ফাল্গুনের হাত ধরে অশোক,পলাশের রঙ মেখে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। আর তখন শীতের শুষ্কতা, জড়তা ঝরে আমাদের প্রাণেও লাগে রঙীন দোলা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু বছর আগে শান্তিনিকেতনে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই ঋতুরাজকে বরণ করেন যা বসন্ত উৎসব নামে পরিচিত, সেই ধারা আজও বহমান। তবে তা শুধুমাত্র ঋতুর অনুষ্ঠানের গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় তার একটা ধর্ম নিরপেক্ষতার দিকও আছে। জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে নাচ,গানের সাথে সাথে নারী,পুরুষ,সকলের আবির খেলায় অংশগ্রহনে তা হয়ে ওঠে বর্ণময়। উৎসবের সকালে ‘ওরে গৃহবাসী, খোল্ দ্বার খোল্’ সুরের ধ্বনিতে দিকেদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার বর্ণিল প্রতিধ্বনি।
মানব সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব বলে মনে করা হয় দোল উৎসবকে ।অনেক বিখ্যাত কবিতা, গান, সিনেমা রচিতও হয়েছে এই উৎসবকে ঘিরে। কবি নজরুলের-‘ব্রজগোপী খেলে হোরী’ এখনো আগের মতোই সমান জনপ্রিয়।
নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও জৈমিনি মীমাংসায় দোল উৎসবের কথা জানতে পারি। তৃতীয় শতকে বাৎসায়নের ‘কামসূত্রে’ দোলায় বসে আমোদ-প্রমোদের উল্লেখ আছে। এমনকি সপ্তম শতাব্দীতে রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ের এক শিলালিপিতে এবং ‘রত্নাবলী’ নাটকে এই উৎসব পালনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
অনেকে পণ্ডিতেরা মনে করেন রাধা-কৃষ্ণের দোলনায় দোলা থেকেই দোল কথাটির উৎপত্তি। হিন্দু বৈষ্ণব মতে,দোলপূর্ণিমার বা ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে রাধিকা ও অনান্য গোপীগণের সাথে শ্রীকৃষ্ণের আবির খেলার ঘটনা থেকেই উৎপত্তি দোল খেলার।তাই ভক্তেরা সেইদিন কীর্তন গানের সাথে ধুমধামে আবির খেলায় মেতে ওঠেন। আবার ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের এই তিথিতে জন্মগ্রহণের জন্য দিনটির গুরুত্ব বহুগুন বেড়ে যায়। এই অনুষঙ্গেই ফাগপূর্ণিমার নাম ‘গৌরপূর্ণিমা’।
হোলিকা দহন’ থেকে ‘হোলি’ কথাটি এসেছে বলে অনেকেই মনে করেন।এই নিয়ে অনেক লৌকিক কাহিনী প্রচলিত। ‘স্কন্ধপুরাণ’ গ্রন্থে হোলিকা ও প্রহ্লাদের কাহিনী আমাদের সকলের জানা। মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর পত্নী দিতির সন্তান হিরণ্যকশিপু ছিলেন ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত।তিনি নিজের সন্তান প্রহ্লাদকে পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন।হোলিকা দাদার আদেশে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে প্রবেশ করে কিন্তু বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অক্ষত থাকে, আর হোলিকা আগুনে নিঃশেষ হয়ে যায়। হোলিকার এই আগুনে পুড়ে যাওয়ার কাহিনী থেকেই হোলির আগের দিন বাঁশ,কাঠ,শুকনো পাতা ইত্যাদি জ্বালিয়ে ঘটা করে পালিত হয় নেড়াপোড়া বা হোলিকাদহন। এর মূল উদ্দেশ্য শুভ শক্তির জয় ঘোষনা অশুভ শক্তির প্রতিবাদে। অনেকটা বাংলায় চাঁচর উৎসবের মতো। সেখানে বছরের পুরনো জঞ্জাল পুড়িয়ে নতূন বছরের আহ্বান করা হয়।
অন্যদিকে শোনা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামে এক অত্যাচারী অসুরকে বধ করেন এবং তার রক্ত ছড়িয়ে সকলে মিলে মহানন্দ উপভোগ করেন। আবার অনেকে মনে করেন অনার্যদের থেকে এই উৎসবটি গ্রহণ করেন আর্যরা। হোলক বা হোলাক থেকে সৃষ্টি হোলি। আজন্ম দৈত্যর খড় জ্বালিয়ে ভাল শস্য উৎপাদনের প্রার্থনায় জন্ম এই উৎসবের।এরকম অনেক পৌরাণিক কাহিনী শোনা যায় এই প্রাণের উৎসবটিকে কেন্দ্র করে।
বাংলায় যেদিন দোলযাত্রা ঠিক পরের দিন উত্তর ভারতে পালিত হয় হোলি। এছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন মধ্যপ্রদেশে ‘হোরি’, পাঞ্জাবে ‘হল্লামহল্লা’, গোয়া-কঙ্কন অঞ্চলে ‘শিমাগা’, দক্ষিণে ‘ কামায়ন’ নামে। আসলে এটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। যার মধ্যে সর্বজনীন আবেদন আছে।ভারতের বাইরেও ভিন্ন ভিন্ন নামে পালিত হয়।বাংলাদেশে লালন ফকিরের আখড়ায় ঘটা করে হোলি পালিত হয়্ কারণ সেইদিন তিনি শিষ্যদের সঙ্গ দিতেন।
ঐতিহাসিকরা মনে করেন আর্যরা পূর্বভারতে এই উৎসব পালন করতেন। যুগে যুগে বদল হয়েছে ব্যাখা ,বিশ্বাস কিন্তু উদযাপনের রীতি এক।আসলে দোল আমাদের প্রাণের উৎসব, প্রেরণার উৎসব। খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় ৩০০ বৎসর আগে পাথরে খোদাই করা এক ভাস্কর্যে হোলির কথা জানতে পারি। এছাড়াও অষ্টম শতকে ‘মালতী মাধব’নাটকে,জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ এবং ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থে পাওয়া যায় এই উৎসবের অস্তিত্ব। মধ্যযুগের কোন কোন অঞ্চলের মুসলমানরাও এই উৎসব পালন করতেন আলবিরুনীর বিবরনে তা স্পষ্ট। এছাড়াও সেই সময়কার বিখ্যাত চিত্রশিল্পের বিষয়বস্তু হোলিকে কেন্দ্র করে। শোনা যায় সম্রাট আকবর ১৩ দিন ধরে হোলি খেলতেন।
আমাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব গুলির মধ্যে দোলযাত্রা একটি অন্যতম উৎসব যেখানে কচি কাঁচা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই আবির খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারে।এখনো এই মাঝ বয়েসে ছোটদের পিচকারীর রং খেলা দেখতে দেখতে নিজের অতীতে ফিরে যাই। যদিও এখন দোল খেলা হয় ভার্চুয়াল মিডিয়াতে ছবি পোষ্ট করে লাইক কমেন্ট। তবুও দোল আমদের প্রেম জাগায়, ভালবাসার বন্ধন গড়তে সাহায্য করে। তাই আমরা মিলিত ভাবে আহ্বান জানাই -
‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে-’
barnalibishi21@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন