“বাংলা ভাষা দিবস উপলক্ষে ঠিক করেছিলাম যে যথাসাধ্য কম বিদেশী ভাষা ব্যবহার করে দৈনন্দিন কাজে বাংলা ব্যবহার করবো। সকালে ছেলে কে বললাম "শুক্র বার তোর শিক্ষক আসবেন" ও বললো "কোন ডে? কে আসবেন !" বললাম "ফ্রাইডে তোর টিচার আসবেন" বললো "তা easy করে বললেই হয়" ।
পাড়ার xerox এর দোকানে গিয়ে অনেক ভেবে বললাম "এই কাগজ পত্র গুলোর প্রতিলিপি করে দিন" যদিও ডকুমেন্টস এর অক্ষম বাংলা হলো কাগজ পত্র। প্রকৃত অনুবাদ মনে পড়লো না". ওরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। বললাম "xerox করে দিন" । বললো "তাই বলুন, ভয় পেয়ে গেছিলাম"। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি কাজের লোক ছেলের জামা কাপড় গোছাচ্ছে। আমাকে দেখে বললো "বৌদি এগুলো তো ও পরে না, ডিসকাস করে দেব?" বুঝুন ইংরাজীর অনুপ্রবেশ কত দূর ! ও বলতে চাইছিলো "ডিসকার্ড করে দেব?" চিন্তায় পরে গেলাম যে ডিসকার্ড এর বাংলা তো ফেলে দেওয়া নয়, তবে ঠিক কি??? না ভেবে পেয়ে বললাম "আলাদা করে রাখ"।
টিভি তে বনশ্রী সেনগুপ্তর স্মরণ অনুষ্ঠান হচ্ছিলো। বক্তা বললেন "বনশ্রী দি ছিলেন এ ভেরি ফেমাস আর্টিস্ট অফ the গোল্ডেন এরা উইথ এ ভেরি distinguished sweet ভয়েস" উনি অবশ্য বাংলাই বলছিলেন !! তবু ভাবতে লাগলাম যদি আর একটু বাংলা করে বলা যায় তবে কি বলা যেত? অনেক ভাবনা চিন্তা করে ছেলে কে বললাম "বনশ্রী সেনগুপ্ত ছিলেন বাংলা সংগীতের স্বর্ণ যুগের একজন প্রথিত যশা বিদগ্ধ কোকিল কন্ঠী শিল্পী" ! ছেলে বললো "কিছুই বুঝলাম না, musician ছিলেন ? শ্রেয়ার চেয়ে better গাইতেন?" এখানেই আমার বাংলা ভাষা ব্যবহার এর চেষ্টার ইতি টানলাম।“
এ হল বাংলা ভাষা দিবস উপলক্ষে গত ফেব্রুয়ারী ২০১৭তে ফেসবুকে দেওয়া আমার একটি পোস্ট । ভাবলাম এটা দিয়েই শুরু করি ।
আমাদের বঙ্গবাসী এবং বঙ্গভাষী মানুষের বাংলা বলার এবং বিশেষতঃ নতুন প্রজন্মের পশ্চিমবঙ্গবাসীর বাংলা বলার ও বোঝার অবস্থা এখন সত্যিই এই পর্যায়ে পৌঁছেছে । মাতৃভাষার জন্য দুঃখ হয় । যে ভাষা রবি ঠাকুরের ভাষা, যে ভাষা নজরুলের ভাষা, যে ভাষা মোদের গরব মোদের আশা তা আজকের প্রজন্ম ভুলতে চলেছে । বাংলা ভাষায় ছড়িয়ে আছে কত মণিমাণিক্য, আছেন বংকিম, আছেন শরতচন্দ্র, আছেন জীবনানন্দ, আছেন তারাশংকর, বিভুতিভুষণ, মানিক থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় – কত কবি, কত সাহিত্যিক যারা বাংলা ভাষাকে পরিপুষ্ট করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন, ভরে দিয়েছেন অনন্য সাধারণ উপন্যাস, গল্প, কবিতা, রম্য রচনা ও প্রবন্ধ দিয়ে তা আজ পড়ার লোক নেই । আজকের প্রজন্ম পাঠ্য বইয়ের বাইরে এদের নামও শোনে নি । আর বাংলাকে পাঠের বিষয় হিসেবে নেওয়ার লোকই তো নেই আজ শহর কলকাতার স্কুলগুলিতে । যদি বা কেউ নেয়, তারাও সবচেয়ে অবহেলায় পড়ে এই বিষয়টিকে । তাই আজ বইমেলায় টি ভি চ্যানেল এর রমরমা, ফেলুদার ইংরাজী অনুবাদ পড়ছে বাঙালি ছেলেরা ! কমিক বুকের বেশি বাংলা জ্ঞান তাদের নেই । তারা স্মারট মোবাইল নিয়ে অতি ব্যাস্ত । সময় কোথায় বাংলা বই পড়ার? আজকের প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন রিয়েলিটি প্রোগ্রামে যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় তখন তাদের উচ্চারণ ভঙ্গী শুনেই বোঝা যায় যে গানটির মানে তারা বোঝে নি বা অনুভব করে নি । তাই ভাষার গভীরতা অনুভব করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় ।
হয়ত লেখা পড়ে মনে হতে পারে যে আমি শুধু নঞর্থক দিকটিই তুলে ধরছি – কিন্তু এই জলন্ত সত্য । “দোতারা বাজাইলে মনে পইরা যায় – একদিন বাঙ্গালী ছিলাম রে !”
এমন দিনে যখন দেখি আমাদের কবি ও লেখক বন্ধুরা বাংলা ই-পত্রিকা বের করছেন, ছাপা বই বের করছেন, আয়োজন করছেন পাঠ সভার, ফেসবুকে দিচ্ছেন চমৎকার সব বাংলা পোস্ট তখন মনে হয় এখনো আশা আছে – এখনো পশ্চিমবঙ্গে মানুষ আছেন যারা বাংলাকে ভালবাসেন, বাংলা পড়েন, আলোচনা করেন তার ভাল মন্দ নিয়ে । আমাদের সবার চেষ্টায় যেন এই প্রয়াসগুলি আরও এগিয়ে যায় এই প্রার্থনা করি ।
আমরা চমকিত হই ওপার বাংলার মানুষের বাংলা ভাষা নিয়ে গরব দেখে – তারা বাংলাভাষার জন্য আন্দোলন করে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন, জন্ম দিয়েছেন এক নতুন দেশের – বাংলা ভাষাকে ভালবেসে শহীদ হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ ! আজ তারা শুধুই বাংলায় কথা বলেন, লেখেন, বাংলা গান করেন, বাংলা বই পড়েন, বাংলা নাটক করেন, বাংলা চলচ্চিত্র বানান, মনে করেন তাদের একুশে ফেব্রুয়ারীকে । আজ বিদেশে কেউ বাংলায় নমস্কার করলে, দোকানে বাঙালি মশলা পাওয়া গেলে, মাছ পাওয়া গেলে, এমন কি একটা সেলুনে বাংলা নাম লেখা থাকলে তা বাংলা দেশের কল্যানে । তাই আমরা যারা বাংলা ভাষাকে ভালবাসি তারা শ্রদ্ধা জানাই এই ভাষা আন্দোলনকে ও বাংলাদেশের মানুষদের যারা বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন ।
সুচিন্তিত মতামত দিন