আমোদিনী ইত্যাদি প্রভৃতি বর্গের আলোচনায় ঘোরাফেরা করিয়া থাকে। নন্দিতা সান্যাল, লীলাবতী দাস, পূর্ণা সিনহা দিগের নাম উচ্চারণ হইবার পর যে প্রমুখ শব্দ টি উচ্চারিত হইতে থাকে সেখানে আমোদিনী সরকার সেইখানে অবস্থান করে। যাহাদের নাম সকল কাজে অগ্রে রাখা হইয়া থাকে তাহারা যে আমোদিনী সরকারের তুলনায় অধিক কাজ করিতে বা বুঝিতে সক্ষম তাহা নহে, আসলে আমোদিনী সরকার গ্রাম্য একটি কন্যা সেই কারনে সে গ্রহনযোগ্য নহে। তাহার পিতা তাহাকে ভাষা শিখাইয়াছে, বানান শিখাইয়াছে, কিন্তু কলিকাতার ইংরেজিমাধ্যম আদব কায়দা শিখাইতে সমর্থ হন নাই।সে নাগরিক সজ্জায় নিজেকে সজ্জিত করিতে সক্ষম নহে। কিন্তু বিধাতা পুরুষ তাহাকে অন্তরে বীরত্ব দিয়াছে, মস্তিস্কে প্রজ্ঞা দিয়াছে, আর হৃদয় তাহার প্রত্যাশাহীন। তাহার বিদ্যালয় টি দক্ষিণ কলিকাতায় নামজাদা বলিয়া খ্যাত। এই স্থানের শিক্ষিকা হইয়াও তাহার কোন উন্নাসিক প্রবণতা গড়ে ওঠে নাই। বিদ্যালয়ের অধস্তন কর্মীরা তাহাকে খুব সম্মান করিয়া থাকে। মনের কথা খুলিয়া বলিতে পারে। আর সেও তাহাদের কথা সাগ্রহে শুনিয়া থাকে। কারণ সে নাগরিক কথোপকথনে পারদর্শী না হইলেও, সমস্যা ও তাহার গভীরতা বুঝিতে সক্ষম।
আমোদিনী সরকার দক্ষতার সহিত বাঙলা ভাষা শিখাইয়া থাকেন। সপ্তম শ্রেনিতে একটি ছাত্র তাহার মনোযোগের কেন্দ্রে আসিল। অকারনে সে চঞ্চল হইয়া থাকিতেছে। অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ করিতেছে। নিভৃতে কাছে ডাকিলেন।“ তুই তো ভালো ছেলে ছিলি। এতো দুষ্টুমি কেন করছিস?”সাদা বাঙলা ভাষায় জিজ্ঞাসা করিতে তাহার চোখে মেঘের ছায়া পড়িল।সদা ইংরেজি তে কথা বলা ছেলেটি বাংলায় বলিল, “ আমি ভালো হয়ে কি করব? যাই করি সবই তো খারাপ।”অনেক কথায় সে জানালো।
তাহার পিতামাতার সম্পর্ক টালমাটাল হইয়া আছে। সে আয়ার কাছে খাদ্য গ্রহন ও নিদ্রা যাপন করিয়া থাকে । তিন জন গৃহ শিক্ষক তাহাকে পড়াইতে আসিয়া থাকে। আমোদিনী সরকার তাহার বাড়ির ঠিকানা লইলেন আর তাহাকে বলিলেন শান্ত হইতে। শিশুপালন সংক্রান্ত যে সকল আইন কানুন হইয়াছে,তাহা লইয়া দুইতিন দিবস ব্যয় করিল আমোদিনী সরকার।নিজের পরিছন্ন হাতের লেখায় সুচারু রূপে লিখিল তাহার পিতা ও মাতা কে। আর জানাইল যদি এভাবে তাহারা তাদের দায়িত্বে অবহেলা করিয়া থাকে সে উপযুক্ত স্থানে জানাইবে।ছেলেটির পঠন পাঠন আর আচরণে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আসিল।দেখা হইলে সে লজ্জাশীল নয়নে তাকিয়ে সন্তোষ ও প্রফুল্লতা জ্ঞাপণ করিয়া থাকে। তাহার পর কি হইল কে জানে সদ্য কিশোর কিশোরী ছাত্রছাত্রীরা তাহাকে খুব ভালবাসিয়া মনের কথা বলিয়া থাকে এবং মান্য করে। যাহারা আমোদিনী সরকার কে তাহাদের সামাজিক ও বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলের উপযুক্ত মনে করিত না, এই জনপ্রিয়তা তাহাদের অনেক কেই কষ্ট করিয়া হজম করিতে হইল।
বিদ্যালয় টির নানা আধুনিকী করন সম্পন্ন হইতেছে। অগ্নী নির্বাপক যন্ত্র টি বসানো হইবে। একজন শিক্ষিকা কে আগুয়ান হইতে হইবে। কেবল মাত্র অধস্তন কর্মচারীদের হস্তে তাহা নস্ত করিলে চলিবে না। কয়েকজন সানন্দে আসিলেন। আর ইত্যাদি প্রভৃতি হইতে উঠিয়া আসিলেন আমোদিনী সরকার। বাস্তব ক্ষেত্রে অনুসন্ধান করিয়া প্রধান শিক্ষিকা দেখিলেন কেবল মাত্র আমোদিনী সরকার পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে যন্ত্রটির ব্যবহার বিধি সম্বন্ধে জানেন ও প্রয়োগ করিতে সক্ষম। তিনি প্রভুত খুশি হইলেন। আমোদিনী সরকার ইত্যাদি হইতে কিঞ্চিৎ উপরে উঠিলেন। কাহারও কাহারো সেই দিবসে মাইগ্রেনের ব্যাথা খুব বাড়িল।
বিদ্যালয় সুচারু রূপে চলিতে ছিল। আমোদিনী সরকার হঠাৎ একদিন পদত্যাগ পত্র দিলেন প্রধানা শিক্ষিকার কাছে। তিনি হতবাক হইলেন।নানান কথা উড়িতে লাগিল। সত্য কেহ জানিল না। কেহ বলিল, “ গ্রামের তো শহরের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিল না।” “ বিয়ে হয়ে গেল নাকি?” “ পলিটিক্স জয়েন করেছে?” । এমনি করে পনের বৎসর হুড় হুড় করে চলিয়া গেল। আচমকা টিভিতে খবর হইল “বীরভূমের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে আমোদিনী সরকার নামে একজন শিক্ষিকা একটি বিদ্যালয় চালাছেন। দরিদ্র ঘরের মেধাবী তিরিশটি ছাত্রছাত্রী এখান থেকে রাজ্যস্তরে অসম্ভব ভালো ফল করেছে।” মিডিয়া ছয়লাপ হইল তাঁহার ও ছাত্রছাত্রীদের ছবিতে। দক্ষিণ কলিকাতার সেই বর্ধিষ্ণু বিদ্যালয়ের শিক্ষিকারা অ্যালবাম খুঁজিতেছেন যদি আমোদিনীর সহিত তাঁহাদের ছবি একখানি প্রাপ্ত হয়। ফেসবুকে সাঁটাইতে হইবে।
niveditaghosh24@gmail.com
Tags:
ধারাবাহিক