কৃষ্ণা রায়

রুদ্রপলাশের দিন
সুরমা চায়ের কাপ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল । সব্যসাচী তখন মন দিয়ে কাপড়ের পুঁটুলিতে গিঁট বাঁধতে ব্যস্ত। দেখেই হাড় জ্বলে যায় সুরমার, “ আবার ওই ছাই ভস্ম নিয়ে বসেছ? কতবার তো বলেছি ও বাড়িতে আর কো্ন দিন ফিরে যাবনা আমরা। রোজ রোজ সেই এক অকম্ম। আমার গতর সস্তা পেয়েছ তো! সারাজীবন তোমার মা জ্বালিয়ে গেছে, আর এখন তুমি তার বাকিটা উসুল করে নিচ্ছ।“

সব্যসাচী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে। সুরমার ঝঙ্কারের ছিটেফোঁটা তার মগজে ঢুকেছে বলে মনে হচ্ছেনা। সুরমা ব্যস্ত হাতে কাপড়ের পুঁটুলি খুলে তাল-গোল পাকানো জামা কাপড় যথাস্থানে গুছিয়ে রাখতে রাখতে গজগজ করে, রোজই এক ভুতের খাটনি। এই টুকু ঘর দুয়োর, সারাদিন সব কিছু একজন লন্ড ভন্ড করে দিচ্ছে, আর এর মধ্যে দশবার করে গুছিয়ে রাখো। কুটো নেড়ে সাহায্য করার মানুষ নেই পাশে। নাও, চা টা খেয়ে আমায় উদ্ধার করো,আর চোখ মেলে দ্যাখো, বিস্কুটের কৌটো পাশে রইল। 

কদিন ধরে কোমরের ব্যথাটা যাচ্ছেনা, মালিশ করে, হট-ওয়াটার ব্যাগ লাগিয়ে লাভ হচ্ছেনা। মেজাজটাও আজকাল অল্পতেই গরম হয়ে যায় । আর হবে নাই বা কেন ? সুরমা আপন মনে বিড়বিড় করে, পঁচাশি বছরের পুরোনো মেশিন, চলছে তো চলছেই, বিশ্রাম তো পায়না। অমন খোলামেলা নিজেদের বাড়ি, ছড়ানো দালান, বাগান-গাছপালা ছেড়ে এক কামরার এই ছোট্ট ফ্ল্যাট ! দশ পা ভাল করে ফেলার জায়গা নেই। প্রথম প্রথম সব্যসাচী প্রায়ই বাথরুমে যাবার বদলে রান্না ঘরে ঢুকে পড়ত। এখন তো আরো খারাপ অবস্থা। গত সাত মাস হল, একটু একটু করে সব কিছু ভুলে যাচ্ছে । ছেলে, মেয়ে, আত্মীয় পরিজন কাউকে সে আর চেনেনা। এক এক দিন, সুরমাকেই প্রশ্ন করে বসে, আপনি কে? আমাকে আপনি খাবার দেন কেন? নিভৃতে চোখের জল ফেলে সুরমা। চিরটাকাল কান্নাকাটি মোটেও দেখতে পারেনা মানুষটা। এখনকার এই মানুষের সঙ্গে অতীতের প্রেমিক, পত্নী-বৎসল সব্যসাচীর কোন মিল নেই। অনেক কষ্ট- যন্ত্রণায় ওর সামনে দু একদিন কেঁদে ফেলার পর কী ভয়ানক কান্ড হয়েছিল!। লোকটা দুহাতে মাথার গুচ্ছ গুচ্ছ কাঁচা পাকা চুল উপড়ে, বুক চাপড়ে কেঁদে উঠেছিল। সেই থেকে সুরমা মনের ক্ষোভ মেটাতে প্রচুর চেঁচামেচি করে দীর্ঘ ক্ষণ, কান্না ? না, একেবারেই বন্ধ। আর কান্না আসবেই বা কি করে? আপন জনের প্রতারণায় বুক, চোখ সবই এখন ধূ ধূ মরুভুমির বালিয়াড়ি। দুই ছেলে , মাঝখানে এক উকিল বন্ধুকে রেখে বাবাকে ঠকিয়ে, সম্পত্তির দিব্যি ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিল। পুরোন বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি হবে। বাবাও আহ্ললাদে সায় দিলেন। ছেলেরা নাকি মা- বাবার জন্য দোতলায় সেপারেট ইউনিট করে দেবে। তারা হাসি হাসি মুখে ঘোষণা করল, এবার থেকে তোমরা স্বাধীন  ভাবে থাকবে। খরচা পাতি সব আমাদের। ব্যাস! আর কি? অতদিনের অমন ইলেক্ট্রিক গুডসের চালু দোকানের মালিকানাও বাপ আর রাখল না। ছেলেদের বাবা না আমি? ওরা কি আমাদের বুড়ো বয়সে ঠকাবে? সুরমা মা হলেও বাস্তবভোলা নয় । অনেক ভাবে অনেকবার বলেছে, দোকান একেবারে নিজের নামে না রাখো, ছেলেদের সঙ্গে নিজেকে বা আমাকে জুড়ে রাখো । মানুষের মন? বলা কি যায় ? সব্যসাচী সেদিন তীক্ষন গলায় বলেছিল, নিজেকে দিয়ে সবাই কে বিচার করোনা সুরো। তুমি বাপ মা মরা অনাথ মেয়ে ছিলে, মামা মামীর গলগ্রহ হয়ে। তারা তোমায় যেমন তেমন করে অনাদরে রেখে মানুষ করেছেন। আমার ছেলেমেয়েরা তা নয়। তারা আমাদের ভালবাসার সন্তান। তারা বেইমান হবেনা। তুমি দেখে নিও। 

না সব্যসাচীকে কিছু দেখতে হয় নি। চোখ থাকতেও মানুষটা ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে গেছে। স্মৃতিহারা একটা মানুষ। অন্তরদৃষ্টিতে সে শুধু দেখে তার পুরোনো ঘর বাড়ি। জানে, এই এক কামরার ফ্ল্যাট তার ক্ষণিক আবাস মাত্র । প্রতিদিনই সে নিজের মত করে জিনিস-পত্র বাঁধে, নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে। ঘরের যত্র তত্র অজস্র পুঁটলি। সারাদিন সুরমাকে কত কি দরকারি জিনিস খুঁজে খুঁজে বার করতে হয়।

প্রায় মাস চারেক হল দুই ছেলের কেউই বুড়ো বাপ –মায়ের খোঁজ রাখেনা। গোটা বর্ষা কালটায় এ বাড়ির সামনে জল জমে থাকে। এ বছর বৃষ্টিও হয়েছে খুব। সে দিন গুলো বড্ড কষ্টে কেটেছে। সব্যসাচী কাশি আর জ্বর নিয়ে দিন পনেরো খুব ভুগল। বছর দুয়েক আগে অব্দি দুই ছেলেই আলাদা আলাদা করে স্তোক দিয়ে বলেছিল, বুঝলে না, তোমাদের অংশটা একটু ভাল করে তৈরি হচ্ছে। এক্কেবারে ফারনিশড ফ্ল্যাটে ঢুকবে তোমরা। সে সুখের দিন আর এলনা। জল থৈ থোই একতলার এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটার ভাড়া দেয় এখন মেয়ে। সে সদ্য স্বামীহারা, নিজে প্রাইমারি স্কুলের টিচার। দাদারা ঘর-বাড়ি করে হাত –ফাঁকা করে ফেলেছে, তাই তাকেও কিছু দায়তো নিতেই হবে। সে তার সাধ্যমত করে যাচ্ছে এখনো। কতদিন পারবে কে জানে! সব্যসাচীর পেন্সন নেই, জমানো টাকা তলানিতে ঠেকেছে। গয়নাগাঁটি সুরমার কোন কালেই তেমন কিছু ছিলনা। কালে ভদ্রে মামাতো ভাইরা টাকা পাঠায়। দোকানের পুরনো দুই কর্মচারীদের ছেলেরা অবশ্য আজো শ্রদ্ধা ভক্তি করে , একজন মাঝে মাঝে বাড়ি এসে ফল, বিস্কুট, সাবান, তেল দিয়ে যায়। দুজনতো নিয়মিত মাসোহারা পাঠায়। একদিন নিজের ছেলেদের চেয়ে এদের আলাদা ভাবতেন না সব্যসাচী। তারা যেটুকু খোঁজ- খবর রেখেছে, যত্ন করে যাচ্ছে , নিজের ছেলেরা তার সিকি ভাগ যদি রাখত! আর এ সব নিয়ে ভাবতে এই বয়সে আর ভাল লাগেনা। সুরমা শুধু জানে এই কষ্ট, হাড়ভাঙা খাটুনি তার নিয়তি। প্রতিদিন সকালে স্বামীর  ক্লান্ত রুগ্ন মুখ দেখে দিন শুরু করতে হবে, তিনি রোজ ভুল করে এবং নিয়ম করে বাথরুমের কাজ রান্নাঘরে গিয়ে করে আসবেন। সে সব পরিষ্কার করা শেষ না হতেই নতুন করে আবার কিছু সমস্যা তৈরি হবে। পাশের ঘরে থাকা ভাড়াটে ছেলেটা দয়া করে মাঝে মাঝে সবজি বাজার করে দেবে, সন্ধ্যেবেলায় চুপি চুপি দরজায় তালা দিয়ে একান্তই জরুরি কিছু জিনিস সওদা করে ভয়ে ভয়ে একটা ভাবনা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে, বন্ধ ঘরে চিকিৎসা- বঞ্চিত মানুষটার বড়সড় কোন বিপদ হয়ে যায়নি তো? এ বাড়িতে দিনের পর দিন আসে, ঋতুর পর ঋতু আসে, চলে যায় । সুরমার জীবনে এখন শুধু একটাই ঋতু। অনন্ত হিমঋতু ।




দিন দুয়েক আগে মেয়ে এসেছিল। বাপ তাকে দেখেও দেখলনা। চিনতেও পারলনা। একদিন এই মেয়ে বাপের কত আদরের ছিল!। ব্যবসার কাজে শহর ছেড়ে দূরে কোথাও যেতে হলে ঠিক ফিরে আসত। একটু বেশি রাত হলেও। ওর বিয়ের পর রাতের পর জেগে বসে থাকত। মেয়ের চুলের ফাঁকে এখন ধুসর রঙ লেগেছে, আর বাপের স্মৃতির ভাঁড়ার একেবারেই শূন্য। মেয়ে যত্ন করে বাপের মুখে তুলে দিল তার পছন্দের খেজুর গুড়ের রসগোল্লা। জিভে ছোঁয়াতেই মানুষটার মুখ চোখ শিশুর মত উজ্জ্বল , এত ভাল মিষ্টিটি অনেক দিন পর খেলাম। কে আপনি জানিনা, তবে আপনি মাঝে মাঝে এই মিষ্টি নিয়ে আসবেন? 

মেয়ে চোখ মুছে ঘর ছেড়ে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। সুরমা ম্লান হেসে বলে, আবার কবে আসবি?

আসতে খুব ইচ্ছে করে। আর আসার পর মনটা ভারি হয়ে যায় । সারাটা পথ এই মন ভার যাবেনা । যাই এবার , ছেলেটা ঘরে একা একা পড়াশুনো করছে।

সাবধানে যা মা, এখনো শীত পুরোপুরি যায়নি। ভাল করে মাথাটা ঢেকে নে।

#

উঠোনে ম্লান চাঁদের আলো এসে পড়েছে। ঘরের ভেতর ফিকে হলুদ রঙের খুব কম পাওয়ারের আলোর মধ্যে কম্বল দিয়ে মাথা ঢেকে সব্যসাচী বসে আছে। দরজার বাইরে থেকে দৃশ্যটা দেখে সুরমার হঠাৎ মনে হয়, কে ও? সব্যসাচী না ওর প্রেত! কতদিন এইভাবে লোকটা বাঁচবে কে জানে? 

কাল রাত থেকে মাথা খুব ধরে আছে সুরমার। সকালে বিছানা ছাড়তে আর ইচ্ছেই করছেনা। বোধহয় জ্বর এসেছে। বিছানা না ছাড়লেই বা উপায় কি? অসহায় লোকটা কিছুই নিজে পারেনা। সুরমার ব্লাড প্রেশারটা বোধহয় বেড়েছে । ওষুধের পাতাটা দুদিন হল ফুরিয়েছে। কেনা হয়নি মনে করে। আজ যদি সুরমা মরে যায়, কিংবা প্যারালিসিস হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়, কি হবে? একফালি জানলা দিয়ে সকালের নরম ঠান্ডা হাওয়া হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ছে। সব্যসাচী জানলার দিকে তাকিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে চেয়ারের ওপর স্থির বসে আছে। মাথার কাছে রাখা ঘড়ি বলছে সকাল আটটা পনেরো। ওরে বাবা! এত বেলা হয়ে গেছে! সকাল থেকে লোকটার পেটে কিচ্ছু পড়েনি। আজকাল কথা বার্তা কিছুই বিশেষ বলেনা। থেকে থেকে দুটি নাম শুধু বলে, নাতি পুপ্লু আর বাগানের গাছপালার কথা। কাল দুপুরেও ভাত মাখতে মাখতে আপন মনে বলেছে , লেবু গাছ থেকে লেবু পাড়োনা কেন আজ কাল? 

সুরমা ইদানিং আর অবাক হয়না। বিরক্ত গলায় বলেছে, সেই পুরোনো ফাটা রেকর্ড । সে গাছই বা কোথায় আর তার ফলই বা কোথায়? 

রাগ করতে গিয়েও ক্ষোভ পথহারা হয়ে যায় । কার ওপর রাগ দেখাবে আজ? সুরমার দুর্দশা দেখে এই তো দিন দশেক আগে পাড়ার ছেলেরা উদ্যোগ নিয়ে বাড়িতে ভাল ডাক্তার এনেছিল। দেখে শুনে তিনি শুধু বললেন্, আশা করার মত আর কিছু নেই। এখনো এ রোগের চিকিৎসা বিশেষ নেই। অসুখটার নাম আলঝাইমার্স ডিসিস। ধীরে ধীরে উনি সবই ভুলে যাবেন । মাঝে সাঝে হয়তো কিছু মনে করতে পারলেও পারেন, তবে নিজের কোন কাজ আর করতে পারবেনা। 

না, অনেক হয়েছে। আর ছেলেদের এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায়না। ভাবলে ঘেন্না লাগে, দু দুটো ছেলে এত বেইমান হল কি করে? সারা জীবন সুরমা একাই বা কেন এত দায় দায়িত্ব নিতে যাবে? এই বয়সে এত লাঞ্ছনা আর সহ্যই বা করতে হবে কেন ? এবার মন শক্ত করে ছেলেদের নামে মামলা করা দরকার। না পারলে একটাই পথ --- বেশ কটা ঘুমের বড়ি গিলে জন্মের মত ঘুমিয়ে পড়া। সব স্বার্থপর! কী লাভ প্রতিদিন এত কষ্ট করে বেঁচে থেকে? ছোট ছোট রাগের ফুলকি জমতে জমতে সারা শরীরে দাহ ছড়িয়ে দেয়। ঘাড়ে, কানের পেছন থেকে মস্তিষ্কের কোষে কোষে যুক্তিহীন ক্রোধ বিদ্যুৎ প্রবাহের মত দ্রুত ছড়িয়ে যায় , অসহ্য লাগে ঘরের লোকটার অন্তহীন উপেক্ষা আর ঔদাসীন্য। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে ওঠে সুরমা, একদিন এক কাপ চা মুখের কাছে ধরার লোক নেই। আর রোগের ভাণ করে একজনের ন্যাকামো চলছে তো চলছেই। দিনের পর দিন। 

চাদর মোড়া মূর্তি নড়েনা। 

ব্যথায় , ক্ষোভে সুরমা হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে, তুমি কি? তুমি কি আর মানুষ আছ? 

চাদরমোড়া মূর্তি ঈষৎ দুলে ওঠে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে পরিষ্কার গলায় বলে, আজ অনেক ঘুমিয়েছ। দেখো সুরো, জানলা দিয়ে দ্যাখো। ওই গাছটাই এতক্ষণ দেখছিলাম। কমলা রঙের ফুলে ঢাকা গাছটা রুদ্র পলাশ না? ফাল্গুন মাস কি এসে গেছে এবার? 

মাথার যন্ত্রণা ভুলে সুরমা নিঃশব্দে টের পায় , হিমঋতুর পর পৃথিবীতে আবার আচমকা একটুকরো বসন্ত এসে পড়েছে, সেই অনেক কাল আগের মত। 

krishna.roy@rediffmail.com



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.