(পর্ব-২২)
নিখিলেশ এখন আর শিঞ্জিনীকে আসতে মানা করে না। মানা করলেও ও শুনবে না। রাগ দেখিয়ে দেখেছে নিখিলেশ,উঁচু স্বরে কথা বলেছে,এমনকি গৈরিকার যখন শরীর আরো খারাপ ছিল তখন বাড়ি ফিরে শিঞ্জিনীকে চোখের সামনে দেখে সব শালীনতা ভুলে ওকে গালিগালাজ করেছে। শিঞ্জিনী কোন কথা বলেনি। মুখ বুজে সয়ে গেছে। নিজের কাজটুকু করে চলে গেছে নিঃশব্দে। এখন আর ওকে তাড়ায় না নিখিলেশ। বকে না। খারাপ কথাও বলে না। ওর নিঃশব্দে আসা আর নিঃশব্দে চলে যাওয়াটা যেন একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর ঝামেলা বাড়াতে ভালো লাগে না। তার থেকে যেমন চলছে,চলুক। গৈরিকা সেরে উঠুক,তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সুহার্ত ছেলেটা ভারী ভালো। ওর কাজ থেকে গৈরিকার প্রত্যেকটা খবর পায় নিখিলেশ। নিখিলেশের উৎকণ্ঠার মর্যাদা দেয় ও। বারবার ফোন করলেও বিরক্ত হয় না। সুহার্ত বলে গৈরিকা ঠিক সেরে উঠবে। একটা দৃঢ় বিশ্বাস থেকে কথাটা বলে ও। ওর বিশ্বাসের আঁচ পেয়ে নিখিলেশেরও বিশ্বাস হয় সেরে উঠবে গৈরিকা। উঠলেই ভালো। কিন্তু নিখিলেশের সাথে ওর আচরণের কোন পরিবর্তন হবে কি? নিখিলেশের এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। গৈরিকা ফোন ধরছে না,নার্সিংহোমে দেখা করতে গেলে দুর্ব্যবহার করল-নিখিলেশের এখন ভীষণ খারাপ লাগে। ও তো নিজের ভুল স্বীকার করেছে। ও তো লুকাতেই পারত। লুকিয়ে গেলে গৈরিকা জীবনেও কিছু জানতে পারত না। ওকে ঠকাতে না চেয়েই স্বীকারোক্তি করেছিল নিখিলেশ। অথচ এখন ব্যাপারটা বুমেরাং হয়ে গেছে। নিজের সততার ফাঁদে নিজেই বাঁধা পড়ে গেছে নিখিলেশ। ছটফট করছে। এমন কি আর বড় অপরাধ করেছে নিখিলেশ? যা করেছে,না বুঝে করেছে। নেশার ঘোরে করেছে,ভুল করে করেছে। ভুল স্বীকার করলে,অপরাধ কবুল করলে-অপরাধ লঘু হয়ে যায়। তবুও গৈরিকা কেন এত কঠিন হয়ে আছে? আজকাল রোজ রাম খায় নিখিলেশ। রোজ খেতে হয় ওকে,না হলে ঘুম আসে না,লেখা আসে না। সারাক্ষণ গৈরিকার চিন্তা মাথায় ঘোরে। নেশার ঘোরে নিখিলেশ আয়নার সামনে দাঁড়ায়। দেখতে চায় ওকে ঠিক কতটা কলঙ্কিত দেখাচ্ছে। কলঙ্কের ছাপ সারা দেহে খোঁজে। চেষ্টা করেও খুঁজে পায় না। গৈরিকাকে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে। নেশার ঘোরেই এই ইচ্ছা জাগে ওর। গৈরিকা তো পাঁচবছর আগে নিজে থেকে নিখিলেশকে ছেড়ে গিয়েছিল। স্বেচ্ছায় ঘর বেঁধেছিল অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে করেনি ঠিক-কিন্তু একছাদের তলায় থাকত তো। তার বেলায় বিশ্বাসভঙ্গ হয়নি? ভালোবাসা যখন একতরফা হয় না,যখন দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে তাহলে বিশ্বাসের দায়ভার কেন একা নিখিলেশকেই বয়ে বেড়াতে হবে? নিখিলেশের দিকে আঙুল তোলার আগে গৈরিকা নিজের দিকে আঙুল তুলে দেখেছে কখনো? নাকি ও ভাবে ওকে সবাই ভালোবাসবে,নিঃশর্ত ভাবে ভালোবাসবে,অথচ ওর কাছ থেকে ভালোবাসা চাইবে না। এ কেমন ভালোবাসা? নেশার ঘোরে নিখিলেশের মনে এসব প্রশ্ন জাগে। নিজের মনে বিড়বিড় করে চলে প্রশ্নগুলো। সকালে সজ্ঞানে এই প্রশ্নগুলোকে আউড়ায় না ও। ভালোবাসায় হয়তো একটা অদ্ভুত মায়া আছে,অদ্ভুত বশ্যতা-সব প্রশ্ন ভুলিয়ে দেয় তা।
সেদিন দিদি এসেছিল। ব্যাজার মুখ করে এসেছিল। এসেই নিখিলেশের ঘরে ঢুকে কোন ভুমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করেছিল
-গৈরিকার শখ মিটে গেছে তো? ফোন করে,নাকি...
-ওর শরীর খারাপ।
-ও মা! তাই নাকি? আবার কি হল?
নিখিলেশ গৈরিকার অসুস্থতার আসল কারণ কাউকে জানায়নি। ওকে মিথ্যাই বলতে হল
-অ্যানিমিয়া। রক্ত খুব কমে গেছে শরীরে। সেই দিন রাতে গেলাম দেখলে না?
-বাবাঃ! তাহলে তো তোর আর একবার গিয়ে দেখা আসা উচিৎ। হাসপাতালে আছে এখন,নাকি বাড়িতে...
-ফ্ল্যাটেই আছে। যাবো। আর্চির পরীক্ষাটা হোক।
-বুঝলাম। তা এই মেয়েটির কি হবে?
নিখিলেশ বুঝেও প্রশ্ন করল
-কোন মেয়েটা?
-এই যে,কি নাম যেন...তোর ছেলেকে পড়ায়,শিঞ্জিনী। সে তো আবার এ বাড়িতে যাতায়াত ধরেছে। চারিদিকে লোকজন যা-তা বলছে। এর তো একটা বিহিত হওয়া দরকার,নাকি?
-আমি তো ওকে আসতে বলি না। তাও যদি আসে,কি করব?
-তোর মতলবটা কি বল্ তো? গাছেরও খাবি,তলারও কুড়োবি?
-দিদি! কি যা-তা বলছিস্?
-ঠিকই তো বলছি। গৈরিকার মায়া ত্যাগ কর। ওর সাথে তোর ডিভোর্স হয়ে গেছে,এটা ভুলে যা। শিঞ্জিনী মেয়েটা ভালো,আর্চিকে যত্ন করে,তোকে ভালো রাখবে।
নিখিলেশ এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না। তবে দিদি আজকাল ঘনঘন এ বাড়িতে আসছে। শিঞ্জিনী দিদির সাথে কথা বলে,গল্প করে-ওরা দুজনে চা খায়,টিভি দেখে-ব্যাপারটা ভালো ঠেকে না নিখিলেশের। তবুও ও কাউকেই নিরস্ত করতে পারে না।
সুদেববাবুর কথায় সেদিন কলকাতা যেতে হয়েছিল। দ্বিতীয় প্রুফটা দিয়েছেন। প্রচ্ছদের জন্যও বেশ কয়েকটা ছবি দিয়েছেন। পেনড্রাইভে ভরে নিয়ে এসেছে নিখিলেশ। সবকটাই ভালো। সৌগতদার মত নিয়ে ফাইনাল করবে। সুদেববাবু হঠাৎ করেই বলেছিলেন
-গৈরিকা সান্যালের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসটা প্রতিবিম্ব থেকেই বেরোবে।
-তাই? কোনটা?
-কাঁটা তারের বেড়া। দেশভাগের উপরে এমন লেখা আর হয়নি।
গৈরিকা তাহলে কথা রেখেছে। উচ্ছ্বাসের চোখ রাঙানিকে ভয় না পেয়ে উপন্যাসটা প্রতিবিম্বকে দিয়েছে। কিন্তু এই মানসিক অবস্থায় ও এত বড় সিদ্ধান্ত কি করে নিল ভেবে অবাক হয়েছিল নিখিলেশ।
-ও নিজে এসে দিয়ে গেল,না আপনি গিয়েছিলেন?
-ম্যাডামের তো শরীরটা খারাপ। উনি আসেননি। সুহার্ত দিয়ে গেল,চেনেন তো?
-হ্যাঁ। সুহার্তকে ভালোমতই চিনি।
-আপনি কি জানেন না ম্যাডাম অসুস্থ?
নিখিলেশ অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল।
-জানি।
-কি হয়েছে?
-রক্তাল্পতা। শরীর খুব দুর্বল।
-ওহ। অন্যরকম কিছু শুনছিলাম যেন?
-কি শুনছিলেন?
-এই মানে কানাঘুষা আর কি,গৈরিকা নাকি সুইসাইডাল অ্যাটেমপ্ট করেছিল?
নিখিলেশ চেয়ারে সোজা হয়ে বসেছিল।
-না,একদম না। সবটাই মিথ্যা কথাটা। ও কেন সুইসাইড করতে যাবে?
-আমি তো তাই ভাবছিলাম। কেরিয়ারের পিকে কেউ এমন বোকামো করে নাকি? তা ম্যাডাম নাকি বেশ ক’দিন রাণাঘাটে ছিলেন?
নিখিলেশ অস্বস্তিতে পড়েছিল। সুদেববাবুর ব্যাপারটা নিয়ে নিদারুণ কৌতূহল রয়েছে। আর কৌতূহল নিরসনের জন্য বারবার খোঁচাচ্ছেন।
-আর্চি মানে আমার ছেলের শরীর খারাপ ছিল...
-ও,তাই বলুন। তাহলে তো যেতেই হবে। আর বলবেন না,এই নিয়েও কিসব যা তা রটেছে। অনেকে বলছে গৈরিকা আবার আপনার সাথে সংসার করতে চান আর এই কথা জেনেই ইন্দ্রনীল বসু বিবাগী হয়ে বিদেশে চলে গেছে। গৈরিকা ওকে ঠকিয়েছে-এমন কথাই বলে বেড়াচ্ছে ও আর ওর বাবা।
-যে সম্পর্কটা ভাঙার তা ভেঙ্গেই যায়। তার জন্য অন্য সম্পর্ককে দায়ী করা ঠিক নয়। আমি কি পাঁচবছর আগে বলেছিলাম,ইন্দ্রনীল বসুর জন্য আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে?
