কৃষ্ণা রায়

সৌর পক্ষ
রোজ সকালে মা বেরিয়ে যায়, মর্নিং ডিউটিতে। লোকের বাড়ি আয়ার কাজ । রাতে একলা থাকতে পারেনা ঝুমুর। তাই এই ব্যবস্থা। ঝুমুরের বাবা নেই, মানে থেকে থাকলেও ঝুমুর জানেনা। মাঝে মাঝে মা বলে ফেলে, দেখব, দেখব, যেদিন তাড়া খাবে সেখেন থেকে। কে তাড়া দেবে , কেনই বা দেবে , তাও ঝুমুর জানেনা। শুধু জানে তাকে পাড়ার হরসুন্দরী স্কুলে পড়তে যেতে হবে, পাশের ঘরের দীপ্তি মাসির কাছ থেকে বেলা দশটার সময় এক কাপ গরম দুধ নিয়ে কলা আর মুড়ি দিয়ে খেয়ে স্কুলের দিকে হাঁটা লাগাতে হবে। স্কুলে মিড ডে মিল দেয় বলে, মা সকালে বাড়িতে রান্নার পাট রাখেনা । 

ঝুমুরদের বস্তিতে পনেরো ঘর লোক আছে। সবাইকে ও ভালমত চেনেনা । ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে যাবার সময় ঝুমুরকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে যায় মা । তারপর তার কত কাজ। মুখ ধোয়া, মশারি পাট করে বিছানা তোলা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, সামনের করপোরেশনের কল থেকে খাবার জল তোলা, রাতের বাসন ধোওয়া, দরজার বাইরের বেঁটে মালসায় রাখা তুলসি গাছে জল দেওয়া। সবশেষে এক্মুঠো ভিজোনো ছোলা আর দুটো বিস্কুট খেয়ে পড়তে বসা। মাঝে একবার দীপ্তিমাসি ঠিক উঁকি দিয়ে দেখে যাবে ঝুমুর পড়ছে কিনা, কোনদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে নিজের ভাগ থেকে দু বালতি জল ও দিয়ে যায়। ঝুমুর কি অত জল তুলতে পারে! মা সে কথা জানে। করার কিছু নেই। কলের জল আসে ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। 

এক এক দিন খুব ইচ্ছে করে কিচ্ছুটি না করে দরজার সামনের সিঁড়িতে চুপ করে বসে থাকে। বস্তির টুম্পি, ঘন্টা, মিঠির মায়েদের অত শাসন নেই, ঘরের কাজও তেমন করতে হয়না। ওদের মায়েরা কাছাকাছি জায়গায় কাজ করে ফিরে আসে। স্কুলে গেলেও বাড়িতে ওদের পড়া লেখার পাঠ নেই। সকাল থেকে সামনের রাস্তায় খেলা করে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকদের গায়ে গাছের পাতা, কাগজের গোল্লা ছুঁড়ে মারে। কেউ বকুনি দিলে হেসে হেসে বলে, সরি , ভুল হয়ে গেছে। আসলে ওকে মারতে গিয়ে--- বোকা বোকা মুখ করে নিজেদের মধ্যেই কাউকে দেখিয়ে দেয়। ওরা মিথ্যে বলে। সে সব দেখেও ওদের বাড়ির লোকেরা কিচ্ছুটি বলেনা। । বস্তিতে একজন দিদি আছে, রিম্পাদি। খুব মোটা হাত পা সব গোদা গোদা। রিম্পাদি সারাদিন রাস্তার ধারে নিমগাছের তলায় বাঁধানো বেদিতে বসে থাকে, সবার জল নেওয়ার পর হেলে দুলে কলপাড়ে এসে গা হাত ধোয় , দাঁত মাজে। তারপর আবার গাছতলায় বসে থাকে কতক্ষণ। চুল আঁচড়ায়, মুখে কত কী মাখে। ঝুমুরকে দেখতে পেলেই মিষ্টি করে হাসে, লজেন্স দেয়। একদিন হাঁটুর নীচ থেকে জামাটা তুলে বলেছিল, দ্যাখ, আমার এখানটা কী ফরসা না? এখানটাই মেয়েদের সব। তোরটা দ্যাখা। ঝুমুর ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছিল। মাকেও কথাটা বলতে পারেনি। মাকে এরকম অনেক কথাই বলতে পারেনা ঝুমুর। মা বড্ড রাগী। ভীষণ শাসনে রাখে সারাক্ষণ। আর খালি বলে আমার মায়ের কথা সময়মত না শুনে নিজে যা ভুল করেছি, তোকে সে ভুল করতে দেবইনা। মার ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে যায়। কী ক্লান্ত দেখায় তখন । হাতের ভারি ব্যাগ থেকে উঁকি মারে আটা, সবজি, আরো কত কি। ভ্যানিটি ব্যাগটা দেয়ালের পেরেকে রেখেই মা টিন ঘেরা কলঘরে ঢোকে। অনেক্ষন ধরে চান করে। বেচারা! সকাল থেকে চান হয়না। সময় তো লাগবেই। এক এক দিন দীপ্তি মাসি ছুটে আসে, ওরে! মণিকা, আর কত চান করবি? ঠান্ডা লেগে নিমুনি ধরবে যে। মা টিনের দরজার আড়াল থেকে বলে, লোকের বাড়িতে রুগির সেবার কাজ বড় খাটনির দিদি, , এত গা ঘিন ঘিনঘিন করে এক্ সময়, জানোই তো সব। দীপ্তি মাসি চাপা গলায় তখন বলে, তা বলে এভাবে রোজ ধুবি? সারাজীবনের ময়লা কী ওভাবে ধোওয়া যায় রে? দীপ্তিমাসি মায়ের খুব বন্ধু, আপদে বিপদে সব সময় পাশে থাকে, কাজ সেরে ফেরার পর দীপ্তিমাসির হাতের এক কাপ চা মায়ের বরাদ্দ। আপত্তি করলেও মাসি শোনেনা, ঝঙ্কার দেয়, থামতো। মেয়েটা বড় হোক তারপর না হয় গুমোর দেকাস। দীপ্তি মাসির বড় মেয়ে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল, অনেক কাল আগে। তাই এত ভয় পায়। ঝুমুর সে কথা এখন জানে। না হলে ঝুমুরের ক্লাসের অনেক মেয়েই রান্না করতে পারে। মাও মাঝে মাঝে বলে সাত বছরের ধাড়ি মেয়ে, একটু চা করলে কি হয়? দীপ্তিদির সবেতেই বাড়াবাড়ি । 

দীপ্তিমাসি খুব ভাল, মায়ের থেকেও । তাইতো কিছু বলতে পারেনা ঝুমুর, না হলে---থাক বাবা, দরকার নেই--- মাসি যদি কিছু মনে করে!

আজ সকাল থেকে মাকে খুব হাসি খুসি দেখাচ্ছে। কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে,। মা অবশ্য বলে ছুটি কিসের? গেলে রোজগার, না গেলে হাত খালি। তবু মা ছুটি নিয়েছে। মার মুখে আজ গানের কলি। মা নাকি ছোটবেলায় গান শিখত। কিন্তু ঝুমুরকে গান শেখাবেনা বলেই দিয়েছে। দীপ্তি মাসি একদিন বলেছিল, ঝুমুরের বাবা নাকি ভাল তবলা বাজাতে পারত। মাকে জিগ্যেস করাতে চড় খেয়েছিল। ব্যাস! তারপর আর বাবার কথা মার কাছে তোলাই যায়না । মাধ্যমিক পাশ করার আগেই মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দাদু দিদা কে আছে না আছে কিচ্ছু জানেনা ঝুমুর। মা বলে তার কেউ কোত্থাও নেই জ্ঞান হওয়া অব্দি ঝুমুর শুধু জানে, মায়ের পরেই দীপ্তিমাসি তার আপন। অসুখ বিসুখ হলে বস্তির কেউ কেউ সাহায্য করতে আসে । তবে মা মোটেই এসব পছিন্দ করেনা। শুধু দীপ্তিমাসির দাদার কাছে কিছু বলতে বা চাইতে গেলে এখনো অব্দি রাগ দেখায় না। ওকে মামা বলে ডাকতে শিখিয়েছে। মামা খুব সকাল ছাড়া বাড়ি বিশেষ থাকেনা। ভাড়া গাড়ি চালায়, ফেরে অনেক রাতে। এক একদিন দূরে কোথাও গেলে ফিরতেও পারেনা। মাঝে মাঝে অনেক রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে মাসিকে বকাবকি করে। ঝুমুর জানে। বিছানায় মার পাশে শুয়ে ঝুমুর টের পায়। বছর দুয়েক আগে পর্যন্ত ঝুমুরকে মামা খুব ভালবাসত, পুতুল, ক্যাডবেরি এনে দিত। মা রাগারাগি করার পর আর ওসব দেয়না। একদিন বলেওছিল, তোকে ভালবাসি , তাই মন হলে খুচখাচ কিছু এনে দিতাম। মণিকা পছন্দ না করলে কি করব? তুই সোনা আমার ওপর রাগ করিস না। সেদিন মামার চোখে জল দেখেছিল ঝুমুর। তবে মামা আজকাল রিম্পাদির সঙ্গে খুব গল্প করে। আহা! বেচারা রিম্পাদিকে বস্তির সব্বাই দুরছাই করে। সারাদিন রাস্তায় বসে থাকে আর সাজগোজ করে। সন্ধ্যেবেলায় শুধু পাড়ার সেলুনে কাজে যায় । মাকে কি সে দিনের কথাটা বলবে? রিম্পাদির সঙ্গে--- মামা বস্তির পেছনের কলা ঝাড়ের কাছটায়--- মামার হাতে ক্যাডবেরি ছিল, দূর থেকেও ঝুমুর সেটা দেখেছে। থাক বাবা, মা ওসব বিশ্বাস করবেনা, ঝুমুরকেই উলটে ওখানে যাওয়ার জন্য রাত দুপুরে মার খেতে হবে। দীপ্তিমাসিরকেও সে জন্য বলেনি কিছু। মাসির বর মারা গেছে। দুই মেয়ের এক জন গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা গেছে, আর স্কুলে না পাঠিয়েই অন্যটার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ঝুমুরকে তা করলে চলবেনা। পড়াশুনো করে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে । নামতার মত মা রোজ একথা ঝুমুরের কানে ঢেলে দেয়। মাকে সবাই নাকি ঠকিয়েছে। অনেক কষ্ট করে মা অল্পবিস্তর নার্সিঙের ট্রেনিং নিয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। মার এখন ডেলি রোজগার, দীপ্তিমাসির তা নয়। মাসকাবারি মাইনের চাকরি। দীপ্তিমাসি সকাল বিকেল চার বাড়ি রান্নার কাজ করে। তার মধ্যে দুটো বাড়িতে আজ লোক নেই। ঝুমুর বলল, মা আজ আমরা কোথাও যাব? মা হাল্কা হেসে বল, দেখি। ঝুমুরের আজ স্কুল নেই। আজ চৈত্র সংক্রান্তি, আর কার একটা জন্মদিনের জন্য ছুটি। একটু বেলায় মা বলল, দীপ্তিদির সকালের কাজ শেষ হলেই আমরা বেড়াতে যাব। কিছু দরকারি কেনাকাটা , তারপর দুপুরে হোটেলে খাওয়া। গোলাপি রঙের প্রিয় ফ্রকটা গায়ে গলাতে গলাতে ঝুমুর ভাবে, কাল স্কুলে কত যে গল্প করতে হবে!

বিকেলটা সেদিন বড্ড ভাল ছিল। গঙ্গার পাড়ে বেশ দামি একটা হোটেলে বসে আইস্ ক্রীম খাচ্ছে ঝুমুর। দীপ্তি মাসি মাকে বোঝাচ্ছে হোকগে দাম , একদিন মেয়েটা্কে ভাল কিছু খাওয়াতে আমার সাধ হয়না? ও তোর একার মেয়ে নাকি? মা ফুচকা খেতে খেতে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। নদীর জলে সূর্যের আলো । কী সুন্দর রঙ্গীন বিকেল। জলের ধারে ধারে নীলচে আলোর মালা। -- মা বলছে আজ আর বাড়ি গিয়ে পড়তে বসতে হবেনা—তুই এখন থেকে ক্যারাটে শিখবি--- তোকে এবার জন্মদিনে সাইকেল কিনে দেব। সাঁতার শিখবি ঝুমুর? সাঁতার জানা খুব দরকার ----- ---

বার বার গাঢ ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে ঝুমুর। কেমন দম বন্ধ লাগছে --চারপাশে কোথা থেকে এত জল আসছে? ঘুম নাকি অতল জল ? কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে ঝুমুর? চোখ খুললেই দেখতে পাচ্ছে আবছা ছায়া মূর্তিরা নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে----। ওষুধের গন্ধ আর শরীর এ ফোঁড় ওফোঁড় করা যন্ত্রণা----- সন্ধ্যেবেলা লোডশেডিঙের সময় ঘরের দরজা ঠেলে কে ঢুকল? দীপ্তিমাসি আমায় একা ঘরে মোম জ্বালতে দেয়না। কে ঢুকেছিল ? বললাম তো, অচেনা কেউ আসেনি মা ---- গলা শুনেই তো বুঝলাম--- আমাকে তো চকোলেট দিল , গরমে ঘামছিলাম, তাই আদর করে রুমাল দিয়ে দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দিল, রুমালে কী মিষ্টি একটা গন্ধ--- --- 

এমারজেন্সি অপারেসন থিয়েটারের সামনে আকুল হয়ে অপেক্ষায় মণিকা আর দীপ্তি। দীপ্তির দাদা দুদিন ঘরে ফেরেনি। পেশায় ড্রাইভার হলে যা হয়, মাঝে মাঝেই সওয়ারি নিয়ে শহরের বাইরে গাড়ি নিয়ে যায় । এবার আরও দূরে গেছে দিন সাতেকের জন্য---- বস্তির অনেকেই এসেছে। বাইরে অপেক্ষা করছে। আজ কেউ কাজে যায়নি। ফুটফুটে একটা মেয়ের ওপর এ রকম অত্যাচারের পর তারা সবাভাবিক জীবন কাটায় কেমন করে? ওরাই তো হাঁকডাক করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল। মণিকা কাজ থেকে ফেরার আগেই---

ডাক্তার গম্ভী্র মুখে বলল,বড্ড বেশি রকমের অত্যাচার হয়েছে মেয়েটার ওপর। অনেকক্ষণ ধরে , না হলে এভাবে ----এত কম বয়স--- ব্লিডিং হয়েছে খুব , তাছাড়া অপারেশন করতেই হবে। ব্লাডের ব্যবস্থা করুন ইমিডিয়েটলি। বি পজিটিভ ব্লাড। 

ডাক্তারবাবু , আমার মেয়েটার জ্ঞান ফিরবে তো? ওকে—ভাল করে দিন , আমার যে আর কেউ নেই ও ছাড়া--- 

মণিকার কান্নার রেশ ধরে গর্জে উঠল দীপ্তি, ওর জ্ঞান ফিরলে শয়তানটার নামটা একটু জিগ্যেস করবেন? পিশাচটাকে নিজের হাতে শাস্তি দেব। 

নাম ? ডাক্তারবাবু ফিরে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ান, ওতো পুরো জ্ঞান হারায়নি, মাঝে মাঝে ঘোরের মধ্যে কথা বলছে --- কে এক মামার কথা বারবার বলছে , আপনারা তাকে চেনেন ? পারলে লোকটাকে পুলিশের হাতে তুলে দিন। সমাজের আবর্জনা যত সব। 

মণিকা কিছু বলার আগেই দীপ্তি বরফ ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে, দেব ডাক্তারবাবু, চিনি তাকে। অনেক কাল আগে থেকে। 

তার বুক নিংড়ে পুরোনো দিনের জমাট কান্না গলে গলে বেরিয়ে আসতে চায়। বিড়বিড় করে, আমার আগেই মনে হত, কতবার , এ কাজ , সেই করতে পারে! না হলে আমার অমন শান্ত মেয়েটা মুখ ফুটে কিছু বললনা, এত অকালে--- 

হাসপাতালের চত্বরে বস্তির লোকেদের জমায়েতের কাছে দৌড়ে যায় মণিকা। ওরাই এখন ভরসা। ব্লাড লাগবে। মাথার ওপর মধ্যদিনের সূর্যের অমিত প্রতাপ উপেক্ষা করে ওরা নিশ্চিত পাশে থাকছে। মণিকা এর বেশি এখন আর ভাবতে পারেনা। 

আই সি ইউ র ঠাণ্ডা ঘরে শুয়ে আমি কতক্ষণ ধরে জলের শব্দ শুনছি। ঠান্ডা জল আমার চারপাশে টলটল করছে। এখন কি বিকেল হয়েছে? সেদিন বিকেলে মা বলেছিল আরেকদিন বেড়াতে নিয়ে আসবে, গঙ্গায় নৌকোর ওপর থেকে সূর্যাস্ত দেখাবে। মা আরেকদিন ছুটি নাও। প্লীজ মা,---- বস্তির ঘরটা বড্ড অন্ধকার। একা একা ভাল লাগেনা । আমাকে সকালে গঙ্গার ওপর থেকে সূর্য ওঠা কবে দেখাবে---- ? আমার সঙ্গে মিঠি , ঘন্টা, টুম্পি --- ওদের নেবে সব্বাইকে------? 

krishna.roy@rediffmail.com



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.