অনিন্দ্য আরেকবার নীল রত্নটার দিকে তাকিয়ে নিলেন । এসি গাড়িতে ঠাণ্ডা আছে । তাও খুব গরম লাগছে ! অনিন্দ্যর চেহারায় – গালে, কপালে , ঘাড়ে ঘামের বিন্দু - বিন্দু বহিঃপ্রকাশ ঘটছে , এটা হচ্ছে তার জীবনে আচমকা একটা ঘটনা ঘটে যাওয়া জন্য । যখন কিছু ঘটে, তাৎক্ষণিক টের পাওয়া যায় না । কিছুক্ষণ পরেই সেই উপলব্ধিটুকুই ভীষণ সস্তায় উপলব্ধ হয়ে ওঠে ।
অত ঝামেলায় না গিয়ে , অনিন্দ্য স্বীকার করে নিলেন – তার উপলব্ধ উপলব্ধি , তাকে আচম্বিতে হৃদরোগে না আক্রান্ত করে ফেলে ! দর – দর করে ঘামছে । সরু জলের রেখা সাদা ফুলহাতা ব্লু- স্টাইপের শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছে । ডান হাত দিয়ে , কানের লতির নীচে নামতে থাকা নোনতা ঘাম মুছছে । সামনের সিটে বসে থাকা ড্রাইভারের দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে , পুনরায় নিজের নিরীক্ষণে মুগ্ধ হয়ে গেল !
জীবনে এই প্রথম তার হাতে রয়েছে এক টুকরো নীল রঙের রত্ন ! এতদিন মুঘল বাদশাহের ইতিহাস পড়তে গিয়ে পাতায় – পাতায় কল্পনা করেছিল , সিনেমার পর্দায় দেখেছে ; এইপ্রথম হাতে ধরল ! শিরা – উপশিরায় রোমাঞ্চ অনুভূত হচ্ছে । সে নবাব ? না , এমনটা হলে অনিন্দ্যর অবস্থা এই রকম হতনা ! কেননা তার জানা নেই , ইতিহাসে কোনও নবাব বা বাদশাহ বা জমিদার - নীল রত্ন গুনতে – গুনতে হার্ট অ্যাটার্কে পটল তুলেছেন ! তাদের হাতে অত সময় ছিল না , যা সঞ্চয়ের খাতায় জমেছিল , সব থেকেই গিয়েছে । খরচ হয়েছে । আবার জমেছে ।
অনিন্দ্য এই প্রথম হাতে নীল রত্নটা পেলেন , আর সম্ভবত এই শেষ ! কেননা , তার মতন ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের পক্ষে পুরো চাকরী জীবনে মাত্র একবারই এই বিশাল অঙ্কের ঋণ দেওয়ার ঝক্কি নিতে পারবে ।
সকলের সুযোগ হয়না । তার হয়েগিয়েছে , এটাই মনে হচ্ছে একমাস আগে তার জ্যোতিষীর গণনা করা রাজযোগ । অবশ্য সে নিজেও জানে , এই যোগ আচমকা বিয়োগ হয়েও যেতে পারে ।
অনিন্দ্য মনে –মনে বললেন - পরের কথা পরে ভাবব ।
মালদহের এক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন গ্রাম থেকে সে শহর কলকাতার বুকে নিজের ব্যক্তিগত বাড়ি তৈরী করেছেন । মধ্য বয়সে এসে প্রকৃত সুখের সন্ধান পেলেন ! এখন আর ভবিষ্যতের চিন্তায় মুড নষ্ট করবেন না ।
তার বাবা সামান্য স্কুল মাষ্টার ছিলেন । তিন ভাই দুই দিদির সংসারে অনিন্দ্য নিজেই নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় পেত না । সাইন্স গ্রাজুয়েট হয়ে , সরকারী চাকরীর পরীক্ষায় বসত । তিনবার তেমন কিছু করতে পারেনি । একদিন আচমকাই ওয়েব সাইটে নিজের নাম দেখে হতবাক হয়ে যায় ! ব্যাঙ্ক ম্যানেজার পদের জন্য ইন্টার্ভিউ ! তখন বিশ্বাস করতেন , তার মতন মধ্যমেধার ছেলে , ইন্টার্ভিউতে গেলেও , ম্যানেজারের পদে বসতে পারবে না ।
দাদার হাতে রবিবারের দুপুরে নিজের নামে আসা জয়নিং লেটার দেখতেই , অনিন্দ্য বিশ্বাস করলেন - তার ভাগ্য ঘুরছে ! প্রথম ব্রাঞ্চ ছিল আসানসোল । চাকরীর পর প্রেম । বিয়ে । দুই সন্তান ।
পরিবার থেকে দূরে নিজের আলাদা পরিবার হয়েছে । উচ্চাকাঙ্ক্ষী বউ , ছেলে , মেয়ে--- তাকে প্রতিমুহূর্তে বুঝিয়ে দেয় , যতটা সফল নিজেকে ভেবেছিলেন , আদপে ততটা সফল হতে পারেননি । এই সফলতার উৎস আর উৎসে পৌঁছানোর পথ , সে জানেওনা । নিজেকে আদপে ব্যর্থ মধ্যবিত্ত ভারতীয় বলে মনে হচ্ছে । প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে ওঠে সফলতার মাপকাঠি খুঁজে পাওয়ার আশায় , আর রাতে ঘুমিয়ে পড়ে , পরের দিন - হয়ত ভাগ্য খুলবে ! প্রতিদিন ভাবছে একটু সুযোগ আসবে । প্রতিদিন সেই সুযোগ , তাকে ঠকিয়ে চলে যায় ।
অনিন্দ্য শেষ অব্দি সুযোগ পেয়ে গেলেন ! সরকারী ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সে । এক হীরে ব্যাবসায়ী তাকে বলেছে , একটু বেশী ঋণ দিতে । অবশ্য এর একটা লভ্যাংশ সেও পাবে । শুধু তাই নয় , অনিন্দ্যের অল্প মেধাবী ছেলের জন্য ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নও সেই ব্যবসায়ী পূরণ করবেন । সাথে এই হীরেটি বিশেষ উপহার হিসেবে পেয়েছেন । হাতে নিয়ে , চোখের সামনে আনছেন , আবার চালকের দিকে তাকিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন । এই গাড়ী তার নিজের । ড্রাইভার নেই । বাইরে কথাও যেতে হলে , এজেন্সি মারফৎ যোগাযোগ করেন । আজ যেমন শহরের নামজাদা পাঁচতারা হোটেলে এই চুক্তিটা হয়েছিল , সেই সময় ব্যবসায়ী তাকে আচমকাই উপহারটি দিলেন , আর কাঁধ হেলিয়ে হাসতে – হাসতে বলল – বুঝলেন , আমি আছি । সে এদেশে থাকি বা বিদেশে ...
ব্যবসায়ীটি গুজরাটি । ধার্মিক ।মদ ছুঁয়ে দেখেননি । ধোকলা , অনিন্দ্যর মুখে ঠেসে দিয়ে হিন্দিতে বললেন – আপনার বাড়িতে গিয়ে একদিন পেট ভরে রসগোল্লা খেয়ে আসব ...
আপাতত এক কাজটিতে কোন অন্যায় নেই । কেননা ঋণ নেবে বদলে ব্যবসায়ী সুদ গুনবেন । এতে ব্যাঙ্কের লাভ হবে । কথাটা হচ্ছে , সে পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে - তা একজনকে এমন ভাবে দেওয়া যায় না । এই নিয়মবহির্ভূত কাজ করেছে , সেই সাহসের পুরুস্কার স্বরূপ এত আয়োজন । এটা ঘুষ নয় । অনিন্দ্য মুচকি হাসলেন । মনে –মনে বললেন – আজ কিছু করলাম । এখন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে , শুয়ে থাকব । তার আগে অবশ্য এই জিনিসটিকে ঠিক ভাবে রাখতে হবে ,দিন দিন যে ভাবে দেশে চোর –ডাকাতের পরিমাণ বাড়ছে !
গাড়ি বাড়ির সামনে আসতেই , অনিন্দ্য নিজে নেমে এলেন । চাবি দিয়ে গেট খুললেন । গ্যারেজের দরজা খুলতেই চালক গাড়ি রেখে চলে গেল ।
ভালো করে দরজা বন্ধ করে , চারদিক দেখে বাড়িতে ঢুকলেন । আজ রাত তাকে একাই থাকতে হবে । ছেলে এখন বন্ধুদের সাথে কালিম্পং এর পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরছে । ফোনের ইনবক্সে ছবি পাঠিয়েছে মেয়ে আর বৌ শ্বশুর বাড়ি । বাড়ির লোকদের চমক দেওয়ার জন্যই এই পরিকল্পনা ।
২
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেতেই , ঘরের অন্ধকারে হাল্কা আলোর উৎস খুঁজে পেল ! অবশ্য অনিন্দ্য রাতে সবকটা আলো নিভিয়ে ছিলেন । খানিক নেশা হয়েছে ঠিক , তাইবলে জ্ঞান শূণ্য হয়ে পড়বেন! পাশে টেবিলের উপর রাখা শান্তবিকল্পে থাকা মুঠো ফোনে এখন রাত দু’টো । নরম গদির উপর নিজের থলথলে দেহটা ধরলেন -- শুধু মাত্র লুঙ্গি পড়েছে । আজ বাড়িতে কেউ নেই বলে এমন সাহস দেখাতে পেরেছেন । বউ , ছেলে , মেয়ের নিষেধ আছে --- এই লুঙ্গিতে সকলের খুব আপত্তি । কেমন যেন বিদঘুটে লাগে । বাড়ির ঝামেলার ভয়েই কেউ না থাকলে , লুঙ্গিটা ব্যবহার করেন ।
অনিন্দ্য দেখলেন , উল্টো দিকে সোফার উপর একজন বসে রয়েছে ! সব চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার তার চারপাশ থেকেই আলোর ছটা এই দিকে আসছে ।
চোখ দুটো হাতের তালু দিয়ে ঘষে , অনিন্দ্য দেখছেন । একজন মধ্য বয়স্ক মানুষ বসে রয়েছে । খুব সাধারণ চেহারা । মুখ দেখে মনে হচ্ছে গোবেচারা । শুধু নাকের নীচে আর ঠোঁটের উপরে সরু গোঁফের রেখা ।
সে আরেকটু ভালো করে দেখল , তারপর ঘাড় ডানদিকে ঘোরাতেই চমকে উঠল ! পাশে লোকটা বসে আছে ! মানে ? এই রাতে তার হলটা কি ? আচমকা ঘুম ভেঙে , এই সব দেখছে । এটা মনে হচ্ছে স্বপ্ন ।
-না , স্বপ্ন নয় । আমি তোর পাশেই বসে আছি ।
কানে কথা গুলি খোঁচা দিল । অনিন্দ্য এই প্রথম ভয় পেলেন । গলা শুকিয়ে নিজের মনে নিজেই প্রশ্ন করলেন – অদ্ভুত , লোকটি ওইখান থেকে , এত তাড়াতাড়ি এলেন কেমন করে ? সোফা আর বিছানার মাঝে কম করে হলেও দশ’ পা দূরত্ব । লাফিয়ে এলেও তো দেখতে পারতাম !
-লাফিয়ে আসতে যাব কেন ? হেঁটে এসেছি । তোর ঠিক ঠাওর করতে পারেনি । পাপী চোখ । মন স্বার্থে পরিপূর্ণ ।
অনিন্দ্য অবাক হয়ে গেলেন – মনের কথা লোকটা জানল কেমন করে ? দরজা বন্ধ , তাহলে ঘরে ঢুকল কেমন করে ?
সামনে ঝুল বারান্দার দিকে তাকাতেই ... মনে – মনে বলল - লোকটা চোর । এই বারান্দা থেকে এসেছে ।
-আমি নই রে , তুই চোর । শুধু চোর হলে হয়ত ছেড়ে দিতাম , তুই একজন বিশ্বাস ঘাতক । আমার বিশ্বাসের হত্যা করেছিস ।
অনিন্দ্য বুঝতে পারলেন – লোকটি মুখ দেখে মনের কথা বুঝে যায় । তাই মনে –মনে না , মুখেই বলব – শোন , তুই কে বলত ? এই রাতে চুরি করতে এসেছিস ! আবার ধরা পরে কায়দা দেখাচ্ছিস !
লোকটি আপাতত নিরীহ , রোগা চেহারার , এই কথা শুনে রেগে গেলেন । বললেন – ভাষা ঠিক কর । না হলে এখনি বুঝিয়ে দেব । আমি কিন্তু কিছুই ভুলিনি ।
অনিন্দ্য একটু মিইয়ে গেলেন । বললেন - ইয়ে , আপনি মানে তুমি ...
-অতো তোতলাচ্ছিস কেন ? অবশ্য অন্যায় যে করে তাকে সবসময় ভয়ে থাকতে হয় । তুই ভেবেছিলিস তোকে কেউ ধরতে পারবে না । তোর বিশ্বাসঘাতকতা আমি ধরে ফেলেছি ।
অনিন্দ্য ভাবছেন - এই রে সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের লোক নাতো ? না , আয়কর দপ্তরের হতে পারে ! না তাহলেও এমন ভাবে আসবে কেন ? আবার কোন বিরুদ্ধ শিল্প গোষ্ঠীর হতে পারে ! যাই হোক না কেন , তার নিয়ম বহির্ভূত ঋণ দেওয়ার ব্যাপারটা জেনে গিয়েছে !
-দেখুন , আপনি মাথা ঠাণ্ডা করে বলুন । আমি এতটুকু বুঝলাম , আপনি সব জানেন । দেখুন সত্যি বলতে আমি কোন দলের নই । আপনাদের ভিতরের ঝামেলায় আমাকে জড়াবেন না । উনি আমায় বললেন , ওনার কথা শুনলে আমি জীবনটাকে পাল্টে যেতে দেখব । তাই এমনটা করলাম।
লোকটি গলা ভারী করে বললেন - চালাকি , কচি খোকা কেউ কিছু বলল , আর সাথে – সাথে তাই করে বসলে ! নিজের স্বার্থ ভালোই বোঝ । এই সব করার জন্যই বুঝি তোকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল ?
-না , লোভ অনেকটা সর্দির মতনই ছোঁয়াচে । তাই আমিও হেঁচেছি ।
-তোকে যে বিশ্বাস করবে তাকেই হত্যা করবি ?
-দেখুন , আমার ঠিক মনে নেই আপনি কে ? তবে দু’মাস আগে একজন মধ্যবয়স্ক লোক আমার ব্রাঞ্চে এসেছিলেন , তার ছেলের জন্য ঋণ নিতে । গার্মেন্টসের ব্যবসা করবে । শিক্ষিত ছেলে , বেশ অনেকদূর পড়াশোনা করেছে । চাকরী জোটেনি । তাই এসেছিল । আমি বেশ বুঝিয়ে বলেছিলাম আমাদের ছোট ব্রাঞ্চ , অতটাকা দিতে পারবে না । এটা কিন্তু সত্যি । আপনিই মনে হচ্ছে , সেই লোকটি । আচ্ছা ছেলেকি আত্মহত্যা করেছে ? মানে আপনি বলেছিলেন অবশ্য মনে পড়ছে , ছেলে ব্যবসাটা না করতে পারলে ভেঙে পড়বে । আমি সহানুভূতির নাটক করেছিলাম । তা স্যার । এই রাতে আপনি প্রতিশোধ নিতে এসেছেন ! দেখুন , দেশের লোক ব্যাঙ্কে টাকা রাখে এতা এটা ঠিক । তাইবলে দেশের লোকের আর্থিক উন্নতির দায়িত্ব ব্যাঙ্কের নাকি ? অনুগ্রহ করে ব্যাপারটা বুঝুন । এই ঋণ দেওয়ার গল্পটা অত সহজ নয় ।
-তাই ?
-হ্যাঁ । অনেক কাঠ – কয়লা পুড়িয়ে ম্যানেজ করে দিতে হয় । জনগণের টাকা ফিরত না এলে বিপদ।
-বিশ্বাস হারিয়ে গেলে ফেরত আসে ?
-না , স্যার আসেনা । ঋণ অনেক খাটানোর পর যখন ব্যাঙ্কে আসে , কিছুটা লাভের মুখ দেখে । সাধারণ লোকের ক্ষমতা আর কতটুকু । তাই শিল্পপতিদের দিকে ঝুঁকতে হয় । তাছাড়া বুঝতেই পারছেন । এই রোজগারে ছেলে মেয়েদের কথা ঠিক ভাবে ভাবা যায়না !
-শুধু নিজের কথাই ভাবলি ?
-না , শুধু নিজেরটা নয় । আমার পরিবারের কথাও ভেবেছি । তাইতো , ঋণ পাইয়ে দিলাম মোটা টাকার বিনিময়ে ।
-এরফল কী হবে বুঝতে পারছিস ?
- ক্ষমা করে দিন । আমি না হ্য় , প্রাণ ভিক্ষার জন্য কিছু টাকা দেব । না ঋণ নয় । এই টাকা শোধ করতে হবে না । দেখুন আমাকে নিজের হাতে না মেরে , বিচারের ব্যবস্থা করুন ।
-তুই আমাকে উন্মাদ ভেবেছিস ! তোর বিচার আমি নিজে করব । পালাতে পারবি না ।
-এই এইরকম করবেন না । আমি ভুল করেছি । দরকারে প্রচুর টাকা দেব ।
-মূর্খ , অর্থের লোভ দেখিয়ে লাভ নেই । এইসব আমার কাজেই আসবেনা।
অনিন্দ্য দু’হাত দিয়ে লোকটির পা ‘দুটো জড়িয়ে হাউ –হাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন । আমায় খুন করবেন না । আমি মানছি , আমি স্বার্থপর । আচ্ছা কে নিজের কথা ভাবে না ? আমায় ছেড়ে দিন ।
অনিন্দ্যের কান্না দেখে , লোকটি বললেন – এই ব্যাটা চুপ কর । তোকে মাপ করতে পারি , যদি তুই আমার গল্পটা মন দিয়ে শুনিস ...
বেশ কিছুক্ষণ মিউ –মিউ করে কাঁদবার পর অনিন্দ্য বললেন – দাদা , বাঁচবার জন্য আমি টাকা খরচ করতে গিয়েছিলাম । আপনি বলুন , ভোর অব্দি আমি ঘুমাব না।
-তুমি রাজ-রাজার গল্প পছন্দ করো ?
-মানে ... দাদা রূপকথার গল্প ?
-বলতে পারিস...
-বলুন
অনিন্দ্যর খুব রাগ হচ্ছিল । এই এলেবেলেটা , তাকে তুই করে সম্বোধন করছে । ভাগ্যিস এমন একটা পরিস্থিতি , নইলে বুঝিয়ে দিত ..
৩
এক ঝড়ের রাতে , পাথরে –পাথর ঘষে , আগুন জ্বালিয়ে গুহার ভিতর বসে আছে এক ভারী চেহারার মধ্য বয়সী পুরুষ । ঘাড় পর্যন্ত ছুঁয়ে থাকা কালো চুলে জট পড়েছে । তার দুটি চোখ ভরা স্বপ্ন। পৃথিবী এখন খুব সরল । এখানে মানুষের মনে লোভ নেই। দিনের আলো ফুটলে , পুরুষটি গুহার বাইরে যাবে । উল্টো দিকে জঙ্গল রয়েছে , সেই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটলেই --- পাতলা একফালি নদী । এই নদী পেড়িয়ে গেলেই পাহাড় আছে , দেবতাদের আস্তানা ।
গুহায় বসে পুরুষটি ভাবছিল--- কয়েকদিন আগে দেবতারা তাকে খাতির করে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল । দেবতাদের কষ্ট শুনিয়েছিল । সেই সব কথা ভাবছে । গুহার বাইরে ঝড়ের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছে , আজ রাতে খুব বৃষ্টি হবে । সেই বৃষ্টিতে জঙ্গলের ভিতরের নদী ভরে উঠবে । গাছ গুলো ভিজবে ।
এই গুহায় সে একাই থাকে । সঙ্গিনী নেই । বেশ কয়েকদিন ধরে সে এক বিশেষ কাজে হাত দিয়েছে । এক অদ্ভুত অনুসন্ধান করছে । এই ধরণের খোঁজ তার নিজের কাছেও নতুন । সে জঙ্গলে এক বিশেষ পাথরের খনির সন্ধান পেয়েছিল । সেখানকার পাথর গুলোকে নিয়ে এসে পরীক্ষা করছে । সাধারণ থেকে অনেক আলাদা । এগুলো যেমন সুন্দর , তেমনই আকর্ষণীয় । এই সব রঙিন পাথর গুলো নিয়ে চিন্তা করছিল । গুহার মেঝেতে শুয়ে , পায়ের উপর পা রেখে --- বাইরের প্রকৃতির গর্জন শুনতেও তার বেশ ভালো লাগছে ।
এই চিন্তায় ছেদ পড়ল , যখন শুনতে পারল , কেউ গুহার মুখে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে ।
-বলাসুর ?
সে ঠিক শুনেছে । এক কাঁপা –কাঁপা কণ্ঠে নিজের নাম শুনছে । এত রাতে কেই বা তাকে ডাকবে ? না , এখনো স্পষ্ট শুনতে পারল ।
উঠে গুহার মুখে গিয়ে দেখল , ছিপছিপে চেহারার ছেলে । খুব বেশী বয়স হবে না । তাকে দেখে বলল – তুমি ?
-আমাকে ভিতরে আসতে দিন ।
-এসো । এত রাতে !
ছেলেটি ভিজে গিয়েছে । বলাসুর খেয়াল করেনি , কিছুক্ষণ আগেই হয়ত ঝড় থেমে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । আগুনের আলোয় দেখল , ছেলেটি কাঁপছে ।
-তুমি ওই আগুনটার কাছে গিয়ে বসতে পারো । আমি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করছি । বুনো শুয়োর মেরেছি , মাংস সেঁকে তমায় তোমায় দিচ্ছি । তারপর শুনব , আমার কাছে আসবার কারণ ।
বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেল । ছেলেটি খাবার সময় টুঁ শব্দ টি করেনি , পাছে খাওয়ার কোন অসুবিধা হয় । গোটা মাংস শেষ করে বলল – আপনি , আপনার সব খাবার আমাকে দিয়ে দিলেন ! আমিও ক্ষিধের তাড়নায় সব খেয়ে ফেলেছি !
সত্যিই আজ রাতে বলাসুর অভুক্ত থাকবে ? এই যে তার খাবার অন্যকেউ খেয়েছে । সারা রাত খালি পেটে থাকতে হবে । আগামীতে ভালো শিকার পাবে কিনা তাও জানা নেই ! এত কিছু হলেও , তার মুখে বিন্দু মাত্র দুঃখের ছাপ নেই । শিশুর মতনই কোমল বিশ্বাস ছড়িয়েছে মুখ মণ্ডলে । খিল –খিল করে হাসছে । বলল - তুমি আজ আমার ভাগের খাবার খেলে , আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি । আমি জানি , ভবিষ্যতে আমার দরকারে তোমার কাছ থেকে খাবার পাবো ।
-এত সরল বিশ্বাস !
-দেখো , বিশবাশ বিশ্বাস ছাড়া জীবন চলেনা । তুমি এত রাতে কষ্ট করে এসেছ কেন ?
কিছুক্ষণ চুপ থাকল । ছেলেটি বলল – দেবতারা তোমার কাছে পাঠিয়েছে ।
-দেবতারা ? কেন ?
-তোমাকে তারা ডেকেছিল কেন ?
-আমার কাছ থেকে এক বিশেষ শিক্ষা শিখবার জন্য ।
বলাসুরের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল ছেলেটি । বলল
-এই শিক্ষা যেমন -তেমন নয় । এই যে পাথর আছে অনেক রকমের তার সম্বন্ধে অনেক রকমের জ্ঞান তুমি সংগ্রহ করেছ । এমন কি সমুদ্রের মুক্তা , রত্ন , হীরে – এই সব কিছুই তোমার নখদর্পণে ।
-হ্যাঁ । আমি দেবতাদের সেই সব কিছু শিখিয়েছি । যদিও আমি তাদের খুব এক্তা পছন্দ করিনা । তারা যখন বললেন নিজেদের লোকসানের কথা , আমার খুব খারাপ লাগল । এখন বিনিময় প্রথায় বানিজ্য চলছে , দেবতারা চাইছেন খাদ্য ফসলের বিনিময়ে রত্ন পাথরের মাধ্যমে ব্যবসা চালাতে । তাই তাদের সাহায্য করেছিলাম । আমি এতটুকু জেনে গিয়েছি , তারাই সভ্যতায় ভেদাভেদ করবেন । অনেকেই বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যবসায় পিছিয়ে পড়বে । তাও তাদের জ্ঞান দিলাম , কেননা আমি চাই সমাজ বৈষম্যমুক্ত হোক ।
ছেলেটি চুপ করে মাথা নিচু করে ছিল । বলল – দেবতারা চায় , এই বৈষম্য থাকুক । নতুন করে তৈরী হোক । এই অবস্থা থেকেই মানুষের ভিতর প্রতিযোগিতা শুরু হবে। আপনি যাতে এই জ্ঞান সমাজের অন্যত্র প্রচার করতে না পারেন , তাই দেবতারা আমাকে এখানে পাঠিয়েছে ।
-মানে ?
-বলাসুর , আমি আপনাকে হত্যা করছি । ভাবুন এটাই যজ্ঞে আপনার , আত্ম বলিদান ...
কিছু বুঝবার আগেই , নাভির উপর থেকে রক্তের স্রোত ফিনকি দিয়ে ছুটল ! বলাসুর দেখল ছেলেটির মুঠো করা হারে বেশ সূক্ষ্ম হাতিয়ারটা ধরা রয়েছে । নাভি ভেদ করে পুঁতে দিয়েছে !!
৪
যতক্ষণ গল্পটি বলছিল , অনিন্দ্য শুনলেন । শেষ হতেই সে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছেন ! গলা শুকিয়ে আসছে । এখনো বুঝতে পারছেন না , শেষ পর্যন্ত বেঁচে কি থাকবেন ? আবার এমন হতে পারে -- কাল সকালে তার পরিবার সংবাদপত্রের শিরোনামে - অনিন্দ্যের নলি কাটা রক্তাক্ত বীভৎস দেহের ছবি দেখবে ! মানুষকে ইদানীং আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না । সে যেন বারুদের চলমান মশলা । একটু অসতর্ক হলেই বিস্ফোরণ !
লোকটির দিকে আরেকবার তাকিয়ে মনে –মনে বললেন – কে জানে , ঘাতক লোকটারও কোন দায়বদ্ধতা ছিল কিনা আমার মতন ! হয়ত বাধ্য হয়ে ঠকিয়েছে । আমি যে নিয়ম বহির্ভূত ঋণ দিলাম , একপ্রকার নিজের বিপদ নিয়ে দিলাম । সাধারণ মানুষ তাদের সম্পত্তি ব্যাঙ্কে জমা রেখেছে , আমাদের বিশ্বাস করে । আমরা তাদের টাকা নিয়ে শিল্প পতিদের সাহায্য করছি । অথচ, ভারতের মতন উন্নয়নশীল দেশে , ব্যাঙ্কের প্রধান দায়িত্ব হবে আর্থিক বৈষম্য দূর করা । সেই দিকে না তাকিয়ে , আর্থিক সমৃদ্ধির দিকে তাকিয়েছি । শিল্পপতিদের কাছ থেকে সুদ নেব বলে । শুধু তাই নয় দেশীয় শিল্প হলে অনেকে জীবিকার সন্ধান হবে , এটাও একটা কারণ । মজার ব্যাপার হলও , আমরা নিজেরাও জানি এই কারণ কেবল শিক্ষিত মনকে বোকা বানানোর জন্য । বিবেককে বশ করবার জন্য । কেননা শিল্পপতিরা ঋণ নিয়ে ফেরত দেওয়ার নাম করেননা অনেক সময়ই । আর শিল্প , কর্মসংস্থানের গল্প থাকলে বেকারদের স্বনির্ভরে দিতাম । আবার এটাও ঠিক আমরা ব্যবসা করছি সমাজ সেবা নয় । শিল্পপতিরা টাকার প্রতি অবিচার করবেন না , এই বিশ্বাস থেকে নেওয়া । তাও বলব রিস্ক আমরা নিতেই পারতাম । এটাও একপ্রকার বিশ্বাস ঘাতকতা । জনগণের আমানত নিয়ে ব্যক্তিগত গোষ্ঠীপতিদের আর্থিক সহায়তা , নিয়মবহির্ভূত ভাবে বেআইনি । তাও তো ঝক্কিটা নিলাম , পরিবারের কথা ভেবে । খুনি লোকটির হয়ত এমনই কোন বাধ্যবাধকতা ছিল ?
হুঙ্কার দিয়ে অনিন্দ্যর পাশে বসে থাকা লোকটি বললেন – না , কোন বাধ্যকতা ছিল না । বলাসুর সমাজের সকল শ্রেণীর জন্য এই বিদ্যা দিয়েছিল , দেবতাদের নির্দেশে সেই অপদার্থ হত্যা করল । সে এই কাজ নাও করতে পারত । খারাপ কাজের বাধ্যতা বলে কিছু হয়না । শুধু শাস্তি হয় । তুমি সেই শাস্তি নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হও ।
-মানে ? দেখুন আমি আপনার গল্প শুনেছি । আপনি আমাকে খুন করতে পারেন না । আপনি কে বলুনতো ? অনেক হয়েছে , আমি লোক ডাকছি ......
বলতে – বলতে অনিন্দ্যর কথা গুলো আটকে যাচ্ছিল । স্পষ্ট বুঝলেন - কেউ যেন তার গলা টিপে ধরছে ।
লোকটা দাঁড়িয়ে বললেন – মূর্খ , ভেবেছিলিস পুনঃজন্মের চক্করে তোকে খুঁজে পাবনা ! সেইদিন আমাকে মেরে ফেলেছিলিস ঠিকই , আমার আত্মা মুক্তি পায়নি । ঘুরে বেড়িয়েছি । এই পৃথিবীতেই ছিলাম । আজ তোর হাতে যে মণিটা আছে , তা ইন্দ্রনীল মণি , আমার চোখ দিয়ে তৈরি । তোর হাতে আসতেই , বুঝলাম তুই সেই পাপী । তোকে খুঁজেছি শাস্তি দেব । তাই দিলাম...
-আমায় ছেরে ছেড়ে দিন । আমি জানিনা আপনি কি বলছেন ! এটা বুঝতে পারছি , আমার মতন ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের উপর আপনার রাগ হয়েছে । অবশ্য হতেই হবে , আমি ক্ষমা চাইছি ... ক্ষমা করুন...
অনিন্দ্য কাঁপছিলেন । কানে শুনছেন , বলাসুরের ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের হাসি । এই বুঝি গলায় কোপ মারল...
চোখ দুটো যতক্ষণ খোলা ছিল , অনিন্দ্য দেখলেন - লোকটির দেহ থেকে অদ্ভুত আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ছে । অনেকটা টেলিভিশনের কোন ভক্তিমূলক সিরিয়ালের দেবত্ব চরিত্রের চারপাশ দিয়ে যেমন আলো খেলা করা দেখায় , তেমনই ...
৫
হুঁশ ফিরতেই অনিন্দ্য নিজেকে পাথরের মেঝের উপর শুয়ে থাকতে দেখলেন । শরীরটা দুর্বল লাগছে । অনেক কষ্টে বিছানায় উঠে , পাশে থাকা বোতলের শেষ জল ঢক – ঢক করে পান করলেন । মুঠোফোনে সকাল পাঁচটা । শেষ রাতে জ্ঞান চলে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সব কিছু মনে রয়েছে । সেই অদ্ভুত লোক । গল্প । তার শাস্তির হুমকি । শেষে আচমকাই উধাও হয়ে যাওয়া !
অনিন্দ্য বুঝতে পারলেন না , বলাসুরের গল্পটি সত্যি না মিথ্যা , স্রেফ সময় কাটানোর জন্য । এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে কে ?
বেশ কিছুক্ষণ অনেকের কথা ভাবতে গিয়ে , নিজের শ্বশুরের মুখ মনে পড়ল । এক সময় সংস্কৃত পড়াবেন । তিনি বলতে পারবেন , ভারতীয় পৌরাণিক গল্পে এমন কোন চরিত্র আছে না কি ?
-হ্যালো ।
-কে অনিন্দ্য !
-হ্যাঁ বাবা । আপনি ভালো আছেন তো ?
-এই বয়সে যতটা থাকা যায় আর কি । তা এত সকালে !
-আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম ।
-আরে না না । আমি খু ব ভোরেই ঘুম থেকে উঠি । তুমি এত সকালে ফোন করলে তাই ...
-বাবা , একটু দরকার আছে আপনার সাথে ।
-তা বলো না ।
-বাবা , আপনিতো প্রাচীন সংস্কৃত তে লেখা অনেক কাব্য পড়েছেন ।
-ওই আর কি । তবে প্রাচীন না বলে বর্তমান বলও । কোন ভাষা অপ্রচলিত হলেও , তা পুরানো বলে অচল বলে বাতিল করে দেওয়াটাও ঠিক নয় ।
-না । মানে আমি ঠিক তা বলতে চাইনি। আচ্ছা বাবা বলাসুর বলে কোন পৌরাণিক চরিত্র রয়েছে । মানে যাকে বিশ্বাসঘাতকতা করে খুন করা হয়েছিল ?
-এই রে স্পষ্ট মনে নেই । তবে গরুড় পুরাণে , এমন একটা কাহিনীর উল্লেখ থাকলেও , থাকতে পারে । আমাকে দেখে বলতে হবে । বলাসুর নামে এক ধার্মিক রাক্ষস ছিলেন । পুরাণ বলছে , তাঁর আত্মত্যাগেই হীরে – মুক্তো - রত্নের সৃষ্টি । পুরোটা আরেকবার পড়ে বলতে হবে ।
-আচ্ছা এখন রাখছি।
-কেন বলতো ?
-এমনি , মানে অফিসে একটা নাটকের কথা চলছে তাই। আচ্ছা রাখছি পড়ে আবার ফোন করব । আপনার মেয়েকে বলবেন , দুপুরে আমি ফোনে কথা বলে নেব।
অনিন্দ্য ভাবছেন , বলাসুরের গল্প সত্যি ! কেন জানি তার খুব ভয় করছে । অজানা ভয় তাকে দুর্বল করে ফেলেছে। এতদিন এমন অদ্ভুত ধরা পড়বার ভয় অনিন্দ্যর ছিল না । কোত্থেকে এসেছে ?
মনে –মনে বললেন – আমি অক্ষত আছি । তারমানে শাস্তি দেয়নি !
একটা নিঃশ্বাস , বড় চাপা নিঃশ্বাস ছাড়লেন । তবে এই ভয়- ভয় ভাবটা কেন ?
chakrabortypinaki50@gmail.com
Tags:
গল্প