তিনি কলম হাতে যত না কথার মারপ্যাঁচ কষেন, নিজের সম্পর্কে ততটাই কম বলেন। তিনি গম্ভীর চালে ছুঁড়ে দেন কমেডি অব হিউমার এর অস্ত্রসকল। তাঁর হাতে বাংলা রম্যরচনা এগিয়ে গেছে কয়েক লাফ। তাঁর অগুন্তি রচনার সাথে পাঠক পরিচিত লেখকের নাম না জেনেই। "সংগৃহীত" পাদটীকা সম্বলিত তাঁর রচনা ঘুরে বেড়ায় ফেসবুকি আর অ্যাপস অ্যাডিক্টদের হাতে হাতে। সম্প্রতি তাঁর লেখা এভাবে চুরি হবার একটা নমুনা দিই ,
"অবনী, তাড়ি আছে?
অবনী, তাড়ি আছে?
বাপ রে! এ কী ভীষণ অত্যাচার!
থরথরাচ্ছে মজ্জা থেকে হাড় –
অবনী, তাড়ি আছে?
ঠাণ্ডা হাওয়া নাড়িয়ে দিল প্রাণ,
ওপর থেকে একনাগাড়ে হিম,
বন্ধ দু’নাক, চোখের গোড়ায় টান,
মাথায় ধরে ঝিম –
অবনী, তাড়ি আছে?
রাত্রি বাড়ে, বেড়েই চলে ক্লেশ,
লেপের ভেতর কাঁপছে সারা পাড়া,
জমাট দেহে আবছা ঘুমের রেশ,
সহসা কড়ানাড়া -
অবনী তাড়ি আছে?
[With due respects to Shakti Babu]"
আজকের আগে কজন জানতেন বলুন তো এটার আসল লেখক শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ? আজ "শব্দের মিছিল" এর পক্ষ থেকে আমরা এহেন রজতদা র মুখোমুখি। আমাদের জন্য তাঁর কলম এমন ই রসগ্রাহী থাক। গোমরাথেরিয়ামদের তাহলে আর লাফিংক্লাবের পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করতে হবে না।
⌗ শর্মিষ্ঠা - খড়গপুর আই আই টি র রাশভারী স্হপতির আড়ালে এই যে একজন দুরন্ত রসিক মানুষ বাস করেন, এই ডুয়েলিজম কি করে সামলান?
⌗ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - হা হা হা! আমার ইস্কুল কলেজের বন্ধুরা এই "রাশভারী" শব্দটি শুনলে আঁৎকে উঠবে! ওরা সবাই জানে এই শব্দটি আমার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা মুশকিল! (তবে ১৪৬, রাসবিহারী অ্যাভেনিউতে আমার নিজের প্রথম অফিস ছিল ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত, কাজেই হয়তো আমাকে রাসবিহারী স্থপতি বলা চলে।) কাজেই “ডুয়েলিজম” বলতে কিছু নেই মনে হয়।
⌗ শর্মিষ্ঠা - আপনার অনেক রম্যরচনা নাম ধাম ছাড়াই হোয়াটস আ্যাপ বা ফেসবুকে ঘুরে বেড়ায়, কেমন লাগে আপনার? কোনদিন তো স্ক্রিনশট নিয়ে বা প্রমাণ দাখিল করে তেমন প্রতিবাদ করতে দেখি নি...
⌗ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - কী আর করি! প্রথম বই বেরিয়েছিল ১৯৯১ তে, সেই বইতে ছিল -
যাও ভাই, ফোটো!
ফুল হয়ে ফুটে কোনো বাগানেতে ওঠো।
পরে সেটি (এবং ওই বই থেকে আরো কিছু ক্ষুদ্র লেখা) আমার অজান্তেই একটি ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন এক পরিচালক, বেশ কয়েক বছর পর। আমার নামের কোনও উল্লেখ ছিল না কোথাও। কিছুই বিশেষ বলতে পারিনি। সেই পরিচালকের মামা আমার ইস্কুলের প্রিয় বন্ধু, তাকে ই-মেল করে জানিয়েছিলুম, সে জবাব দিয়েছিল, “You should be proud!” লে হালুয়া!
⌗ শর্মিষ্ঠা - কাতুকুতু মার্কা চড়া দাগের মোটেই নয়, আপনার রচনা স্যাটায়ারধর্মী , চূড়ান্ত মেধার সাক্ষ্য দেয়। গুরু মানেন কাউকে?
⌗ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - গুরু বলতে দু'জন। সবার ওপরে সুকুমার রায়। তারপর অগডেন ন্যাশ। দু’জনের লেখাই সুযোগ পেলে বার বার পড়ি।
⌗ শর্মিষ্ঠা - হুতুম পেঁচা, ত্রৈলোক্যনাথ, শিব্রাম, সঞ্জীব, শীর্ষেন্দু থেকে আপনার জঁ র স্বাতন্ত্র্য চোখে পড়ে। এটা কি যুগধর্ম কেবল না কি সাহস?
⌗ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - যুগধর্ম বা সাহস কিছুই নয়। যাঁদের নাম করলেন, তাঁদের মধ্যে শিব্রাম প্রচুর পড়েছি, গুলে খেয়েছি বলা যায়, তবে বাকিদের লেখা বিশেষ পড়িনি, আমার দুর্ভাগ্য।
⌗ শর্মিষ্ঠা - অসম্ভব সমাজ সচেতন আপনার সৃষ্টি। রাজনীতিও ব্রাত্য নয়। কাউকে চটিয়ে দেবার ভয় নেই? বিশেষত চেয়ার কে?
⌗ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - এটা নিয়ে খুব একটা ভাবিনি কখনও।
⌗ শর্মিষ্ঠা - গদ্য, পদ্য দুটোতেই সমান সাবলীল। খুব পড়তেন বা পড়েন? না কি প্রভাবিত হবার ভয়ে কম কম?
⌗ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - সত্যি কথা বলতে, (সুকুমার রায়ের লেখা ছাড়া) প্রায় ৪৫/৪৬ বছর বয়স পর্যন্ত বাংলা কবিতা আমি বিশেষ পড়িনি কোনোদিন, যা পড়েছি তাও বহুদিন আগে, ইস্কুলে। সেখানেও বাংলা 2nd language ছিল, কাজেই syllabus ছিল বেশ ছোট। বাংলা কবিতা পড়া শুরু হয় ২০০৫ নাগাদ, অর্কুটে ঢুকে। তারপর অনেক পড়েছি, শিখেছি, আজও শিখে চলেছি।
গদ্য অবশ্য ছোট থেকে প্রচুর পড়েছি। বাংলা ও ইংরিজী, দুই। এখনও পড়ি। প্রভাবিত হওয়া নিয়ে ভাবি না, ভেবে লাভ আছে, তাও মনে করিনা, যা যা ভাল লাগে তার প্রভাব তো থাকবেই, জেনে বা না জেনে।
⌗ শর্মিষ্ঠা - কোন সাহিত্যিক উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন ? কোন মেন্টর?
⌗ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - সেরকম মেণ্টর কেউ নেই। লেখালেখি শুরু ১৯৮৮-৮৯ থেকে। (তার আগে মোট দুটি কবিতা লিখেছিলুম, একটি ১৯৮২ তে, আর একটি ১৯৮৫ তে।) অফিসে কাজের চাপ ওই সময় কমে গিয়েছিল, বসে বসে খাতায় হিজিবিজি লিখতুম। বন্ধুরা এলে পড়ে শোনাতুম। সেই সব লেখা থেকে বেছে নিয়ে প্রথম বই ছাপিয়েছিলেন শ্রী রঙ্গন চক্রবর্তী ১৯৯১ তে। তার ১১ বছর পর পরের বই, সেও সব কাজের ফাঁকে লেখা। তারপর অরকুটে এসে প্রচুর লেখক ও কবির সঙ্গে আলাপ হল, অনেক কিছু শিখলুম। সেখানে কেউ কেউ “মেণ্টর”এর কাজ করেছেন বটে, ছোট বড় অনেকেই।
⌗ শর্মিষ্ঠা - বাবাকে হারিয়েছেন সম্প্রতি। মনে হয়েছে আপনি খানিকটা পাপাস্ চাইল্ড । ঠিক হল কি?
⌗ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - হা হা হা! ছোটবেলায় আমার কাকারা আমাকে “ছাগল” বলত, দিন রাত “ম্যা ম্যা” করতুম বলে! কাজেই মনে হয়না আমাকে “Papa’s child” বলা যাবে।
⌗ শর্মিষ্ঠা - গ্রুপবাজি কী চোখে দেখেন? এত্ত এত্ত গ্রুপ, সিলেক্টেড সদস্য, পৃষ্ঠপোষকতা, ভালো না খারাপ?
⌗ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - এ বড় শক্ত প্রশ্ন। মানুষের ধর্মই হচ্ছে গ্রুপ বানানো। সেই নিয়েই থাকতে হয়। কিছু কিছু গ্রুপ দারুণ লাগে, বিশেষ করে ইস্কুল বা কলেজের বন্ধুদের গ্রুপ, যেখানে যা ইচ্ছে তাই বলা যায়, কোনও বাধা নেই! সেখানে যেমন বাহবা আছে, তেমন গালিও আছে, মাটিতে বাঁধা থাকার শ্রেষ্ঠ উপায়।
⌗ শর্মিষ্ঠা - আপনার প্রকাশিত বইগুলোর সম্পর্কে কিছু তথ্য দিন, নাম, বিষয়, প্রাপ্তিস্হান এই সব আর কি। অনেকেই আপনাকে না চিনেই আপনার লেখা পড়ে বা শেয়ার করে। আমার কাছেও এসেছে এমন অনেক...
⌗ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - প্রকাশিত বই :
১) আগজুবী – প্রকাশক - গ্রাফিটি (রঙ্গন চক্রবর্তী) – বইমেলা ১৯৯১
২) বোলতা বোলতা – প্রকাশক - রায় মিত্র (ইন্দ্রাণী রায়) – বইমেলা ২০০২
৩) সাড়ে পাঁচ বেলা – প্রকাশক – প্রেসিডেন্সি লাইব্রারি (সুভদ্রা দে) – বইমেলা ২০১৩
৪) নেড়ুদা – প্রকাশক – সৃষ্টিসুখ (রোহন, সৌরাংশু, অমিতাভ) – বইমেলা ২০১৬
প্রথম তিনটে বইতে পদ্য গদ্য দুই আছে। শেষেরটি গদ্য। (প্রথম দুটি বই কোথায় পাওয়া যায়, বা আদৌ পাওয়া যায় কিনা আমার জানা নেই।) এ ছাড়া Co-author with Sudip Mallik – Calcutta Compendium – publishers – Writing Inc – 2000. কলকাতার ইতিহাস, ভুগোল ও খবরাখবর নিয়ে বই।
সুচিন্তিত মতামত দিন