১।
ভোরের আলো খুব সরু হয়ে , ঋষিকার দু’ চোখের পাতা ভিজিয়ে দিল ! ঘুম ভেঙে যেতেই সে দেখল , মাথার উপর গাছেদের পাতার ফাঁকে -ফাঁকে ঝালরের মতন ঝুলে রয়েছে বিন্দু – বিন্দু আলো । সে নিজেকে বৃষের পেশী বহুল বুকের উপর আবিষ্কার করল । আগের রাতে ভয় আর ক্লান্তিতে কখন দু’চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল ! চোখ খুলতেই গত রাতের ভয়ংকর স্মৃতি তাড়া করছে । আজ নতুন কিছু ঘটতে চলেছে ।
যে অভিজ্ঞতা তারা নিয়েছে , তা সুখের ছিল না । যে অভিজ্ঞতা তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে -- তাও সুখের হবেনা । বৃষের তপ্ত বুকের ওম - ঘাড়ে , কানে এখনো উষ্ণতা দিচ্ছে । এই অনুভূতিটুকু সত্যি । টানা দুই দিন , দুটি মানুষ একসাথেই প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু উদযাপন করে চলেছে । এই উদযাপিত মৃত্যু –সময় তাদের জীবনের প্রাপ্তি । দু’জনেই পরস্পরের খুব কাছে এসে গেল ।
পাশে শুয়ে আছে বৃষ । মুখে শান্তির ছবি । এত নিরাপত্তাহীনতার ভিতরেও , নিরাপদ স্বপ্নবিলাসিতা । ঠোঁটে শেষ রাতের পরিতৃপ্তি ।
ঋষিকা নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে সেই মুহূর্তটুকু অনুভব করল । মুখে লাল ছাপ ।মনে –মনে বৃষের উদ্দেশ্যে বলল - ইস , খুব বীর পুরুষ , ভালোবাসে এই কথাটুকু স্বীকার করতে ভয় !
মাথার চুলে বিলি কাটছিল ।
বৃষ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে । উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল - অনেক বেলা হয়ে গেল !
-কত ?
-সে অনেক । কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে । তোমার শরীর ঠিক আছে ?
কথাটা শুনে মিচকি হাসল ঋষিকা । বলল – কেন শরীর খারাপের মতন , শেষ রাতে কিছু ঘটেছিল ?
বলেই হাসতে শুরু করেছে ।
বৃষের লজ্জা লাগছে । বলল – চলো , আর সময় নেই ।
বৈবস্বত মনুর রাজত্বে , এক ভয়াবহ মন্বন্তর নেমে এসেছে । তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য বিদ্রোহীরা এক গোপন আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে । তার আগে মনুর ক্ষমতাকে দৃঢ়তা দিচ্ছে যে নৈমিষারণ্য , সেখানকার ক্ষমতার উৎস জানবার জন্য বিদ্রোহীদের সংগঠন বৃষ আর ঋষিকাকে পাঠিয়েছে । এই অভিযান তাদের কাছে বেশ শক্ত । কেননা এই অরণ্যকে ঘিরে রয়েছে তিনটি অরণ্যের স্তর । প্রথম দুটো তারা পেড়িয়েছে । এখন তৃতীয় স্তরে তাদের প্রবেশ ঘটবে ।
সম্ভবত এই স্তরটিই সবচেয়ে বেশী বিপদজনক এবং মৃত্যুপ্রবণ । মুখে – মুখে প্রচলিত রয়েছে , এই স্তরটি পাহারা দেয় এক ভয়াবহ দৈত্য । অবশ্য এই দৈত্য হচ্ছে এক অদ্ভুত জন্তু । খুবই হিংস্র আর বর্বর । এতটুকুই জেনেছে তারা । এই স্তর থেকে যদি বেঁচে যেতে পারে তবেই নৈমিষারণ্যতে প্রবেশ করতে পারবে । সেখানে অনেকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গোপন কুঠুরিতে প্রবেশ করতে পারলেই , সভ্যতা সৃষ্টির আদি রহস্য জানা যাবে । ব্রক্ষ্মা প্রথমে এখান থেকেই সভ্যতার সূচনা করেছিল । আশ্রমিকদের এমন কিছু দিয়েছিল , যা আজও রহস্য । এখন দেখবার ---- এই অভিযান সেই রহস্যকে ভেদ করতে পারে কি না ?
