অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

ফণিকালার জীবন দর্শন
ণিকালা আমাদের বাড়িতে মুনিষ খাটে। তার ডোঙায় আমি কোনদিন চড়িনি। এই যে ডোঙায় নিয়ে ফণিকালা দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়, সে চলে যায় কোথায় না কোথায়, সাত সমুদ্দুর ঘুরে আসে সে এই ডোঙায় চড়েই। আমি খাল পারে বসে তার সেই উজান বেয়ে যাওয়ার কাহিনি শুনি। মাথার উপর সজনে ফুলের গাছ। গাছের ডালপালা ভর্তি ফুল। সেই সব ফুল টুপটুপ ঝরে পড়ে আমাদের মাথার উপর। সেই সব কাহিনি শুনে আমি ভাবি, ফণিকালার কি ভয় ডর নেই? 

সে আমায় একটি ডোঙা বানিয়ে দেবে বলেছে। তালগাছ কেটে বানানো। এছাড়া মই বানাতে পারে ফণিকালা। চাল ছাইতে জানে। গ্রামে যখন হরিনাম সংকীর্তনের আসর বসে, সে বসে বসে খোল বাজায়। দু’চোখ বোজা। বন্ধ চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পাশে তার ছোট ছেলে কানাই। তার হাতে থাকে খঞ্জনি। সেও তার বাপের সাথে আমাদের জমিতে কাজ করে। বাপের সাথে বাজায়। তবে সে চোখে ভালো দেখতে পায় না। খুবই কম দেখার ফলে একটু কাত হয়ে রাস্তার ধার দিয়ে ঘাড় কাত করে হাঁটে। 

সজনে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে যতদূর খাল চোখে পড়ে, তার বাইরেও অনেকটা আছে। সেদিকেই ফণিকালা যায়। দু’ তিনদিন পরে ফিরে আসে। এসেই বলে, -উঃ, কি দেখলুম!

-কী কী কী? আমার উত্তেজনা আর বাঁধ মানতে চায় না।

-সে কী এক কথায় বলা যায় বাবুভাই! আমি তো গেছিলাম সমুদ্দুর। সেখানে দেখি এক দেবী। তাঁর চারটি হাত। পরনে জমকালো শাড়ি। নাকে এই বড় নথ; কানে টান দেওয়া। মাথায় তাজ। তিনি এক বৃহত গোলাপি পদ্মফুলের ভেতর বসে আছেন। এক হাতে ধরে আছেন একটি হাতি। সেই হাতিকে এক হাতে গিলছেন, অন্য হাতে উগড়ে দিচ্ছেন। 

-বল কী! তারপর?

-দেখে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া। ভুল দেখছি নাতো! চোখ কচলে নিলুম; না, ভুল নয়; যা দেখছি তা সত্য বটে।

-কি করলে তখন?

-কি আবার করব, এখানে কিছু করাও যায় না, দেবীর কাছে কোন কিছু বরও মাগা যায় না। কেবল অবাক হয়ে দেখতে হয়। 

-তারপর কী হল বল না! 

-তেমনি চলল, চলতেই থাকল। তারপর আমি ফিরে এলুম। 

-যাঃ! চলে এলে কেন? 

-ভয় করছিল যে! 

-কিন্তু তোমার তো ভয়ডর বলে কিছু নেই।

-কে বললে এসব?

-কে আবার, দাদু।

–আসলে কি জানো বাবুভাই, আমি ভূতকে ভয় পাইনে। নিত্যরাতে তাঁদের সনহে আমার দেখা হয়, মোলাকাত হয়। কত কথা হয়, গল্প হয়। রাত বিরেতে যখন আমি ডোঙা বাই, খালের নিঝুম পথ বেয়ে চলতে থাকি, কত বন-জংগল পেরিয়ে যাই, তখন তেঁনারা এসে আমার ডোঙাতে বসেন। তাঁরা কেউ অনেকটা পথ যাবেন, সব সময় কি আর লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতে বা উড়ুতে ভালো লাগে, তাই ডোঙা চাপা। বা ধর না কেন, তেঁনাদের সখ হল একট ডোঙা চেপে জলে ভেসে বেড়ানো। আর মানুষের সাথে গল্প-গুজব করা। মানুষের যেমন নানাবিধ সখ জন্মায়, তেমনি তেঁনাদেরও শখ আহ্লাদও থাকে বইকি। 

-কিন্তু সকলে ভূতকেই তো ভয় পায়, ভগবানকে নয়। তুমি দেখি উলটো। ভূত নয়, ভগবানকে ভয় পাও। 

-ভগবানের সঙ্গে এই প্রথম হল কিনা, তাই— । 

আমরা তালগাছ দেখতে বেরুই। খালপাড়ে গাছ আছে আমাদের। পরপর এগারোটা তালগাছ। তাদের নামেই এই মাঠের নাম ‘এগার তালের মাঠ’। এখানে আমাদের জমি আছে। শীতে আলু, গরমে পাট। খালের জলে সেচ চলে। বাঁশের কপিকল ফিট করে তালগাছের ডোঙা লাগিয়ে জল তোলা হয়। আবার সেই ডোঙাতেই ভেসে চলে ফণিকালা। সে বলে, -এমনি করেই যে মানুষ ভাসে বাবুভাই।

-আর কি ভাসে?

-পতং ভাসে।

-আর? 

-সাপ ভেসে যায়।

-ওমা, সাপ! সে তো খুব ভয়ের ব্যাপার হল।

-ভয় করলে তুমি কি করে খাল বেয়ে, নদী ছুঁয়ে সাগরে মিলবে বাবুভাই? আর সাগরে না মিললে সমুদ্দুর দেখবে কি করে? সে যে এক বিষম জিনিস! সেখানে যেতে গেলে সাহস চাই। সেখানে গিয়ে বড় বড় উঁচু উঁচু ঢেউকে বলবে, আয় আয়। তখন দেখবে ঢেউ কেমন ভয় পাবে তোমায়। 

-আমি সাহসী।

-সাহস কোথা থাকে বাবুভাই?

-দেহের ভিতর।

-এই তো। তোমার যে ডোঙা আমি বানিয়ে দেব বলেছি, তার একটা জুতসই নাম দিতে হবে বইকি, যেমন লোকে আমার ডোঙার নাম দিয়েছে ‘ফণিকালার ডোঙা’, তেমনি। 

তালগাছ দেখতে দেখতে কথা হয় আমাদের। এখান থেকে একটি তালগাছ কেটে ডোঙা বানানো হবে, কেউ জানবে না। 

তালগাছের নিচে বসে ফণিকালা আমার তাদের কাহিনি শোনায়। বলে, -তোমার দাদুর বাবা এক আদর্শবাদী মানুষ ছিলেন। আমাদের গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুলটা তাঁর হাতেই তৈরি। আর করেছিলেন এই এগার তালগাছ। তিনি এই সব গাছ করেছিলেন কেন জানো? এরা জমি পাহারা দেবে।

-তালগাছ পাহারা দেয়? আমি অবাক। 

-হ্যাঁ। কতশত উপদ্রব আছে জমিকে ঘিরে। পঙ্গপাল আছে, ভূত-প্রেত-অপদেবতা আছে। আর আছে মানুষ। তারা জমি কেড়ে নিতে চায়। জমি কিনে কারখানা বানাতে চায়। সে সব থেকেও জমিকে রক্ষা করা দরকার। তাই এই সব গাছ করেছিলেন তোমার পূর্বপুরুষ। তাই এই গাছ কেটে ডোঙা বানানো ঠিক হবে না।

-কিন্তু ডোঙা যে আমার চাই!

-তাতে আর অসুবিধা কি! আমারটা তোমায় দিয়ে যাব। 

-তুমি তাহলে কি চাপবে?

-আহা! সে কথা নয়, এখুনি দিচ্ছি না। আগে বড় হও, তখন। অতদূর যাবে, একটু বড় না হলে চলবে কেন!

-আমি আর কত বড় হব? ভাবি আজই তোমার নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করি। সেখানে গিয়ে দেখব সেই দেবীকে। একহাতে একটা গোটা হাতি গিলে নিচ্ছে আবার উগড়ে দিচ্ছে। তার দু’দিকে জলের ফোয়ারা এই উঁচুতে উঠে যাচ্ছে! 

-ফোয়ারা! কই অমন তো আমি বলিনি!

-তুমি বলনি বটে, কিন্তু হতে কি পারে না? 

-তা বটে! 

-তাঁর মাথার উপর দিয়ে কী নীল মেঘ উড়ে যেতে পারে না?

-পারে বইকি!

-সমুদ্দুরের বড় বড় ঢেউ উঠল, আর হাজার হাজার সোনালি মাছ তাঁকে ঘিরে পাক খেতে লাগল। 

-হুম! 

-সমুদ্দুরের সাদা সাদা বিরাট বিরাট পাখিরা তাঁর মাথার উপর উড়ে উড়ে গান শোনাতে লাগল। 

-আহা! সে গান যেন আমি চোখ বুজলেই শুনতে পাই। 

ডোঙার কাছে এসে আমি করি কি, মন দিয়ে ডোঙাকে দেখতে থাকি। আলকাতরা মাখানো। এগারো তালগাছের কাছেই রাখা থাকে সেটি। দরকারে ফণিকালা তাকে কাঁধে চাপিয়ে জলের কাছে নিয়ে যায়। সঙ্গে একজন লোক। সেটিকে যখন জলে ভাসানো হয়, আমার মনে যেন তুফান ওঠে। মনে হয় আমাদের বাড়িতে যখন কার্তিক মিস্ত্রি ঠাকুর গড়তে আসে, সে যখন মা দুর্গার চোখ ফোটায় খুব ভোরে, তেমনি জলে ভাসানো মানে ফণিকালা চোখ ফুটিয়ে দিল ডোঙার। এবার সে জীবন্ত। তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্টা হল। 

আমি বলি, -সে না হয় হল ফণিকালা; তুমি আমায় দিয়ে দিলে। কিন্তু আমি যে বাইতে জানি না। তাহলে?

-সে তোমায় আমি শিখিয়ে দোব। কিন্তু সমদ্দুর অবধি যেতে পারব না। তোমার দাদুর বারণ আছে তোমায় ডোঙায় তোলার। একটু যাব। নদীর পথ দেখিয়ে দোব। সেখান দিয়েই তুমি সাগরের পথ পেয়ে যাবে।

-কিন্তু তখনো কি সেই দেবী থাকবে? 

-নিশ্চয় থাকবে। 

-হাতি গিলবে আর ওগড়াবে?

-নিশ্চয়ই। 

এর দু’বছর পর, আমি যখন সেভেনে পড়ি, ফণিকালা গ্রাম ছাড়া হয়ে যায়। তার যে দু’কামরা মাটির ঘর ছিল; টালির চাল, তাতে লতিয়ে ওঠে লাউ ডগা, সামনে উঠোন। সেই এক ফালি উঠোন যাতে বাকি মাঠের সঙ্গে মিশে না এক হয়ে যায়, সে জন্য কঞ্চির বেড়া তুলে রাখে সে। এক ধারে বড় বড় তুলসী গাছ। এ সব কিন্তু শেষ জীবন পর্যন্ত ভোগ করতে হয়নি ফণিকালাকে। তার বড় ছেলে গোবিন্দ, যে কলকাতার মিষ্টির দোকানে কাজ করে, সে বাড়ি থেকে বের করে দেয় ফণিকালাকে। 

দরাজ গলা ছিল ফণিকালার। প্রাণ খুলে হরিনাম করত। যেদিন সে গ্রাম ছাড়া হয়, সেদিন ভোরে সে নামগান করতে করতে গ্রাম পরিক্রমা করে। সঙ্গে তার অবিবাহিতা মেয়ে বিজলি। তার হাতে খঞ্জনি। লোকে বোঝে না এই তার শেষ গান, আর কখনই সে গ্রামে ফিরবে না। বরং লোকে ভাবলে, ভোরবেলা এই যে মন প্রাণ ঢেলে নামগান করতে করতে গ্রাম পরিক্রমা করছে, এ খুব ভালো জিনিস। রোজ যদি সে এমনি করে তো আমাদের পুণ্যি বাড়ে। 

সেদিন সেই আত্মহারা গান শুনে সকলে উঠে পরেছিল। গ্রামের সকল পশু পাখি, তারাও কুজন করতে লাগল। আমিও উঠে পড়লাম। কান পেতে সেই গান শুনি। দাদু বলে,-কে গাইছে বলত?

-ফণিকালা! 

-দারুণ মিঠে গলা ওর।

-ও কি রোজ ভোরে এমনি গায়?

-না। আজই প্রথম। ফণিকে বলব, রোজ এমনি করে গাইতে। 

গ্রামের সব লোকের ঘুম ফণি একাই ভাঙ্গিয়ে দিয়েছিল। এবার তারা ঘর ছেড়ে বাইরে এল। বাঁকপাড়া, মুদিপাড়া, কাঁড়ারপাড়া। কলতলার অমলেন্দুর মুদি দোকানের কাছে আসার আগেই দেখা গেল ফণিলাকার পিছনে এক লম্বা লাইন। সকলেই ফণির সঙ্গে গলা মিলিয়ে নামকীর্তন করছে। ফণির দু’ চোখের জল টপটপ করে পড়ছে। লোকে জানল ধর্মের আবেগ। ফণি জানল, বিদায় সম্বর্ধনা! 

সেই মিছিল শেষ হল আমাদের ঠাকুর দালানের সামনে এসে। ঠাকুর দালানের বাইরে দাদু দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে দেখে ফণি থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পিছনের সেই দল। দাদু বলল, -এসো সব। 

আমাদের সেই দালানে বসে আরও গান হয়। ঠাকুরের নাম হয়। আমাদের গ্রামের সবাই শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত। তাঁর গান হতে থাকে। সবশেষে চা পান দিয়ে সেই পরিক্রমা শেষ হয়। 

সেদিনই সে সকলের অগোচরে গ্রাম ছাড়ে মেয়েকে নিয়ে। ওর ছোট ছেলে কানাই রয়ে যায় আমাদের বাড়ী। সে দু’চোখেই কম দেখে। রাস্তার ধার দিয়ে হাঁতে। টাল খায়। এখন আমাদের মুনিষ। আমাদের ঠাকুর দালানই এখন তার ঠিকানা। সে বাপের একটি গুণ খুব ভালো পেয়েছে। ঢাক বাজানো। প্রতি পুজোয় তার বায়না পড়ে। একমাত্র সেই বাজানোর দিনই তার গায়ে জামা দেখি। বাকি সময় কেবল গিঁত দেওয়া মালকোচা মারা লুঙ্গি। 

গোবিন্দ কিন্তু এমন ছিল না। যখন সে কলকাতার মিষ্টির দোকানে কাজে যায়নি, গ্রামের নানা কাজে হাত লাগাত। ইস্কুল মাঠে যখন বাতসরিক হরিনাম হোত, সে কাগজের শিকলি বানাত। রঙ্গিন কাগজ কিনে সরু এক কাঁচি দিয়ে সে নক্সা বানাত। হরিনামের মঞ্চ জুড়ে সেই কাগজ টানা হোত। সে আমাদের ঠাকুর দালানের কাজেও এমনটি করত। নিজেই চলে আসত কোন বড় পুজো হলে। নিজেই কাগজ কিনে আনত, কাজ করে দিত। তখন গ্রামের একটি মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের আত্মার সম্পর্ক খুব বেশি ছিল। 

পরে গ্রামে খবর আসে ফণিকালা চন্ডীতলা বাজারে তেলেভাজার দোকান দিয়েছে। আমি শুনে দাদুকে বলি। দাদু বলে, -তবে তো একদিন দেখতে যেতে হয়।

আমি আর দাদু চলেছি চন্ডীতলা বাজারে, ফণি কালার সন্ধানে। আমাদেরও বেশি বেগ পেতে হল না। বাজারে মিনিট কুড়ি ঘোরাঘুরি করে আমরা দোকানটা পেয়ে গেলাম। বেড়া দেওয়া দোকান। মাথায় টালিখোলা। দাদু দোকানে ঢুকে বলে, -কেমন আছিস ফণি?

সে যেন জানত দাদু আসবে। তাই সে অবাক হয় না। খুব স্বাভাবিক গলায় বলে, -আছি দাদা। চলে যাচ্ছে।

-চলে এলি, কাউকে বলে এলি না।

-তাহলে তোমরা আসতে দিতে না। 

-সে তো দিতুম না। বরং আমরা বার করে দিতুম গোবিন্দকে।

-সে জন্যি চুপচাপ মেনে নিলুম দাদা। নিজের সন্তানের সঙ্গে কি আর ঝগড়া করা যায়। এই আমি ভাল আছি। বিজলি মশলা করে, আমি ভাজি। ঘুঘনি করি। টিন ভরে মুড়ি রাখি। বাড়ি ফিরে দুটিতে মিলে রান্না করে খাই। আর কি? 

-তোর দোকান তো দেখলুম। কিন্তু থাকিস কোথা?

-সরকারি জমি দখল করে আছিস দাদা। ছিটে বেড়ার ঘর। 

-আবার আগের অবস্থা হয়ে গেল তোর! 

-এই বেশ আছি দাদা। 

-নাম গান করিস?

-না দাদা। তেমন করে আর করা হয় না। ওই নিজের মনে গুনগুন করি; কাজ করি আর গান গাই। আর কিছু মাতাল আসে, মদের চাট নিতে; ওরা শোনে। ভদ্দরলোকরা এ সব শোনে না। 

-আর খোল? সেটা আছে না গেছে? 

-আছে। 

-বাজাস?

-না। আসার পরপর ক’দিন বাজিয়ে ছিলুম। শহরের লোক সব, রাত জাগে, ভোরে আওয়াজ হলে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত হয়। শহরে ও সব চলে না দাদা। এরা সব অন্য রকম প্রাণী। 

-তুই এভাবে বেঁচে আছিস আমি ভাবতেই পারছি না। তোর জীবনে নদী নেই, খাল নেই; ডোঙাহীন, সমুদ্দের কাহিনিহীন তুই যে কী করে এই ইঁট-কাঠ-পাথরের নিষ্প্রাণ শহরে বাস করছিস, আমি ভাবতে পারি না! 

-সব আছে দাদা। এই আমার মনের ভিতর। আমার দেহের মধ্যে আকাশ আছে, তার নিচে নদী বল, সাগর বল, সব আছে। আমি সেই নদীতেই ডোঙা ভাসাই। 

দাদু শ্বাস ফেলে বললে,- তুই আছিস ভালো। যাক, তুই যদি এখানে ভালো থাকিস, সে তো ভালোই। তুই কানাই কে যে নিয়ে এলি না? তার কথা একবারও জিগাসাও করলি না সে কেমন আছে না আছে!

-তাকে যে তোমার হাতে ছেড়ে এসেছি দাদা। সে ভালো না থেকে যায় কই! ওর চোখে আলো কম, এমি না থাকলে ওর হবে কি? বরং তোমার আশ্রয়ে আমার সেই অবলা ছেলে আছে, যুগ যুগ ধরে থাকতে পারবে, এর থেকে আর বড় কথা কি হতে পারে। 

আমি অবাক হয়ে ফণিকালার কথা শুনি। এ সব কথার সঙ্গে আমি পরিচিত নই। তাই আবাক হই, নতুন লাগে। সে গোপনে এক রুমাল দেয় আমায়। গিঁট বাঁধা রুমাল। ফণিকালা চুপিচুপি বলে, -সেই এগারো তালগাছের ফাঁকে এটিকে পুঁতে দিতে হবে বাবুভাই।

-কি আছে এতে? 

ম্লান হেসে ফণিকালা জানায়, -আমার আত্মা আছে। কাউকে কিন্তু বলবে না। 

-আমাকে যে ডোঙা বাওয়া শেখাবে বলেছিলে?

-সে আর এমনকি। সময় হলে তুমি নিজেই শিখে নেবে। 

-আত্মা কি জিনিস ফণিকালা? 

-এখন না, বড় হলে জানতে পারবে। 

আজ আমি মধ্য তিরিশ। ফণিকালার সঙ্গে আজ আর কোন যোগাযোগ নেই। সে বেঁচে আছে কিনা তাই জানি না। গ্রামের মানুষদের কাছেও তার স্মৃতি মুছে আসছে। গ্রামের পুরাতন মানুষরা কেবল ইস্কুল মাঠের বটগাছের নিচে বসে মাঝে মাঝে তার কথা আলোচনা করে। তার পুরো নাম যে ফণিচরণ বাগ, তা এখন ক’জন জানে? কানে একটু কম শুনত বলে লোকে তাকে ফণিকালা বলে ডাকত। সে ছিল আমার ছেলেবেলার রূপকথা। আমার কল্পনা শক্তির রাজা। আমার আত্মার মুক্তি। আমাদের চৌঘরা গ্রামে আজ আর কোন ফণিকালা নেই। হয়ত বাংলার আর কোন গ্রামেই তাদের দেখা মেলে না। 

না, সেদিনের কথা আমি কাউকে বলিনি। আজও নয়। ফণিকালা যে রুমাল আমাকে দিয়েছিল, গ্রামে ফিরেই আমি সেটা সেই তালগাছের নিচে পুঁতে দিয়েছিলাম। তখনও আমি জানি না আত্মা কি জিনিস না জিনিস। ফণিকালা বলেছিল, -রুমাল খুলে দেখ না বাবুভাই, তাহলে আত্মা উড়ে যাবে। 

গাছকে আমি বলেছিলাম,-দেখ, কেউ যেন মাটি খুঁড়ে তুলে না নেয়! 

একাকী অবসরে, বা কোন নিদারুণ মনকষ্টে আমি সেই এগারো তালগাছের কাছে এসে বসি। সেই ডোঙা, দেবীর হাতি গিলে নেওয়া, আর ফণিকালার নানা কাহিনি মনে পরে। ডোঙা, সেই কবে থেকেই আমি বেয়ে চলেছি, এই জীবন থেকে অন্য জীবনে। এক জীবনেই অনেক জীবন। তার গলি ঘুঁজি বেয়ে সেই যাত্রা প্রতিটি মানুষ ডোঙাযাত্রা করে চলে। 

মনের ভেতর ধীরে ধীরে শান্তি নেমে আসে। আকাশ হয়ে ওঠে নদী, মেঘ হয় ডোঙা। তখন আমি সেই রুমাল পোঁতা জায়গাটা খুঁজে বের করতে চাই। এগারো তালগাছের ঠিক কোনখানে আমি তা পুঁতেছিলাম, সে কথা আমার আজ মনে নেই। এখন পুরো চত্ত্বর জুড়ে সারা বছর ঠাস হয়ে ফুটে থাকে নীলঘাস ফুল। আগে এ ফুল এখানে ছিল না। এই নীলফুলই হয়ত বা ফণিকালার আত্মা। 


ani.chotogolpo@gmail.com



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.