আহেলীর বেড রুমের এই জানালাটা দিয়ে একটুকরো আকাশ দেখা যায়। আকাশকে ওর ভীষণ এক্সপ্রেসিভ মনে হয়। কখনও নির্মেঘ আর প্রখর সূর্যতাপ- যেন বীতশ্রদ্ধ নিত্যকার এই সূর্য, চাঁদ, তারা, গ্রহ, উপগ্রহ... সবার সাথে মানিয়ে চলতে চলতে। আবার কখনও একটুকরো মেঘ- ধীরে ধীরে সেই মেঘের রঙ বদল; যেন একটু একটু করে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে মন। কখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি- যেন অতি ধীরে বিগলিত হয়ে যাওয়া কষ্ট গুলো। আবার কখনও মুষল ধারায়- যখন নিজের মনকে কিছুতেই প্রবোধ দেয়া যায় না। কখনও আবার বৃষ্টি শেষে রংধনুর সাত রঙে নিজেকে সাজিয়ে যেন জানিয়ে দেয়; আছে! কষ্টেরও শেষ আছে- অতঃপর আছে নতুন করে বেঁচে থাকার আনন্দ।
আকাশ পারে; অনায়াসে নিজের দুঃখ গুলো শেষ শীতের ঝরা পাতার সাথে উড়িয়ে দিয়ে বসন্ত সোহাগে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে। আহেলী পারে না। তাই প্রতিদিনের অভ্যস্ত ব্যস্ততা শেষে রোজ কিছুটা সময় এই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ও আকাশ দেখে। আকাশের সুখে হাসে আর তারই দুঃখে কাঁদে। ভুলে থাকে নিজের অস্ত্বিত্বের টানাপোড়েন।
আকাশের গায়ে বিকেলের রঙ ধরতেই আজও জানালার ধারে এসে দাঁড়ায় আহেলী- রোজকার মত। একান্ত সখ্যতায় জিজ্ঞেস করে, “কি গো? আছো কেমন?” উত্তর না দিয়ে আকাশ মিষ্টি হাসে। আহেলী বুঝল, আজ সূর্যের সাথে আকাশের বেশ ভালো বোঝা-পড়া রয়েছে সকাল থেকেই।
থাক, আকাশ আর সূর্য এখন পরস্পরের সান্নিধ্যেই থাকুক কিছুক্ষণ। আহেলী চোখ সরিয়ে নেয়। ওর বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি এখন আকাশ থেকে সরে পাশের বহুতলগুলোর ধার ঘেঁষে নেমে আসে নীচের দিকে- ওদের এই সুপরিকল্পিত টাউনশিপের বাউন্ডারি ওয়ালের বাইরের রাস্তা দেখা যায় এখান থেকে। রাস্তার উল্টো দিকেই খোয়া বিছানো পথ এঁকে বেঁকে চলে গেছে জগার্স পার্ককে দ্বিখণ্ডিত করতে করতে। পথের দুপাশে সারি সারি পলাশ,কৃষ্ণচূড়ায় কেমন আগুন রঙা ফুল ফুটেছে। মাঝে মাঝে সেই আগুন রঙের ফাঁকে ফাঁকে ঘুমিয়ে আছে সোনা রঙের অমলতাস। পুরো বসন্ত জুড়ে ঘুমিয়ে থাকার পর ওর ঘুম ভাঙবে বৈশাখে।
“এখন তবে বসন্ত?” আহেলী ভাবে। সহসা মনের আকাশে শ্রাবণ নামে। স্মৃতির ক্যানভাসে নিমেষেই স্পষ্টতর হয় সময় স্রোতের আঘাতে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাওয়া দুটি অবয়ব... অমল আর কুহু। কুহুর পছন্দ অমলতাস... আর তাই বসন্ত নয়; ওর প্রিয় বৈশাখ। অন্যদিকে অমল বলে; বসন্তে প্রকৃতি এক দুর্দান্ত মেকওভার পায়... নতুন রঙ পায়... তাই-ই ওর মন কেড়ে নেয়। তাছাড়া বসন্ত মানেই তো কোকিলের কুহুতান।
-“বসন্ত আর কিছু নয়; কবি সাহিত্যকের ফ্যাসিনেশন মাত্র।” কুহু বলে, “তোর মত নিরেট বাস্তববাদী ছেলে কিভাবে বসন্তের প্রেমে পড়ে?”
-“ও তুই বুঝবি না।” তর্কে যেতে চায় না অমল।
-“বোঝালেই হল;” কুহু নাছোড়বান্দা, “বসন্ত কাকে বলে? কিভাবে বুঝব আজ বসন্ত?”
-“ফ্রান্সিস হডসন বার্নেটের দ্য সিক্রেট গার্ডেন পড়েছিস?” অমল জানতে চায়?
