শেষ পর্ব
ক্ষুদ্র পরিসরে এবং ক্ষুদ্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে এমন বিবর্তনের সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখে ফেলা এক কথায় স্পর্ধার প্রকাশ। নিজের মনে শুধু নাড়াচাড়া করতে করতে এত তথ্য পাওয়া হয়েছিল। এরপর দেখলাম বৌদ্ধ যুগে বৃহৎ বঙ্গে প্রতি শুক্লা পঞ্চমীতে সরস্বতীর আরাধনা হতো। গৃহস্থ পরিবারে নিত্য আরাধিতা দেবী তখন হাজার হাজার বছর পেরিয়ে হংসবাহিনী শুদ্ধাজ্ঞানদায়িনী দেবী। বৌদ্ধ বিহারগুলিতে ছাত্ররা এভাবেই প্রতি শুক্লা পঞ্চমীতে সরস্বতী পূজা করত। বৌদ্ধ দর্শন তখন মহাযান ধর্মের দৌলতে জটিল এবং অত্যুচ্চ এক মার্গ অবলম্বন করেছে। গুহ্যযান তন্ত্রের নানা পঙ্কিলতা সত্ত্বেও তখনও মহাযানের শুদ্ধ ভাব বজায় আছে। এই সময়ে পাল রাজত্বের শেষে বঙ্গে এলেন কর্ণাট বংশীয় সেন পরিবার। এরা হিন্দু ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক আর রইলনা। ধীরে ধীরে বৌদ্ধ দেব দেবীগণ হিন্দু ধর্মের আওতায় চলে এলেন। বলা যেতে পারে যে বেদে আমরা সরস্বতী স্তোত্র ইত্যাদি আগেই পেয়েছি। তাহলে উল্টোটাই কি সত্যি নয়? এখানে বলা প্রয়োজন বেদে মূর্তিপূজা নেই। গুরুপূজা বা দেবদেবীর প্রতিমাপূজা বৌদ্ধধর্মের দান। তাই সরস্বতী প্রতিমার পূজা হিন্দু ধর্মে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে সেন রাজাদের আমলে। তাও সে নিতান্তই গৃহস্থের গৃহকোণে ও বিদ্যালয় বা বিহারে।
এরপর একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে মঙ্গলকাব্যের সময়ে সরস্বতীর ধারণা কেমন ছিল। উদ্ধৃতিটি অন্নদা মঙ্গল থেকে।
অন্নদা মঙ্গলে সরস্বতী বর্ণনা
উর দেবী সরস্বতী : স্তবে কর অনুমতি : বাগীশ্বরি বাক্যবিনোদিনী।
শ্বেতবর্ণ শ্বেতবাস : শ্বেত বীণা শ্বেত হাস : শ্বেতসরসিজনিবাসিনী।।
বেদ বিদ্যা তন্ত্র মন্ত্র : বেণু বীণা আদি যন্ত্র : নৃত্য গীত বাদ্যের ঈশ্বরী।
গন্ধর্ব্ব অপ্সরাগণ : সেবা করে অনুক্ষণ : ঋষি মুনি কিন্নরকিন্নরী।।
আগমের নানা গ্রন্থ :আর যত গুণপন্থ :চারিবেদ আঠার পুরাণ।
ব্যাস-বাল্মীকাদি যত : কবি সেবে অবিরত : তুমি দেবী প্রকৃতি প্রধান।।
ছত্রিশ রাগিনী মেলে : ছয় রাগ সদা খেলে : অনুরাগ সে সব রাগিণী।
সপ্ত স্বর তিন গ্রাম : মূর্চ্ছনা একুশ নাম : শ্রুতিকলা সতত সঙ্গিনী।।
তান মান বাদ্য ভাল : নৃত্যগীত ক্রিয়া কাল : তোমা হৈতে সকল নির্ণয়।
যে আছে ভুবন তিনে : তোমার করুণা বিনে : কাহার শকতি কথা কয়।।
তুমি নাহি চাহ যারে : সবে মূঢ় বলে তারে : ধিক্ ধিক্ তাহার জীবন।
তোমার করুণা যারে : সবে ধন্য বলে তারে : গুণিগণে তাহার গণন।।
দয়া কর মহামায়া : দেহ মোরে পদচ্ছায়া : পূর্ণ কর নূতন মঙ্গল।
আসরে আসিয়া উর : নায়কের আশা পূর : দূর কর অজ্ঞান সকল।।
কৃষ্ণচন্দ্র নরপতি : গীতে দিলা অনুমতি : করিলাম আরম্ভ সহসা।
মনে বড় পাই ভয় : না জানি কেমন হয় : ভারতের ভারতী ভরসা।।
অতএব এই সময়ে আমাদের বোধে পরাবিদ্যাপ্রদায়িনী, পরম জ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতীর উদয় হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে ব্রহ্মচারিণী দেবী, যিনি হংসের মতো সংসার রূপ দুধ থেকে পরমতত্ব রূপ মাখনকে পৃথক করতে সাহায্য করেন, যিনি আমাদের চেতনায় সর্বপ্রকারের অন্ধকার নাশ করেন তাঁর উদয় হলো। এভাবেই জটিল ও উচ্চ এক দার্শনিক চেতনায় সরস্বতীর উত্থান। কিন্তু আম বাঙালির সরস্বতী পূজা বা শারদীয়ায় মা দুর্গার সঙ্গে তাঁর কন্যা সরস্বতীর আগমন, এর ইতিহাস কিন্তু বেশি পুরনো নয়। সরস্বতীকে দুর্গার কন্যা বা শিবের কন্যা বানিয়ে তোলাও হিন্দু ধর্মের পরিধিতে টেনে আনার একটি কৌশল।
আজকের সরস্বতী পূজা, যা মাঘী পঞ্চমীতে হয়, তার প্রচলন বেশিদিন নয়। মাসিক আরাধনা থেকে বাৎসরিক আরাধনার কালটি হয়ত সম্ভবত উনিশ শতকের প্রথমে প্রচলিত হয়। এই আমাদের সরস্বতী পূজার ইতিহাস।
anindita.gangopadhyaya@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন