ইন্দ্রাণী সমাদ্দার

খোলস
ন্ধুতের বয়স তাদের নয় নয় করেও ছয় বছর। পর্ণা তিতানের স্কুলের প্রথম দুবছর কেজি আর ক্লাস ওয়ানে সে শুধু সকালটুকুই ছেলেকে স্কুলে দিয়ে যেত। বেলায় ছুটির সময় তিতানের ঠাম্মা আসতেন নাতিকে নিতে। ৭.৫০এ স্কুলের প্রথম বেল বাজার পর ছেলেকে স্কুলে দিয়েও হাতে তার অনেক সময় থাকত। অফিস সেই দশটায়। আসে পাশে বিভিন্ন বয়সের অভিভাবকদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আড্ডা চলে। বাবাদের আর দাদুদের মানে যারা নাতিকে স্কুলে ছাড়তে এসেছেন তাঁরা তুলনামুলক ভাবে মৃদুভাষী। মা,ঠাকুমা বা দিদাদের গল্পের আওয়াজে স্কুলের রাস্তাগুলো গম্ গম্ করছে।এখনে বিভিন্ন জিনিস কেনাবেচা ও চলে। অ্যামওয়ে, ওডিফ্লেম থেকে মোদিকেয়ার কী নেই। শাড়ী থেকে সালোয়ার,পর্দা থেকে চাদর –সবই আছে। আটটা বাজতে ২মিনিট বাকি । এক অভিভাবক ছেলে কে স্কুলে দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিয়েছে। তাকিয়ে দেখে পর্ণা তাঁর পিঠে স্কুলের ব্যাগ। সে তাঁর মত হেঁটে চলেছে। পর্ণা ছুটতে ছুটতে গিয়ে সেই ভদ্রমহিলা কে ডাকে। খুব সম্ভব তিতানের ক্লাসেই পড়ে এর ছেলে। পর্ণা জিজ্ঞেস করে –‘বাড়ি যাচ্ছেন? ছেলের স্কুলের ব্যাগটা ?” তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই সেই ভদ্রমহিলা বোঝেন পর্ণার ডাকার কারণ। উঁচু ক্লাসের এক পরিচিত ছাত্র ,তাঁর ছেলের ব্যাগ পৌঁছেদেয়। হিয়ার সঙ্গে সেই থেকে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব গাঢ় হয় চাকরিটা ছাড়ার পর। হিয়া রায় – মিষ্টি ছোট খাট চেহারা, স্বল্পভাষী কিন্তু স্পষ্টবাদী। পরিচয়ের প্রথম দিনই ভালো লাগে পর্ণার মেয়েটিকে।

বন্ধুত্ব গাঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে জানতে পারে যৌথ পরিবারের আজ হিয়া কেবলমাত্র গৃহবধূ। এক সময় সে চাকরি করত, ছেলের জন্য তা ছেড়েছে। আজ কাগজে কলমে সে ব্যবসায়ে যুক্ত কিন্তু সেটা কাগজে কলমেই। ব্যবসা তাঁর স্বামী দেখেন। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কনভেন্ট এডুকেটেড হিয়ার সঙ্গে প্রত্যন্ত গ্রামের টিপসই দেওয়া গৃহবধূর সেই অর্থে কোন পার্থক্য নেই। হিয়া পর্ণাকে জানায় সুখী থাকতে যা যা লাগে সবই নাকি আছে হিয়ার কাছে। হিয়া জানায়, যৌথ পরিবারে তাঁর পছন্দে সাজান ঘর, টিভি, ফ্রিজ,মাইক্রোওয়েব,এসি , বছরে দুবার ঘুরতে যাওয়া ... সুখ। হিয়ার এই ভালো থাকার সরলীকরণ ভাবতে ভাবতে মেট্রোয় চড়ে বসে। পর্ণা ভাবে সুখ কী এতই সহজলোভ্য আর বিক্রয়যোগ্য। মহানায়ক উত্তমকুমার মেট্রো স্টেশন-এর পরই নেট কানেকশান ফিরে আসে। অন্য পৃথিবী ডাক দেয়। এই পৃথিবী এই আছে, আবার এই নেই – ভার্চুয়াল জগৎ। এই জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ আছে, কিন্তু এ ডাকে সাড়া দেবে না এমন সাধ্য তাঁর নেই। পর্ণা তার সহযাত্রীদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। কম-বেশী সকলেই তাদের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। সিনিয়ার সিটিজেনের সিটে এক ভদ্রলোক আনন্দ বাজার পড়ছেন। আর ক’বছরের মধ্যে এই দৃশ্যও বিরল দৃশ্যের আওতাভুক্ত হবে। টুং করে একটি মেসেজের প্রবেশ ঘটল। পর্ণা দেখে এক রাশ সুপ্রভাতের ভিড়ে নীলের সুপ্রভাতের বার্তা ম্যাসেজ্ঞার মারফৎ। নীল পর্ণাকে চেনে সেই এক যুগ আগের থেকে। সেই দিনের পর্ণা আর জীবনের পথ বেয়ে বিবর্তিত আজকের পর্ণার অনেক ফারাক। পর্ণারা যে সময় গ্রাজুয়েশন পাশ করে সেই সময় কোথায় ছিল ফেসবুক আর কোথায়ই বা what’s app। সেই সময় ইন্টারনেটের ব্যবহার সাধারন মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল। এমনকি কারোর হাতে মোবাইল দেখলে লোকে ঘুরে ঘুরে দেখত। প্রত্যেক স্বচ্ছল বাড়িতেই সেই সময় ল্যান্ড ফোন থাকত, না থাকলে প্রতিবেশীর বাড়িতে ফোন আসত। আজকের মত ছোট্ট এক চলমান দুরভাষ মানুষকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করে সম্পর্কের স্বতন্ত্রীকরণ করেনি। সেই সময় yahoo messenger ছিল। চ্যাট করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জনপ্রিয়। yahoo messenger-এ প্রথম নীলের সঙ্গে পরিচয়। প্রায় দু’বছর চ্যাট পর্বের পর নীল কলকাতা থেকে দেখা করতে আসে পর্ণার শহরে। অনর্গল বকবক করা সমবয়সী নীলকে বন্ধু হিসেবে ভালো লেগেছিল কিন্তু নীলের বিয়ের প্রস্তাবে পর্ণা রাজি হতে পারেনি। বিয়ের মত গুরুগম্ভীর সামাজিক এক যৌথজীবনের জন্য নীলকে তাঁর উপযুক্ত মনে হয়নি। নীলের কী সেদিন বড্ড খারাপ লেগেছিল, কে জানে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পর্ণা নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। বাড়িতে ফিরে ব্যাগ বিছানায় ফেলেই পর্ণা ছুট লাগায় রান্নাঘরের দিকে। রান্না শেষ করে ছেলের খাবার নিয়ে তাকে আবার ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে।

#

আজকাল এইসময় রোজই পর্ণা রান্নার ফাঁকে ফাঁকে নীলের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে লেখালেখি চালায় কিন্তু আজ পর্ণার মনের আকাশে স্মৃতিরা বড্ড ভিড় করেছে। বিয়ের পর নীল তার জীবন থেকে স্বাভাবিক হারিয়ে গেলেও একই শহরের সহনাগরিক তারা। অর্কুটে দেখা নীলের সঙ্গে আবার লেখালেখির শুরু। তাঁরপর এখন তো সারাদিন ফেসবুক না হলে whats app। সারাদিন ফোনে বহুবার কথাও হয় তাঁদের। এখন তো আবার জিও ফ্রি অফার চলছে। পর্ণার সকাল থেকে রাত অব্দি প্রত্যেকটা মুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে নীল। মাঝে মধ্যে আজকাল এই জন্য সে অপরাধবোধে ভোগে। নীলের স্ত্রী ও একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে। সারদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা প্রতিটি মুহূর্তে পর্ণার সঙ্গে চ্যাটের মাধ্যমে নীল তার সঙ্গে থাকে, তাহলে তো তার স্ত্রী ও কন্যা অবহেলিত হয়। এর জন্য কোথাও না কোথাও সে-ই তো দায়ী। আবার মনে মনে সে নিজেই যুক্তির উপর যুক্তি খাড়া করে। রাহুলের সঙ্গে বিয়ের পর সে তো আর নীলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেনি, বরং নীলই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্কুটের মাধ্যমে। তবু ও সে চায় না তার জন্য ন্যায্য অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হোক। নীলের কাছে শুনেছে মেয়েকে নিয়ে নীলের স্ত্রী বকুল বড্ড ব্যাস্ত থাকে, আর কারোর জন্য তাঁর নাকি সময় নেই। যদিও এ সব তাঁর নীলের কাছে শোনা। তবে বহুবার বলা সত্বেও এই কয়েক বছরে নীল বকুলের সঙ্গে তাঁকে দেখা করানোর ব্যাপারে এড়িয়ে গেছে। তাই এই কথার পিঠে কথা, তার ওপর কথা যা সারাদিন চলে, হয়ত বা তাঁর কোন মূল্য নেই, কিন্তু আছে এক অদ্ভুত ভালোলাগা। এটা বৈধ নাকি অবৈধ সেটা সে জানে না। শুধু জানে দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে তাঁকে এই সম্পর্ক (যদি আদৌ একে সম্পর্ক বলা যায়) তাঁকে অক্সিজেন সরবাহ করে। মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয় নীলের সঙ্গে বিয়ে হলে হয়ত তাঁর ভালো হত। আবার এক সময় মনে হয়, যত ভাল বন্ধুই হোক না কেন, বিয়ে নামক সম্পর্কের মাধ্যমে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত হলেই বোধ হয় উভয় পক্ষেরি দাঁত, নখ বেরিয়ে পরে। সম্পর্কের মাধুর্য্য হারিয়ে যায়। তাই যা হয়েছে ভালই হয়েছে, শুধু আজকাল নীলের উপর বড্ড নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে যা ঠিক নয়, সে জানে। ইশ্, কী করল সে! শুধু ডাল আর পোস্ত রান্নাই বাকি ছিল কিন্তু উল্টোপাল্টা ভাবতে ভাবতে কখন যে সে মুসুরির ডালেই পোস্তবাটা ঢেলে ফেলেছে। এদিকে মেশিনে কাপড় ঘোরানো হয়ে গেছে, এখন মেলতে হবে। স্নানও বাকি, ওদিকে ঘড়ি ছুটছে ।





#

রাহুল পর্ণার স্বামী। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শখ, বই আর অতীতের স্মৃতির অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো। না হলে টিভিতে খেলা দেখা। সরকারী চাকুরে সে। দশটা-পাঁচটার অফিস বাদ দিয়ে বাড়ির বাইরে বেড়ানো, তার একদম না-পসন্দ। ছুটির দিন মানে তার কাছে বেলা এগারোটা অব্ধি ঘুম। তারপর ঘুম থেকে উঠে মিনিটে মিনিটে চা খাওয়া। তারপর ইচ্ছে হলে কমপ্লেক্সের মাঠে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা। বাড়ি ফিরে স্নান করে মন চাইলে দুপুরের খাবার খাওয়া না হলে আবার কোনও না কোনও বই-এ ডুবে যাওয়া। এই ভাবেই দিব্যি কাটছিল তাঁর জীবন, কিন্তু বাবা–মা বিয়ে বিয়ে করে তাঁর মাথাটা খারাপ করে দেয়। রাহুলের সেই ছোট্ট বেলা থেকে প্রেমিকা সংখ্যা নেহাত কম ছিল না, কিন্তু কোন প্রেমই তার খামখেয়ালির জন্য টেকেনি। পর্ণাকে প্রথম দর্শনেই তাঁর পছন্দ হয়েছিল এমন নয়। পর্ণা সুন্দরী নয়। সে চুপচাপ সবার কথা শুনছিল, জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিচ্ছিল। রাহুলের সঙ্গে যাওয়া আত্মীয়রা গান শুনতে চেয়েছিল পর্ণার কাছে। পর্ণা জানায়, গান তাঁর বড় প্রিয়। শুধু নিজের ভালোলাগার জন্য সে গানটা গায়, কোনও অনুষ্ঠান বা কারও সামনে নয়, তাই সে গানটা আজও গাইবে না। উত্তরটার মধ্যে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল, যা রাহুলের ভালো লেগেছিল। বিয়ে হয়ে যায় তাদের। তার একান্ত নিজের ঘরে ভাগ বসে। রাহুলের এতদিনের পরিচিত সিঙ্গল খাটের বদলে ডবল খাট, ড্রেসিং টেবিল আর আলমারি ঘর দখল করে। তার এত দিনের চেনা ঘরকে অচেনা লাগে। ওদিকে মুখে না বললেও সে ঠিক বোঝে পর্ণা বিয়েতে খুশি নয়। প্রথম প্রথম সে রাহুলকে তাঁর মনের মত গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু সফল না হওয়ায় প্রাইভেট ফার্মে চাকরিতে যোগদান করে। নিজেকে এক অদ্ভুত নিস্পৃহতার মোড়কে ঢেকে ফেলে। তারপর স্বাভাবিক নিয়মে তিতান আসে তাঁদের জীবনে। সারা বাড়ি আনন্দে ভাসতে থাকলেও পর্ণা তার সঙ্গে একটা দুরত্ব রেখে আজও চলে। আজকাল প্রায়ই রাহুলের মনে হয় এই সম্পর্কের গুমোট কেটে গেলে বড্ড ভালো হয়। যদিও এক সময় সে পর্ণাকে বড্ড অবহেলা করেছে। এখন তাঁর নতুন এক শখ হয়েছে। পর্ণা কাছাকাছি না থাকলেই পর্ণার ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করে, শুধু কী তাই ফেসবুকে পর্ণাকে কে লাইক দেয় বা কে কি মন্তব্য করল সে দিকে তাঁর সতর্ক দৃষ্টি। ম্যাসেঞ্জার ঘেটে দেখেছে নীল নামে একজন সারাদিন লেখে। পর্ণাও তাকে উত্তর দেয়, কিন্তু এই নিয়ে অশান্তি করার মত কোন লেখা সে খুঁজে পায়নি। আর তাঁর নিজেরও তো ফেসবুকে কম বান্ধবী নেই। এই সেদিনই তো শার্টের পকেটে ছিল কে এফ সি-র রিসিট। রাখীর সঙ্গে খেতে গিয়েছিল সে। রাখী তাঁর ফেসবুক বান্ধবী। এই প্রথম দেখা। পর্ণার হাতে রিসিটটা দেখে বুকটা ধক করে ঊঠেছিল, মনে মনে কথার পিঠে কথা সাজাচ্ছিল জবাবদিহি করবে বলে, কিন্তু পর্ণা শুধু বলে, শার্টের পকেটে পেলাম ফেলে দেব, নাকি রাখবে? শূধু এটুকুই বলেছিল। মুখ দেখে রাগ, কষ্ট, খারাপ লাগা- কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। বড্ড রাগ হচ্ছিল রাহুলের নিজের উপর।

পর্ণার আজও স্কুলে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে। সকালে হিয়াকে বলেছিল নিউ মার্কেটে যাবে কিন্তু আজ সময়ে কুলাবে না। এদিকে ফোন বেজেই চলেছে। রিসিভ করে দেখে নীলের ফোন ... “ এ্যাই দেরী হয়ে গেছে! ছুটছ নিশ্চয়ই? সাবধানে যাও। ফোনটা ব্যাগে রেখে হাঁটা শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে সে ডায়েল করে হিয়াকে। হিয়া জানায় সে বেড়িয়ে পড়েছে বাড়ি থেকে ।পর্ণাকে নিউমার্কেটের দিকে এগিয়ে যেতে বলে সে। যেখান থেকে তাঁরা রোজ অটো ধরে। আজ আর পর্ণার নিউমার্কেট যাওয়া হবে না। অটোর কাছে আসতে না আসতেই হিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। হিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে আসছে অটোর দিকে।

#

হিয়ার যৌথ পরিবারের বাড়িতে কাজের লোকের কাজ করার প্রচলন নেই। বাড়ির বউয়েরা বাড়ির গৃহস্থালির সমস্ত কাজ করে। ছেলেরা বাড়ির কোন কাজে অংশগ্রহণ করেনা। এমনকি হিয়া যখন চাকরি করত তখন ও সকালে বেড়োনোর আগে তাঁকে বাসন মেজে ,ঘর ঝাড় দিয়ে,মুছে বেড়োতে হত। আর রাতে বাড়ি ফিরে সবার জন্য রান্না করতে হত। দুপরে হিয়ার জা রান্না করত আর রাতে হিয়া। কোন কোন দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে রাত নটা হলেও সে দেখেছে সবাই তাঁর জন্য বসে আছে। সে রান্না করবে তাঁর পর সবাই রাতের খাবার খাবে। এমনকি তাঁর স্বামী সায়ন কোনদিন বলেনি যে “এত দেরী হল আসতে আমি বরং বাইরে থেকে রাতের খাবার টা নিয়ে আসি” । হিয়ার সঙ্গে সায়নের বহু বছরের প্রেম। প্রায় সাত বছর। তাঁর পর তাঁদের বিয়ে হয় বাড়ির অমতে। হিয়ার মা-বাবা কোনোদিন ই এই বিয়ে মেনে নেন নি। অনেক করে বুঝিয়ে ছিলেন, হিয়ার পক্ষে এদের সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। বিয়ের এক বছরের মধ্যে হিয়ার মা ও বাবা মারা যান। মনে মনে হিয়া সে জন্য নিজেকেই দায়ী করে। হিয়ার কাছে বিয়ের পর চেনা মানুষ সায়ন অচেনা হয়ে যায়। তবে এই চেনার থেকে অচেনায় উত্তোরণে সময় লেগেছিল। ততদিনে সে গৃহকর্মে নিপুণা হয়ে ওঠে। চোখে প্রেমের কাজল অনেকটাই ফিকে হয়ে যায় । তত দিনে সে বুঝতে পারে আবেগের বশে জীবনে মস্ত ভুল হয়ে গেছে। ভুল টা শুধরে সে মা -বাবার কাছে ফিরে যাবে ভেবেছিল । তাঁর এই ভুলের ক্ষত কে তাঁকে জীবন ভর বয়ে নিয়ে যেতে হবে সে জানত কিন্তু যেটা জানত না জীবন আর তাঁকে ভুল সংশোধনের সুযোগ দেবে না। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মা-বাবা প্রায় কয়েক মাসের ব্যবধানে মারা যান। এত বড় পৃথিবীতে তাঁর নিজের বলে আর কেউ রইল না। তাই অগত্যা সে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্কগুলো কে আঁকরে ধরে । বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁদের পুত্র সন্তান হয়। আর্য হওয়ার পর ও হিয়া বছর দুই চাকরি করে কিন্তু ছেলেটাকে সে বডড কম কাছে পায়। এত বড় পৃথিবীতে তাঁর নিজের বলতে শুধু তাঁর আত্মজ। সে মনে মনে ঠিক করে চাকরিটা ছেড়ে দেবে। চাকরি ছাড়ার কথা সায়ন শোনার পর প্রথম কিছুদিন সে হিয়া কে বোঝায় যাতে হিয়া চাকরি না ছাড়ে। সায়নের ব্যবসা কোন স্থায়ী রোজগার নেই। সে হিয়াকে বোঝায় আজ ব্যবসা থেকে ভালো আয় হচ্ছে কিন্তু কাল নাও হতে পারে তাছাড়া তাঁদের সন্তানের জন্য এখন অনেক খরচা –ভালো স্কুল আর আনুসাঙ্গিক কত কিছু আর সেই দায়িত্ব খনিকটা হিয়ার ও তো আছে। যদি হিয়া প্রথম থেকে চাকরি না করত তাহলে এক কথা ছিল কিন্তু দুম করে চাকরি ছেড়ে দেওয়া একদমই ঠিক নয়। আবেগে প্রেম চলে কিন্তু সংসার নয়। আর সায়ন যেহেতু তাঁর স্বামী তাই তাঁর মতামতই শেষ কথা বলে সায়ন জানায়। হিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে যায় । এতদিনে সে সায়নের আসল স্বরূপ জানা হয়ে গেছিল বলেই ভাবত কিন্তু সেটা যে কত বড় ভুল ধারনা ছিল, সে আজ বুঝল। হিয়ার সেলারি অ্যাকাউন্টের এটিম টা সায়নের কাছে নয় হিয়ার কাছেই থাকত কিন্তু মাসের প্রথমেই কিছু সামান্য টাকা যাতায়াত আর হাতখরচা হিসেবে রেখে বাকি টাকা সায়ন কে দিয়ে দিত সেরকমই কথা হয়েছিল সায়নের সঙ্গে হিয়ার। ভবিষ্যতের সঞ্চয়ের জন্য এই টাকা জমা হবে এরকম কথাই হয়েছিল দুজনের মধ্যে । একদিনের জন্য ও হিয়া কোনো হিসাব চায়নি সায়নের কাছে। ওর মনেও হয়নি যে হিসাব চাওয়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে। কিন্তু আজ তাঁর মনে হচ্ছে সন্তানের ভালোভাবে দেখাশুনোর চেয়েও হিয়ার চাকরি সায়নের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ । মুখোশের আড়ালের আসল মানুষটাকে চিনতে হিয়ার বড্ড দেরী হয়ে গেল। অনেক অশান্তির হলেও হিয়া চাকরীটা ছেড়েই দিল। তাঁর কাছে ছেলেকে মানুষ করাই জীবনের একমাত্র ব্রত হল। শ্বশুর শাশুড়ির কাছে অবশ্য শুনতে হয়েছে সে বড্ড কুড়ে। ঘর সংসার আর ছেলে সামলে মাঝে মাঝে তাঁকে সায়নের ব্যবাসার কাজ ও সামলাতে হয়। সায়নের অনেক ব্যবসায় হিয়ার নামেই চলে কিন্তু এই পর্যন্তই। মতামত প্রকাশে বা তাঁর নামে ব্যবসা বলে তাঁর কোনও আর্থিক স্বাধীনতা নেই। তাঁর এখন মনের সবটা জুড়ে তাঁর ছেলে আর্য। তাঁকে মানুষের মত মানুষ করাই তাঁর জীবনের ব্রত। পর্ণার সঙ্গে বন্ধুত্ব তাঁর জীবনে অন্য মাত্রা এনেছে। এমন একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু সে পেয়েছে যাকে মনের ভিতরকার কষ্ট গুলো বলা যায়। পর্ণার সঙ্গে কথা বলে তাঁর মনের ভার লাঘব হয়।

#

আজ পর্ণা আর তিতান দুজনেই মেট্রোএ বসার জায়গা পেয়েছে। এখন পুজোর ভিড়ের জন্য তিতান কে মেট্রোতে ওঠার পর এক দু- স্টেশন পর বসতে পারলে ও পর্না বসতে পেরেছে এরকম কম দিন হয় ।একএকদিন একপিঠে বইএর ব্যাগের বোঝায় পিঠ যন্ত্রনায় টনটন করতে থাকে ,সে চাতক পাখির মত এদিক ওদিক তাকায় যদি কোনও সিট ফাঁকা হয়। আজ অবশ্য সে সমস্যা নেই বরং তাঁর সহযাত্রীদের বসার ধরন দেখে তাঁর কেন জানি মনে হয় এরা রোজ মেট্রোয়ে চড়েনা। এরা যেভাবে বসে আছেন অনায়াসে আরো দুজন তো বসতেই পারবে। নেতাজী ভবন থেকে দুজন উঠলেন। তাঁর মধ্যে একজন বেশ বয়স্ক আর আরেকজন কলেজ পড়ুয়া। হঠাৎ শুনি এক কন্ঠস্বর আমার সিটের বিপরীতে এক হিজড়ে বসেছিল। সে বলে “তোদের ঘরে বুড়ো মানুষ নেই ।তোরা ঠিক করে সরে বস আর ওই মাসিকে বসতে দে” ওরা সরে বসে আর বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসেন। তখন আরেকজন বসার মত জাগয়া ছিল। সেই হিজড়ে এবার কলেজ পড়ুয়াকে বলে “ জায়গা আছে তো বস নারে ” উত্তরে কলেজ পড়ুয়া বলে “ আমি বসব না । আমি দাড়িয়েই ঠিক আছি। ” হিজড়ে বলে “আমি তোকে বসতে বলেছি , কোমরে বেশী জোর হয়েছে না ”মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে সিটে বসে পরে। স্নেহ বা ভালবাসার থেকে ভয় কি বেশী শক্তিশালী – কে জানে । আমার খুব ভালো লাগে হিজড়ে টিকে - তাঁর মানবিকাতা ,জীবন থেকে শেখা শিক্ষা স্কুল কলেজের তথাকথিত শিক্ষাকে হার মানাবে।

মেট্রো থেকে নেমে অটোয় উঠতে না উঠতেই রাহুলের ফোন ছেলে ঠিক আছে তো, রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি তো – এই জাতীয় সব প্রশ্ন। রোজই এই ফোন টা আসে আর এই জাতীয় প্রশ্ন থাকে। কখন জানতে ইচ্ছে করে না পর্ণা কেমন আছে ! হ্যাঁ জিজ্ঞেস করে মাঝে মাঝে আর যেদিন জিজ্ঞেস করে সেদিন একবার না বারবার । দীর্ঘ এত বছরের অভিজ্ঞতায় সে তখন বুঝতে পারে কোন ব্রেকআপ ঘটেছে রাহুলের জীবনে আর যতদিন না আর কাউকে পাচ্ছে ততদিন পর্ণার প্রতি অঝোরে এই ভালবাসা বর্ষিত হবে। তবে এর স্থায়িত্বকাল খুব বেশী হলে চারদিন আর কম হলে একদিন। পর্ণার মাঝে মাঝে নিজেকে সবার থেকে আলদা মনে হয়। স্কুলে দেখে সবাই না হলেও বেশীভাগ মহিলারাই নিজের স্বামীকে অনেকটা নিজের সম্পত্তির মত মনে করে । কে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে সেটা তাঁদের কাছে একটা বড় ব্যাপার। পর্ণা জোর করে অধিকার টা চাপাতে পারলা না বলেই কি তাঁদের দুজনের এরকম সম্পর্ক , কিন্তু পর্ণার মনে হয় যে তাঁকে ভালোবাসেনা শুধুমাত্র তাঁদের বিয়ে হয়েছে বলে তাঁকে নিয়ন্ত্রিত করবে বা অধিকার ফলাবে সেটা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব না। কোথায় যেন তাঁর ভিতরের শিক্ষা তাঁকে এই কাজ করতে বাঁধা দেয়। এই ভাবেই তো চলল এতগুলো বছর ,বাকিটা নয় এই ভাবেই চলে যাবে।

#

রাহুল আজকাল পর্ণার কাছেই ফিরতে চায় । পর্ণা বহুবার জানিয়েছে তাঁদের জীবনে যা যা স্বাভাবিক নিয়মে আসার কথা ছিল সেরকম কিছু হয়নি। রাহুল মনে মনে স্বীকার করে ভুল তাঁর আর ফেরার তাগিদ ও তাঁর আছে কিন্তু পর্ণার একরাশ অবহেলা সে মেনে নিতে পারে না। তাই পর্ণার সামনে যে কথা বলবে না ভাবে সে কথাই সে বলে ফেলে। আসলে সে বড্ড অগোছালো আর ভারসাম্যহীন এক মানুষ। তাই যতবারি সব ঠিক করতে চায় আরও গণ্ডগোল হয়ে যায় আর ভার্চুয়াল জগতের হাতছানি তো তার আছেই। আর আছে অগণিত বান্ধবী। তাই সে ঠিক করেছে ,যেভাবে চলছে ঠিক সেভাবেই চলুক ।অনেকের থেকেই তাঁরা ভালো আছে। একটা সম্পর্কের অদৃশ্য বন্ধন তাঁদের আছে। এই ভাবেই চলুক যৌথ জীবনের বাকি পথটুকু।

indranisamaddar5@gmail.com




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.