ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

অসুর
কে একে তিনটে ভারি বস্তাই ঘাড়ে তুলে নিল বিরজু। তাই দেখে লখিরাম প্রশংসার চোখে তাকায় বিরজুর দিকে। তো, ইসিকো কহতে হ্যায় পহলবান! উল্টোদিকে চায়ের দোকানের ভাঙ্গা বেঞ্চিতে বসে চায়ের গেলাসে সব মুখ দিয়েছে তুলসী, লখিরামের শাদী করা নতুন বৌ। বিরজুর তাকত দেখে সেও হাঁ। আরে, এই লোকটার গায়ে খুব ক্ষমতা তো! তুলসী এ গাঁয়ের মেয়ে নয়, সে বঙ্গাল মুলুক কা লেড়কি আছে। লখিরাম দেড় সালকে লিয়ে বাংলা মুলুক গিয়েছিল কাম করতে। তো সিখানে তুলসী কে সাথ জান-পহেচান হল, পেয়ার হল, তো সাদী ভি হল। এখন শাদী করা বৌকে গাঁও লিয়ে এসেছে । এখান থেকে আর মাত্র মাইল দুয়েক গাঁও, তাই একটু চা-নাস্তা খেতে সবে দাঁড়িয়েছে, বিরজুকে সাথ মুলাকাত হয়ে গেল। লখিরাম বহুত খুশ বিরজুকে দেখে। লখিরাম খুশ তো বিরজু ভি! 

বিরজুর বাড়ি লখিরামের বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে। একসময় বিরজুর বাবা লখিরামের সঙ্গে বিরজুর মঝলি বোনটার শাদী দেবার খুব চেষ্টা করেছিল। লখিরাম তখন বাংলা মুলুক যাবার জন্য তৈয়ার। শাদিটা হয়নি। তাই কি বিরজু বারবার তুলসীকে দেখছিল। হয়ত মনে মনে মেপে নিচ্ছিল, কে বেশী ভাল দেখতে, তুলসী না তার বোন। বিরজুর বোনটাকে দেখতে মন্দ নয়। বলতে কি, লখিরামের বেশ পছন্দই ছিল। কিন্তু...এখন ভেবে লাভ নেই। তুলসীও খারাপ নয়। রং গোরা নেই আছে, লেকিন মন খুব সাফ...একদম সীসাকি তরহা। সব দেখা যায়। লখিরামকে খুব ভালওবাসে। নরম চোখে তুলসীর দিকে একবার তাকাল লখিরাম। দেখল, তুলসী বিরজুর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুরিয়ে বিরজুর দিকে তাকিয়ে দেখল, সেও তুলসীর দিকে তাকিয়ে। আবার চোখ ঘুরল তুলসীর দিকে। তুলসী চমক খেয়ে চায়ে মুখ দিল। কি ব্যাপার, এরা কি জান-পহেচান নাকি? লেকিন বঙ্গাল কি লেড়কি জানে ক্যায়সে? তাড়া লাগাল লখিরাম। আর নয়, এবার হাঁটা লাগাতে হবে। তুলসী চায়ের গেলাস শেষ করে উঠে দাঁড়াল। গায়ের শাড়ি টেনেটুনে ঠিক করে মাথার ঘোমটা আরো একটু বেশি করে টেনে দিয়ে লখিরামের সঙ্গে পা চালাল। বিরজু একবার সেদিকে তাকিয়ে বস্তা কাঁধে বড় বড় পা ফেলে উল্টো রাস্তা ধরল। সে এখন গঞ্জে যাবে। 

(২)

দিন সাতেক হল লখিরাম গাঁ এসেছে তার নতুন বৌ নিয়ে। এর মধ্যে বার পাঁচেক তুলসী কাজের কথা বলেছে। কাম কাজ তো করতে হবে, ঘরে বসে থাকলে চলবে নাকি? কিন্তু, দেড় সাল বাদ ঘরে এলো মানুষটা, দুদিন জিরোতে তো দেবে! আর তুলসীর অত জোরাজুরি করবার কি আছে, সে কি খেতে পায় না? লখিরামের ঘরে তো খাবার অভাব নেই, তবে? মনে মনে বিরক্ত হল লখিরাম। আট দিনের দিন সকালে এই নিয়ে তুলসী কিছু বলতে যাবে, দেখল উঠোনের দরজায় বিরজুর মুখ উঁকি মারছে। পরনে ছোটঝুলের পাজামা। গায়ে নীল রঙের হাতকাটা গেঞ্জি, পায়ে টায়ারের চটি। বেশ হাট্টাকাট্টা চেহারা। বিরজুকে দেখে একবার লখিরামের দিকে চাইল তুলসী। মনে মনে তুলনা না করে পারল না। এই মানুষ খাটবে কি করে? কিন্তু ওখানে তো খাটত! কিছু বলতে যাবে, বিরজু লখিরামকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।

লখিরামকে যখনই কিছু কাজের কথা বলতে যাবে, কি করে যেন বিরজু এসে যায় আর লখিরামকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে চলে যায়। আজকেও লখিরাম ঘরে ফিরল যখন প্রায় মাঝ দুপুর। সাসু-মা খেয়ে নিয়েছেন। তুলসী হাঁ করে বসে আছে তো আছেই। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু লখিরাম ফিরল যেন মাতাল হাতী। এর আগে এইরকম কোনদিন দেখেনি লখিরামকে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তুলসী। লখিরাম সারা ঘর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর হুঙ্কার ছাড়ছে—দেখ লো, কোই হ্যায় মেরে সমান, হ্যায় তেরা বিরজু ? দেখ লো...’ আই বাপ্‌, তো এইজন্য এত হুঙ্কার! তুলসী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে দেখল তারপর খাবারের থালা মাটিতে নামিয়ে রেখে একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভাত, দুটো রুটি, একটা পাঁচমিশেলি তরকারি, পেঁয়াজ,দুটো কাঁচালঙ্কা আর একপাশে অল্প একটু লেবুর আচার। তুলসী ওদের মত এইরকম ভাত-রুটি মিশিয়ে পাঁচমিশেলি খাবার খেতে পারে না, কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে বলবেই বা কি করে, কোনরকমে খেয়ে নেয়। সেই খাওয়াও আজ কখন জুটবে কে জানে! চোখ লাল করে খাবারের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল লখিরাম তারপর ধপ্‌ করে মাটিতে বসে পড়ল। গলা যতটা সম্ভব উপরে তুলে জিজ্ঞেস করল—কৌন বনায়া?’ 

তুলসী ঠিক ভেবে পেল না, কি উত্তর দেবে। তুলসী বানিয়েছে বললে যদি না খায়, আবার আম্মা বললে যদি রেগে যায়! উত্তর না দিয়ে চুপ করেই রইল। একটা রুটি কোনরকমে কয়েকটা টুকরো মুখে গেল কি গেল না, লখিরাম উঠে পড়ল। টাল সামলাতে না পেরে পায়ে লেগে খাবারের থালা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। টলমল করে এগিয়ে গিয়ে সামনের দড়িতে ঝোলানো লুঙ্গি কি শাড়ী যা ছিল তাতে মুখটা কোনরকমে মুছে ভর দুপুরে উঠোনে চারপাইতে রোদে দেওয়া কাঁথা-কাপড়ের উপর গিয়ে শুয়ে পড়ল। চারিদিকে ভাত,তরকারি...একেবারে যা তা অবস্থা। তুলসী তাড়াতাড়ি তুলতে গেল, ঘরের ভিতর থেকে সাসু-মা এসে গম্ভীর হয়ে বললেন—রখ দো, ও খুদ উঠায়ে গা। যা, তু খা লে।‘ 

কিন্তু, এইরকম করে ফেলে-ছড়িয়ে রেখে যাবে! তুলসী কি ভেবে আবার তুলতে গেল, সাসুমা আবার গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন---যা, তু খা লে। রখ দে ইয়ে সব...’। ঘরের বাইরে এল তুলসী, তারপর দেয়ালের একটা কোণায় বসে কাঁদতে লাগল। হে ভগবান, কে তাকে এখানে আসতে বলেছিল। এই লোকটা তো এমন মনে হয়নি। কই,ওখানে তো অমন করেনি! দুহাতে মুখ ঢেকে ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়।

(৩)

পাক্কা তিনমাসের মাথায় লখিরাম একদিন উঠোনের চারপাইতে সেই যে শুয়ে পড়ল আর উঠল না। সেই চারপাইতে করেই গাঁয়ের লোক ‘রাম নাম সত্‌ হ্যায়’ করে নিয়ে গেল শম্‌শাম। শম্‌শান থেকে ফিরে লোকের নজর এড়িয়ে ঘরের এক কোনে ডেকে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল বিরজু—শালা! বহুত মেহনত কিয়া , বহুত মেহনত কিয়া ইসকে লিয়ে। বহুত টাইম লগা... মরতা হি নহি শালা..তিন মাহিনা লগা দিয়া....!!!!!’ শিউরে উঠল তুলসী। তারপর সাপিনীর মত স্থির, ভয়ানক চোখ মেলে চেয়ে রইল বিরজুর দিকে। তবে কি, এতদিন ধরে মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে......!

রাতের বেলায় গরুর গোয়াল থেকে বিচালি কাটার বড় বঁটি আর দা নিয়ে সাসু-মায়ের ঘরে এসে আশ্রয় নিল তুলসী। অসুর নিধনের গল্পটা কি জানে বিরজু? 

দুর্গারা এখনও আছে, অসুর যে সব জায়গায়...!

chatterjee.jharna@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.