ভাস্কর চাটার্জী

ভাস্কর চাটার্জী
ভাষা মনের ভাব প্রকাশ করে বলে জেনে এসেছি।কিন্তু মনের কতগুলি ভাব প্রকাশ করতে ভাষা যে এত দুর্বল তা আগে টের পাইনি।মানে বাংলার পাঁচটা, ইংরাজির আটটা পদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি নিয়ে যে বাক্য তৈরি করে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি।যেমন প্রিয়জন বিয়োগের পর মনস্তাপ,শোক, প্রকাশের জন্য লেখক, সাহিত্যিক, কবি,ভাষাবিদ থেকে আম মানুষ শব্দ সমাহারে যে বাক্য দিয়ে মনভাব প্রকাশের ব্যাবস্থা করে গিয়েছেন,তা যেন কিছুতেই ভুক্তভোগীর যন্ত্রনাময় অনুভুতিটাকে স্পর্শ করতে পারেনা।হাহাকার করা মন,শূন্য হয়ে যাওয়া হৃদয়,বুক খালি করে চলে যাওয়া,চরম একাকিত্ব, শোকে পাথর, চোখের জল বাঁধ মানেনা,- প্রিয়জনের চির বিচ্ছেদ শোক বোঝাতে এ ধরনের শব্দ সমাহার যেন অনেকটা নিজ মুখে স্বাদ,গন্ধ গ্রহনের বদলে, সিনেমায় লোভনীয় বিভিন্ন পদ দেখে,ক্ষিরের স্বাদ স্যাকারিন জলে মেটানোর মতন হয়ত বা।ঐ সব শব্দ দিয়ে ভুক্তভোগীর হাহাকারি হৃদয়কে অনুভব করা যায়না।ভুক্তভোগী যা অনুভব করে তা একটা সিনথিসিস কে অনুসরণ করে বলে বোধ হয়।সে ছিল,আর সে নেই। চরম বাস্তবঅস্তিত্ব আর অবিশ্বাস্য অস্তিত্বহীনতার মধ্যে সংঘাতে তৃতীয় এক ভয়ংকর হৃদফাটা অনুভুতি তৈরি হয়।যেটা মনে হয় ডায়ালেকটিসের তত্ব মেনে চরম সংঘাতে সিনথিসিসের মতন কিছু।আরও বলা যায় দুখ,কষ্ট, যন্ত্রনা, আক্ষেপের মিশেলে তৃতীয় এক এমন অনুভুতি যা বাংলা বা ইংরাজি ব্যাকরণের বিখ্যাত পদগুলি দিয়ে প্রকাশ করা অসম্ভব বলে আমি অনুভব করেছি।পরিশীলিত, উচ্চ চিন্তার অধিকারী মানুষ ঐ সব শব্দের রূপ কল্পনা করে অনুভুতির কেন্দ্রে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সে অনুভুতি প্রকাশ করতে সেই চির ব্যাবহৃত শব্দ গুলির বাইরে সাধারণত যায়না তারা। আমাদের মতন সাধারণ মনের জন্য কবি,সাহিত্যিক, দার্শনিক, উপকথা, লোককথাকার,ধর্মতাত্ত্বিক,চলচিত্র কারেরা বহু উদাহরণ, বহু উপমা,মন্তাজ,মেটাফরের ব্যাবহার করবে।অধিকাংশ পদ ব্যাবহার করেও এই নৈর্ব্যক্তিক অনুভুতি ছোঁয়া বা প্রকাশ করা যাবেনা। অন্তত ভাষার তথাকথিত গুরুত্ববাহী বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়াপদ দিয়ে এ অনুভুতির পঁচিশভাগ রাস্তাও অতিক্রম করা যাবে না।

তবে ভাষায় চির অবহেলিত, সবচেয়ে গুরুত্বহীন একমাত্র পদ অব্যয় দিয়ে এই মনভাবের অন্ততপক্ষে পঁচাত্তর ভাগ প্রকাশ সম্ভব। কারণ সম্ভবত অব্যয়ই (ইংরাজির INTERJECTION)সৃষ্ট ভাষার আদিমতম রূপ। যা শক্তিশালী অবচেতন মনের অনুভুতির আদি ( RAW)প্রকাশ। উহঃ,আহঃ,হায়,আঃ,আ আ,হা-হা-হা, ওহঃ, এসব অব্যয় পদের সাথে, মা,বাবা, ভগবান,আল্লা,গড,গুরুজীর মতন বিশেষ্যপদ যোগ করলে আরো একটু এগিয়ে মনের অনুভুতিগুলি বের করতে সবিধা হয়।ওঃ মাগো, ওহঃ বাবা,হায় ভগবান,হায় বা ইয়া আল্লা, ওহঃ গড,ওয়ায়ে গুরুজী। 

এখন ভাবছি,এত শক্তিশালী একটা পদকে আমরা ব্যাকরণে কি তুচ্ছরূপে পড়েছি,লিখেছি। মাস্টারমশাইরাও ঠিক তেমনি হেলাফেলা করে অব্যয় পদ কে শিখিয়েছন। যার কোনো ব্যয় নেই সেটাই অব্যয়। উঃ,আঃ,হায় এলাজ,হুররে, এসব হচ্ছে অব্যয় বা INTERJECTION উদাহরণ। অথচ বিশেষ্য, বিশেষণ, বিশেষ করে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াপদ ( লেখক,কবি,সাহিত্যিকদের কাছে ঢের বেশী গুরুত্ববহ বিশেষণ, সর্বনাম কখনো অব্যয় ও।ক্রিয়ার সঠিকভাবে প্রয়োগ কে তারা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়) কে পড়ুয়াদের ঠেসে শেখানো ছিল তাঁদের গুরুগত কর্তব্য। আগেই বলেছি বিদ্বজ্জন, অভিজ্ঞজনদের তৈরি পদের সমাহার দিয়ে মনের ভাব বা সুচিন্তিত ভাবনাপ্রকাশ বড়ই ক্লিশে বলে মনে হয়েছে আমার।আরও ক্লিশে বুদ্ধিমান বাস্তববাদীদের চিন্তাপ্রসুত সুচিন্তিত মতবাদ।তা একটা বুদ্ধিবাদ সমর্থিত হলেও, মনে হয় তীব্র অনভুতির অনুরণন থেকে বেশ খানিকটা দূরে।( স্বাভাবিক ভাবেই বাস্তববাদীরা সুক্ষ অনুভুতি থেকে একটু দুরেই থাকে মনে হয়)।এঁদের কথা প্রিয়জনের সাথে থাকা দীর্ঘ অভ্যাসের আচমকা পরিবর্তনে, নতুন অভ্যাস বড়ই হৃদয় বিদারক। আমায় ক্ষমা করবেন।ব্রহ্মচর্য থেকে গার্হস্থে প্রবেশ,সন্তানের আবির্ভাবে নতুন জীবন সুরু ও ত অভ্যাসের পরিবর্তন। এ সুরু ত আনন্দের।কর্মক্ষেত্রে বদলী,কারাবাস,অজ্ঞাতবাস, এসব

পরিবর্তীত পরিস্থিতি জনিত নতুন অভ্যাসে প্রবেশ।তা কখনো অতিত রোমন্থনে মনখারাপ,কখনো বিরক্তি উতপাদক হলেও, কর্মক্ষেত্রে বদলী, কারাবাসে একটা আশা থাকে যে আবার ফিরে আসব।অতএব প্রিয়জন বিয়োগের মতন সে অনুভুতি ভয়ংকর চীর বিচ্ছেদের নয়।

এ অনুভুতির আশ্চর্য দিক চহচ্ছে, বহু টুকরো স্মৃতির রোমন্থন যখন জীবন্ত হয়ে এই মুহুর্তে তোলপাড় করা অস্তিত্ব কে জানান দেয়,ঠিক একই ভাবে ভাইরাসের মত ঐ টুকরোগুলি অস্তিত্বহীনতাকেও উস্কে দেয়। জীব জগতের জীব আর জড় যেন একই অস্তিত্বের মতন। এ অনুভুতির কাছাকাছি পৌঁছতে আমার কাছে এক চিত্রকল্প এই মুহুর্তে ভেসে উঠলো। মনে করুন, যার মৃত্যু হয়েছে তাকে নয়, যে এ সংসারে শোকে পাগল, তাকে আচমকা তাঁর সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেউ লক্ষ আলোকবর্ষ দুরের কোনো এক গ্রহে নিয়ে গেল। তারপর সেই কেউ বিলিন হয়ে গেলো। এখান থেকে তার লাখ আলোকবর্ষ দুরের সাধের সংসারে ফেরা এ জীবনে অসম্ভব।সে উষর ন্যাড়া ভিনগ্রহের যতদুর চোখ যায় ততদুর অপার্থিব কালচে ছাইরঙা যোজন বিস্তৃত ছেঁড়া ছেঁড়া কাগজের মত জমি।তার উপরে হাটু মুড়ে উবু হয়ে বসে রয়েছে মানুষের মতন দেখতে হাজার লক্ষ শীর্ণকায় তেল পিচ্ছিল চামড়ার লিঙ্গহীন উলঙ্গ বৃদ্ধের দল।যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে তারা বহুদুরে দৃষ্টি ছড়িয়ে অনবরত শোঁ শোঁ করে মৃদু ঘড় ঘড় শব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলেছে।হাজার হাজার অপার্থিব অবয়বের মিলিত দীর্ঘশ্বাস চৈত্রের ঝামালের মতন, কিন্তু অপেক্ষাকৃত মৃদু, অথচ একঘেয়ে গুমোট শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি করে চলেছে।ওদের পাশে ফেলে রাখা, তীব্র বিষাক্ত মৃত সাপ শুকিয়ে তৈরি শক্তপোক্ত লাঠি।গোটা গ্রহে পচা জেসমিন আতরের গন্ধ।অদৃশ্য কোনো নক্ষত্র থেকে অপরিচিত ভয়ংকর ছাই রঙা মৃতপ্রায় আলো দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ঢাকা গ্রহটা।আপনি নিশ্চিত যে এ জীবনে আপনি আর আপনার সাধের সংসারে ফিরতে পারবেননা। তখন টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলির সাথে আপনার ঘর,বাড়ী, প্রিয়জনের অস্তিত্বের সান্নিধ্যের সাথে অস্তিত্বহীনতার তীব্র সংঘাতে সেই তৃতীয় অব্যক্ত ইম্প্রেশনিস্টদের ছবির মতন অনুভুতির সাথে প্রিয়জন হারানোর অনুভূতির অন্তত আশিভাগ মিল রয়েছে বলে আমার মন বলছে। অভ্যাস-তার বদল,অশেষ যন্ত্রণা,শোকে পাথর,চোখে বন্যা,বুকভাঙ্গা ( অপরিমিত ভাষাজ্ঞানের জন্য এ লেখায় আমিওঅগত্যা এসব পদসমষ্টি ব্যবহার করেছি) শোকসন্তপ্ত, শব্দ সমাহার গুলি আমাকে ছুতে পারেনি।এটা আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা। কারণ আজ প দু'মাস হল আমি আমার প্রিয়তমা পঁচিশ বছরের সাথী স্ত্রীকে হারিয়েছি।ওঁর নাম ছবি।শীতের হাত থেকে রক্ষা পেতে তোষকের নিচে রাখা ছিল আমার শাসকষ্টেভোগা(কিন্তু কর্মঠ।সংসারের সব কাজ একাই সামলাত) স্ত্রীর ছ'জোড়া মোজা, একটা ভেল, কালো মোটা মাফলার,ইনহেলার,সিন্দূরে মাখামাখি চিরুনি, লালসাদা টুথব্রাশ,আধখর্চা বোরোলিনের কৌটা,হাতের ভাংগা শাখা,নোয়া,নাকের অন্দরফুল,নেকড়ায় জড়ানো মজুদ বংগলক্ষী সিন্দুরের কৌটো,খয়েরি টিপের পাতা,পলিথিন বাক্সে রাখা সূচসুতা,হুক,খুচরো পয়সা,মাথার কুমীর ক্লিপ, গার্টার,ভাত খাবার কানা উঁচু স্টিলের থালা,মাথা ভারী গ্লাস,বেঢপ গহষা খাওয়া জলের বোতল, গীতা। হনুমান চল্লিশা,শক্ত বালিশ, রোজ ব্যাবহারের সাস্তার সোয়েটার, হাওয়াই চটি,নানা দরের শাড়ী, ব্লাউজ, সাধের লোকনাথ বাবার মিনিয়েচার মুর্তি,কালিঘাটের মায়ের পট,পুরীর ঝিনুকের চাবির রিং,মাটির তৈরি নকল আম,আতা,কলা,এক্সপো মেলা থেকে কেনা এক জোড়া ছোট্টছোট্ট খরগোশ,আর বহু ধৈর্যধরে বোনা আমার জন্য এক জোড়া ক্যাশমিলনের তৈরি সোয়েটার। সব আমার কাছে আছে।থাকবে। তফাৎটা এখানেই, যে ঐ ভীনগ্রহে গেলে ওগুলো পেতাম না।

( দুঃখ ভাগ করলে কমে।তাই এদুঃখ টুকু আপনার সাথে ভাগ করলাম। আপনি কারও সাথে ভাগ করলে খুশী হব।লেখাটাতে পুনরাবৃত্তি থাকলেও কাটাকুটি করিনি।

ভাস্কর চাটার্জী,বালুরঘাট।।
২৫ চৈত্র,১৪২৪।(৯ এপ্রিল,২০১৮)



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.