কোথায় থাকবো? এত ভিড় বাজার এলাকা কিন্তু একটা মানের হোটেল চোখে পড়ছে না। গাড়ি আমাদের ড্রপকরে ফিরে যেতে চায়লো। হোটেল পাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে রাজি নয়। গাড়ি ছেড়ে জিনিস আর ছেলেকে নিয়ে চারমাথার মোড়ে ফুটপাথের উপর দাঁড়ালাম, আর কত্তা গেলেন হোটেল খুঁজতে। প্রায় ঘন্টাখানেক হোটেল খুঁজে হোটেল না পেয়ে যখন বেশ চিন্তিত,দেখা পেলাম এক ড্রাইভারের। তারকাছেই শুনলাম, ভালো হোটেল সব মূল শহরের বাইরে আছে। তিনিই আমাদের নিয়ে গেলেন হোটেল ‘কর্ম্ফোট ইন’। একটা গ্রাম্য পাহাড়ি রাস্তার তিনমাথার মোড়ে সুন্দর থাকার জায়গা পেয়ে বেশ খানিক নিশ্চিন্ত হতেই পেটে ছুঁচোর ডন মারাটা টের পেতে শুরু করলাম। এতসবের মাঝে ঘড়িতে তখন দুটো পনেরো বাজে। হোটেলের নিজের খাবার তৈরির ব্যবস্থা নেই, কিন্তু অর্ডার দিলে ওরাই খাবার ব্যবস্থা করে। এতবেলায় ভাত ছাড়া অন্য কিছু জোটার আশ্বাস ওরা দিলেন। আমরা ফ্রেশ হতে হতেই চাউমিন পৌঁছালো আমাদের টেবিলে। মার্চমাসের দিন এমনিতেই ছোটো, তাতে পাহাড়। তিনটে পনেরোর দিকে আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। হোটেলের ম্যানেজার জানালেন, এক কিলোমিটার মত হাঁটলেই সামনে বাজার আছে। পড়ন্ত বিকেলে, দু’পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো গাছের সারির মাঝদিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা। পথে বিছানো হলুদ হয়ে যাওয়া শুকনো পাতারা। গাছ থেকে টুপ টুপ ঝরে পড়া হলুদ পাতা বসন্তের গান গায়ছে যেন। পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম বাজারে। আরে একটু আগেই তো আমরা এই বাজারেই দাঁড়িয়েছিলাম জিনিসপত্র নিয়ে।
বাজারটা এতো কাছে বুঝতে পারিনি তখন। বেশ আনন্দ হচ্ছে মনে। একটা ফুরফুরে বাতাস বইছে। আমরা দোকানে দোকানে ঢুঁ মারছি। হঠাৎ আকাশের এক কোণে শুরু হলো কালো মেঘের আসা যাওয়া। আমরা ফেরার পথে ছুটে চলছি, কিছুটা এগোতেই মাথার উপর থেকে মোটা মোটা হয়ে নেমে আসতে লাগলো বারিধারা। নিমেষে শুকনো রাস্তাটা ভিজে যেতে লাগলো। চড়বড় করে কিছুক্ষণ, তারপরই সব ঠান্ডা। থেমে গেল ঝোড়ো হাওয়া। সোঁদা গন্ধে ভরে উঠলো চারপাশ। মনের মধ্যে জেগে উঠলো কেমন যেন এক বন্য নেশা। হোটেলে ফিরে ঢিলেঢালা পোশাকে এলিয়ে দিলাম শরীরটা। রাস্তার দিকের দুটি দেওয়াল পুরো কাচের। যে রাস্তাটা পাশ দিয়ে নীচে চলে গিয়েছে, চেয়ারে বসেই কাচের দেওয়াল দিয়ে দেখতে পেলাম কলেজের ছেলে মেয়েরা হেঁটে চলেছে সেই পথে। রাস্তার অপর পাশে গাছগাছালি ঘেরা একটা সুন্দর বাংলো। সন্ধ্যের হলুদ আলোয় যেন জেগে উঠলো। বড় জীবন্ত লাগছে বাংলোটাকে। তাকিয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ সেই দিকে। নজরে এলো না কেউ। কেমন যেন অজানা কোনো রহস্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে লাগলো চোখ। মস্তিষ্ক সজাগ, হাতে তখন ধোঁয়া ওঠা কাপ।
ক্রমশ...
সুচিন্তিত মতামত দিন