সমীরন চক্রবর্ত্তী

"দোল বিভ্রাট"
কানু পই পই করে বলে দিয়েছিল, চার মাথার মোড় থেকে ফ্লাইওভারের দিকে বিশ পা হাঁটলেই একটা কদম গাছ পাবি, নিচটা পাথর দিয়ে বাঁধানো, ওখানেই অপেক্ষা করিস।

        রাত বারোটার পর থেকে বাকি রাতটা রাধে হোয়াটস্অ্যাপে চ্যাটিয়েছে কানুর সাথে। পাশের ঘরে বাবা মা শুয়ে, ফোনটা থেকে থেকেই কাঁচ ভাঙার মত বিটকেল স্বরে ঝন ঝন করে জানান দেয়, খবর এসেছে কানুর। নতুন প্রেমে পড়লে যা হয়, ওদিক থেকে একটি করে কথা আসে তো এদিক থেকে দ্বিগুন আগ্রহে দুটি করে কথা ছুটে যায় ফোরজি স্পীডে। ও ঘরে স্যুইচ টেপার শব্দ, বাবা বাথরুম থেকে ফেরার পথে বলে গেল, রাধে শুয়ে পড়। ওমনি নোটিফিকেশান সাউণ্ড মিউট, ভাইব্রেসান মোডে-

                আলো জ্বলে, নড়ে চড়ে... কথা কয় না
                (ওদিকে) রাধার মনে তখন উথাল পাতাল প্রেম যমুনা...
                নড়ে চড়ে... কথা কয় না...
        
        কাল সারা রাত জেগে হ্যাংওভার কাটেনি রাধের, সক্কাল সক্কাল মানে এই দশটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠেই একটু এদিক ওদিক ঢুঁ মেরে অবশেষে অভিসারে। 

        জায়গাটাতো ঠিকই আছে তবে কানু নেই কেন? ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে রাধে ফোন করতে যাবে, একি! চার্জ শেষ, দেহ রেখেছে গত রাতের অত্যাচারে। এক নিমেষেই সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল কানুর উপর, কিছুটা রাগ আর অল্প একটু মায়া মিশিয়ে নিয়ে, হতাশ রাধে ফিসফিসিয়ে সেই গানটাই ধরলো-

            "মা, তুই জলে না যাইও
            ও হে কলঙ্কিনী রাধা
            কদম গাছে উঠিয়া আছে কানু হারামজাদা
            মা তুই জলে না যাইও !"

কানুকে দেখতে না পেয়ে রাধের বিরহ তখন ক্লাইম্যাক্সে। রাস্তায় অলস ভাবে দাঁঁড়িয়ে থাকা লালু, কা্লু,  ভুলু এমনি হাফ ডজন লেড়ি কুকুর দেখে তার মনে হলো, আরে! এই তো সেই বেন্দাবন, সবুজ মাঠে ধেনু চরে বেড়াচ্ছে, তবে আমার বংশীধারীটি কই? নিশ্চয়ই সখীদের সথে মেতেছে ইয়েতে...। এমন সময় ঢোলা বারমুডা আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি পরা জমাদার জঞ্জালের গাড়ি নিয়ে হুইসেলে ফুঁ দিল, ফুঁ...ফুঁ...। অমনি রাধের কানে সে বাঁশি পশিল কানুর বাঁশি হয়ে-

            ওইতো আমার কানুর বাঁশি
            রাধে রাধে ডাকে
            কদম তলে একলা রাধে
            কানু হারায় চোখে...

        আবেগে কত কিছুই হ্য় ,তেমনি হয়েছে রাধেরও, অতি পীরিতির ঠেলায় তার বাহ্যিক জ্ঞান লোপ পেয়েছে। আসলে কদম গাছ না খুঁজে পেয়ে, বসে পড়েছে ছাতিম গাছের তলায়, আর সেখানেই থেকে থেকে বেন্দাবন দেখছে।

        এদিকে কানু এসে গেছে কদম তলায় নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা আগেই, চারখানা অপেক্ষার চারমিনার ফুঁকে, শূন্য বুকে, কানুর মেজাজ বেদম চটে, আধুনিক কানু, কীর্তন ছেড়ে বিড়বিড়িয়ে গাইছে-

            নারী চরিত্র বেজায় জটিল
            কিছুই বুঝতে পারবে না...
            ওরা কোন 'ল' মানে না
            তাই ওদের নাম ললনা।

        কদম তলা থেকে ছাতিম তলা বেশি দূর নয়, মেরে কেটে বিশ হাত, তবুও কেউ কাউকে দেখছে না, দেখলেও চিনতে পারছে না।অমন কষ্টি পাথরে খোদাই করা বছর একুশের তেল চুকচুকে কানু মেখেছে রূপোলী রঙ, টপ টু বটম, ফুল-পলিশড্।আর ওদিকে অষ্টাদশী রাধেকে বাঁদরামীর বাঁদুরে রঙে চেনাই যাচ্ছে না কোনো ভাবেই। কানুর হঠাৎ চোখ পড়লো ছাতিম তলায়, তবে ওই কি আমার রাধে?  ছিঃ ছিঃ, একি দেখি, এমন চাঁপা ফুলের মত ইস্কিন কিনা ঢাকা পড়েছে বাঁদুরে রঙে-

            এত সহজে কি রাধে
            কানুর চোখকে দেবে ফাঁকি 
            যতই তুমি মাখো না রঙ
            আমি তোমায় ঠিক চিনেছি...

কদম তলা ছেড়ে কানু এগিয়ে যায় রাধের দিকে, রাধে বুঝতে পারে কেস জণ্ডিস, রাধে মিনতি করে- (কীর্তণের সুরে...)

            ক্ষমা করো কানু        ও পাড়ার ভানু
                       পুরনো প্রেমিকও বটে,   
            সারা অঙ্গ জুড়ে          মাখালো বাঁদুরে
                        না যাইও তুমি চটে।

কানু গদগদ হয়ে বলে আমারওতো সেম টু সেম কেস-           

           ক্ষান্ত হইয়ো রাধে            এ দশা কি সাধে
                       আমারো আছে কিছু নালিশ,
            ঘোষ পাড়ার মনি            রূপোলী রঙ আনি
                      করে দিয়ে গেল ফুল পালিশ
            আহা পয়সা নেয়নি, কি আনন্দ, নিত্যানন্দ, আহা পয়সা নেয়নি...।

দোল বিভ্রাট পালা এখানেই ইতি, যত ভক্তগণে করি মিনতি, সমস্বরে বলুন সবাই-

        ভ্যালারে ফোন, ভ্যালারে দোল
        পড়ো নাকো প্রেমের ফাঁদে...
        টাচস্ক্রীণে আঙুল রেখে
        প্রেমানন্দে সবাই বলুন জয় রাধে রাধে...,রাধে রাধে...।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.