না ! আজও একটা কাম জুটলো না গো বউ !' --- বলে খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসলো পরাণ। কাঁধ থেকে গামছাটা নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতেই বলল -- 'এই হালার সংসার বড়োই মায়ার ! আমাগো লোকেরা বাঁচতে চায়লে কি হবে, ও দয়াল যি সি গরে চাবি ঝুলাই দিসেন ! তুই হালারা যিতা ছুটবি ছুইট্যা মরগা যা, বাঁচার আস্তা কহোনোই পাবি না !' ---বলে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে সে। ঘরের ভিতর একবার ঝুঁকে দেখে নেয়, তারপর আবার বলে --- 'পোলাটা কি এহোনো সুস্ত হয় নাই? সাতদিন একটানা জ্বরে এক্কেরে শুকাই গেসে বাপজান ! মুকে দিস্সে কিচু? নাকি এক্কেরে বন্দো করে দিসে? '
' না দেয় নাই। ওষুদ না মুকে দিলে কিচুই হবে নি কো। আজ দু 'মাস বান হসে,সমস্ত কিচু জলে তলিয়ে গেসে ; যকন জল একটু কমলো তোমারে তো অন্য গাঁয়ে বাসা বাঁধতে কইলাম, শুনলে আমার কতা !'---ঘরের ভিতর থেকেই পরাণের বউ উত্তর দেয়।
ঘর বলতে একটাই ; ঝিটেবেড়া একটা ঘর। সাবেকের যে ঘরটা ছিল তা নদীতে পড়ে গেছে। টাকা-পয়সা, খাদ্যশস্য যা ছিল সবই নদীতে ভেসে গেছে। জল একটু কমতে তার বউ তাকে অন্য গ্রামে যেতে বললে তা পরাণ শোনেনি। বরং বউকে মেজাজ দেখিয়ে বলেছিল এই সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।
তাই পাশেই একটা ঝিটেবেড়া তুলেছিল। তার বিশ্বাস ছিল দু 'দিন শহরে ঘুরলে কোনো কাজ জুটে যাবে। এই বিশ্বাসেই সে পনেরো দিন ঘুরেছিল শহরের বুকে, কিন্তু একটাও কাজ জোটেনি।
ঘরের ভিতর থেকে আবার তাকে জিজ্ঞেস করে --- 'তোমারে যে হারান মন্ডলের কাচে যেতে কইছিলাম , গেছিলে? '
' তোরে তো একবার কইছি ,কুনো হারাম কাজ করবো না '
'তাইলে দিনের পর দিন অনাহারে মারবা ! ওর কাচে গেলে জাত যাবে নাকি ! ও হইলো গিয়ে এক জনদরদী নেতা। ওরা না আমাগো দেকলে কে দেকবে শুনি! '
বউয়ের কথা একবার ভালো করে ভাবে পরাণ। সত্যি তো, তখন তো ওরা ভাষণ দিত , " বন্ধুগণ ,তোমরা আমাদের ....এই চিহ্নে ...আমরা যুগ পাল্টাবো "। তাহলে গেলেই ক্ষতি কি ! আজ বিকালে না হয় তার বউকে হারানের বাড়ি পাঠাবে, কিছু সাহায্যের জন্য।
বিকাল হয়। পরাণ ও তার বউ বেড়িয়ে আসে ঘরের ভিতর থেকে। আজ একটা চালও নেই ভাত রাঁধার জন্য, পরাণের বউ পরাণকে জানায়।
' আজ যেমন কোরে হোক একটা কাম জোগাড় করুম। বউ, তুই হারানের বাড়ি যা, দ্যাক কুনো সাহায্য করে কিনা আমাগোরে। '
' আর তুমি কোতাই যাইবা? '
' কুনো কাম মেলে কিনা দেকি ! যদি না পাই ভিক্ করুম গিয়ে। '--- বলে পরাণ আবার শহরের দিকে রওনা দেয়।
রুগ্ন ছেলেকে নিয়ে পরাণের বউ হারানের বাড়ি আসে। হারানের সাথে দেখা হতেই সে তাদের সাহায্যের কথা বলে। একটা লোলুপ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে হারান বলে --- 'হবে, হবে ...সাহায্য পাবে, সব পাবে। কিন্তু একটা শর্তে যদি তুমি রাজী হও '
' কি শর্ত? '
' শুধু একটা রাত....'
হারানের কথা শেষ হতে হয় না। তার আগেই এই জনদরদী নেতার কথা বুঝে যায় পরাণের বউ। রেগে যায়। আর এক মিনিটও সেখানে না দাঁড়িয়ে বাইরে চলে আসে সে। পথের মাঝে পরাণের সাথে দেখা হয়ে যায়। পরাণকে সব খুলে বলে। পরাণের চোখ দুটো রক্ত বর্ণ ধারন করে কথাটা শুনে।
' হালা, জানোয়ারের একটুও দয়া নাই! মায়া নাই! '--- চেঁচিয়ে ওঠে পরাণ,
'বউ, তোকে বলেছিলাম না, কুনো হারাম কাম করবো না ! চল, দু 'জনে ভিক্ষে করি গিয়ে '।
তিনজনে শহরে যায়। শহরে মিছিল দেখে, অসংখ্য মানুষের সামনে ভিক্ষার বাটি বাড়িয়ে দেয়। মিছিলে আরও ভিড় জমে। শ্লোগান ওঠে --- " বানভাসিদের পাশে দাঁড়ান ....ওদের সাহায্য করতে আমাদের .....আমরা ওদের পৌঁছে দেব ..."। পরাণ ও তার বউ ভিক্ষার উদ্দেশ্যে বাটি হাতে দাঁড়িয়েই থাকে। তাদের দেখেও সবাই না দেখার ভান করে এগিয়ে যায়। মিছিল এগিয়ে যায়, দূরে, বহুদূরে ....
ghoshpintu907@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন