এবারের বইমেলা থেকে প্রিয় বন্ধু ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের “ত্রিধারা” উপন্যাসটি সংগ্রহ করলাম । নিজের ব্যস্ত রুটিন স্বত্বেও তেরাত্তিরে উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম, কারণ একবার ধরলে শেষ না করে ছাড়া যাচ্ছিলো না – বইটি এতোটাই টানটান । তাই এর একটি সমালোচনা না লিখলে শান্তি পাচ্ছিলাম না ।
প্রথমেই বলি এর যে দিকগুলি আমার ভাল লেগেছে । ১৭১ পাতার বইটি ঝকঝকে বাঁধাই ও সুন্দর প্রচ্ছদের কল্যানে মনোগ্রাহী । ভিতরের পাতাগুলিও উৎকৃষ্ট কাগজে ছাপা । অনেক ভাল প্রকাশকের বইতেও এত মোটা পাতার ব্যাবহার দেখি নি ।
উপন্যাসের শুরুটি ভারি চমৎকার । পাঠকের মন আকর্ষণ করে নেয় । “Once is happenstance, Twice is coincidence, but third time definitely is some evil design” উক্তিটি যেনও গোটা উপন্যাসের মূল সুরটি এক কথায় ধরে ফেলে ।
বইএর প্রথম প্রধান চরিত্র যশোধরা যেন লেখিকারই অন্য এক সত্তা বা অলটার ইগো ! একাধারে গৃহকর্ত্রী হিসেবে সংসার প্রতিপালন করছেন, আবার লিখে চলেছেন অসাধারন ভ্রমন বৃত্তান্ত বা ডাইরি, যা প্রকাশ হচ্ছে ! কখন করছেন গান বাজনা । তার সৃষ্টিশীলতাকে তিনি মরে যেতে দেন নি । যশোধরার জীবন বর্ণনার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে তার সময়ে বঙ্গ সমাজের নানা কুসংস্কার, ছেলে ও মেয়ের মধ্যে ভেদাভেদ করা, একটি মেয়ের কাছ থেকে শ্বশুর বাড়ির অন্যায় প্রত্যাশা, মেয়েদের স্বাধীন সত্তাকে অবদমন ইত্যাদি । যশোধরার ডাইরিতে নর্মদা অববাহিকার সুদীর্ঘ বর্ণনা, জব্বলপুর মার্বেল রকের বর্ণনা অত্যন্ত সুললিত এবং মনগ্রাহী । আমরা জানি লেখিকা নিজেই ভ্রমন সাহিত্য রচনয়ায় পারদর্শিনী । তার প্রমান এই অংশে পাওয়া যায় ।
![]() |
তপশ্রী পাল |
স্রগ্ধরার মেয়ে শ্রীধারা আধুনিক কালের প্রতিভূ । সে ও তার প্রিয় মানুষ বাল্মিকির গল্প যেনও সমকালের কোন কলেজ পড়ুয়ার গল্প । তার মধ্যে মিশে আছে ফ্রি মিক্সিং, আধুনিক মনস্কতা, সাহসিকতা, স্বাধীনতা এবং পড়াশুনার ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিষয় যেমন ফিল্ম স্টাডি নিয়ে পড়া ইত্যাদি । শ্রীধারার চেহারার মধ্যেই যেনও লুকিয়ে আছে এই উপন্যাসের সব রহস্যের চাবিকাঠি ! মূল গল্পের বিষয়ের সঙ্গে লেখিকা ছুয়ে গেছেন সমকামিতা, দ্বিগামিতা, স্বামী স্ত্রীর সম্পরকের টানা পোড়েন, টিন-এজারদের মনভাব ও সমস্যা ইত্যাদি সমকালিন বহু বিষয় যা প্রশংসার যোগ্য ।
এবার বলি দু একটি বিষয় যা মনে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করে বা সেদিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে । যশোধরার ডাইরিতে নরমদার ও জব্বলপুরের বর্ণনা সুদীর্ঘ । মূল কাহিনীর সাপেক্ষে তা হয়ত আর একটু সংক্ষিপ্ত হতে পারত যদিও ভ্রমন কাহিনী হিসেবে তা সুখপাঠ্য ।
যশোধরার ভাইএর সমকামিতা দেখান কি কাহিনীর জন্য কোন প্রয়োজন ছিল? মূল গল্পের সঙ্গে এই চরিত্রটির যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ ।
ভীমবেটকার গুহায় আদিবাসীরা কি আজও লুকিয়ে থাকে? তাদের সাহস হয় কি করে টুরিস্ট এক মহিলাকে হিপনোটাইজ করে অজ্ঞান করে ধর্ষণ করার? নাকি অন্য কিছু ঘটেছিল সেখানে তা পরিষ্কার নয় । প্রত্নতাত্বিক মুরতির নিদর্শনটি কি প্রমান করে? স্রগ্ধরার সঙ্গী নচিকেতা, মেয়ের চেহারা দেখেও সন্দেহ করে না কেন? শ্রীধারা ও বাল্মিকীকে ভুলিয়ে ভীম বেটকা নিয়ে গেছিল যে মেয়েটি, সে কে ছিল? তাকে কেন কোন প্রশ্ন করে নি তারা? একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি শ্রীধারার সঙ্গে হওয়া কি স্বাভাবিক? কেন কেউ একই পরিবারকে বারবার টারগেট করবে? এ যেন “কাটাপ্পা কিউ বাহুবলিকো মারা” এই প্রশ্নের মতই লেখিকা আমাদের এই সব প্রশ্নের মধ্যে রেখেই শেষ করেছেন এই উপন্যাস – হয়তো এর দ্বিতীয় খন্ডে এর উত্তর পাওয়া যাবে । লেখিকাকে ধন্যবাদ এত কৌতূহল উদ্রেককারী একটি উপন্যাস লেখার জন্য ।
উপন্যাস “ত্রিধারা”
– ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
সুচিন্তিত মতামত দিন