২।
ওরা দু’জনেই এগিয়ে চলল । সামনে বৃষ কাঁধে ধনুক আর পীঠে তীর । পিছনে ঋষিকা তার কাঁধে ধনুক হাতে বল্লম । খুব ছুঁচালো । ঋষিকা বলল – আমাদের সজাগ থাকতে হবে ।
-ঠিক বলেছ । এই স্থান একদমই নিরাপদ নয় ।
-আচ্ছা বৃষ , আমরা স্বাধীন হতে পারব ?
-তা বলতে পারব না । তবে এতটুকু বুঝি , মনুর নিয়ম তার নিজের সুবিধা অনুযায়ী সৃষ্টি । এই নিয়ম শোষণের এক পন্থা । এই পন্থা বিলোপ করতে হবে । দুঃখের বিষয় , এখনো সাধারণ মানুষদের এর বিরুদ্ধে কিছুই উপলব্ধি নেই । তারা এই সব কিছুকে মেনে নিয়েছে ।
-নারীরাও পরাধীন । তাদের নিঃশ্বাস নিতে দেওয়া হয়না । স্বাধীন জীবনের জন্যই এত কিছু । আমাদের সফল হতেই হবে । আমরা স্বাধীন না হলে , মানবতার মুক্তি ঘটবে না ।
-ঋষিকা , মনুকে রাজনৈতিক দিক থেকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে পুরোহিতরা । তাদের হাতেই সমাজের সামাজিক স্বীকৃতি । ধর্মের শৃঙ্খলায় , মানুষকে পরাধীন করে রাখবার কৌশল তাদের হাতেই । আমাদের তাই ধার্মিক - সম্মানকে সামাজিক চেতনায় পরিবর্তন করতে হবে । ধর্মের পুনর্গঠন দরকার ।
-মানে ?
-দেখো , পুরোহিতরা আমাদের মতন শূদ্রদের অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছে । অথচ মনু তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে ! এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে । সমাজে নতুন কিছু শুধুই ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে আসবে না । এই পুরানো প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা আমাদের শত্রু । তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে নতুন মানসিকতাকে আহ্বান করে গঠন করতে হবে । শুধুই ধ্বংস নয় ।পরিবর্তনের অর্থ আরও শক্তিশালী কোন কিছু সৃষ্টি করা । মনে রেখো , সৃষ্টিতেই বিপ্লব রয়েছে । মুক্তি রয়েছে । ধ্বংসে কেবল অরাজকতা ।
-তুমি কখনো মানবশাস্ত্র অধ্যায়ন করেছো ?
-না । শুনেছি , বৈশ্য আর ব্রাক্ষ্মন ছাড়া এই শাস্ত্র কেউ শুনতে পারেনা । মনুর এক বিশেষ বাহিনী আছে , যারা শূদ্রদের হত্যা করে , যদি কোন শূদ্র বা নারী কৌতূহল বশত এই পাঠ নিতে আগ্রহী হয় , তাকে হত্যা করা হবে । এমন কী লুকিয়ে শুনে নিলেও মেরে ফেলবে । খুন করবে । যে শাস্ত্রে সকলের অধিকার নেই , তা কখনই মানুষের প্রয়োজনে আসতে পারেনা । শিক্ষা সমাজকে উন্নত করে । তার যুক্তির ধারেতে রক্তাক্ত হয়ে উঠবে দাসত্বের বোধ । তেমন জাগরণ দরকার । এই শাস্ত্রে দাসত্ব রয়েছে । মানবশাস্ত্র হতে পারে না ।
-আমরা পারব মুক্তি দিতে ?
-এটা খুব শক্ত প্রশ্ন করলে । মানুষের ভিতর ভয় উৎপাদন করা অপেক্ষাকৃত সহজ , চেতনার জন্ম দেওয়ার থেকে । কেননা ভয় সমষ্টিগত চেতনা , মানে সব সময় তুমি নিজে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এই অনুভূতি গ্রহন করবে , এমনটা নাও হতে পারে । লোকমুখে শুনে বা মনু কর্তৃক প্রচারিত করা হয় । তুমি খুব সহজেই ভয়কে বিশ্বাস করে ফেলবে । চেতনাকে নয় । কেননা চেতনা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উপলব্ধি । তাইতো আমাদের সমাজে পরিবর্তন করতে হলে আগে জানতে হবে , সভ্যতার অধিকাংশ মানুষকে নিজেদের মতাদর্শে বিশ্বাস করাতে হলে যে পথ মনুরা নিয়েছে , তার রহস্য ।
-সত্যি , আজ যে এত মানুষ মৃত্যুর মুখে শুয়ে আছে । দেশে অনাচার চলছে , এই সব কিছু মনুর ক্ষমতা লোভী চিন্তা ।
-মনু পরিবেশের বিরুদ্ধাচারণ করেছে । তাই দেশে এই মন্বন্তর । আমাদেরকে এই মোক্ষম সময় কাজে লাগাতে হবে । যে ভাবেই হোক না কেন , সেই রহস্যময় কক্ষ খুঁজে নিতে হবেই । নইলে আমাদের এই অভিযান ব্যার্থ ।
ওরা বনের ভিতর চলে এসেছে । চারপাশে অনেক গাছ –গাছালি রয়েছে । সূর্যের আলো থেমে – থেমে আসছিল । মনে হচ্ছে , এটাই সেই অভিশপ্ত এলাকার সীমান্ত ; যা পেড়িয়ে গেলেই মৃত্যুর অববাহিকা শুরু হবে ।
এই প্রথম , এক অজানা আতঙ্কে --- ঋষিকার ভিতরটা কেঁপে উঠল ! সে বুঝতেও পারছেনা , বিপদের চেহারা কেমন হবে !
বেশ কিছুটা পথ পেড়িয়ে , সামনে জলাশয় দেখতে পেল । ঋষিকা বলল – আগে কিছু ফল খেয়ে নিয়ে , তারপর মুখ ধোব ।
বৃষ বলল - মাথার উপরে সূর্য দেখা না গেলেও , বেশ বেলা হয়েছে বুঝতে পারছি । ক্লান্তিতে ভরে উঠেছে দেহ । একটু জল পান করতেই হবে । তুমি এখানে দাঁড়াও । বলা যায়না জলাশয়ে কোন সরীসৃপ আমাদের খাদ্য করবে বলে অপেক্ষা করছে !
-তুমি একা যাবে কেন ?
-কারণ , যদি কোন হিংস্র সরীসৃপ আক্রমণ করে , তুমি প্রতি -আক্রমণ করতে পারবে । তাই নিজেকে সজাগ রাখো । আমি আসছি ।
বৃষ খুব ধীরে –ধীরে নামছে । জলাশয়ে পা রাখবে । জলাশয় আর বৃষের পায়ের মধ্যে একটি মাত্র ধাপের দূরত্ব । এমন সময় কানে শুনতে পেল ঋষিকার চিৎকার – বৃষ ফিরে এসো ......ওটা মৃত্যু !!
আর দেখল , কানের পাশ থেকে অতিদ্রুত একটা তীর জলাশয়ের ধারে পড়তেই – তা অতি দ্রুত চুম্বকীয় টানে জলাশয়ের মাঝখানে চলে গেল । ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়ে , কিছুক্ষণ বাদেই তীরটি জলাশয়ের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে !
বৃষ ঘাবড়ে গিয়েছে । গোটা ঘটনার কোন ব্যাখ্যা তার কাছে নেই । পিছনে ফিরে এসে কাঁপতে – কাঁপতে ঋষিকাকে জড়িয়ে ধরল । নরম ঠোঁটে , উত্তেজনায় চুমু খেয়ে বলল – প্রাণ রক্ষা করলে ।
ঋষিকা , নিজের হাত দিয়ে বৃষের শুকনো ধুলো জমা মাথা বুলিয়ে দিল । বলল – এমন এক ধরণের জলাশয়ের অস্তিত্ব আমি বাবার কাছে শুনেছিলাম । এই জলাশয়ে জল নেই । জলের মতন দেখতে এক বিশেষ পদার্থ , যা ভীষণ আঠালো । কেউ নামলেই তাকে টানতে – টানতে চুম্বকীয় টানে জলাশয়ের মাঝে নিয়ে যায় । তারপর সে জলাশয়ের মাঝে চোরা বালির স্থানে হারিয়ে যায় । এরজন্যই আমি তীর চালিয়ে দেখলাম । আমাদের আগে আরও সজাগ হতে হবে ।
৩।
শেষ কয়েক ঘণ্টায় নতুন কোন বিপদ আসেনি । সন্ধ্যা নামবে , এই প্রহর চলে গেলেই জঙ্গল আচমকাই অন্ধকারে ঢেকে যাবে , তখন আরও মৃত্যুপুরী হয়ে উঠবে। যে কোন অবুঝ পদক্ষেপ , তাদের অভিযান ব্যার্থ করতে যথেষ্ট। তাই ওরা ভাবছে – আজ রাত এখানেই বিশ্রাম নেবে । আগামীকাল নতুন ভাবে শুরু করা যাবে ।
সন্ধ্যার দিকে কিছু ফল খেয়েছে । এই ফলই তাদের তৃষ্ণা মেটাতে সাহায্য করল । অত্যন্ত চতুরতার সাথে , শত্রুদের জলের জন্য হাহাকার করবার জন্য পরিকল্পিত ভাবে কোন জলাশয় স্থাপন করা হয়নি । এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে , নিষ্ঠুরতা । আশ্রমিকরা শত্রুকে বিন্দুমাত্র রেয়াত করে না । তাদের কাছে ভয়াবহতার কোন অন্তিম সীমারেখা হয়না । অবশ্য খুব চতুর আর রণকৌশলে পটু না হলে এই স্তর অতিক্রম করা যায়না ।
ওরা দু’জনে শুয়ে আছে । বৃষের বুকের উপর মাথা রেখেছে ঋষিকা । খোলা চুলে রাতের অন্ধকার মিশে আছে । বন ফুলের গন্ধ ঋষিকাকে আরও মায়াবি করে তুলছে । বৃষের নিম্মাঙ্গে কাপড় । ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন । ঋষিকার স্তন দুটো অন্তর্বাসে আচ্ছাদিত । নিম্মাঙ্গে কাপড় । মধ্যরাত ।
বৃষের চোখের দিকে চোখ রেখে , ঋষিকা বলল – তুমি জীবনে কাউকে ভালবেসেছো ?
খোলা গভীর চুলের রাশিতে নাক চুবিয়ে , বন্য ফুলের গন্ধে মেতে গিয়েছে । বৃষ বলল –হ্যাঁ
-কে !
ঋষিকার গলায় চিন্তার স্বর ।
-কেউ একজন । রাজকন্যা । যাকে পাওয়ার জন্য অনেকেই পাগল । তেমন মেয়েকে...
-কে ?
-যে আমার সাথে এসেছে , আমার কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে লড়ছে । আমার প্রাণ বাঁচালো ...
কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল – ভারী মন রেখে কথা বলতে পারো ... এই কথার ধরণ শিখলে কোত্থেকে ? শুধু যোদ্ধা নও , একজন কবিও ।
-আমি প্রেমিক । জানোনা , কবিতা লিখতে হলে আগে প্রেম করা শিখতে হয় ।
-আমার জীবনে তুমিই প্রথম ।
-ঋষি , আমার মধ্যে এমন কিছু পেয়েছ , তোমাকে আমার দিকে টেনে এনেছে ?
-হু । পেয়েছি বলেই , তোমাকে পাগলের মতন ভালবাসছি । মেয়েরা মিথ্যা – মিথ্যা ভালবাসতে জানেনা । এই ভালবাসা আছে বলেই এখন ভয় হচ্ছে খুব । তোমাকে হারাতে চাইনা ।
-সময় বলবে আমরা এক হতে পারব কি না ? তবে ঋষি , যদি আমার কিছু হয়েও যায় , তুমি এই লড়াই থামিও না । যারা শোষিত , নিপীড়িত তাদের জন্য এই জীবন একবার নয় শত –সহস্রবার দিতে প্রস্তুত । এই যে ভালোবাসা আমরা পাচ্ছি । এই পাওয়ার রেসটুকুই থেকে যাক ।
ওরা যেখানে শুয়ে রয়েছে , আগুন জ্বালায়নি । এখানে আগুন জ্বালানো মানেই বিপক্ষ শিবিরকে বার্তা দেওয়া ।
অনেক রাত । এই রাতের সীমা জানা নেই । গভীর অরণ্য ভেদ করে , চাঁদের আলো ভূমি স্পর্শ করতে পাচ্ছে না । বেশ বড় আর গভীর বৃক্ষের পাতার ভিতর থেকে যে আলো এসেছে , সে আলোয় চারপাশে ছায়া – ছায়া দৃশ্য দেখা যাচ্ছে ।
বৃষই প্রথম টের পেল ব্যাপারটা । বুকের উপর ঋষিকা ঘুমোচ্ছে । তাকে ডাক দিতেই , সে জেগে গিয়ে বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটছে । ফিসফিস করে বলল
-সে এসেছে !
-খুব কাছেই । আমার পিছনেই নিঃশ্বাস টের পাচ্ছি । সাবধান ! তুমি আস্তে – আসতে ডানদিকে গড়িয়ে নেমে যাও । অস্ত্র প্রস্তুত করো ।
বৃষ নিজের হাতে অস্ত্র নিয়ে উঠে গেল । সে টের পাচ্ছে খুব কাছেই কিছু আছে । হাত নেড়ে বলল – আর নিরাপদ নই আমরা । সে আমাদের সাথেই আসবে । চলো ...
ওরা রাতের অন্ধকারে , দুটো পাথরে ঠুকে -আগুন জ্বালিয়ে নিল । মশালটা ঋষিকার হাতে রয়েছে । সামনে বৃষ বল্লম ধরে আছে । লোহার ফলা । মনে হচ্ছে রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের বুক চিড়ে এক বিন্দু আলোর স্রোত বইছে !
অনেকটা ছুটবার পর বৃষের খেয়াল হল ঋষিকা তার সাথে নেই ! তখনই মেয়েটার চিৎকার শুনতে পেল !
৪।
না , এমন বীভৎস সরীসৃপ সে আগে দেখেনি ! দেহের উপরিভাগ কুমীরের মতন । লেজটা কাঁটা – কাঁটা বেশ লম্বা আর চওড়া । হাতের নখ অনেকটা বাঘের নখের মতনই । গোটা দেহ থেকে বিশ্রী দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে ! চোখ দুটোর দিকে তাকালেই দেহ অবশ হয়ে আসে ।
বৃষ আর সেই ভয়ঙ্কর দৈত্যটার মাঝে ঋষিকার সংজ্ঞাহীন দেহ । না , ভয় পেলে চলবে না ।
নিজের মনে বল সঞ্চয় করে বর্শাটা ছুঁড়ে দিল । দৈত্যটাও লাফ মেরেছে । বৃষ গড়িয়ে গেল ডানদিকে । অস্ত্রটা বুকে বিঁধে গিয়েছে ! তাও দৈত্যটাকে থামানো যাচ্ছে না । তার গলায় কোন চিৎকার নেই । শুধু চোখে তীব্র হিংসার বহিঃপ্রকাশ । আবার তার দিকে ছুটে এসেছে । বৃষ এইবার খুব দ্রুত তীর মারল । সে জানে আক্রমণ করবার আগেই সরীসৃপটিকে বিদ্ধ করতে হবে ।
বৃষ উঠে দাঁড়িয়ে আরেকবার ধনুকে –তীর রেখেছে । দৈত্যটা লাফ মারল ।
বৃষের বুকে যখন পড়ল , বোঝাই গেল দেহের ওজন এতটাই , মনে হচ্ছে মাটির নীচে চাপা পড়ে যাবে । এইবার সব শক্তি দিয়েও রুখতে পাচ্ছে না । দৈত্যটা মুখটা হা করে কামড়াতে আসছে । দেহের সব শক্তি দিয়ে যে প্রতিরোধ , তা ব্যার্থ হবে !
চোখ বন্ধ করে খুলতেই দেখল , বৃষের মুখে রক্ত মেখে রয়েছে । দৈত্যের মুণ্ডু কাটা । পিছনে ধারালো অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে ঋষিকা । এই লড়াইয়ের মাঝে জ্ঞান ফিরেছে ! হাঁপাচ্ছে । সে নিজেও জানত না , এক কোপে এমন মাথা নেমে যাবে ! কাঁপতে- কাঁপতে বলল – বৃষ ঠিক আছতো ? আমি দেখলাম দৈত্যটা তোমার উপর আক্রমণ করবে । নিজেকে সামলাতে পারিনি । খুব ভয়ানক জন্তু !
-হ্যাঁ , নৈমিষারণ্যের নিরাপত্তার জন্য জন্তু আর সরীসৃপের সংমিশ্রণে তৈরী করা হয়েছে ।
-এই জন্তু এখানেই থাকে ?
-আমার মনে হয় আশ্রমে ঢুকবার অধিকার এর নেই । মূলত নৈমিষারণ্যে প্রবেশের আগে তিনটি একই রকম অরণ্যের স্তর তৈরী করা হয়েছে । সেই স্তরের তৃতীয় স্তরের নিরাপত্তায় এই জন্তুটা রয়েছে । খাবারের সন্ধানে দ্বিতীয় স্তরে চলে আসে । আমাদের সাথে তাই আগে এর একবার মুখোমুখি হয়েছিল । তখন অবশ্য আমাদের সন্ধান পায়নি বলে পালিয়ে গিয়েছিল । এখন মুখোমুখি হয়ে গেলাম ! এই বনে অন্য কোন মাংসাশী নেই তার প্রধান কারন , এমন একটা জন্তুর থাকা । সেই সবাইকে খাদ্য করেছে । আমরা এই জন্তুটির কথাই শুনেছিলাম ।
আকাশে আলো ফুটছে । ওদের দু’জনের খেয়াল হল --- এতক্ষণ অরণ্যের যে বন্দী দশা ছিল তা আর নেই । বৃষ উঠে দাঁড়িয়ে বলল – আর ভয় নেই , এই সংকর প্রজাতির হিংস্র সরীসৃপটি মারা গিয়েছে । ওই দেখো ... নৈমিষারণ্যের সীমারেখা শুরু হয়েছে । মুক্তির দ্বার । ওই যজ্ঞবেদী । এসো ...
ঋষিকা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছে না ! শেষ পর্যন্ত তারা একটা মিথকে ছুঁয়েই ফেলল !
৫।
যে পথ দিয়ে তারা ঢুকেছে , তা গোপন পথ । আশ্রমের ভিতরে উপাসনায় মগ্ন সাধুদের দেখে ঋষিকা বলল – আমাদের খুব দ্রুত গোপন কক্ষ খুঁজে নিতে হবে । আর সময় নেই । পুরোহিতরা উপাসনায় মগ্ন , এখন কেউ আসবে না ।
-আমার কাছে খবর আছে , যজ্ঞ বেদীর দক্ষিণে নকশা করা স্থান রয়েছে । সেখান থেকে বাঁদিকে দশ ‘পা হাঁটলেই ... সুরঙ্গ দেখতে পাবে । এই সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে কিছুক্ষণ যেতে হবে , তাহলেই রহস্যের সমাধান । এই অরণ্যে ব্রক্ষ্মা যে গোপন জিনিসটি দিয়েছিলেন সেটি জানতে পারব ।
-তোমার কী মনে হচ্ছে ? সেই গোপন অস্ত্র কেমন হবে ?
-বলতে পারব না ঋষিকা । তবে এতটুকু বলতে পারি , তা নিশ্চই কোন ভয়ঙ্কর অস্ত্র হবে ।যা ব্যবহার করে একটা সভ্যতাকে মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করা যায় ।
-নিশ্চিহ্ন !
-নচেৎ সকলেই কেন তাদের বশ্যতা মেনে নিয়েছে । এত দ্রুত সভ্যতা বিস্তার করল । এখানকার আদি লোকেদের সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও দখল করে নিল ! আজই এই রহস্যের সমাধান ঘটবে । জানতে পারব , সেই অস্ত্রের ক্ষমতা । রূপ ।
বৃষ যজ্ঞ বেদী থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে । কাছেই সুড়ঙ্গের হদিস পেল !
-ঋষিকা , আমাদের এই সুড়ঙ্গের ধরতে হবে । এখানেই আছে সেই রহস্য । আমাদের সেই শায়িত রহস্য দেখেই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা যাবে ।
সুড়ঙ্গের ভিতরে দুজনেই নেমে , বুক উপুড় হয়ে মাটিতে ঘঁষে- ঘঁষে এগিয়ে চলেছে । সুড়ঙ্গের মুখটা অন্ধকারে ভরা । কিছুটা গিয়ে দেখল , সামনেই বেশ বড় কক্ষ । সেখানে এক অদ্ভুত জিনিস শায়িত রয়েছে । গোটা কক্ষের চারদিকে বাতিদানী রয়েছে । সেখান থেকে আলো বেরিয়ে আসছে । সেই আলোয় কক্ষটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে । বাইরে থেকে কেউ বুঝতেই পারবেনা , মাটির নীচে এমন একটা কক্ষ রয়েছে ! এই কক্ষের ভিতরেই রয়েছে সেই বহু কথিত রহস্য । লোকমুখে যা রহস্যাবৃত ।
ঋষিকা আর বৃষ কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখল , ভিতরে --- ব্রক্ষ্মার ধর্মচক্রের গোল চাকার হাল! ধাতুর । খুব সুন্দর আর অত্যাশ্চর্য ।
এই হাল চালিয়ে জমিতে ফসল ফলানো হয় । খাবার সংগ্রহ করা হয় । ওরা দু’জনে এতক্ষণ যে শক্তিশালী অস্ত্রের কথা আলোচনা করছিল , সামনে থাকা চাকাটি সেই অস্ত্র ! ক্ষিধেই মানুষের প্রাচীনতম ও প্রধান শত্রু । চাকার হাল সেই শত্রুকে মুহূর্তে হত্যা করতে সমর্থ । আধুনিক চাষাবাদের পদ্ধতি লুকিয়ে রয়েছে , নৈমিষারণ্যের এই গোপন কক্ষে । মানুষকে বশ্যতা স্বীকার করাতে হলে , তাকে ক্ষুধা মুক্তির পথ দেখাতে হবে । ব্রক্ষ্মার সেই পদ্ধতি এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে । খাদ্য উৎপাদনের জ্ঞান দেওয়ার পরিবর্তে ক্ষত্রিয়রা পুরোহিতদের রক্ষা করে । শূদ্ররা খাদ্যের জন্যই বশ্যতা স্বীকার করেছে । আর এইসব কিছু লুকিয়ে রাখা হয়েছে , শুধুমাত্র মানুষের চোখে ভগবান সাজতে । পরিত্রাতা হতে ।
ওরা দু’জনেই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল !
সুচিন্তিত মতামত দিন