শব্দদুটি রাস্ট্র, সমাজ, নাগরিক কল্যাণে যতটা মানবিক মুখ হয়ে ওঠে, সত্য এবং স্পষ্টবাদী হয়ে ওঠে, প্রভূত কল্যাণকরে যোগ্যতার ভার বহন করে, আজকাল স্বচ্ছ চোখে স্পষ্ট করে বলতে অধিকাংশই ঠিক ভার নয় - যেন শোষকের ভাঁড় বহন করে।
বুদ্ধিজীবী, বিদ্দতজ্জন! অর্থাৎ শব্দদুটির ভাব, কর্ম, ব্যবহার সম্পর্কে ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, উনিশ শতকের ষাটের দশকে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার সামাজিক ও রাষ্ট্রের নানাবিধ সঙ্কটকালে পরামর্শ দানের মাধ্যমে যথার্থ দিকনির্দেশকারী পন্ডিত সম্প্রদায়ের লোকদের বোঝাতে প্রথম Intelligentsia শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তবে উনিশ শতকের সোভিয়েত রাশিয়া থেকে শব্দটি যখন ইংরেজি ভাষায় প্রচলিত হয় তখন তার অর্থের ব্যপক বিস্তার ঘটে। Oxford English Dictionary শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে: ‘The class consisting of the educated portion of the population and regarded as capable of forming public opinion.’ অর্থাৎ এঁরা জনসংখ্যার শিক্ষিত অংশের অন্তর্ভুক্ত শ্রেণি এবং জনগণের মতামত গঠনে সক্ষম বলে গণ্য ।
এরপর থেকেই ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত Intelligentsia শব্দটি সাধারণত সমাজের সর্বোচ্চ বিদ্বান, স্পষ্টবাদী ও সমাজ এবং সর্বোপরি মানুষের আশু কল্যাণে সর্বাপেক্ষা ভূমিকা গ্রহণকারী গোষ্ঠীকে বোঝাতে, সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় নির্ধারণ করে সম্মানে আখ্যায়িত করা হয়। মুলত এঁরা নিরপেক্ষ। স্বাভাবিক ভাবেই মনে করা হয় যে, উল্লেখিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় অর্থাৎ মননশীল সচেতন ও সুস্থ বিবেক সম্পন্ন এই শ্রেণীর মানুষ স্বসমাজের জনমত, রাজনীতি ও মূল্যবোধকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। এঁদের এই প্রভাবশক্তির জন্য সাধারণ মানুষ সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের অস্তিত্বকে অপরিহার্য বলে মনে করেন। তবে এ সম্প্রদায়ের সকলেই যে ব্যক্তিগতভাবে এরূপ প্রভাব খাটাতে সক্ষম, তা নয়, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই সময়ের বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক থেকে শিক্ষা সাহিত্য সাংস্কৃতিক পটভূমিকা।
বাংলায় অতীতে এই বুদ্ধিবাদী আন্দোলনের মূল নিহিত হলেও Intelligentsia-র সন্ধান পাওয়া যায় উনিশ শতকের পূর্বে। সে সময় রাজা রামমোহন রায় এবং ইয়ং বেঙ্গল নামে একটি প্রগতিবাদী গোষ্ঠী এমন কিছু প্রশ্ন তোলেন যা কার্যকরের মধ্যদিয়ে সমকালীন বাংলার সমাজকে বিস্মিত করে তুলেছিল।
বুদ্ধিজীবী, বিদ্দতজ্জন অর্থাৎ যিনি একজন মননশীল সচেতন ও সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ, যিনি শুধু সামাজিক পরিমন্ডলেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না। তার বিচরণ সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা, বর্তমান আর ভবিষ্যতের উপর। আমরা তার মাঝে খুঁজে পাবো মুক্ত মন ও সৃজনশীল চেতনা। কর্মে ও চিন্তায় নিজেকে বিকশিত করার মাধ্যমেই তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজনে পরিণত হবেন। দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি, রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে বিক্রীত আজ মেধা, মুক্ত মন ও সৃজনশীল চেতনা। যার ফল ... শোষকের অমানবিক পেশী শক্তির বল।