-“আমি বসন্ত কী সেটা জানতে চাইলাম, অমল।” বিরক্তিতে কুহুর ভ্রূ জোড়ার মাঝের দূরত্ব উধাও হয়ে গেছে।
- “বার্নেট সেখানে বলছেন, Spring is the sun shining on the rain and the rain falling on the sunshine.” অমলের ঠোঁটে রহস্যময় হাসির ঝলক।
কুহু নিরুত্তর। অমলের সাথে থাকলে কুহুর মন ময়ূরী বৈশাখের খরতাপেও কেমন পেখম মেলে দেয়। আবার একদিন অমলের সাথে দেখা না হলেই শরতের আকাশেও কেমন কালো মেঘ দেখতে পায় কুহু।
দু’তরফেরই কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর আঁজলা ভরে জল তোলার মত করে কুহুর মুখটি নিজের দুহাতের মধ্যে তুলে ধরে অমল।
-“এই-ই তো বসন্ত।” কুহুর চিবুকে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে অমল। “মনের কোণে যখন ভালোবাসার আবীর রঙা আগুন জ্বলে... তখনই তো বসন্ত আসে পায়ে পায়ে।”
অমলের চোখে চোখ পড়তেই কুহু যেন অমলের চোখের তারায় নিজেকেই দেখতে পায়; কুহুর অনুভূতিগুলো অবশ হয়ে আসে। নিজেকে হঠাৎ ভীষণ অচেনা মনে হয় কুহুর। সব যুক্তি তর্ক অর্থহীন হয়ে ওঠে, পৃথিবীটাকে নতুন মনে হতে থাকে। সেই নতুন পৃথিবীতে তখন শুধু একটাই ঋতু- বসন্ত। অজান্তেই কুহুর চিবুক বেয়ে গড়িয়ে নামে ঝর্ণা ধারা।
কুহু আর অমলের কথা মনে হতেই আহেলীর চোখেও বর্ষণ শুরু হয়। কোথায় হারিয়ে গেল সেদিনের সেই কুহু আর অমল? অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে... অথচ মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষ্যে কলেজে ‘রক্তকরবী’ নাটকটির মঞ্চায়ন করবে ওরা। প্রস্তুতি তখন প্রায় শেষ। স্টেজ রিহার্সালের প্রথম দিনে কুহু হঠাৎ বেঁকে বসল। বিশু পাগলা চরিত্রে অমলকে রাখা হলে নন্দিনীর চরিত্র ও কিছুতেই করবে না। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর জানা গেল, সিগারেটের গন্ধ কুহু একেবারেই সহ্য করতে পারে না। আর অমল চেইন স্মোকার। দুটি দৃশ্যের মাঝের সময়টুকুতে ও স্মোক করে আসে। কুহু কিছুতেই সেই গন্ধ বরদাস্ত করতে পারছে না।
-“সরি। রিহার্সালের সময় আর স্মোক করছি না। ইটস অ্যা প্রমিস।” বলেছিল অমল। কুহু মিষ্টি হেসে থ্যাংকস জানায়। সেই থেকে ওদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। তারপর থেকে আর কোনদিন স্মোক করেনি অমল।
এখান থেকেই ওদের বন্ধুত্বের শুরু। সেই বন্ধুত্ব কখন, কিভাবে, কোন জাদুমন্ত্রে দুটি বিপরীত স্রোতের মানুষকে এক করে দিল সেটি আজও রহস্যময় আহেলীর কাছে।
তারপর ঠিক কবে থেকে অমল আর কুহুর পৃথিবী আলাদা হতে শুরু করেছিল, সেও জানা নেই আহেলীর। যখন বুঝল, তখন আর কিছুই করার নেই। ততদিনে বসন্ত গুরুত্ব হারিয়েছে অমলের জীবনে। আর কুহু আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে তার স্বপ্নে, চেতনায় বসন্তকে ছুঁয়ে থাকার। অমল এখন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী- অমলেন্দু সেনগুপ্তকে চেনে না এমন লোক এদেশে খুব কমই আছে। আর কুহু? অমলের দেয়া কুহু নামটি বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে সে এখন নিজের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ায়। কুহুকে ভুলে এখন সে আহেলী। অবশ্য একাকী, নির্জনে আহেলী মুহূর্তেই ফিরে যায় তার “কুহু জন্মে।” যেখানে এখনও ভালোবাসা রঙের ফুল ফোটে সর্বক্ষণ...বসন্ত যেখানে চিরস্থায়ী।
ডোরবেল।
বর্তমানে ফিরে আসতে আসতেই দরজা খুলে দেয় আহেলী- মিসেস অমলেন্দু সেনগুপ্ত। বসন্ত ততক্ষণে অতীতের ঠিকানায় আত্মগোপন করেছে।
munmun.mukherj@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন