আমোদিনীর জিহবা সতত শানিত। সে কাহাকেও ছাড়িয়া দিয়া থাকে না। তাহাকে কেহ সামান্যতম হেলা করিলে তাহাকে সে সমুচিত উত্তর দিয়া তবে শান্ত হয়। তাহাকে এই কারনে সকলে ভয় পাইয়া থাকে আবার কেহ কেহ এড়াইয়া যায়। মাধববাবু অবশ্য তাহাকে স্নেহ করিয়া থাকেন।তিনি সকল কে একথাও বলিয়া থাকেন যে, “ আমোদ কোনোদিন আদর পায়নি ,ভালোবাসা পায়নি তাই অমনি করে। আসলে আমোদ খুব ভালো মেয়ে”। আমোদিনী ওই অহেতুক স্নেহের কারনে মাধববাবু যাহা বলেন তাহা মানিয়ালয়। তিনি আদেশ করিলে সেই কাজ প্রানপাত করিয়া শেষ করিয়া থাকে। আমোদিনী সাধুখাঁ কে আপনারা বর্ধমানের চালকলে দেখতে পাবেন।তাহার পরিবারের তিন পুরুষ এই চালকলের সেবায় নিয়োজিত।তাহাদের পরিবারের সকলের কাজের জায়গা এই চালকল। তাহারা মাধব বাবুর কাছ হইতে বেতন পায়। উহাই পৃথিবী। আমোদিনীর ভগিনী দিগের উপযুক্ত বয়সে বিবাহ হইয়া গিয়াছে। আমোদিনীর হয় নাই। তাহার পুরুষালী শরীর,শ্রীহীন মুখমন্ডল,সৌষ্ঠবহীন গমনাগমণ, আর শানিত জিহবা কাহারও হৃদয়ে আঘাত করে নাই। সে ধানের বস্তা অনায়াসে মাথায় লইয়া পুরুষ শ্রমিকদের ন্যায় বহন করিয়া থাকে। হাতের তালু দুইখানি পায়ের চামড়ার ন্যায় শক্ত। মাতা তাহাকে ফেলিয়া এক সুদর্শন শ্রমিকের সহিত চলিয়া গিয়াছে।তাহার তখন অবোধ বয়স। ভগিনীরা তাহাকে কোলে লইয়া চালকলের উঠানে বসিয়া থাকিত। পিতা আর বিবাহ করে নাই। ওই পরিশ্রমশীল মানুষটি কে দেখিয়া আমোদিনী ও পরিশ্রম শিখিয়াছে, বিশ্বস্ততা শিখিয়াছে কিন্তু সুক্ষ জীবনবোধ তাহার জাগেনি।সে পিতা কে লইয়া সদা চিন্তা ভাবনা করিয়া থাকে।কিন্তু পরিবারের আর কারো সাথে তাহার কোনরূপ হৃদ্যতা নাই।তাহার ভগিনীরা তাহাদের স্বামীদের লইয়া ঘন ঘন তাহাদের অতি ক্ষুদ্র কুটিরে আগমন করিয়া থাকে। তাহারাও পিতার স্নেহের কাঙালি। আমোদিনী কে লইয়া তাহারা চিন্তিত হইয়া নানান শঙ্কা মনে পোষণ করিয়া থাকে। কিন্তু আমোদিনীর দাপটে কেহ তাহাকে আচরণ কিঞ্চিৎ মধুর করিবার কথা বলিতে সাহস করিয়া থাকে না। সে সশব্দে পদচারণা করিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া নানবিধ কর্ম করিয়া বেড়ায়।
তাহার ধমকের দাপটে শিশুগুলি মাতামহের বাড়ি ছুটি কাটাইতে আসিয়া আনন্দহীন হইয়া পড়ে। ভগ্নীপতিরা অতি গোপনে ধুম্রপান করিয়া থাকে।“যে হারামজাদা ছাই ফেলে নোংরা করবে তাকে এই ঝাঁটা হাতে ধরিয়ে দেবো। নিজের বাড়ি পেয়েছ?” বলিয়া চিৎকার করিয়া পাড়ার সকলের কর্ণ গোচর করিয়া দ্যায়।কিন্তু সে উপার্জন করিয়া সমগ্র অর্থ পিতার হাতে তুলিয়া দেয়।তাহার কাছে কেহ কিছু চাহিয়া ফিরিয়া যায় না। সে নিজে না পারিলে মাধববাবুর কাছ হইতে ঠিক ব্যাবস্থা করিয়া দিয়া থাকে। হাসপাতাল যাইতে হইলে মহিলা শ্রমিকরা তাহার কাছ হইতে অসামান্য সাহায্য পাইয়া থাকে। তিনপ্রস্থ শাড়ী-সায়া-ব্লাউজ,হাওয়াই চটি আর শীতকালের একখানা চাদর ভিন্ন আর নিজের বলিতে কিছু তাহার নাই।হিসাব সে বুঝিতে সক্ষম কিন্তু অর্থে তাহার লোভ নাই তবে নিখুঁত কর্ম তাহাকে খুব আনন্দ দিয়া থাকে।
পিতা জরাগ্রস্ত হয়ে পড়িতেছেন। তিনি আমোদিনী কে পাত্রস্থ করিবার প্রবল চেষ্টা করিতেছেন।মনিব মাধববাবু কে একদিন অন্তস্থলের দুঃখের কথা বলিয়া ফেলিলেন। মাধব বাবু মন দিয়া শুনিয়া মৃদু হাস্য করিয়া বলিলেন,আমোদিনীর উপযুক্ত এক পাত্র তাহার কাছে আছে। কিন্তু তাহার বিষয়ে আলোচনা তিনি আমোদিনীর সহিত করিবেন।আধুনিক সমাজে এইরূপ ভাবেই আলোচনা হইয়া থাকে। মাধব বাবুর স্ত্রীর বৃক্কে কর্কট রোগ হইয়াছে। আর বেশী দিন বাঁচিবে না। পুত্রদিগের বিবাহ হইয়াছে। তাহারা কলিকাতা শহরে থাকে। তিনি তাহার চালকলের বিপুল সাম্রাজ্য লইয়া থাকিবেন। একটি শক্তিশালী সেবাদাসী থাকিলে বড় সুবিধা হইবে। কুশ্রী হইলে এই অথর্ব বৃদ্ধকালে কোনরূপ অসুবিধা হইবে বলে মনে হইতেছে না। গোপনে একটিপ সিঁদুর কালীবাড়ি তে পড়াইয়া দিলেই হইবে। পুত্রদের সম্পত্তি বুঝাইয়া দিবেন। তাহারা টাকা ছাড়া আর কি কারনেই বা সম্পর্ক রাখিয়া থাকে। বৃদ্ধকালে শয্যাগত হইলে আমোদিনী যত্ন করিবে-এই ভাবিয়া একটু তন্দ্রা আসিল তাহার।
ডাক্তার পিয়ালি সমাদ্দার কে আমোদিনী খুব পছন্দ করিয়া থাকে। দৃপ্ত অথচ মৃদুভাষী, আকার শীর্ণ অথচ পাহাড়ের ন্যায় ব্যক্তিত্ব। তিনিও আমোদিনী কে বুঝিতে পারেন। সে যে শঠতা অভ্যাস করিতে পারে না তিনি জানেন। তাঁর চেম্বারে আজ রোগী বিশেষ নাই। বাহিরে আসিয়া দেখিলেন আমোদিনী চুপ করিয়া বসিয়া আছে। “কি রে আমোদ? এখানে মশার মধ্যে বসে আছিস কেন?”আমোদিনীর মুখ খানি ম্লান। “ এত্তু দরকার ছিল ডাক্তার দিদি।” আমোদিনী এক নিঃশ্বাসে বলিয়া উঠিল। অবস্থার গুরুত্ব বুঝিয়া তিনি ভেতরে তাহকে লইয়া আসিলেন।“ আমি বিবাহ করবো না গো দিদি” মাটিতে বসিয়া সে ক্রন্দন করিতে লাগিল।“ আমি ওই সব ঢঙ করতে পারবো না। আমাকে ভয় দেখাচ্ছে আমার কাজ খেয়ে নেবে। আমি নাকি ভিক্কে করে লোকের দরজায় ঘুরে ঘুরে বেড়াবো। আমি খেটে খাবো। কারো বাঁধা মেয়েছেলে হব না দিদি। আমায় বলে কিনা ফ্যানের হাওয়া খাবি। ভালো মন্দ খেতে পাবি। গাড়ি চেপে ঘুরে বেড়াবি। শাড়ি দিবে, গয়না দিবে। ওই সব আমি লিবো না গো দিদি। আমি বাবার সাথে থাকবো। আমি কিছু চাহিছি না গো দিদি।” “ঠাণ্ডা হ্ আমোদ, করতে হবে না তোকে বিয়ে।কাঁদিস না।” জলভর্তি গেলাস তাহার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পিঠে হাত দেয় ডাক্তার দিদি। “তোর মত মানুষের কাজের অভাব হয় কখনো, কিছু চিন্তা করিস না”।
যদি বর্ধমান বাসস্ট্যান্ডে নামিয়া সামনের সবপেক্ষা বড় প্রসুতিসদন টিতে কখনো যান।দেখিতে পাইবেন আমোদিনীকে,সর্বদা ব্যস্ত। পুরুষ সেবকদের চাইতে দ্রুত গতিতে সে চলাফেরা করিয়া থাকে। যে কোন জটিল ও জরুরী অবস্থায় সে সচেষ্ট হইয়া থাকে। কেহ লুকাইয়া বিড়ি ফুঁকিলে, চিৎকার করিয়া ওঠে ,“যে হারামজাদা ছাই ফেলে নোংরা করবে তাকে এই ঝাঁটা হাতে ধরিয়ে দেবো। নিজের বাড়ি পেয়েছ?”
niveditaghosh24@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন