তুষার কান্তি দত্ত

সাহেবগঞ্জ - রাজমহল
09162080014....এই মোবাইল নম্বর টা বৈজনাথের। স্টেশন চত্বর থেকে বের হতেই, হাতের ডানদিকে অটো স্ট্যান্ড। গতকাল অটো স্ট্যান্ড থেকেই বৈজনাথের নম্বরটা নিয়েছি। কিন্তু আজ সাতসকালে এই নম্বরে ফোনটা ধরল সীতারাম। সীতারাম সামান্য কথাও খুব উচ্চ স্বরে বলে। গলায় ভোজপুরী মেশানো অদ্ভুত হিন্দি। সাহেবগঞ্জের আকাশগঙ্গা হোটেলের চেক আউট করে আমরা তখন বের হচ্ছি। কালো রঙ এর ছোট্টখাট্ট চেহারার সীতারাম দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের মুখে। গুটখায় ভর্তি মুখে সারল্যের হাসি। সীতারামই আজ আমাদের ড্রাইভার। আমাদের অটোর কোনো নম্বরপ্লেট নেই।

সত্যি বলছি, নম্বরপ্লেট তো দুরের কথা অটোর সামনের কাঁচটা পর্যন্ত নেই। একে তো সামনের কাঁচ নেই, তার উপরে বেশ ভালই স্পীড। গায়ে একটা টিশার্ট, ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে....।

দক্ষিণে মালভূমির টানা শৈলশিরা, নদী সমান্তরালে। অন্যদিকে গঙ্গার বিস্তৃত প্লাবনভূমি। গাড়ি চলছে সোজা পশ্চিমে, যাচ্ছি তেলিয়াগড়হি ফোর্ট। ফোর্টের পাশেই রক্ষীস্থান। দেবী মায়ের মন্দির । সাহেবগঞ্জ থেকে সকাল ৮টায় রওনা দিয়েছি। রাস্তার দুপাশে সবুজ মাঠের লালিত্য নষ্ট করে যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে পাথর ভাঙ্গার শিল্প। ধুলায় ভরে যায় গা, মাথা, ব্যাগ, মোবাইলের স্ক্রিন। মহাদেবগঞ্জ, বড়ি-কোদরজন্যা, করমতোলা স্টেশন পেড়িয়ে কিছুটা আসতেই একটা শিমূল গাছের ধারে ছোট্ট একটা মাঠ। সীতারাম গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করতেই নেমে পড়লাম আমরা। পিঠে ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলাম সিতারামের সাথে। ফাঁকা জায়গাটাতে আমাদের গাড়িটা পড়েই থাকল। রেললাইন পার করে আমরা হাঁটা দিলাম রক্ষীস্থানের দিকে....। এটা দেবী মায়ের মন্দির। মায়ের কোন মূর্তি নেই এখানে। প্রকান্ড এক বটগাছে তলায় মায়ের থান। গাছ ভর্তি লাল কাপড়ে মোড়া ইঁটের টুকরো ঝোলানো।

পাহাড়ের গা দিয়ে স্পারের উপর প্রসারিত উত্তর-পূর্ব রেলপথ। পূর্বে মালদা, পশ্চিমে ভাগলপুর। রক্ষীস্থান থেকে তেলিয়াগড়হি ফোর্ট যাবার রাস্তা স্পারের উপর দিয়েই। ইতস্তত ছড়ানো প্রস্তর। বনতুলসি, কাঁটাগাছ, বাবলা আর লম্বা ঘাসের জংগল বাঁচিয়ে পথ চলা। রাধাচূড়া গাছের মাথায় গুলঞ্চ, তেলাকুচো আর ধুন্দুল এর ঝোপ। রেল লাইনের নড়বড়ে পাথরে পা রাখতেই পা টলমল করে।

সাহেবগঞ্জকে কেন্দ্র করে দু দিনে ঘুরে নেওয়া যায় -- ভাগওয়া কুঁয়া, তেলিয়াগড়হি ফোর্ট, রক্ষিস্থান, মহারাজপুরের মতি ঝরনা,কানাইয়াস্থান, শিবগাদি,বিন্দুবাসিনী, ভোগানাদি - পঞ্চকাঠিয়া, উধওয়া লেক বার্ড স্যাংচুয়ারী আর মঙ্গলহাটের সম্রাট আকবরের আমলের জামি মসজিদ।

জংগলের মধ্যে ধ্বংস প্রাপ্ত তেলি জমিদারদের দুর্গ। স্থানীয় গ্রানাইট পাথর আর ইঁট নির্মিত। পরবর্তী কালে সাহাজাহান এর আমলে তেলি জমিদাররা ইসলাম কবুল করে। পাহাড়ের উঁচু থেকে করমতোলা স্টেশন দেখা যায় ছবির মত। বসন্তে গাছে গাছে শিমূলের রক্তিম পরশ।

চড়া রোদ, আবার এসে বসি অটোতে, স্টার্ট দেয় সীতারাম। ধুলো উড়িয়ে ছুটে চললো আমাদের অটো। আজ দোল পূর্ণিমা। মনে মনে একটা ভয় ছিল। ভেবছিলাম বিহার- ঝাড়খন্ডের এসব জায়গায় কত না রং খেলে লোকে! কিন্ত সত্যি বলতে কি, প্রতিদিনের কঠিন জীবন সংগ্রামে এদের জীবন বর্ণহীন। যতটুকু পেরেছে প্রকৃতিই রং ঢেলেছে আপন খেয়ালে। গঙ্গার পাশ দিয়ে সাহেবগঞ্জ পার করছি। শ্মশান ঘাট পেরিয়ে কিছুটা এসে দেখি একজায়গায় আখড়াতে কীর্তনের আসর বসেছে। খোলা নাটমঞ্চ। অটো থেকে নেমে, কিছুক্ষনের জন্য মিশে গেলাম ওদের ভোজপুরী গানে। মন্দিরের সামনে একটা অশ্বত্থ গাছ। লাল সাদা সুতায় পেঁচানো কান্ড। ধূপকাঠি, ফুল, বাতাসা, প্রদীপ আর আবীর নিয়ে বসে আছে এক দোকানী। সামনেই ফাঁকা মাঠ। গুটি কয়েক ভক্ত মাথা দুলিয়ে কীর্তনে সুর মেলাচ্ছে।

ভোজপুরী গানের সুরে মিশে যায় বাঁশির ধুন....আমাদের ব্লুটুথ সাউন্ড সিস্টেমে তখন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার "রিভার"। মালভূমির প্রান্ত দিয়ে গঙ্গা ছুঁয়ে ছুটে চলছি মহারাজপুরের দিকে। মহারাজপুরের প্রধান আকর্ষণ মতি ঝরনা। মতি ঝরনা পাহাড়ের উপরে। মূল রাস্তা ছেড়ে হাতের ডানদিকে হ্যান্ডেল ঘোরালো সীতারাম। বেশ কিছুটা উঁচুতে উঠে এসে ঝুড়া বালিতে চাকা গেল আটকে। নিরুপায় হয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাত লাগাই। সীতারাম আবার স্টার্ট দেয়, আর আমরা পেছন থেকে ঠেলি।

কিছুক্ষন উপরে উঠতেই দূর থেকে দেখতে পেলাম ঝরনাটা কে। গত ১৬ বছরে পুরো জায়গাটাই বদলে গেছে। পাহাড়ের গা কেটে বানানো হয়েছে মন্দিরের গর্ভগৃহ। পাহাড়ের দেওয়ালে আঁকানো মন্দিরের নক্সা। ঝরনার জলকে কংক্রিটের দেওয়ালে আটকে পাড় বাঁধানো জলাশয় বানানো হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য রেস্ট হাউস আর ভিউপয়েন্ট করা হয়েছে পাহাড়ের গায়ে। গ্রানাইট শিলা আবহবিকারে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে টর ভূমিরূপ সৃষ্টি করেছে জায়গায় জায়গায়।

জলাশয়ের সিঁড়ি তে ব্যাগ দুটো রেখে, গামছা জড়িয়ে নেমে গেলাম ঝরনার নীচে। শান্তি.... ঠান্ডা ধারায় অখন্ড শান্তি। মনে হচ্ছে কতদিন পর ঠান্ডা হলাম। উপরে জলপ্রপাতে ঠান্ডা জল, নীচে খাঁজকাটা পাথর। জলের ধারা নেমে আসছে ৭০-৮০ফিট উপরে থেকে। বেশীক্ষন দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।

তেলিয়াগড়হি ফোর্ট দেখে রওনা দিয়েছি সকাল ৯টায়। এখন দুপুর ১২টা। স্নান করে গা মুছছি। প্রসাদীর থালা হাতে এগিয়ে এলো নিরেন দাস- মন্দিরের কেয়ারটেকার। প্রণামী বক্সে ১০০টাকা দিল প্রবীর। খুব খিদে পেয়েছে। সকালের কেনা কলা, বিস্কুট সব শেষ। শুধু জল পড়ে আছে এক বোতল।

খাড়া ভৃগু। পাহাড়ের গা বেয়ে যেখান থেকে ঝরনার জল নামছে, সেখানে যাওয়া যায় ঘুর পথে। এখান থেকে ওঠার কোন উপায় নেই। মালভূমির উপরের পাহাড়িয়াদের গ্রাম। গ্রামের নাম মান্ডাই। মহারাজপুর থেকে ৪কিমি। মান্ডাই থেকে দারকাল্লা আরো ২ কিমি। ঝাড়খন্ডের আদিবাসী মানুষজনের বসবাস গ্রাম দুটিতে। হাতে সময় থাকলে দারকাল্লা থেকে বাঁনঝি'ও চলে যাওয়া যায়। দারকাল্লা থেকে বাঁনঝি বড়জোর ১০ কিমি হবে। মাঝে সহর্সা বলে আরো একটি পাহাড়ি গাঁও পরে রাস্তায়। তবে রুক্ষ মালভূমির এই অঞ্চল প্রচন্ড তেতে ওঠে দুপুরবেলা। তাই দুপুরবেলা যাতায়াত না করে সকাল ও সন্ধ্যে বেলাতেই ট্রেক করা ভালো। ঝরনার ধারা ছাড়া রাস্তায় আর কোন জলের উৎসও নেই। তাই যাবার আগে পর্যাপ্ত জল থাকাটাও বাঞ্ছনীয়।

আজ ৩রা মার্চ। সকাল ১১টা।

কানাইস্থানের ঘাট থেকে উঠে এসেছি উল্টো দিকের চরটা তে। শঙ্কর ভাইয়া আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল সমস্তিপুর,সুয়াপুর, কানাইস্থান আর নুরপুর। গুগল ম্যাপে লোকেশন বাটন ক্লিক করতেই ভেসে উঠল প্রকান্ড চরটা। পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত এই চরের দুপাশ দিয়ে গঙ্গা দুটি শাখায় বিভক্ত। চরের উত্তর-পশ্চিমে গদাইয়ের চর(বিহার) আর পূর্ব দিকটা ভুতনি(প:ব:)। ভাঙ্গাগড়ার পট পরিবর্তনে গঙ্গার এই অববাহিকার মানচিত্র গত একশ বছরে অনেক পাল্টে গেছে। শঙ্কর ভাইয়া ছোটবেলায় গঙ্গার দক্ষিণ খাতকে অনেক বড় দেখেছে.... কিন্তু কালের পরিবর্তনে মূলগঙ্গা আজ সরে গেছে উত্তরে। সাহেবগঞ্জ থেকে সোজা প্রসারিত গঙ্গা রাজমহল পাহাড় ধাক্কা খেয়ে একটা বাঁক তৈরি করেছে। কালের প্রবাহে হয়ত কোন এক দিন গঙ্গার এই ধারা অশ্মখুরাকৃতি হ্রদ হয়ে হারিয়ে যাবে মূল নদী থেকে। প্রবাহিত জল থেমে যাবে বদ্ধ জলায়। কড়া রোদে এসব ভাবতে ভাবতে হাটছি। চরের ঠান্ডা কাদা মাটিতে পা দিয়ে এক অদ্ভুত নরম অনুভূতি। ঘাস জমি কোথাও খুব ঘন। পা দিতেই স্পঞ্জের অনুভব। লম্বায় প্রায় সাত কি.মি। চওড়ায় কোথাও তিন, কোথাও এক কি.মি। আড়াআড়ি এক কি.মি. চলে এসেছি। কড়া রোদ থেকে বাঁচতে পঞ্চি মন্ডলের বাড়িতে এসে উঠেছি। বাঁশের চাটাইয়ের দেওয়াল, খড়ের ছাউনি। ইতিমধ্যে রাস্তায় আলাপ হয়ে গেছে নিরঞ্জন মন্ডলের সাথে, নিরঞ্জন মন্ডলের একপাল গাই, আর কিছু ভেড়া। পশুপালন করেই দিন কাটায়। যতদূর চোখ যায় ধান, খেসারি, শর্ষে, তিসির গাছ। সবুজ প্রান্তর... । বর্ষায় চরের অনেকটাই ডুবে যায়। অতিরিক্ত আদ্রতার কারণে চরের অনেক জায়গাই এখন ফাঁকা ঘাস জমি। নিরঞ্জন মন্ডল এখানেই গাই চড়ায়। আর কিছু দিন পর শুরু হবে খরালি চাষ। তখন অরহর কালাই, পটল, ঝিঙে, লাউ, তরমুজ ফলবে চরের ভেজা মাটিতে।

পঞ্চির বাড়ির সামনে বসতেই, পঞ্চি এগিয়ে দিল পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি চানাচুর মাখা। নিরঞ্জন এগিয়ে দিল ঠেকুয়ার মত একধরণের খাবার। আর আমরা বের করলাম ব্যাগ থেকে জল। দেখতে দেখতে আরো দু একজন জড়ো হয়ে গেল আমাদের দেখতে। আমরা কারা? কোথা থেকে আসছি? কেন এসেছি এসব জানতেই ওদের ঔৎসুক্য। আমাদের দেখে ওরা সত্যিই অবাক। আমরা যে শুধু ঘুরতেই এসেছি, কিছুতেই ওদের বুঝাতে পারি না....। ভাগ্যিস শঙ্কর ভাইয়া সাথে ছিল।আমরা কানাইস্থানে উঠেছি শুনে আবেগের ভক্তিরসে গদগদ হয়ে সদানন্দ যাদব শুনিয়ে দিল, কৃষ্ণ বিরহে রাধার কষ্টের কি যেন একটা গানের দুই কলি। আমরা তখন ব্লুটুথ সাউন্ড সিস্টেমে শুনছিলাম, রশিদ খানের "করম কর দ্বিজে খাজা মঈনুদ্দিন"। সদানন্দের গান শুনে ভাল না লাগলেও মুখে তা প্রকাশ করতে পারলাম না। কথায় আছে না.... "Act as a Roman, while you are in Rome"

হাটা পথে আরো দুই কি.মি পাড়ি দিয়ে চলে এসেছি গঙ্গার মূল নদীখাতে। প্রায় আট মিটার উঁচু স্পার। পুরোটাই কাদামাটির। জলের ধাক্কায় ধাক্কায়, কাদামাটির দেওয়ালে অজস্র ফাটল। সাহস করে নেমে পড়লাম আমি আর প্রবীর। নীলচে সবুজ ঠান্ডা জলে হাত দিয়ে সে এক অপূর্ব স্বর্গীয় অনুভূতি...

শঙ্কর ভাইয়া তাড়া লাগায়। ফিরতে হবে অনেকটা পথ। ঘাটে এসে নৌকাতে উঠি। শঙ্করের ছেলে পঙ্কজ আর ভাইপো প্রীতম ধরাধরি করে নামিয়ে দেয় একটা বাঁশের পাটাতন। কাদা থেকে বাঁচতে পাটাতনের উপর দিয়ে নৌকায় উঠি। ভটভটি ইঞ্জিনে স্টার্ট দেয় শঙ্কর ভাইয়া...পশ্চিম দিগন্তে অস্ত রবির লাল আভা।

খুব ভোরে উঠেছি আজ। নাটমঞ্চের কীর্তন জানান দিচ্ছিল ভোর সাড়ে চারটা। আধবোজা ঘুম ঘুম চোখে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা অন করে দেখলাম ঘড়িতে ৪টা বেজে ৪৫ মিনিট। কোন মতে ব্যাগ গুছিয়ে চলে এলাম ভীমের চায়ের দোকানে। অত সকালে রাস্তায় কোন অটো নেই। চা বিস্কুট খেয়ে অপেক্ষা করছি। এমন সময় বাইক বের করে ভীমই আমাদের পৌঁছে দিল, তালঝাড়ি স্টেশনে।কানাইয়াস্থান থেকে তালঝাড়ি ৬কিমি।স্টেশনে নেমে একশ টাকার একটা নোট বকশিস হিসেবে এগিয়ে দিতেই হাসি মুখে ফিরিয়ে দিল ভীম।

মানুষগুলির এত সারল্য ছেড়ে কিছুতেই ফিরতে ইচ্ছে করছে না প্রতিদিনের হিসেবী জীবনে....

tarai.tushar@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.