সবেমাত্র আয়না দেখতে শিখেছি। নিজেকে বার বার করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। কখনও আয়না জুড়ে শুধু আমি। কখনও আয়নার চারপাশ জুড়ে পছন্দের লতাপাতা। আমি তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। বেশ একটা স্বস্তি পাই। আমার কোথাও একটা দাঁড়াবার জায়গা আছে। কেউ আমাকেও কাছে টানে। আহ্বান না থাকলেও বিসর্জন অন্তত নেই।
আমি কথা বলতে শিখি। এতদিন আমার অনেক কথা বলার মতো অবস্থায় তৈরি হয়ে আছে। প্রতিটি অক্ষর, শব্দ, বাক্য আমাকে প্রকাশ করার জন্য উদগ্রীব। আমি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি। কিন্তু বলব কাকে? বললে তারা আমার কথা শুনবেই বা কেন? যখন আয়নার ফ্রেমে পছন্দের লতাপাতাদের দেখতে পেলাম তখন মনে হল কাউকে অন্তত আমার সামনে দাঁড় করাতে পেরেছি। আমি কথা বললে তাদের কানে অন্তত যাবে। নাও যেতে পারে। কিন্তু তবুও চোখের সামনে কেউ একজন থাকলে কথারা সাহস পায় বেরিয়ে আসার। আমার কথারা তো আমার মতোই। বেশ জড়োসড়ো, লাজুক প্রকৃতির। তাই আমি আমার প্রিয় লতাপাতাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের জন্যেই আমি নিজেকে বাইরে বের করে আনতে পেরেছি।
এক একদিন সমগ্র আয়নার ফ্রেম জুড়ে শুধু আমি। বেশ ভয় পেতাম। আমার লতাপাতারা সব গেল কোথায়? অনেক ডাকাডাকি করতাম। একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাওয়া যেত না। বুঝতে পারতাম আমার কথারা কথা বলতে শিখেছে। আমার কথাদের কেউ কেউ রেখে দিয়েছে তাদের বুকের উষ্ণতায় ।
এবার আমার শরীরে কথাদের ডালপালা ছড়ানোর পালা। বুঝতে পারছি ভেতর অশান্ত হয়ে উঠছে। যেখানে সেখানে নিজেকে দাঁড় করানোর সাহস জন্মাচ্ছে। কথার বৃষ্টি দিয়ে অনেককিছুই ভেজাতে পারছি। কথাকে সঙ্গী করে প্রবেশ করতে পারছি আর এক কথার শরীরে। আমাকেও অনেকে বুঝতে পারছে আমার কথার পথ ধরে এসে।
দিগন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে এমন কোনো জায়গায় এসে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছি। কতকিছুই যে আমার ভাবনার মধ্যে ঢুকে পড়ছে তা কথা দিয়ে বুঝতে পারছি। নিজেকে ভরিয়ে তোলার আনন্দ তা আমাকে জানিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে এক আকাশ রোদ্দুর। আমার কাছে রোদ্দুরের উত্তাপ আজ আর দাবদাহ নয়। রোদ্দুরের গান আমার কানে বাজছে। আমার কথারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে আর এক কথার গভীর প্রদেশে।
গভীর সবসময়ই যে মুক্তাঞ্চল তা আজ বুঝতে পারছি। বাইরেই যত কলহ, যত বিবাদ ----- গহন প্রদেশ নৈঃশব্দ্যে ভরা। আমাদের যাত্রা তো গহন প্রদেশের উদ্দেশ্যেই। কিন্তু আমরা যে থামতে জানি না। কোন সময় কখন কোথায় দাঁড়িয়ে নিজেকে ভরে নিতে হয় সেটা যে আমাদের অনেকেরই জানা নেই। আমাদের সঙ্গে সেই কবে পরিচয় হয়েছে একটি কথার ----- থামলেই থেমে যাওয়া। কিন্তু কোথায় থেমে যাওয়া! শরীরে থামলেও আমাদের মনের চলাচল তো চলেছেই। আরও উচ্চ প্রদেশে ওঠার জন্য বাড়তি কিছু অক্সিজেন।
একটা বিশেষ উচ্চতায় অনেক দূর প্রদেশের বস্তুও চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। শুধু যে তাদের দেখতে পাই তাই-ই নয়। তাদের কথাও কানে এসে পৌঁছায়। মনে হয় তাদের সঙ্গে যেন আমার কতদিনের যোগ। তবুও এই সেদিনও তাদের চিনতাম না। তারা পাশে থাকলেও কোনোদিন বুঝতে পারিনি। আসলে তাদের বোঝার জন্য হৃদয়সম্পদের যে ভার থাকা উচিৎ তা কোনোদিন মনে এসে জমা হয় নি। তাদের সঙ্গে যে কথা তা তো এতদিন মনে তৈরি হয় নি। তাই চোখের সামনে থেকেও তাদের চিনতে পারি নি।
আজ কিন্তু গাছ আমায় ডাকে। আমি গাছের কাছে যাই। চারপাশে কত কথা! কথার পাহাড়! গাছের চোখে চোখ রেখে দেখতে শিখলাম। বুঝতে পারলাম, কথাই সব নয়। না বলা কথাতেও লুকিয়ে থাকে কত কিছুর হদিশ। কথা না বলেও কত কিছু বলা যায়। মনে হয় শুধু বলে যাওয়া কেন? বলে ফেলা মানে তো নিজেকে বলে দেওয়া, কাছে চলে আসা। দূরের ভাষা তাহলে বুঝব কিভাবে? তাই তো গাছের কাছে এসে চুপ করে বসে থাকি।
দিনের পর দিন গাছের কাছে এসেছি। কতদিন গাছ কথাই বলে নি। মনে হতো গাছ আমাকে পড়ছে। আমিও একটা কথাও বলি নি। আমি তো গাছ ভালোবেসে এসেছি। তার সঙ্গটাই তো আমার কাছে সব। সেটাই তো কথা বলা।
বুঝতে পেরেছি গাছ আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। মনে হয়েছে তাহলে একটা কোথাও পূর্ণতার জায়গায় নিজেকে আনতে পেরেছি। এটা যেন জীবনের একটা বড় পাওয়া। বুঝতে পারি নৈঃশব্দ্যের এক বিরাট প্রান্তরে এসে পৌঁছেছি। এখানে সব কথা শেষ। কথার সহজ মাধুরী এখানে বাষ্পীভূত। এখন আত্মউন্মোচনের পালা। এবার সেই অসীম অনন্তে নিমগ্ন হয়ে থাকা।
তাই তো কথা দিয়েও গাছ কথা বলে নি ------
" অ্যাসগাছ
আমাদের সঙ্গে
কথা বলতে চেয়েছিল ।
কিন্তু কোনো কথা বলে নি ।
------ অক্টাভিও পাজ
এ আমার পরম পাওয়া। আমি গাছের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আত্মউন্মোচনের পর্ব শেষ করে আমি এখন অসীম অনন্তে নিমগ্ন।
mharitbandhopadhyay69@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন