শ্রীশুভ্র

রাজনৈতিক পালাবদল ও  প্রতিহিংসার রাজনীতি
ম্প্রতি ত্রিপুরায় রাজনৈতিক পালাবদলের পর প্রতিহিংসার রজনীতির যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে সেটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার। লেলিনের মূর্তি ভাঙ্গার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে, প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে ছাড়খার হয়ে গিয়েছে ভুতপূর্ব শাসকদলের পার্টি অফিসগুলি থেকে কর্মী সমর্থকদের ঘর গৃহস্থলী। বহু মানুষে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছেন। সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই চিত্র কোন ধরণের যুক্তিতেই শোভা পায় না। আরও দুর্ভাগ্যজনক রাজ্যের রাজ্যপালের সেই বিতর্কিত টুইট মন্তব্য। লেলিনের মূর্তি ভাঙ্গার প্রসঙ্গে করা হলেও তাঁর এই মন্তব্যের অভিঘাত অনেক সুদূরপ্রসারী। এবং এই মন্তব্যের পরপরই নির্বাচিত শাসক দলের সহিংস নির্মম হিংস্রতার দায়ভাগ  থেকে রাজ্যপাল নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন কি? অবশ্য ভারতবর্ষের রাজনীতিতে নীতির কোন বালাই কোন কালেই বা ছিল। ভয়াবহ এই প্রতিহিংসার রাজনীতির দায় নবনির্বাচিত শাসক দলের মতোই রাজ্যের রাজ্যপালের উপরেও বর্তায়। কারণ তাঁরই নিজের করা টুইট মন্তব্য। যাকে ঢাল করেই রাজনৈতিক দূর্বৃত্তরা মাঠে নেমে পড়েছে স্বশস্ত্র হিংস্রতায়। এইখানেই মনে রাখা দরকার একটি রাজ্যের রাজ্যপালও কিন্তু সংবিধান বা আইনের উর্দ্ধে নন কোন ভাবেই। তাই তাঁর করা যে কোন মন্তব্যের দায়ভারও তারই। আর সেই মন্তব্যে উৎসাহিত হয়ে দূর্বৃত্তরা মাঠে নেমে পড়লে সেটা ভারতীয় সংবিধানেরই দূর্বলতা। অনেকেই বলবেন, রাজ্যপালের মন্তব্যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কথা কোথায় ছিল? তিনি তো বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থকদের ঘরবাড়ি পার্টি অফিস ভাঙ্গচুর করে অগ্নিসংযোগের কথা বলেননি কোথাও। অবশ্যই সেকথা বলেন নি রাজ্যের দায়িত্বশীল রাজ্যপাল। কিন্তু তিনি নির্বাচিত সরকারের কোন কিছু ভেঙ্গে ফেলার যে অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত টুইটে, সেই কথার অন্তর্নিহিত অর্থকে নিজেদের রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক স্বার্থে যে হঠাৎ ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া রাজনৈতিক দূর্বৃত্তরা কাজে লাগাবে না, সে কথা জোর দিয়ে কে বলতে পারে? একটু তলিয়ে দেখলেই আমরা দেখতে পাবো, সম্প্রতি ত্রিপুরায় ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতার পেছনে এই বিষয়গুলির প্রচ্ছন্ন ও পরোক্ষ প্রভাব নিশ্চয়ই ছিল। না হলে নবনির্বাচিত সরকার শপথ নেওয়ার আগেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুন এমন ব্যপক ভাবে ছড়িয়ে পড়তো না সারা রাজ্যজুড়ে। আর এইখানেই উঠে আসে দায়িত্বশীল পদে থাকার গুরুদায়িত্বের কথা। অবশ্য সকলেই যে সেই গুরুদায়িত্ব সঠিক ভাবে বহন করতে পারবেই নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না সে কথাও। মানুষ ভেদে ইতিহাস রচিত হয় বিভিন্নভাবে। সকলেই জানেন ত্রিপুরার বর্তমান রাজ্যপালের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ও রাজনৈতিক পরিচয় কি। আর সেখানেই তাঁর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ও পরিয়চয়ের সাথে তাঁর সাংবিধানিক বাধ্যবধকতা ও পরিচয়ের কাম্য ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেন নি রাজ্যপাল নিজেই। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ই তাঁর সাংবিধানিক পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠেছে বলেই তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হয়েছিল কুখ্যাত সেই টুইটের বিতর্কিত মন্তব্যটি করে তাঁর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাকেই মান্যতা দেওয়ার, আপন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে অতিক্রম করে। আর এইখানেই ভারতীয় সংবিধানের মস্ত বড়ো ফাঁক। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, সারা রাজ্যজুড়ে এমন বীভৎস সহিংস তাণ্ডবলীলা চলার পরেও, গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে তাঁর বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝর বয়ে যাওয়ার পরেও এখন অব্দি তিনি নিজের মন্তব্যের জন্যে অনুতপ্ত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেননি কোথাও। আর তখনই এই ধারণারই সৃষ্টি হয় যে, খুব সুচিন্তিত ভাবেই তিনি তাঁর মন্তব্যকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। হঠাৎই আবেগের বশে মুখ ফস্কে করা মন্তব্য প্রকাশের মানুষ নন তিনি। আর তখনই প্রশ্ন ওঠে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপেলের মতো সাংবিধানিক পদকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির নৈতিকতা নিয়েই। এবং এই প্রবণতা যদি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতেই থাকে, তবে ভারতবর্ষে সাংবিধানিক সঙ্কট খুব দূরে থাকবে না। 
না রাজ্যপালের সমালোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সাংবিধানিক পদের দায়িত্বে থাকার গুরুত্ব ও তার কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে, সেই বিষয়কে কোনভাবে উপেক্ষায় করলে, যে কোন স্বার্থান্বেষী পক্ষই যে রাজনৈতিক জমি দখলের কাজে সেই সুযোগকেই ব্যবহার করবে না সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অন্তত ত্রিপুরার সাম্প্রতিক ঘটনা সেই অভিমুখেই দিকনির্দেশ করে।




গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল অন্যদল বা বিভিন্ন দলকে হারিয়ে ক্ষমতা দখল করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষমতা দখল করলেই বিপক্ষ দলের উপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে উন্মত্ত সহিংসতায় বিপক্ষ দলের পার্টি অফিস ভাঙ্গচুর করে সেগুলির দখল নিতে হবে, বিপক্ষ দলের কর্মী সমর্থকদের ঘরবাড়িতে চড়াও হয়ে তাণ্ডবলীলা চালাতে হবে, তাদেরকে ভিটে মাটি ছাড়া করতে হবে, কিংবা খুন করতে হবে, এ কোন গণতন্ত্র? এই যদি ভারতীয় গণতন্ত্রের অত্যাধুনিক চেহাড়া হয়, তবে বলতেই হবে সেটা ভারতীয় গণতন্ত্রেরই দূর্বলতা। কোন উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এটা দেখা যায় না। নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর সংসদীয় রাজনীতিতে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন করার অধিকারও অন্যতম মৌলিক অধিকার। কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেলেই অন্যের সেই মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। অন্তত ভারতীয় সংবিধানে সেরকম কোন বিধান নাই। কিন্তু এও সত্য ভারতীয় সংবিধান ও গণতন্ত্র উন্নত দেশগুলির মতো নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষার বিষয়ে আজও নিরঙ্কুশ হতে পারে নি। এখানে রাজনৈতিক হানাহানি আজকে এমন এক বীভৎস পর্যায়ে পৌঁছিয়ে গিয়েছে, যা কোন উন্নত দেশের মানদণ্ড হতে পারে না। কোনভাবেই নয়। কিছুতেই নয়। গণতন্ত্রে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়াটাই শেষ কথা নয়। জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করা দেশে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের গতিকে তরান্বিত করাই নির্বাচনে জয়ের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে জয়ের মূল লক্ষ্যই হলো স্বজনপোষন ও দূর্নীতিকে লাগাম ছাড়া প্রশ্রয় দেওয়া, বিপক্ষ দলগুলির উপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা, গণতান্ত্রিক পরিসরটিকেই সঙ্কুচিত করে দিয়ে সবরকম বিপক্ষ স্বরকে অবরুদ্ধ করে দেওয়া। ভারতবর্ষের রাজনীতির সাম্প্রতিক অভিমুখের এটাই হলো প্রকৃত চিত্র। ঠিক যে চিত্রেরই প্রতিফলন আমরা দেখেছি পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিক পরিবর্তনের হাত ধরে হওয়া পালাবদলকে কেন্দ্র করে। এ এক অসুস্থ ভারতবর্ষেরই চিত্র। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এই ধরণের কুফল কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষেই কাম্য নয়। তাই ভাবতে হবে একেবারে গোড়া থেকেই। উন্নত বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ঠিক কোন জাদুতে সেই সব দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলি এতটা মজবুত ভাবেই সুরক্ষিত। শিক্ষা নিতে হবে তাদের সংবিধানগুলি থেকেও। আর তখনই বোঝা যাবে আমাদের সংবিধানের ফাঁকফোঁকরগুলি কতটা ভয়াবহ। যার সুযোগ নিয়েই এই ধরণের রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়নের এতটা বাড়বাড়ন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে ঘিরেই।     

             


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.