ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়াটাই চিরকালের নিয়ম। পুরো পৃথিবী জুড়ে। বিয়েতে বাবার দেওয়া পেল্লাই খাটের উপর বসে তৃষা, অনেকটা ছিটমহলের মতনই। বেশ তৃষ্ণার্ত। পাশের মানুষটা উঠে পড়ে সকাল হলেই। কত ধরনের অভ্যাস সুদীপ্তর।
জয়সলমীর, অনেক দূরের শহর। সেখান থেকে আজকের দিনে ফোন আসবে কখনও কল্পনাও করতে পারেনি তৃষা। নিজের বাড়ি এখন এটাই। বাপের-বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই আর। সারাটা জীবন বাবা সুপারভাইজার পদে চাকরি সামলে, চারটে ছেলে আর তৃষাকে মানুষ করেছে। অর্থের অর্থ খুঁজতে খুঁজতে পাঁচটা আঙ্গুল আর কোনদিন সমান হল না। দশটা বছর মা এখানেই ছিলেন, সুদীপ্ত কোনদিনও কিছু মনে করেনি, দশটা বছর শাশুড়িকে অফিস থেকে ফিরে সাথও দিয়েছে। একেবারে যেন মা আর ছেলে....দাদাদের সাথেও একইরকম যোগাযোগ, তবে সেটা টেলিফোনে। ফোনটা সুদীপ্তর ফোনে এলেও কথা ছিল। তৃষার ফোনে, তাও আবার মিনিট দশেক টানা কথা হল। দাদা ভাইরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে....আজ দোলের দিনটা এ বাড়িতে বেশ কিছুটা বেশী রঙিন ভাবেই পালন হয়। সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবিতে সুদীপ্ত মধ্যমনি। সেটা অবশ্য ওর সকলের সাথে মেশার ক্ষমতা....তবে তৃষাকে আজ জোর করবে না কেউই। ছেলে আর মেয়েটা বড় হচ্ছে, বাবার বন্ধুও হয়ে উঠেছে বেশ, তৃষাও তাই নিশ্চিন্ত। চিন্তা শুধু ওদের জন্য বাসা বেঁধেছে...একসাথে ওঠা বসা করা মুখগুলো কেমন থাকে, কে জানে!
প্রথম দু-মিনিট মেয়েটা যা যা বলেছে তাতে গলা শুকিয়ে যাওয়ারই কথা, আর সেই কারণেই ফোনটা ছেড়ে এত তেষ্টা পাচ্ছে। ভাইয়াও কোনদিন জানতে দেওয়া তো দূরের কথা, ওর বন্ধুরাও কখনও একটা শব্দ বলেনি মেয়েটাকে নিয়ে। বাকি আট-মিনিট, সব কথা বলেনি বলে মনে হচ্ছে তৃষার, মেয়েটা আবার যদি ফোন করে....বারবার এই কথাটাই ঘুরে ফিরে একেবারে চোখের সামনে আর কানের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে।
নিজের পরিচয় যত কম দেওয়ায় যায় ঠিক ততটাই দিয়েছে সে। কয়েক ঘন্টার বসন্ত উৎসব, যত না রঙ ছড়ায়...মন জড়ায় তার থেকে অনেক অনেক বেশী। সামনে যে দিনটা আসছে তার একটা ছবি পাঠাতে হবে তাকে। যদিও বলেছে আর কোনদিন ফোনও করবে না। সেইসব কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেয়ে চলেছে সমানে। ঘুম ভাঙলেই ভাইয়ার মুখটা প্ৰথম ভেসে ওঠে এই ক'দিন, আর উঠবে নাই বা কেন? ভাইয়ার ওপরেই তৃষা, ওর ওপরে তিন দাদা। বে-ফাঁস কথাটা তৃষাই বলে বসে আছে, আর কথার মধ্যে কত কথাইতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, ঠিক সেরকম ভাবে এটাও বেরিয়ে গেছিল, " না না ফোন কেন করবে না! তুমি না করলেও আমি করবো তোমাকে। তুমিওতো অনেককিছুই জান...আমাদের কিছু সাহায্য হলেওতো হতে পারে।" নাম একবারের জন্য উচ্চারণ করেনি মুখ দিয়ে, শুধু যেটুকু কথা না বললেই নয়। কি অদ্ভুত প্রয়োজন মেয়েটার, তার নিজের জীবনের জন্য যেন, আর দিদি হয়ে দিল্লিতে থাকা ভাইয়ের জন্য কান থেকে ফোনটা নামাতেই পারেনি তৃষা। " আমাদের যোগাযোগ মনে হয় কেউই জানতো না। কোনদিন তোমাকেও কিছু নিশ্চই বলেনি?" " বললে তো আমি তোমাকে চিনতে পারতাম!" গলার কম্পন একবারের জন্যও তৃষাকে বয়স মাপতে দেয়নি আর এরকম অপরিচিতার সাথে প্ৰথম পরিচয়ে অনেক প্রশ্ন মুখে এলেও থামিয়ে রাখতে হয়, " তোমাদের পরিচয় কতদিনের?" " কলেজ-ইউনিভার্সিটি", " কলেজ লাইফ থেকে..", " বললাম তো!", এমন ভাবে কথপোকথন চলছিল যা তৃষার মোটেই এই সাত-সকালে ভাল লাগছিল না, " আমাকেও কিছু বলতে দাও।" " লাইফ শব্দটা সরিয়ে রেখে কথা বল, ওটা তোমার ভাই কোনদিন নিজের ভেতর প্রবেশ করতে দেয়নি। আজ আর জোর করে ওকে ভাবতে বসিও না, কে জানে হয়ত আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে। বাংলায় কি যেন বলে? কর্মবীর... ও তো তাই।" কান্না থামাতে পারেনি তৃষা, " রেস্ট আফটার ডেথ, এইতো ছিল ওর স্লোগান।" " বিশ্রাম পাচ্ছে এটাই ওর শান্তি। কাঁদছ কেন! কল্পনার জগতের মানুষ ছিল কিনা...আমি লেডিস হোস্টেলে জানলা ধরে গান গাইতাম, পাশের বয়েজ হস্টেলে গান কি ভাবে পৌঁছত জানি না। পরের দিন আমাকে নিজের আঁকা ছবি দিত....জানলা ধরে আমি গান গাইছি, চারিদিক অন্ধকার, আর থাকতও তো তাইই....কল্পনায় বড় আনন্দ অনুভভ করত। আমার সাথে কল্পনায় জড়িয়ে রেখেছিল নিজেকে...আর জান আমি কখনই ওকে ফোন করতাম না, ওই আমাকে করত, কল্পনায় আর কত ছবি এঁকেছে কে জানে!" " আমাদের বাড়ি আসনি কেন কোনদিন?" সরাসরি প্রশ্ন তৃষার। " আজতো এলাম। প্রয়োজন নিয়েই তো এলাম তোমার কাছে। আমাকে পাঠিও কিছু ছবি কিন্তু! "
" আমি তোমাকে নিশ্চই পাঠিয়ে দেব, কিন্তু কেন রাখতে চাইছ নিজের কাছে? প্রয়োজন কিসের? এ সব না রাখাই তো ভাল! " " তুমি এত দূর থেকে আমার প্রয়োজন টা বলে দেবে। এই জয়সলমীর শহরটার অনেক কিছুর প্রয়োজন আছে, জান কি ? " " একটু ধর ফোনটা, আমাকে একটা ওষুধ খেতে হবে, " একবারের জন্য ফোনটা কান থেকে নামিয়েছিল তৃষা, সকালের ওষুধটা শুকনো গিলেছিল জোর করে। " আমি জয়সলমীর শহরে থাকি। আগামীকাল তো হোলি, তবুও আজ আমার চোখের সামনে বসন্ত উৎসব, বিশ্বাস কর দিদি ফিরে ফিরে আসে আমার কাছে প্রতিবার। প্রয়োজন বলছিলে না, সামনের দিনগুলোর জন্য চাইছি...",
নিস্তব্ধ হয়েছিল দু-প্রান্ত, দুটো প্রাণ, পরমুহূর্তে দু-দিকের তাগিদেই আবার শুরু করেছিল কথা......তৃষা না গেছে জয়সলমীর, না গেছে দিল্লি। কেমন দেখতে শহর টা কে জানে! সোনার কেল্লা আছে....মরুভূমি আছে, উট আছে, পাগড়ি আছে....ভাইয়া চেপেছে উটের পিঠে,পেছনে তৃষা আর সুদীপ্ত, ছেলে মেয়েগুলো আরও দুটো উটে। বহ্নিশিখা আলাদা একটা উটে। ভাইয়ার উটটা ক্রমশ অন্যদিকে চলে যাচ্ছে...অন্ধকার নামছে। পায়ের শব্দ নেই, ডুবন্ত সূর্য কখনও কখনও ঢেকে যাচ্ছে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা লম্বা উটের মাথায়...এত চিৎকার করছে সবাই কিছুই স্পর্শ করছে না ভাইয়াকে। কোথা থেকে মা বসন্তের গান ধরেছে, আজতো সেই গান গাওয়ার দিন...বাবা নেই শুধু। অনেক দূরে আছে বাবা, একটা উচুঁ বালির ঢিবি, তার ওপর একটা মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে, ভাইয়াকে দেখল একবার। দেখতে পেল কি না, বুঝতে পারছে না তৃষা....শুধু দেখতে পাচ্ছে টিম টিম করা কিছু আলো তাও অনেক দূরে...
কথার শেষে শেষেই সুদীপ্ত জলের পাইপের খোঁজে হন্তদন্ত হয়ে একবার ঘরে ঢোকে..." ওঠ এবার তৃষা, বাথরুম সার। সবাই উঠে পড়েছে।"
" একবার কাছে এস সুদীপ্ত। একটা কথা বলব। "
" বল, " কাঁধে মাথাটা রাখে। " বল কি বলবে! "
" ভাইয়ার শ্রাদ্ধ যখন চলবে আমার কিছু ছবি তুলে দিওতো। বনী, টোটন আর বহ্নিশিখা কে....."
" কি , ওদের কে কি ? "
" না না কিছু না। ছবি তুলে দিও কিছু। "
" মনটা শক্ত কর তৃষা। আমি ঠিক সময়ে স্টেশনে গিয়ে ওদের নিয়ে আসব। ওঠ, উঠে পড়।"
" জান দিদি জয়সলমীরে আলুপোস্ত পাওয়া যায়।"
" নাম তো বললে না, কান থেকে ফোনটা নামিয়ে হয়ত ডিটেলটা চেক করব, তবু জিজ্ঞেস করি আর কি কি পাওয়া যায়?" ফোনের স্ক্রিন দেখে তৃষা।
" এখানকার সব গাইড কে এক লাইন বাংলা বলতে শুনতে পাওয়া যায়।"
" আর কি কি? "
" সত্যজিৎ রায়ের নাম শুনতে পাওয়া যায়। মুকুলের ঘরটা....আর সীজনে অনেক অনেক বাঙালি। "
" ভাইয়াকে দেখতে পাও না? "
" এটা আমার হোয়াটসআপ নম্বর নয় দিদি। তোমার ভাইয়ের সেই নম্বরও আমি জানি না....শুধু গলা শুনেছি। আর..."
" আর কি? আর বালি? মরুভূমি দেখতে যাও না? "
" আজ যাব। আজ মরুভূমিই তো আমার কাছে আবীর। নানা রঙের আবীর। "
indreposedghosh@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন