ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য

 পরিমিত
সিনেমার শো টাইম আর ঠিক একঘন্টা পর, চারটে থেকে । যদিও কাছেই, হেঁটে গেলে মিনিট পনের । রিকশায় গেলে পাঁচ । তবে পরিমিত সরকারের বাড়ির লোকেরা সাধারণভাবে রিকশার আশা করেন না এটুকু দূরত্বে। পাড়াপড়শি আত্মীয় বন্ধু সব্বাই দেখে এল ছবিটি । তাদের আলোচনা. সব খবরের কাগজে রিভিউ, ইউটিউব ইত্যাদি মিলে মোটামুটি সিন বাই সিন জানা হয়ে গেছে চিতোরের রাণীর বীরত্ব আর মুসলিম রাজাটির রমরমা উপস্থিতির কথা । তাও ভবি ভোলেনি । অবশেষে যেদিন ক্লাস সেভেনের বুকুনের বেস্টফ্রেন্ড দেখে এসে বলল যে তুই এখনো দেখিসনি , সেদিন বাড়িতে ভুখ হরতাল । মেয়ের জেদের সামনে বাবার পরিমিতিবোধ নতিস্বীকার করে আজ সিনেমা দেখতে যাওয়া ঠিক হয়েছে । তাও কোন মাল্টিপ্লেক্স নয় । সিঙ্গল স্ক্রিনের । 

তবে পুজো সামলে সময়ে পৌঁছতে পারলে তবেই । পরিমিতবাবুর এই একটি মহা বাতিক হল ঠাকুর নমস্কার । ঘরে হাজার খানেক ঠাকুরের ছবি । কলের জল হাতে নিয়ে গঙ্গাজলের মতই ছিটোতে থাকেন সারা ঘরে । আর মুখে মন্ত্রচ্চারণ । মাঝেমাঝে গুলিয়ে যায় বটে । হয়ত জগন্নাথের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন হনুমান চালিশা । 

একদিন তো আবেগে বলে ফেলেছেন লোকনাথবাবার সামনে ,

- রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিবে..... 

অমনি তো ঋষি আর বুকুন হেসে গড়াগড়ি । সেই দেখে রেগে গিয়ে আরো ভুল করে হাতের মালাটা দিয়ে ফেললেন আসনের পাশেই টাঙানো ওদের ফ্যামিলি ফটোতে । 

আজও ব্যতিক্রম নেই। দীর্ঘমেয়াদী পুজোআচ্চা সেরে যখন পৌঁছন গেল সবাই মিলে তখনি প্রায় পৌনে চারটে। হলের সামনে বেজায় ভিড় । কাউন্টারে পৌঁছে জানা গেল শুধু সবচেয়ে দামী সিটের কয়েকটা টিকিটই বাকি । অন্য সব শেষ । মালা স্বামীর পাশেই । ছেলেময়ে দুটো উশখুশ করছে কখন ঢুকবে ভেতরে । চারজনের জন্য পাঁচশোর বেশি খরচ । স্বামীকে খানিকটা অনুনয়ের চোখে দেখলেন মালা । 

-শোন বুকুন , টিকিট শেষ বলছে । আমরা পরে একদিন দেখব বুঝলি? কাছেই তো । চল আজ মনজিনিসে খেয়ে বাড়ি যাই। 

অম্লানবদনে বলেন পরিমিত। মালা হতবাক । বাচ্চারা আর কি বলবে? 

-আমাদের পরেও তো কতজন টিকেটের লাইনে আছে । হাউসফুল বোর্ড ঝোলায়নি তো । 

বুকুন বলে তাও । 

-আরে এইবার ঝোলাবে । চল চল এখন । 

তাড়াতাড়ি টেনে নিয়ে আসেন বাচ্চাদের পরিমিতবাবু । 

২ 

এই অবদি পড়ে যদি মনে হয় একটি নেহাত কিপটে লোকের গল্প তবে আমরা ঠিকপথে এগোচ্ছিনা মোটেই । 

পরিমিতবাবুর বড় জ্যাঠার ছেলে মন্ত্রী । আবার গয়নার ব্যবসাও বিশাল । তাদের বাড়ির অনুষ্ঠানে কিন্তু হাত দিয়ে টালার জলের মত হড়হড় করে টাকা বেরয় পরিমিতর । সেবেলা হিসেব নিকেশ নেই । জন্মদিনে উপহার দেন হাজার চল্লিশের ব্লেজার । বৌদির জন্য দামী দোকানের সোনার ঝুমকো পঁচিশ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে । ভাইপোটি বাপের টাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকল, কাকা দিল হাজার তিরিশের ঘড়ি । এমনটা চলছেই । 

-এদের হাতে রাখতে হয় বুঝলে গিন্নি? ভগবানের আশীর্বাদে আমার তো ক্ষমতা নেই দেওয়ার এমনটা নয় । 

বছরে একবার তিনদিনের বিচিত্রানুষ্ঠান হয় পাড়াতে । নামী শিল্পীরা আসেন। মোটা টাকা চাঁদা দেওয়ার চল মালার শ্বশুরের আমল থেকেই । পরিমিত সেই ধারা বজায় রেখেছেন । সেই খাতিরে একদিন প্রধান অতিথি করা হয় তাঁকে । সেই তিনদিনের জন্য তিনটে বহুমূল্য বাহারী পোশাক কেনেন পরিমিত । আবার বলেন চারটে লোকের সাথে আলাপ হবে, যা তা গায়ে দিয়ে কি আর যাওয়া যায়? নিজের জন্য দামী সেন্ট, মোটা সোনার চেন সবই আসে শখ করে । এদিকে মালার নোয়াটা টুকরো হয়ে ভেঙ্গে আছে কতদিন । একটা লোহা পড়ে আছে হাতে এয়স্তি হিসেবে । সোনার দোকানে যাওয়ার সময়ই পাননা পরিমিত । 




পরিমিত সরকার জন্মেছিলেন অপরিমিত সংসারে । বাবার এলাহী ব্যবসা । পঞ্চাশজনের যৌথ পরিবার কাকাজ্যাঠা মিলে । পরিমিতরা নিজেরাই বারো ভাইবোন । ছোট থেকেই পাঁচশোর কমে লুচি ভাজা দেখেননি । দশকিলোর নিচে পাঁঠার মাংস আসতনা সেই বাড়িতে । যেদিন পুজোর জামাকাপড় কেনা হত পাঁচ ট্যাক্সিতেও কুলোতনা প্যাকেট এমন দশা । সে রাবণের গুষ্ঠি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এখন সবাই নিউক্লিয়ার । কিছুদিন পড়ে হয়ত আরো ক্লিয়ার হয়ে যাবে সংসারের আবর্জনা । মানুষ শুধু নিজেকে নিয়েই থাকবে , একদম একা একজন একটি বিশাল বড় ফ্ল্যাটে ।

বিশাল বারোয়ারীপনায় বড় হয়েছেন বলে ছোট থেকেই নিজের নামের মতই পরিমিতির প্রতি তীব্র লোভ তার । অবশ্য এইখানে একটা কথা আছে । পরিমিতিবোধ তিনি প্রয়োগ করেন কেবলমাত্র স্ত্রী আর পুত্রকন্যার ওপর । নিজের প্রতি আরোপ এলেই বলেন, ছোট থেকে অতিরিক্তের এমন বদঅভ্যাস হয়ে গেছে বদলাতে পারিনা । তাইতো চাই ছেলেমেয়েগুলো যেন সেই ভুল না করে । আর গিন্নিকে বলেন, 

-তুমি তো মা , তোমায় দেখেই তো শিখবে বেসিকটা । 

অতএব ছেলেমেয়েদের বরাদ্দ পুজোয় দুটি করে জামা , পয়লা বোশেখে আর দুটি করে । গিন্নির বছরে ৩-৪টি শাড়ি , সায়া ব্লাউজ । সঙ্গে করে গিয়ে কেনেন । মুখে বলেন পছন্দ করে দেবেন । আসলে যাতে দাম হিসেবের মধ্যেই থাকে সেই চেষ্টা । 

ছেলেমেয়ের জন্মদিন ভুলে যান প্রায়ই । অভিমান করে মালাও স্বামীকে মনে করে দেননা তারিখগুলো । বিবাহবার্ষিকী তো কোন ছার । কিন্তু বাচ্চাদুটো তো নিজের । সেটাও মনে রাখেনা লোকটা ? মালা নিজেই যেটুকু পারে থালা সাজিয়ে খেতে দেয় ছেলেমেয়েদের । পায়েস দেয় ঠাকুরের সামনে । ধুপ জ্বালে । পুজো করে ভক্তিভরে । মেয়ে বুকুন বড় হচ্ছে। তারও মান অভিমান বেড়েছে। সে মুখে কিছু বলেনা বাবাকে । ঋষিটা এখনো ছোট । বাবাকে জাপটে ধরে বলে ...

-আমায় কি দেবে বাবা জন্মদিনে? 

কুড়ি টাকা দিয়ে চকলেট কিনে আনে বাবা । ধুর , তুমি বাজে । ছেলেমানুষের মন । একটু পরেই সেটাই হাসিমুখে খেয়ে নেয় ছেলেটা । 

চোখে জল এসে যায় মালার । সে তো মন্দ ছাত্রী ছিলনা । পার্ট ওয়ান পাশ দিতেই বিয়ে দিয়ে দিল মা বাবা । গানটাও বেশ ভালই গাইত । তারা চার বোন । বাবার তাড়া থাকাটাই স্বাভাবিক । ভাল পয়সাওয়ালা ঘর আর নামী চাকুরে জামাই পেয়ে দেরি করেননি । নামমাত্র খরচে পার করে দিলেন মেয়েকে । আজ দুটো টিউশানি পেত অন্তত গ্র্যাজুয়েটটা হলে । মাঝে কিছুদিন ভেবেছিল গান শেখাবে ।পরিমিত বললেন, 

-কিসের অভাব তোমার? ছেলেমেয়ের কোন খরচটা করিনা আমি? তোমার কোন দরকার মেটেনা? 

এসবের উত্তর হয়না । এই তো গেল বছর ঘুরতে গেলেন তারা ভুটান । পুজোয় বাপের বাড়িতে হাঁড়ি ভরা মিষ্টি শাড়ি নিয়ে বিজয়া সেরে আসে জামাই । কিন্তু আরো কিছু কিছু টুকরো চাওয়াপাওয়া থাকে যেগুলো মুখে বলা যায়না । বোঝানোও যায়না সেভাবে । সেইখানেই হয়ত নিজের একটু রোজগার বুকে বাজে খুব মালার । মানুষটা এমনিতে খারাপ নয় । কিন্তু ওই শুধু হিসেব চায় সবকিছুর । মাসের অর্ধেকেই চাল শেষ? গেল হ্প্তাহেই তো তেল আনলাম এক লিটার । ওবেলা তো একটাই মাছ খেলাম শুধু , রাতে আধখানাও নেই? তোমার অসুধ এরমধ্যেই শেষ? এই তো ডাক্তার দেখানো হল সেদিনই এমনধারা হাজারো কথা । তার সংসারেই তো যাচ্ছে যদি খরচ হয়ওবা । বাপের বাড়িতে তো দিয়ে আসছেনা মালা । এই যে মায়ের এত অসুখ একদিনও কি যাবে বলেছে? সেই বহরমপুর যেতে খরচ অনেক । আর গিয়ে একটু সাহায্য না করতে পারলেও কেমন একটা লাগে । কিন্তু নিজের মাবাপের জন্য বরের কাছে হাত পাততে ছোট লাগে মালার । ছেলে যেমন জন্ম দিতে পারেনি একলা মরুক । মেয়েদের তো সংসার করতেই পাঠিয়ে দিয়েছে সেই কোনকালে।


কদিন ধরে সুগারটা বেড়েছে মালার । অসুধ অনিয়মিত খাওয়া হয় । ডাক্তার দেখাতে হবে শুনলেই মাথায় বাজ পরিমিতর । নিশ্চই ঠিক করে খাওয়াদাওয়া করনা । মিষ্টিগুলো তো ফ্রিজে রাখলে দুদিন পর খালি বাক্স পড়ে থাকে শুধু । হাঁটতে চলতে নিজেই টুকটাক মুখে চালান পরিমিত । সেইটা আর বলেনা মালা । ওষুধ  কিনে এনে বলেন পরিমিত , 

-সব টাকা তো ডাক্তারের পেছনেই যাচ্ছে বিয়ের পর থেকে । তোমার জানো তো অসুধের দোকানদারকে বিয়ে করলেই ভাল হত । 

বিয়ের পর থেকে একবার গলব্লাডার আর একবার ডায়রিয়া এইটুকুই হয়েছিল মালার । আর এখন সুগার ধরা পড়েছে । তাও এমনকিছু বেশি ছিলনা শুরুতে । এই পরিমিতর কথা শুনে শুনে আজকাল আর অসুধ ফুরোলেও কেনার কথা মনে করেনা মালা । 

হয়ত মাস খানেক পর পরিমিত নিজেই একদিন বলেন, 

-তোমার  ওষুধ আছে? 

তখন এনে দেন নিজেই । 

আজ রাতে ডাল , আলুপটল আর ভাত দিয়ে খেতে খেতে টিভি দেখছেন পরিমিত । 

-বাবা কাল মাটন আনবে? কতদিন খাওয়া হয়না। ঋষি বলে ।

পরিমিত মাটন খান না । ছোট থেকে ওই গন্ধটা নিতে পারেননা বিশেষ । এই বাড়িতেও তাই আসেনা বিশেষ । ঋষিটা খুব ভালবাসে । মালাও ভাল খায় মাটন । কিন্তু নিজের ভালমন্দ কবেই ভুলে গেছে ।

-সামনের মাসে বুচকিপিসির বিয়েতে যত ইচ্ছে খাস মাটন বুঝলি? 

পরিমিত ভাত মাখতে মাখতে বলেন ছেলেকে । মুখ নিচু করে থাকে ছেলেটা ।

-এমনিতেই তো সংসারে হাজারটা খরচ । তেল আনলে নুন নেই, সাবান আনলে শ্যাম্পু নেই ।

মালাকে বিঁধিয়ে কথাটা বলেন পরিমিত ।

আজ সকালেই বাজার করে আসার সময় শ্যাম্পু আনতে বলে দিয়েছিল মালা । তার হাঁটু অবদি চুল । খুব জট পড়ে যায় সপ্তাহে দু’তিনবার শ্যাম্পু না দিলে । একটু পরিমাণে ভালই লাগে বইকি ।

বেশ কটাদিন কেটে গেছে এরপর । একদিন বেশ খুশি খুশি মনে বাড়িতে ফেরেন পরিমিত । আজ অফিসে প্রমোশনের কথা শুনে এসেছেন । আগামী তিনমাসে চিঠি পেয়ে যাবেন হাতে । আলুর চপ আর মোগলাই এনেছেন আজ সবার জন্য। 

বাড়ি ফিরতেই বুকুন বলে মা তো বাড়িতে নেই। 

এই ভর সন্ধ্যেতে কোথায় গেল মালা? বেরোনো মানেই কিছু টাকার শ্রাদ্ধ । কি চাট্টি কিনে আনবে আবার । উফ ।

ব্যাজারমুখে বসে পড়েন পরিমিত । চপ মোগলাই পড়ে থাকে টেবিলে। 

একটু পরেই বেল বাজে দরজার । 

মালা এল বোধহয় । আজ একটু আচ্ছা করে কথা শোনাতে হবে । দুমদাম না বেরোয়  যাতে এই অফিস থেকে ফেরার সময়টা ।

কিন্তু এ কে দাঁড়িয়ে আছে ?

বয়েজ কাট চুলের একজন মহিলা , মালার সেই পেস্তা ছাপা ছাপা সাদা খোলের শাড়িটা পড়ে?

-তোমার মত করে ফেললাম চুলটা জানো। জীবনে সবকিছুই পরিমিত থাকাই ভাল। এই একগুচ্ছ চুল রেখে আর কি হবে? সেদিন বলছিলেনা , এত শ্যাম্পু কেন লাগে রোজ রোজ । তোমার তো এক বোতলে বছর ঘুরে যায় প্রায়। আমারও এবার থেকে তাই হবে মনে হয়। তবে কাটলাম যখন সাধের চুলটা , ভাল জায়গাতেই গেলাম । পাক্কা হাজার টাকা নিয়েছে ।

আয়েশ করে বলে মালা । তারপর ঘরে এসে মোগলাইয়ে কামড় বসায় সোফায় হেলান দিয়ে ।

মুখ থেকে বাক্যই সরেনা পরিমিতর । এই যে অপরিমিত লজ্জায় আজ তাকে গেঁথে দিল মালা এ থেকে আজীবন আর মুক্তি পাবেন তিনি ?


ritusxc@gmail.com





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.