সুদেববাবু চোখ ছোট করছিলেন
-তাহলে পুরনো সম্পর্ক জোড়া লাগার সম্ভবনা আছে?
-জানি না। এর উত্তর আমার কাছে নেই। চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যার সেই ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমি তো জড় বস্তুর মত এক জায়গায় স্থানু হয়ে রয়েছি।
-যদি হয়, তবে মারকাটারি ব্যাপার হবে একটা। ভাবতে পারছেন এতে আপনার বইয়ের কতটা প্রচার বাড়বে? আর গৈরিকার উপন্যাসেরও।
বিরক্ত লাগছিল নিখিলেশের। সমস্ত কিছুকে ব্যবসার দৃস্তিভঙ্গিতে দেখেন এরা। লাভক্ষতির নিক্তিতে মাপেন। এমনকি ভালোবাসা,সম্পর্ক সব কিছুই এদের প্রচারের হাতিয়ার। একটা সম্পর্কের ভাঙার ক্ষত কে যেমন বেচতে জানেন,তেমনি জোড়ার আনন্দকেও।
-আজ উঠি।
বলে উঠে চলে এসেছিল। তাতেও নিস্তার পায়নি। বেরোতে না বেরোতেই অনিন্দ্যর সাথে দেখা। অনিন্দ্য ফেসবুক সূত্রে নিখিলেশের পরিচিত এবং ভাইয়ের মত হয়ে উঠেছিল। ওকে হাত ধরে লিখতে শিখিয়েছে নিখিলেশ। পত্রপত্রিকার সাথে যোগাযোগ করে দিয়েছে। শুরুর দিকে কয়েকটা জায়গায় ‘আমার ভাই’ বলে পরিচয় করে দিয়েছে। এখন অনিন্দ্য বেশ বড় কবি। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়ে এখন অনেকগুলো বড় পত্রিকায় লিখছে। গোটা চারেক কবিতার বই বেড়িয়ে গেছে। এখন চিনতেই পারে না। আগে সকাল বিকাল ফোন সন্ধ্যা ফোন করত,এখন নিতান্ত প্রয়োজন না হলে করে না। সেই সময়টা কাজে লাগায় পত্রিকা সম্পাদকদের অফিসে গিয়ে আলাপ জমাতে কিংবা আরো বড় কবির বাড়িতে হত্যে দিয়ে পড়ে ঠেকে সেই নতুন দাদার ফাইফরমাশ খাটতে। কলকাতায় থাকার এই একটা সুবিধা। সশরীরে পত্রিকা দপ্তরে লেখা জমা দেওয়া যায়,পরিচয়ের দেঁতো হাসি হাসা যায়,ঠেক মারা যায়,কারোর বাড়ি দিয়ে গ্রুপ ধরে রাতভর বাওয়াল করা যায়-বন্ডিংটা বাড়ে আর কি। এইভাবেই প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যানেল তৈরী হয়। আজকাল কবিতা ছাপতে গেলে চ্যানেল থাকা জরুরী। আর থাকা জরুরী কোন দাদার ছায়া। মাথার উপর কোন দাদার স্নেহের হাত থাকলে খাজা কবিতাও ভালো পত্রিকায় বেরোবে,না থাকলে কবিতাগুলো জাস্ট হাপিস্ হয়ে যাবে-কেউ কোন খবর পাবে না তাদের। ফোন করে খবর নিতে চাইলেও সম্পাদক বলবেন, “ফাইলে রয়েছে,এখনো দেখা হয়নি।” কিংবা “ওগুলো না। আপনি বরং অন্য লেখা পাঠান। আমাদের পত্রিকা পড়লেই বুঝতে পারবেন আমরা কেমন লেখা ছাপি।” “হ্যাঁ,আপনার লেখা নির্বাচিত হয়েছিল তবু কেন যে ছাপা হল না বোঝা যাচ্ছে না।দাঁড়ান,খোঁজ নিয়ে দেখছি।” খোঁজটাই কেউ নেয় না,বা নিয়েও জানায় না। কারণ খোঁজ নেওয়ার কিছু নেই। সহজ অঙ্কটা। বড়দাদার পছন্দ হয়নি,তাই ছাপা হয়নি। নিখিলেশ এতে আগে উত্তেজিত হত। বড় দাদাকে ফোন করে বলত, “আমার কবিতাগুলো কি থাকছে না?” বড়দাদা আমতা আমতা করতেন,“না মানে,তুই অন্য লেখা দে” “তাহলে আগের লেখাগুলো,তুলে নেব?” দাদাদের ভীষণ রাগ হয়ে যেত,তারা ব্যক্তিগত স্তাবকদের ভিড়ে বলতেন, “বড্ড তাড়াতাড়ি ছোকরার,আর সাহস দেখ না,লেখা তুলে নিতে চায়।” স্তাবকরা তালে তাল দিত, “ঠিক বলেছেন দাদা। আসলে ও নিজেকে বড্ড বড় ভাবে। এসব পাবলিকদের মাথায় ছিট আছে। এদের লেখা নেওয়া মানেই হ্যাপা।” নিখিলেশ আর লেখা পাঠাত না। এখনো কোথাও লেখা পাঠায় না। অনেকেই চেয়ে নেয়। অনিন্দ্যকে দেখেই পুরনো কথাগুলো মনে পড়ে গেল। আগে দিনের পর দিন নিখিলেশের বাড়িতে পড়ে থাকত। গৈরিকা অপছন্দ করছে বুঝতে পেরেও যেত না। রয়ে যেত। দুটো মাত্র শোওয়ার ঘর। নিখিলেশ আর অনিন্দ্য একঘরে,গৈরিকা আর মা অন্যঘরে শুত। গৈরিকা রাগ করত। নিখিলেশকে বলত, “এত ভাই ভাই ভালো নয়। কোনদিন দেখবে ওই তোমাকে বাঁশ দিচ্ছে।” নিখিলেশ হেসে উড়িয়ে দিত, “ধ্যাৎ! কি যে বলো। ও কি করে বাঁশ-টাঁশ দেবে? সবে লিখতে শিখছে। নতুন ছেলে। তাছাড়া ও আমদের ম্যাগাজিনের কাজ কতটা করে দেয় বলো তো?” গৈরিকা তাও বুঝত না,ও হয়তো বুঝতে পারত-অনিন্দ্যর আসল উদ্দেশ্যটা কি। সেই উদ্দেশ্যের আঁচ নিখিলেশ যখন পেল,বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সব জায়গায় অনিন্দ্যর কবিতা ছাপা হতে থাকল,নিখিলেশের কবিতা বাদ পড়ে গেল। অনিন্দ্য প্রথম প্রথম দুঃখপ্রকাশ করত, “দাদা কি করে এটা মানব বলো তো? আমার লেখা ছাপল,আর তোমার লেখা বাদ দিয়ে দিল!” অনিন্দ্যর দুঃখটাকে সত্যি বলে মানত নিখিলেশ অথচ যতদিন গেল,অনিন্দ্যর আসা কমে গেল,ফোন করা কমে গেল,ফোন ধরাও বন্ধ হয়ে গেল। নিখিলেশ খবর নিয়ে জানল অনিন্দ্যর এখন নিখিলেশের প্রয়োজন নেই। নতুন দাদার বাড়ির ঠিকানা ও পেয়ে গেছে। এখন সেখানে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। দাদা বৌদির ফাইফরমাশ খাটে। ঠিক চাকর বাকরের মত। বিনিময়ে সেই শক্তিশালী দাদা অনিন্দ্যর লেখা ছাপিয়ে দেন। আরো একটা কাজ দায়িত্ব সহকারে করত অনিন্দ্য। সব জায়গায় নিখিলেশের নিন্দা করত। সব দাদাদের কানে তোতা পাখির মত বলত নিখিলেশ বড্ড নাক উঁচু। সে ভাবে সে সবচেয়ে ভালো লেখে। তাই দাদাদের বাড়ি আসে না,দাদাদের স্তাবকতা করে না,চাকরবাকর হতেও তার রুচি নেই। দাদারা এতে ভীষণ রেগে যেতেন। এতটাই রেগে যেতেন নিখিলেশের বেয়াদপি বন্ধ করার জন্য সমস্ত পত্রিকার দরজা বন্ধ করে দিতেন স্বহস্তে। লেখা ছাপা না হলে গুমর ভাঙ্গবে। নিখিলেশ আসবে,পায়ে ধরবে। আর একটা নতুন চাকর চেয়েছিলেন দাদারা। পাননি। নিখিলেশ যে ঘাড়ত্যাড়া ছিল,সেই ঘাড়ত্যাড়াই রয়ে গেছে। এক এবং একাকী নিজের লেখা চালিয়ে গেছে। কারোর পায়ে ধরেনি।
অনিন্দ্য অস্বস্তি হাসি দিয়ে ঢাকল
-দাদা,কেমন আছ?
-চলছে। তুই কেমন আছিস?
-এই আর কি। তোমার বই বেরোচ্ছে না?
-হ্যাঁ।
-অ্যাট লাস্ট বেরোচ্ছে তাহলে?
-হ্যাঁ। তবে যতদিন না বেরোয় ততদিন বিশ্বাস নেই।
-সেই তো। কত খরচা পড়েছে? মানে তুমি কত দিলে?
নিখিলেশ বোঝে অনিন্দ্য কি বলতে চাইছে। মৃদু হাসে
-এক পয়সাও না।
-সে কি?
-পয়সা দিয়ে ছাপব কিরে? ছাপোষা মানুষ। সুদেববাবুই সব খরচা দিচ্ছেন।
অনিন্দ্যর মুখে কে যেন কালি লেপে দেয়। ওর বই-ও এবার প্রতিবিম্ব থেকে বেরোচ্ছে। মোটা অঙ্কর টাকা দিতে হয়েছে ওকে।
-ও। তা বৌদি কেমন আছে?
গৈরিকাকে পুরনো অভ্যাসবশত বৌদি বলে অনিন্দ্য। আজো অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে নি।
-বৌদির খবর তো তোরা রাখবি। তোদের শহরে থাকে।
-কি যে বল? অত বড় সেলিব্রিটির খবর কি আমরা রাখতে পারি? শুনলাম খুব অসুস্থ নাকি? বাঁকুড়া বইমেলায় যেতে পারল না-সে নিয়ে তো আয়োজকরা ভারি অসন্তুষ্ট। কি হয়েছে এমন?
নিখিলেশ খবরটা পেয়েছে। গৈরিকা না যাওয়াতে বেশ শোরগোল হয়েছে চারিদিকে।
-রক্তাল্পতা। অ্যানিমিয়া।
নার্সিংহোমে ভর্তি ছিল নাকি!
-হ্যাঁ। ব্লাড দিতে হয়েছে।
-কি বলছ? সুস্থ তো এখন?
-অনেকটা।
-তুমি বৌদির ওখানে যাবে?
নিখিলেশ এড়িয়ে যায়
-না,আমি ঘুরে এসেছি। এখন বাড়ি ফিরব।
-ও তাহলে আমি পরে যাবো একদিন। ঢুকতে দেবে তো?
-সেটা তোর বৌদি বলতে পারবে।
-ইন্দ্রনীল বসু নাকি আমেরিকায়? এত শরীর খারাপ জেনেও আসেনি? তাহলে ওদের সম্পর্ক কি...
নিখিলেশ কড়া চোখে তাকাল
-সেটা ইন্দ্রনীল বসুই বলতে পারবেন।
-আরে চটছ কেন? লোকে বলছে,তাই বললাম। লোকে বলছে বৌদি ইন্দ্রনীলকে ডিচ্ করে তোমার কাছে ফিরে এসেছে। আবার অনেকে বলছে তুমি না,সুহার্ত চ্যাটার্জী। সুহার্ত তো এখন বৌদির ওখানেই থাকে,নাকি?
-কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে এতটা কৌতূহল কি ভালো?
-না। আমি তো এমনিই...আসলে তোমার ব্যাপারে কেউ কিছু বললে খারাপ লাগে। সুহার্তর মত সেদিনের ছোকরার সাথেও যদি বৌদির নাম জড়ানো হয় তাহলে...
নিখিলেশ কিছু বলে না আর। ওর খারাপ লাগে। মানুষের কিছু বলতেই মুখে আটকায় না। নিখিলেশ মানুষের রুচির ঘেন্না পায়। ও চলে যায়,নিজের গন্তব্যের দিকে চলে যায়।
আজ অরিনের খুব মজা। পরীক্ষা শেষ। কাল মামমামের কাছে যাবে। বাবা প্রমিস করেছে,নিয়ে যাবে। মিসকে তাই মহানন্দে মনের কথা বলছিল। শিঞ্জিনী আর্চিকে খাওয়াতে খাওয়াতে শুনছিল,আর হ্যাঁ-হুঁ করছিল। আর্চির উপর একটু হলেও অভিমান হচ্ছিল ওর। ছেলের সমস্ত কিছু ও করে,অথচ ছেলে সবসময় “মামমাম,মামমাম” বলতেই আছে। মামমাম তো ফিরেও তাকায় না। রাগ হয়েছে আর্চির বাবার উপর হয়েছে,ছেলেকে কি একটা ফোনও করা যায় না? দিদি বলে,ওসব শরীর খারাপ-টারাপ বাহানা। পুতুলখেলায় আর মন নেই,তাই যোগাযোগ করে না। কেমন মা কে জানে? দিদি বলে,বিয়ে হয়ে গেলে শিঞ্জিনীকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। আর্চিকে গৈরিকার সাথে বেশি মিশতে দেওয়া যাবে না। বেশি নয়,একদমই মিশতে দেবে না শিঞ্জিনী। চলে যখন গেছে,তখন অত সোহাগ কিসের? এসে থেকে এসব ঝক্কি পোহাক,তবে বোঝা যাবে।
-কাল কখন যাবো মিস?
-আমি তার কি জানি?
-বাবা বলেনি?
-তোর বাবা আমাকে কিছু বলে নাকি?
-ও। আচ্ছা,ক’দিন ছুটি দেবে আমায়?
-বেশিদিন দেওয়া যাবে না। পরের ক্লাসের পড়া শুরু করতে হবে। কালকেই বই কিনে আনব।
-কালকেই? এমা! তাহলে পড়া কাল থেকে শুরু করে দেবে?
-তাই তো দিতাম। এখন তুই তো নিজের ভালো বুঝবি না,বেড়াতে যাবি। দুটো দিন কিন্তু। তারপরই চলে আসবি।
আর্চি মাথা নিচু করে। মিস্ বলেছে দুটো দিন। তার নড়চড় হবে না। মিস্ যা বলে তাই শুনতে হয়। খুব স্ট্রিক্ট মিস্। আর্চিকে কে খুব বকবে না হলে। কিন্তু আর্চি যে ভেবেছিল এবার মামমামের কাছে একমাস থাকবে? পুরো ছুটিটাই মামমাম আর ও একসাথে কাটাবে,একবারে স্কুল খোলা পর্যন্ত। বাবাও তো সব জানে। বাবাকেও তো সব বলা আছে। বাবা তো কই মানা করেনি? বাবাকেই বলবে তাহলে। আগে বাড়ি ফিরুক।
নিখিলেশ বাড়ি ফেরে দেরিতে। আজ একটা কাজ ছিল। স্কুলের দরকারি কাজ। ফেরার পথে রাম কিনে নিয়ে এসেছে। মনটা ভালো নেই। এতদিন হল,এবার তো গৈরিকার রাগ পড়ে যাওয়া উচিৎ। একটাবার ফোন ধরতে কি হয়? একটাবার মুখোমুখি বসলেই সব সমস্যার সামাধান হয়ে যায়। জটিলতা বাড়িয়ে রেখে কি লাভ? নাকি জটিলতা বাড়ানোই গৈরিকার ইচ্ছা। বাড়ি ফিরে দেখে ছেলের মুখ ভার। তেমন গুরুত্ব দেয়নি নিখিলেশ। পরীক্ষা ভালো হয়নি মনে হয়। শিঞ্জিনী বকেছে হয়ত। ঘা কতক দিয়েও থাকতে পারে। ওসব নিয়ে ভাবে না নিখিলেশ। ওটা শিঞ্জিনীর ভাবনা। কথাটা ভেবেই অবাক হয়। ওর সন্তানের জন্য শিঞ্জিনী এত ভাবতে যাবে কেন? শিঞ্জিনীর ভালোবাসার সুযোগ এভাবে দিনের পর দিন নিয়ে যাচ্ছে নিখিলেশ। বড্ড স্বার্থপরের মত কাজ হচ্ছে না? তাহলে সম্পর্কটা কি একটা নাম দেওয়ার দরকার,যেমন সবাই চায়? কিন্তু নিখিলেশের মন চায় না যে,কিছুতেই চায় না। গৈরিকাও চিঠিতে সেরকম ইঙ্গিত দিয়েছে,তবুও নিখিলেশ গৈরিকার কথা মানতে পারছে না। গৈরিকার পরবর্তী অন্য কেউ হয় নাকি,হতে পারে?
-বাবা...
অরিনের কথায় চমকে তাকাল নিখিলেশ। রামের গ্লাসটা টেবিলে ছিল। অরিন দেখে ফেলেছে
-কি হল? শুয়ে পড়িসনি এখনো?
-একটা কথা ছিল...
-এখন নয়,পরে কথা হবে।
-প্লিজ।
নিখিলেশ তাকাল
-বল্।
-কাল মামমাম যাবো তো?
নিখিলেশ হেসে ফেলল এবার
-কাল থেকে তো ছুটি। মামমাম যাওয়ারই তো কথা আছে।
-তাহলে কখন যাবো?
-সকাল সকাল।
-আমি কিন্তু পুরো ছুটিটাই মামমামের কাছে থাকব।
-থাকিস। কে মানা করেছে?
-না,মিস্ বলছিল দু’দিন ছুটি দেবে। তারপর ফিরে পড়া শুরু করতে হবে।
নিখিলেশ বুঝল শিঞ্জিনী কেন এমন করছে।
-এককাজ করব না হয়। তোকে বই কিনে দেব। মামমামের কাছেই নতুন ক্লাসের পড়া পড়বি।
-তাহলে তো খুব ভালো হয়। মামমাম সবচেয়ে ভালো পড়ায়। একটুও বকে না।
নিখিলেশ হাসল
-মামমাম তো সবদিক থেকেই বেস্ট।
-ওকে। তাহলে সকালেই যাবো। গুডনাইট।
-গুডনাইট।
নিখিলেশ মন দিয়ে লিখছিল। লিখছিল আর কাটছিল। আবার লিখছিল। আজ সারাদিন গৈরিকার খোঁজ নেওয়া হয়নি। দশটা বাজে মাত্র। একবার ফোন করলেও তো হয় সুহার্তকে। ফোন করে কেমন আছে না আছে জানতে পারলে মনটা শান্ত হবে। লেখার মন বসবে। ফোন করল
-হ্যালো
-হ্যাঁ,নিখিলেশদা বল।
-কোথায় তুই? বাইরে নাকি? ট্রেনের আওয়াজ পাচ্ছি।
-হ্যাঁ। উত্তরবঙ্গ মেলে আছি। ডুয়ার্স যাচ্ছি।
-হঠাৎ?
-হঠাৎ না। গৈরিকার কালকেও একটা উত্তেজনা মত হয়েছিল। ডাক্তারবাবু বললেন চেঞ্জ দরকার। ডুয়ার্সে আমাদের নিজেদেরই রিসর্ট আছে। তাই তৎকাল টিকিট করিয়ে নিলাম। গৈরিকারও ডুয়ার্স যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হল যে তোমায় বলতে পারিনি।
নিখিলেশের কান গরম হয়ে যাচ্ছিল। অনিন্দ্যর কথা মনে পড়ছিল ওর। সুহার্তর সাথে গৈরিকার নাম জড়িয়ে বাজারে যা রটেছে-তাহলে সেসব কি সত্যি? না হলে এভাবে ওর সাথে একা ডুয়ার্স চলে গেল কেন? বাঃ! ইন্দ্রনীলকে ছেড়ে এবার সুহার্ত? আর নিখিলেশ কাউকে ঘোরের মধ্যে ছুঁয়ে ফেললেও অশুদ্ধ হয়ে যায়?
-ও।
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল নিখিলেশ। ছেলেটার কথাও মনে নেই গৈরিকার। ওর পরীক্ষা শেষ হলে ওকে গৈরিকার কাছে দিয়ে আসা হবে,সুহার্ত জানত। বারবার করে জিজ্ঞাসাও করত কবে পরীক্ষা শেষ। গৈরিকা নাকি বারবার ঘুমের ঘোরে ওর নাম করছে। নাম করলে বেমালুম ভুলে যায়?
-চেনা পরিবেশ থেকে ওকে সরানো খুব জরুরী নিখিলেশদা,তাই নিয়ে যাচ্ছি। তুমি চিন্তা করো না। ক’দিন থাকুক এখানে,দেখবে-ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরেছে। একদম নতুন গৈরিকাকে দেখবে,দেখো।
নিখিলেশ কিছু বলল না আর। বলতে ওর রুচিতে বাঁধল। এই ছেলেটাও ‘দাদা’ বলে ডেকে ওর সর্বনাশ করল তাহলে। কাউকে বিশ্বাস করাটাই ভুল,মস্ত বড় ভুল। ডুয়ার্স থেকে গৈরিকা ফিরবে-অবশ্যই নতুন গৈরিকা হয়েই ফিরবে-তবে সে গৈরিকা নিখিলেশের নয়,সুহার্তর হবে। একান্তভাবে সুহার্তর।
পর্ব-২৩
ডুয়ার্সে এসে মনটা বেশ ভালো লাগছে গৈরিকার। সারাটা রাস্তা চুপ করে ছিল। সুহার্তও চুপচাপ ছিল স্বভাববিরুদ্ধভাবেই। এনজিপিতেই সুহার্তর জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছিল। বেশ ঠাণ্ডা। গৈরিকা ভাবতেও পারেনি এতটা ঠাণ্ডা হবে। সুহার্ত বলেছিল বলেই গরম জামাকাপড় নিয়ে এসেছিল। এখন দেখছে কার্ডিগানে কাজ চলছে না। তার উপর শালও জড়াতে হচ্ছে। সুহার্তদের রিসর্টটা চাপড়ামারি অভয়ারণ্যের খুব কাছে। সাজানো গোছানো রিসর্ট। কটেজগুলো কাঠের তৈরী। মাটি থেকে অনেকটা উপরে ঘর,সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। সিঁড়ি বেয়ে উঠেই ব্যালকনি। বসার জন্য চেয়ার টেবিল পাতা। ব্যালকনি পেরোলেই সুইটে ঢোকার দরজা। সুইটের ভেতরেও দুদিকের জানলার পাশে সেন্টার টেবিল,সোফা সেট দিয়ে বসার ব্যবস্থা করা। ড্রয়িংরুম মত। একদম মাঝে বেডরুম। বড় খাট। খাটের মাথার কাছে টেবিল,চেয়ার। ঠিক যেমন গৈরিকার বেডরুমে আছে। সুহার্ত এই ব্যবস্থাটা বিশেষভাবে করেছে,বুঝেছে গৈরিকা। যাতে ও লেখে। লেখার জায়গা পায়। পর্দা টানলেই দু’দিকের ড্রয়িংরুমের থেকে বেডরুম সম্পূর্ণ আলাদা। বাইরে থেকে বেডরুমটাকে দেখা যাবে না আর। বাইরেটা ভারি সুন্দর। পশ্চিমদিকের বসার ঘর থেকে রিসর্টের মাঠ,বাগান,পুল,পুলের উপরের কাঠের ব্রিজ,বড় ডাইনিংরুম-সব দেখা যায়। অথিতিরা চাইলে মাঠ পেরিয়ে ডাইনিং হলে বসেই খেতে পারে। আবার কেউ চাইলে ঘরেও খাবার আনিয়ে নিতে পারে। সুহার্ত ঘরেই খাবার আনিয়ে নিচ্ছে। ওদের কটেজে দুটো বাথরুম আছে। বেশ বড়সড় বাথরুম। বাথটব,শাওয়ার,গিজার-সবেরই ব্যবস্থা আছে। বেডরুমে ফায়ার প্লেসও রয়েছে। এই সুইটটা রিসর্টের সবচেয়ে বড় সুইট। সুহার্ত বলছিল এটা নাকি হানিমুন কাপলদের জন্য নির্ধারিত। এছাড়া আরো গোটা পাঁচেক সিঙ্গল কটেজ আছে। আর অনেকগুলো জয়েন্ট কটেজ,মানে যে কটেজের সিঁড়ি দিয়ে উঠলে পরপর তিনটে ছোট ছোট সুইটের দরজা পড়ে। ওগুলো ট্যুরিস্টরা ব্যবহার করে,প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে এখানে। এখন সিজন চলছে। গৈরিকা ভিতরের ড্রয়িংরুমের কাঁচের জানলার ভেতর থেকে ওদের কার্যকলাপ দেখে। কলেজ থেকে একদল এসেছিল। সারাদিন নাচ গান,হৈ হুল্লোড়,রাতে বনফায়ার-খুব মজা করেছে সবাই। পাশের গ্রাম থেকে আদিবাসীদের নাচের দল এসেছিল। ধামসা মাদলের তালে তালে আগুনের চারিদিকে গোল হয়ে নাচ্ছিল ওরা। সাথে সাথে ছেলেমেয়েগুলোও। মদের ফোয়ারা চলছিল সাথে সাথে। গিটার বাজিয়ে গান করছিল সবাই। হাততালি দিচ্ছিল,হেসে গড়িয়ে পড়ছিল অকারণে। জোড়ায় জোড়ায় আলাদা হয়ে এসে অন্ধকারে,ঝোপের ধারে,পুলের ব্রিজের উপর একে অপরকে আদর করছিল,চুমু খাচ্ছিল-ওদের আনন্দ দেখে গৈরিকারও ভালোলাগছিল। জীবনের স্পন্দন খুঁজে পাচ্ছিল ওদের মধ্যে। অকারণে হেসে,কেঁদে,নেচে,গেয়ে,বাওয়াল করে যে মজাটা আছে-কলেজ জীবনের পর মানুষের জীবন থেকে সেই মজাটা উধাও হয়ে যায়। মানুষ হিসেবি হয়ে যায় খুব। বড্ড বেশি ভবিষ্যৎ-এর কথা ভাবে। বড্ড বেশি জটিল ভাবে ভাবে। আগামীকালের কথা ভাবতে গিয়ে আজটাকে ভুলে যায়। অথচ আজটাই সত্যি। আজটাই নির্ভেজাল। যা অতীত,যা ভবিষ্যৎ-সবই ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই ছেলেমেয়েগুলো আজে বাঁচে। তাই প্রাণখুলে বাঁচতে পারে,প্রাণখুলে ভালোবাসতে পারে। সুহার্ত ঘরে এসে গৈরিকাকে জানলার ধারে বসা দেখেছিল। গৈরিকার মুখটা বেশ হাসিতে ভরা ছিল,চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়েছিল।
-যাবে নাকি বাইরে?
গৈরিকা মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল,
-কোথায়?
-ওদের ওখানে। ওরা তো আমাকে বারবার করে যেতে বলল।
-আমার যাওয়া শোভা পায়?
-ও,তুমি তো আবার দিদিমণি। ওদের মত ছেলেমেয়েদের পড়াও। তবে কি জানো,মাঝেমধ্যে ওসব প্রোটোকল ভুলে যেতে হয়। এই দেখো না,এই ছেলেমেয়েগুলোই নিজেদের কলেজে কতটা শান্ত,ভদ্র,ডিসিপ্লিনড হয়ে থাকে,কিংবা বাড়িতেও। ওদের বাবা মায়েরা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না ওরা এভাবে খোলামেলাভাবে আনন্দ করতে পারে। পরিবেশ মানুষকে বদলে দেয়। ঘিঞ্জি শহরের বাইরে এই খোলামেলা পরিবেশে ওরা প্রাণ ফিরে পেয়েছে যেন। সবাই কেমন স্পিরিটেড দেখেছ? কোন ইনিহিবিশন নেই।
-বাঁধন ছেঁড়ার একটা আলাদা মজা আছে।
-মাঝে মাঝে তাই বাঁধন ছিঁড়তে হয়। ছুটে পালিয়ে আসতে হয় রোজনামচার হাত থেকে। এখানে এসে ভুল করিনি তো?
সুহার্ত পাশে বসেছিল।
-না। আমার বেশ ভালো লাগছে পরিবেশটা।
-ঘরে বন্ধ না থেকে একটু বাইরে বেরোও। আরো ভালো লাগবে।
গৈরিকা সুহার্তর কথা শোনে। বাইরের ব্যালকনিতে এসে বসা শুরু করে ওরা। সকালে ব্যালকনিতে বসে ব্রেকফাস্ট করে,নিউজ পেপার পড়ে,তারপর পাশাপাশি হেঁটে সারা রিসর্টটা ঘোরে। হাঁটতে হাঁটতে গৈরিকা ক্লান্ত হলে ওরা বেঞ্চে বসে। সুহার্ত গৈরিকাকে জিরোতে দেয়। তারপর ওর হাত ধরে ধীর পায়ে পুলের ধারে নিয়ে যায়। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে কথা বলে ওরা। গল্প করে। বিকালে চা খেতে খেতে ব্যালকনিতে বসে কবিতা শোনায় সুহার্ত। কখনো কখনো গৈরিকা বই পড়ে। ওর প্রিয় লেখকদের উপন্যাস। সুহার্ত সব জোগাড় করে রেখাছে। দুজন দুদিকে বসে পড়ে যায়। কোন কথা বলে না। আজকাল ডাইনিং হলে খেতে যায় ওরা। লাঞ্চটা ওখানেই করে,ডিনারটা সুহার্ত ঘরেই নিয়ে আসে। গৈরিকাকে খাইয়ে,ওষুধ খাইয়ে,ঘুম পাড়িয়ে দেয়। নিজে সোফাতে শুয়ে পড়ে,গৈরিকার পাশে শুতে ভীষণ ইচ্ছা করে সুহার্তর। মনে হয় গৈরিকা যেন ওর বুকে মাথা রেখে,ওকে আঁকড়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। আর কিছু চাইনা সুহার্ত্। এইতুকু পেলেই যথেষ্ট। অথচ তা পায় না। সোফায় শুয়ে জেগেই রাত কাটায় তাই। গৈরিকা পাশ ফিরলেও তাকিয়ে দেখে-কি হল। নিখিলেশদা ফোন করে না আর। কারণটা বুঝেছে সুহার্ত। নিখিলেশদা কে না জানিয়ে ডুয়ার্সে চলে আসাটা ভালোভাবে নেয়নি। অথাচ সুহার্তর কিছু করার ছিল না। গৈরিকা আবারো ভেঙে পড়ছিল। ওকে এখানে এনে যত দ্রুত সুস্থ করে তুলছে,কলকাতায় থাকলে তা হত না। পুরনো চিন্তাগুলো মাথায় ভিড় করত অযথা। সেরে উঠবে গৈরিকা। খুব তাড়াতাড়িই সেরে উঠবে। সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাচ্ছে সুহার্ত।
লেখার তাগিদটা আবার ফিরে পাচ্ছে গৈরিকা। লেখার জন্য মনটা ছটফট করছে। লিখতে হবে,অনেককিছু লেখার আছে। নিজের জীবনটা নিয়েই প্রথম লিখবে গৈরিকা। সত্যিটা সবার জানা দরকার। যা সত্যি তাই লিখবে। কিছু লুকাবে না,কিছু না।
-কাগজ,পেন লাগত।
গৈরিকার কথা শুনে সুহার্তর মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল।
-লিখবে?
-লিখতাম,কিন্তু হাতটা এখনো...
-ও নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি লিখব।
-পারবে?
-পারব না কেন?
-না,টানা লেখা তো,অভ্যাস নেই তোমার।
-অভ্যাস করে নেব। আজ আনি?
-কি?
-কাগজ,পেন?
-আচ্ছা।
-নতুন উপন্যাস?
-হুম।
-কি নিয়ে?
-আমাকে নিয়েই। বড্ড কন্ট্রোভার্সি আছে। ধোঁয়াশা আছে। নিজে হাতেই সেসব পরিষ্কার করে যেতে চাই।
-মানে উচ্ছ্বাস যে উপন্যাস চায় সেটা?
-হ্যাঁ। আবার না।
-মানে?
-উচ্ছ্বাস যে উপন্যাসটা চেয়েছিল,সেটা মিথ্যায় ভরা হত। এতে সত্যি থাকবে। শুধু সত্যিই থাকবে।
-কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে যে?
-দাঁড়াব। বিচারকের সামনে লুকাব না কিছুই। আমার তো হারাবার কিছুই নেই।
সুহার্ত একমুহূর্ত চুপ করেছিল। তারপর বলেছিল
-সত্যিই কি হারাবার কিছু নেই?
গৈরিকা জবাব দেয়নি। যা হারাবার তা ও হারিয়ে ফেলেছে। কখনো নিজের দোষে,কখনো অন্যের দোষে। যা ওর ছিল না,তা হারাবার দুঃখ ও করে না। সুহার্ত ওকে লুকাতে চাইলেও সত্যিটা ও জেনে ফেলেছে। কালকের উচ্ছ্বাসের সংবাদপত্রে চিরন্তনীর বড় করে ছবি বেরিয়েছে। ও প্যারিসে গেছে। আধুনিক গদ্যের রূপরেখার উপর সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে। শুধু ও একা নয়। ইন্দ্রনীলও রয়েছে সেখানে। দুজনের একসাথে ছবি ছেপেছে একটা। সেই ছবিতে দুজনকে দেখে সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়,ওদের মধ্যে কি চলছে,চলুক। অনিমেষ বসু গৈরিকার বিকল্প খোঁজায় এত মরিয়া হয়ে উঠেছেন যে,চিরন্তনীর সামনেও সেই এক টোপ ফেলেছেন,ইন্দ্রনীলের বৌ হওয়ার টোপ। বসু পরিবারের বৌমা হওয়ার টোপ। চিরন্তনী সেই টোপ গিলেওছে। গিলুক। পরে নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারবে,আর পস্তাবে। বসুরা ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝে না। একজন প্রকৃত শিল্পী কখনো একজন ব্যবসায়ীর সাথে থাকতে পারে না। তাছাড়া অনিমেষ বসু চিরন্তনীকে যে স্থানে বসাচ্ছেন-সেই স্থানের যোগ্য নয় ও। অযোগ্যতা ইন্দ্রাসনকেও নড়িয়ে দিতে পারে। সুহার্ত কালকের কাগজের ঐ পাতাটা লুকিয়ে রেখেছিল। ভেবেছিল গৈরিকা কষ্ট পাবে। অথচ একটুও কষ্ট হচ্ছে না গৈরিকার। একটুও ফাঁকা ফাঁকা লাগছে না। বরং লেখার তাগিদটা বেড়ে গেছে। জেদ চেপে গেছে। ফিরতে হবে ওকে। আবারো স্বমহিমায় ফিরতে হবে।
সুহার্তকে যত দেখে তত অবাক হয় গৈরিকা। অক্লান্ত ভাবে ডিকটেশন নিয়ে চলে ও,লিখে চলে। একটুও থামে না। সারাদিনে যা লিখেছে,রাত জেগে সেটা আবার ফেয়ার করে সুহার্ত। গৈরিকাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজে চেয়ার টেবিলে বসে লিখতে থাকে। গৈরিকা রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে অবাক হয়।
-এখনো শোওনি?
-একটু বাকি। কিছু লাগবে?
-না,শুয়ে পড়।
-শোব। এই লেখাটা যত তাড়াতাড়ি পারি,শেষ করতে হবে।
-এত তাড়া কিসের?
-বইমেলা সামনে তো।
-এবার বার করবে?
-ইয়েস ডার্লিং।
-কোথা থেকে?
-উচ্ছ্বাস থেকে নয় ডেফিনিটলি।
-তাহলে?
-তুমি এ নিয়ে ভেবো না,আমার কথা হয়ে গেছে।
-তাও নামটা বলো।
-সাহা’জ।
গৈরিকা অবাক হল,উচ্ছ্বাসের ঠিক পরের স্থান সাহা’জ-এর,ওরা গৈরিকার উপন্যাস ছাপবে।
-তোমায় পাঁচ লাখ দেবে ওরা।
-পাঁ...চ?
-কম হল? উচ্ছ্বাস কত দিত?
উচ্ছ্বাস তো মোহকুহকের জন্যও একলাখের বেশি দেয়নি। আর রয়্যালটি। তাহলে বাজারদর কি এমন-ই?
-কম দিত।
-সে কি? অশ্বত্থমা মিত্রও তো সাহা’জ থেকে গতবছর তিনলাখ টাকা পেলেন। তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে উপন্যাস,তার উপর তোমার উপন্যাস-পাঁচ তো হবেই। বারগেনিং করলে বাড়তেও পারে।
-বাজারদর এমন-ই?
-হ্যাঁ। তোমাকে ঠকিয়ে নিত মাকালটা। তুমিও যা বোকা,খোঁজখবর নিয়েও দেখো নি...
-তাহলে উচ্ছ্বাসে লেখার জন্য এত ব্যস্ততা?
-ঐ যে,নামটার জন্য। ট্যাগটার জন্য। তোমাকে ভাঙিয়ে কত পয়সা পিটেছে ওরা বুঝছ তো?
সবাই বুঝেছে গৈরিকা। সবই বুঝছে আস্তে আস্তে। সুহার্ত উঠে আসে। ওর পাশে বসে,
-উচ্ছ্বাস তোমার অতীত। ও নিয়ে ভেবো না। ভবিষ্যৎ সামনে পড়ে আছে। উচ্ছ্বাস যে তোমায় তৈরি করেনি,তুমি নিজে যে যোগ্য-এটা প্রমাণ হয়ে যাবে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।
-তুমি সবসময় এত পজিটিভ থাকো কি করে বলো তো?
সুহার্ত মিষ্টি করে হেসেছিল-গৈরিকাকে কপালে আদর করে দিয়েছিল।
-তোমায় দেখে। তুমিই তো আমার ইনস্পিরেশন। জানো,আমি বড্ড অস্থির ছেলে। ছোট থেকেই দুরন্ত। মা বলত পায়ের তলায় সর্ষে রেয়েছে যেন। যেমন কথার খই ফোটে মুখে,তেমনি দুরন্তপনা করে বেড়াতাম। ক্লাসের পড়া এক চেয়ারে বসে আধঘণ্টার বেশি পড়িনি কোনদিন। সারাদিন টো টো করে বেড়াতে ভালোলাগে আমার। অথচ,তোমায় কাছে পাচ্ছি তাই দিব্যি ঘরে রয়ে গেছি। কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না আর। মনের মধ্যেকার ছটফটানি একদম নেই। আমার ঠিকানা খুঁজে পেয়ে গেছি আমি। জানি,এসবই মায়া। তুমি আমায় ভালোবাসো না। বাসবেও না কখনো,তবুও যে ক’দিন পারি,আমার স্বপ্নটাকে বেঁচে নিচ্ছি।
গৈরিকা সুহার্তর চোখে জল দেখে,মুছিয়ে দেয়
-তুমি এখন আমার অভ্যাস হয়ে গেছ। তুমি না থাকলে নিজেকে বড় একা লাগে,অস্থির মনে হয়। একটু বাইরে গেলেই মনে হয়,কখন ফিরবে?
-সত্যি?
সুহার্তর চোখে তারারা ভিড় করে।
-হুঁ।
-অভ্যাসটা যেন রয়ে যায়,এটা চাইব না। এতটা স্বার্থপর নই আমি। আমি তো জানি তুমি কাকে ভালোবাসা।
-সে যে আমায় ভালোবাসে না।
-কে বলল? ভালো না বাসলে এত উদ্বিগ্ন হয়? এভাবে খোঁজ নেয়?
-খোঁজ কি করে নেয়?
-ফোন করে আমায়,তোমার ডিটেল হেলথ আপডেট দিতে হয়,সব শোনে নিখিলেশদা,খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনে।
গৈরিকা অন্যদিকে তাকায়। কথার জবাব এড়িয়ে যায়।
-একটা ভুল ক্ষমা করা যায় না গৈরিকা?
-কি ভুল জানো?
-আঁচ করি।
-তুমি হলে ক্ষমা করতে পারবে?
-হয়তো পারতাম।
-বলা সহজ। করাটা অত সহজ নয়।
গৈরিকাকে রাগাতে চায় না সুহার্ত।
-আচ্ছা। বাদ দাও। একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে জানো?
-কি?
-রিন্টুর না পরীক্ষার পর তোমার কাছে থাকার কথা ছিল?
-কই? না তো। আমি তো অমন কিছু বলিনি।
-আমি কথা দিয়েছিলাম। রিন্টু খুব মন খারাপ করছিল। আর তুমিও তো ঘুমের ঘোরে রিন্টুর নাম আউড়াও। তাই নিখিলেশদাকে কথা দিয়ে ফেলেছিলাম রিন্টু এক্সামের পর আমাদের কাছে থাকার।
গৈরিকার চোখে জল চলে এল। জেদের বশে রিন্টুকে দানপত্র করে দিয়ে এসেছে ও। শিঞ্জিনীকে সঁপে এসেছে। অথচ শিঞ্জিনীকে কখনোই ওর মামমামের পরিবর্ত ভাবতে পারবে না রিন্টু। কষ্ট পাচ্ছে নিশ্চয়। খুব কষ্ট...
-পরীক্ষা শেষে?
-হ্যাঁ। কিন্তু তোমারও চেঞ্জটা দরকার ছিল। তাই দুম করে চলে এলাম। ইস্! একটু দেরি করলেই ওকে নিয়ে আসতে পারবে।
-এখানে?
-হ্যাঁ। রিন্টু আমাদের সাথে বোর হত ভাবছ? না,না। আমি ওকে বোর হতে দিতাম না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলিয়ে মনটা ভালো করে রাখতাম।
-রিন্টু বড় শান্ত ছেলে। ওকে ঘোরাতেও হত না। যদি এখানে আসত,তাহলে সারাদিন চুপটি করে আমার কাছে বসে থাকত।
-নিয়ে আসব তাহলে?
গৈরিকা চমকাল। যতটা সহজে কথাটা বলছে সুহার্ত পরিস্থিতি ততটা সহজ নয়। নিখিলেশ ছাড়বে না।
-না,থাক।
-শিওর?
-ইয়া।
-তাহলে আর কষ্ট পাবে না প্রমিস করো?
-প্রমিস।
সুহার্ত গৈরিকার কোলে মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।
-আচ্ছা,ভাবো আমি রিন্টু। আমাকে গল্প বলে ঘুম পাড়াতে হবে। দেখি কেমন পারো?
-তুমি রিন্টু হতে যাবে কেন?
-আহা! ভাবোই না। তুমি না বড্ড বেরসিক। কল্পনার ‘ক’টুকুই নেই তোমার মধ্যে। গদ্যই উপযুক্ত তোমার জন্য।
-বেশ। তুমি কল্পনা নিয়ে থাকো,আর কবিতা লেখো।
-গল্প বলবে না তাহলে?
-না,ভালো ছেলের মত শুয়ে পড়।
-কোথায় শোব? সেই সোফায়?
-তোমার যেখানে ইচ্ছা শোও।
-কোলে ঘুমোই তাহলে?
-ঘুমোও।
-না থাক। তোমার কষ্ট হবে।
-হবে না। শোও।
সুহার্ত শুয়ে পড়ে। গৈরিকাকে বলে
-মাথায় হাত বুলিয়ে দাও,মামমাম।
গৈরিকা হেসে ফেলে। সুহার্তর নাকটা টেনে দেয়
-ভারী দুষ্টু হয়েছে।
-কেন? তুমি আমার অল ইন ওয়ান। মাতৃস্নেহে পালন করতে চাইলেও করতে পারো।
গৈরিকা সুহার্তর চুলে বিলি কাটতে থাকে। সুহার্ত ঘুমিয়ে পড়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই,ঝুঁকে ওর কপালে চুমু খায় গৈরিকা। বালিশে হেলান দেয়। একটা নামহীন,উদ্দেশ্যহীন সম্পর্কে ওকে যতটা আনন্দ দিচ্ছে-ততটা মনে হয় কেউ দিতে পারেনি। সুহার্ত কোন এক অজানা জাদুতে গৈরিকার সব ক্ষত ভরিয়ে দিচ্ছে। ওকে ছাড়া পথ চলতে হবে,ভাবতে পারে না গৈরিকা। নির্ভর করে ওকে,ভরসা করে,বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসের হাত ধরেই চলে যেতে চায় গৈরিকা।
পর্ব-২৪
সুহার্তর মুখচোখ দেখেই গৈরিকা ওর মনের কথা বুঝতে পারে। ওর প্রত্যেকটা অভিব্যক্তিতে ওর মনের ভাব ফুটে ওঠে। মুখ আর মনের কোন তফাৎ নেই ওর। ওর সাথে থাকতে থাকতে স্বচ্ছ হয়ে উঠছে গৈরিকা। স্পষ্ট হয়ে উঠছে। লেখাতেও তার ছাপ পড়ছে। সবটুকু সত্যি ফুটে উঠছে অকপটে। সুহার্ত লিখতে লিখতে থমকায়। গৈরিকার মুখের দিকে তাকায়
-এতটা স্পষ্ট করা কি জরুরী ছিল?
-লুকিয়ে কি লাভ? আমার জীবনটাকে খোলাপাতার মত করে যাব আমি।
-যাবো মানে? কোথায় যাবে?
-আরে,একসময় তো যেতেই হবে। তখনকার কথা বলছি।
-সে অনেক দেরি। তার আগে কত কি করা বাকি আছে।
-কত কি আর...কয়েকটা লেখা বাকি এই যা।
-জীবনে কি লেখার বাইরে কিছু নেই তোমার? সত্যি বড্ড বোরিং মেয়ে তুমি।
-তাই? তাহলে এমন বোরিং মেয়ের সাথে থাকো কেন?
-কি আর করব? বাঁধা পড়ে গেছি। গৈরিকা,তোমার জঙ্গল দেখতে ইচ্ছা করেনা? পাশেই তো সাংচুয়ারি,একদিন সাফারিতে যাবে?
-লেখাটা শেষ হোক। তারপর যাবো।
-লেখা শেষ হলে ঠিক করেছি দার্জিলিং,গ্যাংটক ঘুরে তারপর কলকাতায় ফিরব।
-বেশ,লেখাটা সাহা’জ-এ পৌঁছাবে কি করে?
-ক্যুরিয়ার করে দেব। চাপ নিও না। সত্যি করে বলো তো,মাকালটাকে তুমি সত্যিই আগে ভালোবাসতে না?
-না। নিখিলেশকে ছাড়ার সিদ্ধান্তটা একদম ব্যক্তিগত ছিল। ওর হতাশার সাথে ঘর করতে পারছিলাম না আর। তখন ইন্দ্রনীলকে বন্ধু ভাবতাম,ওয়েলউইশার ভাবতাম। ভালোবাসতাম না মোটেও।
-আর লোকে বলে তুমি ইন্দ্রনীলকে ভালোবেসে নিখিলেশদার সংসার ভেঙেছ।
-লোকে এ-ও বলে আমি নিখিলেশের কাছে ফিরে গিয়ে ইন্দ্রনীলকে ডাম্প করেছি।
-বলে তো! কিন্তু এখন লোকে কি বলছে,আমি বুঝতে পারছি না। ভেবড়ে গেছে মালগুলো। ইন্দ্রনীলকে যদি গৈরিকা নিখিলেশের জন্যই ছাড়ে,তাহলে রাণাঘাটে না থেকে ডুয়ার্সে কি করেছে?
-ডুয়ার্সে আছি,কেউ জানে নাকি?
-কলকাতায় নেই এটা তো জানে। আর আমিও নেই এটাও জানে। এই যাঃ! এবার ভাবছে সুহার্ত চ্যাটার্জীর জন্য তুমি ওদের দুজনকেই ডিচ করলে। ইন দ্যাট কেস,অ্যাম প্রাউড অফ মাইসেল্ফ। ক্যাপা আছে আমার,কি বলো?
গৈরিকা হেসে ফেলে, সুহার্তও। একসাথে হেসে ওঠে দুজনে। সব জটিলতার বাইরে গিয়ে প্রাণখুলে হাসে গৈরিকা। বহুদিন পর হাসে।
গৈরিকা জানলার ধারে দাঁড়িয়েছিল। মনে মনে কিছু একটা ভাবছিল। ওর চিন্তা এতটাই গভীর ছিল যে টের পায়নি সুহার্ত ঘরে চলে এসেছে। সুহার্ত পা টিপে টিপে এল। পিছন থেকে গৈরিকার কোমর জড়িয়ে ধরল।
-কখন এলে?
সুহার্ত গৈরিকার গালে ঠোঁট ঠেকাল।
-এই মাত্র।
-খুব খুশি মনে হচ্ছে?
-হব না? খুশির খবর তো।
গৈরিকা ঘুরে সুহার্তর দিকে তাকাল
-কি হয়েছে? ডাক্তারবাবু বলেছেন আর ওষুধ খেতে হবে না?
-উঁহু। তবে শিগগির বলবেন। তোমার ওষুধ তোমার কাছেই আছে,তখন ওষুধ খেতে হবে না আর।
-তুমি আমার ওষুধ?
-তা নয়তো কি? আমি তোমার রক্তে আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছি,টের পাচ্ছ না? তোমার সব মন খারাপ ভ্যানিশ করে দিচ্ছি কি করে? ওষুধ না হলে পারতাম?
-ঠিক বলেছ। এবার বলো,খবরটা কি?
-হুম...প্রতিবিম্ব থেকে ‘কাঁটা তারের বেড়া’ গত পরশু বেরিয়ে গেছে।
-সে কি? এত তাড়াতাড়ি? আমাকে জানাল না তো?
-আমাকে জানিয়েছিল। উন্মোচনে তুমি থাকো,এটা চেয়েছিল খুব করে,আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছি আমার সোনার শরীর খারাপ,থাকতে পারবে না।
-এমা! তাহলে খুব ক্ষতি হয়ে গেল যে? আমি না থাকলে বইটা প্রচারই পাবে না তো।
-তোমার মাথায় কিছু নেই। তোমার না থাকাটাই তোমার থাকার থেকে বেশি পাবলিসিটি দেবে। রহস্যময়ী এখন তুমি বুঝলে? রহস্যময়ী হয়ে উঠেছ। তুমি কি করছ,না করছ,কেমন আছো,কোথায় আছো-তোমার ফ্যানরা কেউ জানে না। সবাই তোমায় মিস্ করছে।
-আমায় মিস্ করলে বইয়ের কি লাভ?
-লাভ মানে? সবাই হামলে পড়বে বইটার উপর। দেখতে চাইবে,এটায় গৈরিকা সান্যাল ঠিক কি লিখতে চেয়েছেন,কি আছে এর মধ্যে যা লিখে উনি অজ্ঞাতবাসে...কেন এই উপন্যাস উচ্ছ্বাস ছাপল না,এটাও জানতে চাইবে সবাই।
-তুমিও না! পারোও। তোমার এত বেশি কল্পনাশক্তি...উফ!
-উঁহু ম্যাডাম। কল্পনা নয়। বাস্তব,বইটা বেস্টসেলার। দুদিনে হাজার কপি শেষ।
-কি?
আশ্চর্য হল গৈরিকা। দেশভাগের উপর গবেষণামূলক জটিল উপন্যাস পড়ার জন্য এত লোক উৎসাহী হবে,ভাবতেও পারেনি অ, “লোকে এখনো এসব পড়ে?” অনিমেষ আঙ্কল বলেছিল ‘ক্লিশে টপিক’ কথাটাও কানে বাজল আবার।
-ঠিক শুনেছ। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে কি বলব? উচ্ছ্বাসের মুখের মত জবাব হয়েছে এতদিনে। সুদেববাবু এত খুশি যে কি বলব? তোমাকে একলাখ টাকা রয়্যালটি দেবেন বলে ফোন করলেন। অ্যাকাউন্ট নাম্বারটা বলো তো?
গৈরিকার কানে ওসব কথা যাচ্ছিল না আর। পেরেছে ও,পেরেছে। নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছে উচ্ছ্বাসের বাইরেও যে ওর অস্তিত্ব আছে,ও যে লিখতে জানে,লিখতে শিখেছে-এটা আজ প্রমাণ করে দিয়েছে ও। স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই সুহার্তকে জড়িয়ে ধরল ও। প্রবল আবেগে। সুহার্ত বুঝল,বাহুবন্ধনে জড়াল গৈরিকাকে।
-না,সোনা,কাঁদে না। তুমি পেরেছ,পরেছ তো...
-আমি লিখতে পারি,তাই না? লিখতে পারি তো...
সুহার্ত কিছু বলে না। গৈরিকাকে ওর অস্থির মনটাকে শান্ত করে। অনেক লড়াই লড়ে বিজয় পেলে,সে বিজয়ের স্বাদ অনন্য হয়। গৈরিকার এই লড়াই,এই জয় শুধু ওর একার নয়-সব লেখকেরই। সাহিত্য জগতে উচ্ছ্বাসের দাদাগিরির বিরুদ্ধে গলা তুললে টেকা যায় না-এই ধারনাটা ভুল প্রমাণ করে দিল গৈরিকা। ওকে দেখে নিশ্চয় আরো অনেকেই শিক্ষা নেবে কি করে প্রতিবাদ করতে হয়,কি করে লড়াই করতে হয়,কি করে জিততে হয়। গৈরিকা একটা নতুন যুগের সুচনা করল মাত্র।
গৈরিকার নতুন উপন্যাস তরতরিয়ে এগোতে থাকে। সুহার্ত বোঝে,এখন মন বেশ ভালো। গৈরিকা কাল সিগারেট খাওয়ার জেদ করছিল। ধমক দিয়েছে সুহার্ত। ডাক্তারবাবুর নিষেধ রয়েছে বলে নিরস্ত করেছে। ব্যাজার মুখ করে বসেছিল। তবে বেশি জেদ করেনি। সুহার্তের সব কথা মন দিয়ে শোনে গৈরিকা,মেনে চলে। সুহার্তর ভালোলাগে ওর ভরসা পেতে। নিখিলেশদাকে একটা ফোন করতে ইচ্ছা হয় সুহার্তর। করে না। একেবারে ফিরে গিয়ে করবে। সুস্থ গৈরিকাকে নিয়ে গিয়ে বলবে-দেখো,বলেছিলাম না,সেরে যাবে? নিখিলেশদা খুশি হবে খুব। ওর হাতে গৈরিকাকে তুলে দেবে সুহার্ত,দিয়ে চলে আসবে। কথাটা ভেবেই থম মেরে গেল সুহার্ত-গৈরিকাকে অপরের হাতে তুলে দিতে কি একটুও কষ্ট হবে না ওর? হবে,খুব হবে। কিন্তু গৈরিকা যে ওকে ভালোবাসে না। বন্ধু ভাবে,বিশ্বাস করে-হয়তো এই মুহূর্তে গৈরিকার সবচেয়ে কাছের মানুষ সুহার্ত-তা বলে ভালোবাসার মানুষ তো নয়। প্রত্যেককেই তার ভালোবাসার মানুষের কাছে ফিরতে হয়। গৈরিকাও যাবে। এতদিন ওর সাথে থেকে অভ্যাস-গৈরিকা চলে গেলে ও কি করে থাকবে ভেবেই কষ্ট হয় সুহার্তর। চলে গেলে তাহলে কতটা কষ্ট হবে? অভ্যাস কাটাতে দেরি হয়। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হবে না। ধীরে ধীরে অভ্যাসটাকে কাটিয়ে ফেলতে হবে। তবে সমস্যা এই যে অভ্যাসটা শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার মত হয়ে উঠেছে-চাইলেও থামানো যায় না আর থামলে বাঁচা যায় না। গৈরিকা চলে গেলে সুহার্ত বাঁচবে। তবে সে বাঁচায় প্রাণ থাকবে না। তবুও নিষ্ঠার সাথে গৈরিকার জীবনের গল্পের অনুলিখন করতে থাকে সুহার্ত। সেই গল্পে সুহার্তর কোন অস্তিত্ব নেই,ছায়া মাত্রও নেই,থাকবেও না। গৈরিকার কাছে সুহার্ত নেহাতই তুচ্ছ হয়ত-চলে গেলে ভুলেই যাবে ওকে। তা যাক,তবুও গৈরিকা ভালো থাকুক। ওর সবটুকু নিয়েও ভালো থাকুক গৈরিকা। ওর পাশে কাত হয়ে শুয়ে ওর কপালে চুমু খায়। সুহার্ত নিজের নিঃশ্বাস নিজেই অনুভব করে,আগুন গরম হয়ে গেছে। শরীর বিচলিত হয়ে ওঠে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে সুহার্ত। গৈরিকা ঘুমের ঘোরে সুহার্তকে জড়িয়ে ধরে,ওর বুকে মাথা রেখে শোয়। সুহার্ত জেগে থাকে। সারারাত।
সুহার্ত একটু বেড়িয়েছে। উপন্যাসটা প্রায় শেষের দিকে। আর মাত্র তিন চারদিন এভাবে লিখতে পারলেই হয়ে যাবে। গৈরিকার মন ঝরঝরে এখন। সমস্ত কিছু স্বীকার করে নিলে মনের ভার এভাবেই কমে যায়। লেখাটা শেষ হলেই বেড়াতে যাবে ওরা। সুহার্ত বলেছে। দার্জিলিং,গ্যাংটক-ডিসেম্বরের শেষের দিক। মনে হয় বরফ পড়বে। সুহার্ত বলছিল,স্নোফল দেখার সবচেয়ে ভালো সময় এটাই। স্নোফল কোনদিন দেখেনি গৈরিকা। লন্ডন,আমেরিকায় গিয়েছিল-তাও জুন-জুলাই মাস আর পূজোর সময়। শীতের দেশের বরফ দেখা হয়নি,মানে বরফ পড়তে দেখা হয়নি। কাজ মিটিয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। লন্ডনে সেমিনার অ্যাটেন্ড করে ফিরে এসেছিল,টাইট শিডিউল ছিল একদম। আমেরিকায় বেশ কয়েকটা পূজোয় উদ্বোধন,প্রবাসী বাঙালিদের সাথে নানান অনুষ্ঠান,সম্মেলনী,আড্ডায় সময় চলে গিয়েছিল,চাইলেও বেড়াতে যেতে পারেনি। ইন্দ্রনীলও বেড়াতে যেতে খুব একটা উৎসাহী ছিল না। কাজ মিটিয়ে চলে আসতেই ব্যগ্র ছিল ও। স্নোফল দেখার ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়ে ওঠেনি। লন্ডনে অবশ্য ঐ সময় একঘেয়ে বৃষ্টি ছিল। বিষাদগ্রস্ত আবহাওয়া ছিল একদম। ঘরের থেকে বেরোতে ইচ্ছা হত না। তবে স্নোফল দেখার সাধ গৈরিকার বরাবরের। বিয়ের পর হানিমুনে সিমলা যাওয়ার ইচ্ছা ছিল,টাকাপয়সার চিন্তা করেই যাওয়া হয়নি। গৈরিকা সদ্য স্কুলের চাকরি ছেড়েছে তখন। নিখিলেশের একার রোজগার,তার উপর লেখার তাগিদ-সব মিলিয়ে যাওয়া হয়নি। যাক। সুহার্তর আইডিয়াটা খেটে গেলে এবার বরফ দেখা যাবে অবশেষে। মনে মনে বেশ এক্সাইটেড হয় গৈরিকা। ভালো লাগে ওর। জীবনটাকে উপভোগ করছে আবার। বাঁচাটা খুব একটা খারাপ নয়। এখান থেকে ফিরে অনেক কাজ। নতুন লেখাটার নামকরণ করতে হবে,ভালো করে খুঁটিয়ে পড়তে হবে,জমা দিতে হবে,কলেজ জয়েন করতে হবে, “কাঁটা তারের বেড়া”র সাফল্য উদযাপন করতে হবে,নতুন বইটার প্রচ্ছদ,পাবলিসিটি প্ল্যান করতে হবে-দম ফেলার সময় পাবে না আর। সাহিত্য সভাগুলোতেও যেতে হবে। ওকে নিয়ে যেসব গুজব রটছে,সেগুলো বন্ধ করা দরকার। সশরীরে না গেলে বন্ধ হবে না। রিন্টুটার জন্যও মন কেমন করছে। রাগের বশে ওর বাবাকে লিখে দিয়ে এসেছে রিন্টুকে যেন না পাঠায়। তা আবার হয় নাকি? রিন্টুকে না দেখে ও থাকবে কি করে? তার থেকে রিন্টুকে এবার কলকাতায় নিয়ে আসবে। সুহার্ত বলছিল কলকাতার স্কুলে না পড়লে পরে কম্পিটিশনে টিকতে পারবে না। কলকাতার স্কুলে দিয়ে দেবে ওকে। রিন্টু থাকলে গৈরিকার মনটা সবসময় ভালো থাকবে। একটুও ফাঁকা ফাঁকা লাগবে না। নিখিলেশের সাথে কথাটা বলার দরকার। মুখোমুখি বসে ওদের দুজনের কথা বলা প্রয়োজন। নিখিলেশকে ফোন করবে গৈরিকা। কলকাতায় ফিরেই ফোন করবে।
অচেনা নাম্বার দেখেও ফোনটা ধরল গৈরিকা। কোন পরিচিত হতে পারে। আজকাল সবাই নতুন নতুন সিম নেয়।
-হ্যালো।
-মামণি?
চমকে উঠল গৈরিকা,সৌমি ফোন করেছে। ও নাম্বার পেল কোত্থেকে?
-হ্যাঁ,তিতির। কার নাম্বার এটা?
-মায়ের। আমি অনেক কষ্টে লুকিয়ে ফোন করছি। মামার ফোন থেকে তোমার নাম্বার জোগাড় করেছি কাল।
-মামা দিল?
-না। আমি না বলে নিয়েছি। তুমি কেমন আছ মামণি?
-এখন অনেক ভালো।
-তুমি যে থাকবে বলেছিলে? চলে গেলে কেন?
-থাকতে চাইলেই তো থাকা যায় না,তাই না?
-তুমি তো কলকাতাতেই নেই।
-তুই জানলি কি করে?
-মামা বলেছে। ভাই তোমার কাছে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়,জেদ করে। মামা ওকে খুব বকে। সেদিন নাকি মেরেছে।
গৈরিকা চুপ করে শোনে। ওর জন্য রিন্টু এত কষ্ট পাচ্ছে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও।
-মামণি তুমি চলে এস। না হলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।
-কি খারাপ হবে? কিছু হবে না। মামাকে ভাই জ্বালাতন করছিল,তাই মেরেছে। রিন্টুকে বলিস,আমি ক’দিন পরেই কলকাতা ফিরব,তখন ওকে নিয়ে আসব।
-ভাই পাশেই আছে। ভাইকে তুমি বলে দিও।
-কই? রিন্টুকে দে।
-মামণি,একটা কথা জানো?
-কি রে?
-মা,বাবা উঠে পড়ে লেগেছে মামাকে বিয়ে দেবে বলে। ঐ মেয়েটার সাথে। আর্চির মিস্। ঐ মেয়েটার মায়ের সাথে খুব ভাব। ওর মা-ও আমাদের বাড়ি আসে। ওরা বলে সামনেই নাকি বিয়ে। আমাকে বলেছে ‘মামণি’ বলে ডাকতে। আমি কিছুতেই ডাকত না!
গৈরিকা চমকে উঠল। জল তাহলে অনেকদূর গড়িয়েছে। নিখিলেশের সম্মতিতেই এসব হচ্ছে,নাকি?
-রিন্টু জানে?
-কাল শুনেছে। শুনে থেকেই মন খারাপ। কাঁদছে খুব। আমার খালি বলছে মামমামকে একটাবার ফোন করো না...
-ওকে ফোন দে।
অরিন ফোন নিল।
-হ্যালো,মামমাম...
-রিন্টু,একদম কাঁদবি না। মামমাম এই তো,চলে আসবে-আর তোকে নিজের কাছে নিয়ে চলে আসবে।
-আর বাবা?
গৈরিকা রিন্টুর মনের কথাটা বুঝল। বাবাকেও চাই ওর।
-বাবাও আসবে।
-তুমি বললেই আসবে?
-হ্যাঁ। আসবে তো।
-কবে বলবে?
-এক্ষুনি বলব।
-তাহলে বলো। আমি মিস্কে নতুন মামমাম বলব না কখনো।
-মিস্ নতুন মামমাম হবে কে বলল?
-মিস্ আর মিসের মা। পিসিমণিও ছিল।
-বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি,হবে কি না?
-বাবা খুব বকবে তাহলে। এখন সবসময় বকে। একটুতেই রেগে যায়। সেদিন ‘মামমাম যাবো’ বলতে মারল। বলল,মামমাম এখানে নেই তো কি করে যাবি?
অরিন ফোঁপাচ্ছিল। গৈরিকা নিজের চোখ মুছল।
-বাবা এখন একটু কষ্টে আছে। আমি বাবাকে ফোন করলেই কষ্ট কমে যাবে। রিন্টু বাবাকে আর ‘মামমাম যাবো’ বলে জেদ করবে না। মামমাম গিয়ে ঠিক নিয়ে আসবে,কেমন?
-ওকে। কবে আসবে?
-যত তাড়াতাড়ি পারি।
-লাভ ইউ মামমাম।
-আই লাভ ইউ টু।
ফোনটা রেখে দিল গৈরিকা না। নিখিলেশকে বলে এর একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে,এসব হচ্ছেটা কি?
গৈরিকার ফোন দেখে ভারী অবাক হল নিখিলেশ। গৈরিকা ওকে ফোন করছে কেন? রাগ কমল তাহলে? নাকি কোন বিপদ হল? ঘরে বাইরে খুব সমস্যার আছে নিখিলেশ। শিঞ্জিনী বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। দিদিও তাল ঠুকছে,আর পনেরোদিন পর বইটা বেরোবে। এ নিয়েও বেশ উৎকণ্ঠায় রয়েছে নিখিলেশ। তার উপর সারাদিন আর্চির মুখভার। জেদ করছে। সেদিন রাগের মাথায় ছেলেকে মেরেছে নিখিলেশ। রাগটা পরিস্থিতির উপর ছিল,গিয়ে পড়ল আর্চির উপর। সব কিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। যদি আর্চি না থাকত,চলে যেত এতদিনে। ভালোলাগে না আর।
-হ্যালো।
-হ্যালো।
-হঠাৎ ফোন করলে?
-ইচ্ছা হল।
-ও। ইচ্ছা হয় তাহলে?
-আমার শরীর কেমন জানতে চাইলে না তো?
-আমি জেনে কি করব? তোমার শরীরের খবর অন্যে ভালো জানে।
-অন্যের কাছ থেকে খবর নাও তাই?
-নিতাম,নিই না আর। এক্তিয়ার বহির্ভূত বলে মনে করি। অন্যের সাথে তুমি ভালো আছ,বেশ বুঝতে পারি। তা কোথায়,ডুয়ার্সেই এখনো?
-হ্যাঁ।
-লম্বা ছুটি কাটাচ্ছ তাহলে।
-চেঞ্জটা দরকার ছিল। তাছাড়া একটা উপন্যাসও লিখলাম।
-ওঃ হো! তাই তো! চেঞ্জে গিয়ে দারুণ উপন্যাস লেখা যায়। “কাঁটা তারের বেড়া” তো বাজার মাত করছে।
-পড়েছ?
-না। সময় হয়নি। তা এবারের উপন্যাসের থিম কি? সুহার্ত চ্যাটার্জী?
ইচ্ছা করেই আঘাত করল নিখিলেশ।
-সুহার্ত আমার খুব ভালো বন্ধু। তার বেশি কিছু নয়।
-হয়ে যাবে। ইন্দ্রনীল বসুর সম্পর্কেও আগে বন্ধু শব্দটাই ব্যবহার করতে তুমি। ওর সাথে থাকছ দেখো-ভালোবেসে ফেলবে।
-যেমন তুমি শিঞ্জিনীকে ভালোবেসে ফেলেছ?
-একদম। ঠিক তেমনি।
গৈরিকা আহত হল,রক্তাক্ত হল।
-সত্যিই কি তুমি শিঞ্জিনীকে ভালোবাসো নিখিল?
-কেন? বাসতে পারি না? তুমি যাকে তাকে ভালোবাসতে পারো,যার তার সাথে থাকতে পারো-আর আমি সারাজীবন লয়াল হয়ে বসে আঙুল চুষব ভাবলে কি করে? আমি তো তোমাকে কখনো প্রশ্ন করিনি ইন্দ্রনীলের কাছে কেন গেলে,কেন ওর সাথে শুতে-তাহলে আমার একটা দিনের ভুলের জন্য এত রাগ দেখানোর কি ছিল?
নিখিলেশ ওর সাথে এ ভাবে কথা বলতে পারে,গৈরিকা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। চুপ করে থাকল ও। মনে মনে গুটিয়ে গেল। কুঁকড়ে গেল। ওর সব দোষ নিখিলেশ এতদিন ক্ষমা করে এসেছে। তাহলে আজ এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে ওর ভুলগুলোকে দেখাচ্ছে কেন? তাহলে কি ও শিঞ্জিনীকে ভালোবাসে? বিয়ে করবে ভেবেই নিয়েছে?
-ভুল নয়। ভুল বললে তো মানবে না তুমি। ওটা ভুল ছিল না। আমার ইচ্ছা ছিল। আমার ইচ্ছা হয়েছিল তাই আমি শিঞ্জিনীর সাথে শুয়েছিলাম। শান্তি হয়েছে?
-এভাবে বলছ কেন?
-আর কোনভাবে বলব। একবার চলে গেলে,পাঁচপাঁচটা বছর চরমতম অপমানের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছি। আবার একদিন ফিরে এসে আশা দিলে,থাকবে বললে-আবার চলে গেলে। তুমি কি ভাবো,আমি তোমার খেলার পুতুল? অনেক হয়েছে। তোমাকে আর আমার জীবন নিয়ে খেলতে দেব না। একবার ইন্দ্রনীল,একবার সুহার্ত-ছিঃ! কান পাতা যাচ্ছে না কোথাও,লজ্জায় আমি মুখ দেখাতে পারছি না।
নিখিলেশ নিজের সব ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছিল। গৈরিকার মনে প্রত্যেকটা বাক্য,প্রত্যেকটা শব্দ গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছিল,
-শিঞ্জিনীকে বিয়ে করে নাও। লজ্জা থাকবে না আর।
-সে চিন্তা আমার। অবশ্য তুমি চিঠি লিখে সেইরকম মতই দিয়ে দিয়েছ।
-কবে বিয়ে করছ?
-দেখি।
-বেশ। বিয়ে করবেই যখন,তাহলে রিন্টুকে আমাকে দাও। আমি ওকে নিজের কাছে রাখব।
নিখিলেশ অন্যরকম উত্তর আশা করেছিল,ভেবেছিল গৈরিকার জেদের পাহাড় ও কথার বারুদে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পেরেছে। নত হবে ও। বিনীত হবে,মুখ ফুটে বলবে, “নিখিল,বিয়ে করো না।” অথচ গৈরিকা অনুরোধের রাস্তাতেই গেল না। দাবি পেশ করার বদলে অভিমানের সরণী ধরল।
-কেন তোমার রিন্টুকে তো দিয়েই গেছ। আর দেখবে না বলেছ।
-ভুল করেছিলাম। রাগের বশে ওরকম লিখেছিলাম।
-তোমার ভুল আর ঠিক তো ক্ষণে ক্ষণে বদলায় তাই না?
-আমি আমার ছেলেকে চাইছি। এটা আমার অধিকার।
-ছয়মাসের দুধের শিশুকে যে মা ফেলে যায়,তার কোন অধিকার থাকে না। শিঞ্জিনী ওকে যথেষ্ট ভালোবাসে। ভালোভাবেই দেখবে।
চরম আঘাতটা হানল নিখিলেশ। গৈরিকার সমস্ত আত্মা জুড়ে অন্ধকার নামল তখন। ডুবে গেল ও। চোরাবালিতে ডুবে গেল। ফোনটা নিজের অজান্তেই কেটে দিল। নিখিলেশ বলেই চলছিল
-আমি শিঞ্জিনীকে বিয়ে না করলেও ও দেখবে। আর্চির কোন কষ্ট হবে না। তুমি নিজের ভালোটা দেখ,নিজে ভালো থাকো। নিজের ভালোর বাইরে কিছুই তো ভাবোনি কখনো। স্বার্থপর,বড্ড স্বার্থপর তুমি...
উত্তর আসছে না দেখে ফোনটা দেখল নিখিলেশ। কেটে গেছে। চুপ করে গেল। কপালের ঘাম মুছল। বড্ড বেশি বলে ফেলেছে কি? সারাজীবনের রাগ একদিনেই তুলে নিয়েছে যেন। গৈরিকার মুখে কোন জবাব জোগাচ্ছিল না। ওর স্বেচ্ছাচারিতার শেষ দেখতে চেয়েছিল নিখিলেশ। এতবছর ধরে মুখ বুজে সব সয়ে গেছে। আর নয়। আজ নিখিলেশ যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে-তার জন্য গৈরিকা দায়ী। ও যদি চলে না যেত-তাহলে সাপের ছুঁচো গেলার মত অবস্থা হত না। না পারছে শিঞ্জিনীকে গিলতে না পারছে উগড়াতে। গৈরিকার মত আত্মহত্যার চেষ্টা করবে-তারও উপায় নেই। ছেলেটা রয়েছে। ও নিখিলেশের পায়ের বেড়ি। জীবনটাকে বিস্বাদ বলে মনে হয় নিখিলেশের। নিজেকে স্যান্ডুইচের মত মনে হয়।
পূর্বের পর্ব পরুন
সুচিন্তিত মতামত দিন