স্বতন্ত্রভাবে অনেক পন্ডিত ব্যক্তি এখনও গণমূল্যায়নে একটি উচ্চ ভাবমূর্তি রক্ষা করে চললেও এই বাংলার রাজনৈতিক পক্ষপাত দুষ্টে - সহজ সুলভে আজকের অহরহ ভূমিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে আগামীতে সাধারণ নাগরিক বা নবপ্রজন্ম দেশের বা সমাজের ‘চিন্তাকর’ হিসেবে গন্য বা মান্য করবেন কতটা সেটাই বিপদের প্রশ্ন। সাময়িক প্রচার, ক্ষমতা, অধিক অর্থ, পুরুস্কার লোভী তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এই অবক্ষয় রাজনীতির সঙ্গে গভীর সংশ্লিষ্টতারই পরিণাম।
শোষকপ্রীতি, সুযোগ সন্ধানী তথাকথিতরা জাতে ওঠার অবমাননায়, ঠিক নিজ আত্মকেন্দিক সুখ আবাহনে আজকাল চোখ বন্ধ করে রাখেন। আজকাল আপোষে অনেকেই, পশ্চাদে শোষকের নির্গত বায়ুতেও ফুলের ঘ্রান জেনেই সয়ে থাকেন। সমস্যা এখানেই। আমরা ক্রমশঃ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে চলছি। ঝাঁ চকচকে আশ্রয়ের সন্মোহনে আমরা হারিয়ে ফেলছি শ্রবণ ক্ষমতা, আমাদের ঘ্রান শক্তি এবং নুন্যতম জীবনের নীতি এবং তার ভক্তি।
উপলব্ধি এই, অন্যায়ের বিপরীতে নির্লিপ্ততা, নিরাবতাই সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক মনোভাব পুষ্ট ভেকসেবক এবং দ্বিচারিতা মনোভাব সম্পন্ন মানুষদের আজ জীবন নির্বাহের যাবতীয় উৎস। এই উৎসসূচি থেকেই মূলত উৎসব - স্বজন পোষণ, দমন পীড়ন, গণকণ্ঠ হরণ এবং প্রতিবাদী নির্মুল করণ।
পুর্বে লিখেছিলাম, প্রাণী জগতের অন্যতম সৃষ্টি বেশীরভাগ মানুষেরাই ধোঁয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত। কেউ কেউ পারে, কেউ কেউ পারে না, আগুনের প্রজ্বলিত শিখায় নিজেকে নির্ভিক বহিঃপ্রকাশে। জাত চিনিয়ে দিতে যারা পারেন, তারা স্মরনে এবং বরণে চিরকাল পাথেয়, যারা পারেন না তারা জীবনের প্রবাহে, শোষকে এবং আপোষে চির উপাদেয়।
তাই কে কবি, কারা কবি, কে শিল্পী, কে সাহিত্যিক, কে নেতা কে নেত্রী, কারা মানুষের জন্য নিবেদিত, কারা নাগরিক সভ্যতার নামে শুধুই করে কর্মে খাওয়ায় প্রতিষ্ঠিত, কে বুদ্ধিজীবী, কে বিদ্দজ্জন এর নির্নয় বাস্তবিকই আজ প্রয়োজন। আমরা কেউ কি ভাবছি কেমন আছে আমার দেশ, আমার রাজ্য, আমার পড়শি আমার ভালোবাসার হৃদয়, সহযাত্রী সমগ্র সহদয়। শতাংশে আজ নিরুঙ্কুশ ভাবেই মাণ হুশে আমরা তা ভাবছি না। ভাবছি, শুধুমাত্র নিজের করে নিজের আঁখেরে বলবান হতে - কি রাজনীতি, কি অর্থনীতি কিম্বা যেনতেন প্রকারনের গদোগদে হৃদয় প্রীতিতে।
আদতে প্রাণের সাধনায় প্রতিটি দিনই তো ত্যাগের। সাধনায় নীতি, কর্ম এবং তার একাগ্রতায় বয়সের সীমানা ছাড়িয়ে, জাতপাত বৈষম্যকে ছাড়িয়ে, মানবতার সংজ্ঞায়, ব্যাঞ্জনায়, অভ্যর্থনায় এইভাবেই তো ঋদ্ধ হয় 'মানুষ'। সাফল্যের সার্থকতায় এইভাবেই তো পূজিত হয় মানবিকতা মানুষে মানুষে অধিষ্ঠিত প্রাণের দেবালয়ে।
সত্য এই আরাধনায়, সমাজ এবং নাগরিকে প্রভূত উন্নতি ও স্পৃহাবোধের উদ্ভবনে অতিক্রান্ত হল একটি দিবস। বিশ্ব কবিতা দিবস। প্রসঙ্গত আলোচনায় - কবিতা জন্মায়! কীভাবে জন্মায় একটি কবিতা? কীভাবে বেড়ে ওঠে একটি কবিতা? কোনটা কবিতা, কে কবি, কি তাঁর দায়বদ্ধতা? নাকি ইচ্ছে বা শখের লালন পালন থেকে বেড়ে ওঠা সবই আজ কবিতা। কবিতা কি নিছকই বিনোদন? কবিতা কি স্ক্রাপ বুকে রাশি রাশি শব্দের সজ্জিত আত্মগরিমার আল্পনা? কবি কি বুদ্ধিজীবী নন, বিদ্দজ্জন নন ... ? তাঁদের কি কোনরূপ দায়বদ্ধতা নেই সত্যর প্রতি? তবে কেন তাঁরা সজ্জিত মডেল এমন হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয় কবি - কবিতা নিয়ে।
কবিতা যেমন ভালোবাসার ভাষা, কবিতা তেমনই অন্যায়ে প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের ভাষা। স্বাভাবিক ভাবেই উপলব্ধি, সমাজ সচেতনে কবি তাঁর কবিতা শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস তার আবেগোত্থিত অনুভূতি, সত্য উপলব্ধি ও চিন্তাকে সংক্ষেপে এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত করে। ভাষার নান্দনিক গুণাবলীর ব্যবহারের পাশাপাশি ধারণাগত এবং শব্দার্থিক বিষয়বস্তু ব্যবহার করার মধ্য দিয়েই কবিতা আজ গন মানুষের কণ্ঠ এবং শিল্পের মহত্তম শাখায় পরিগণিত।
উল্লেখ্য, শক্তি এবং আধিপত্যই যখন অতীত থেকে বর্তমান সমাজ এবং রাষ্ট্রনীতির ভেতরের কথা, অনান্য প্রতিভাধর গুণীদের পাশাপাশি অক্ষর কর্মীদেরও নিরলস সক্রিয়তা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধে কবিতার শক্তিও বিবেচ্য হয়ে পড়েছে বারবার নাগরিক সমাজে। ঠিক এই সাফল্য এবং সুফলে কবি ও কবিতার মূল্যবোধকে সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ মার্চ তারিখটিকে বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিবস পালনের উদ্দেশ্যই ছিল হৃদয়ের উজ্জীবনে, মানবতার সমূহ সংযোগে, জীবন-ভাবনার বিনির্মাণে বিশ্বব্যাপী কবিতা পাঠ, রচনা, প্রকাশনা ও শিক্ষাকে উৎসাহিত করা। ইউনেস্কোর অধিবেশনে এই দিবস ঘোষণা করার সময় বলা হয়েছিল, "এই দিবস বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কবিতা আন্দোলনগুলিকে নতুন করে স্বীকৃতি ও গতি দান করবে।"
উল্লেখ্য, শক্তি এবং আধিপত্যই যখন অতীত থেকে বর্তমান সমাজ এবং রাষ্ট্রনীতির ভেতরের কথা, অনান্য প্রতিভাধর গুণীদের পাশাপাশি অক্ষর কর্মীদেরও নিরলস সক্রিয়তা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধে কবিতার শক্তিও বিবেচ্য হয়ে পড়েছে বারবার নাগরিক সমাজে। ঠিক এই সাফল্য এবং সুফলে কবি ও কবিতার মূল্যবোধকে সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ মার্চ তারিখটিকে বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিবস পালনের উদ্দেশ্যই ছিল হৃদয়ের উজ্জীবনে, মানবতার সমূহ সংযোগে, জীবন-ভাবনার বিনির্মাণে বিশ্বব্যাপী কবিতা পাঠ, রচনা, প্রকাশনা ও শিক্ষাকে উৎসাহিত করা। ইউনেস্কোর অধিবেশনে এই দিবস ঘোষণা করার সময় বলা হয়েছিল, "এই দিবস বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কবিতা আন্দোলনগুলিকে নতুন করে স্বীকৃতি ও গতি দান করবে।"
প্রশ্ন, আমরা সব বুঝি - চুপ কেন? বিদ্যা আছে বুদ্ধি আছে নীরব কেন? কবিতা তার স্বধর্মে গতিশীল নাকি ব্যরিকেডে অবরুদ্ধ ? রোজকার স্বজন পোষণ, মেধা হত্যা, দুর্নীতি, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি' ই যখন শিরোনাম তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে - মানুষ কতটা সুরক্ষিত? কতটা সুস্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য আইন ব্যবস্থা? বিবেকের জাগরণে, কতটা প্রয়োজন উচ্চারিত কবিতার প্রতিবাদী ঢেউ ...
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর “আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি” কবিতায় বলেন ...
"জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা -
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না,সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না , সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না, সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।"
নিছকই উদযাপিত দিবসে সীমাবদ্ধ নয়, ফরম্যালিনে ডুবন্ত বুদ্ধিজীবী বিদ্দজ্জনে তো নয়ই, সত্য এবং সৎ প্রবৃত্তি মনোভাব সম্পন্ন মানুষের জন্য, সমাজের জন্য কবির ভীষণ প্রয়োজন, বড় প্রয়োজন কবিতাচর্চার হৃদয়ধারণে, মানবমাহাত্ম্যের গ্রহণে। সাহিত্যের নানা শাখার মাঝে কবিতা পড়া, চর্চাই মানুষের জন্য এনে দিতে পারে মনুষ্য অস্তিত্বের মূল্যবোধ।
সুচিন্তিত মতামত দিন