শ্রীশুভ্র
সাহিত্যিকের ছোবল! একজন অতি বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, আর একজন খ্যাতিমান কবিকে সম্প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন ফেসবুকের মতো ছোটখাটো প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। কারণ বড়ো কবিদের নাকি এমন সোশ্যাল মিডিয়ায় মানায় না। যেখানে পাঠক অতি সহজেই পেয়ে যাবে বিখ্যাত সেই কবির লেখা। স্বস্নেহ এই সদুপোদেশের জবাবে মিনতি ভরে সেই খ্যাতিমান কবিও নাকি বিখ্যাত সেই ঔপন্যাসিককে জানিয়েছিলেন যে, ফেসবুকের কোন বন্ধুর সাথেই তাঁর নাকি কোনরূপ ব্যক্তিগত সম্পর্ক নাই। তবে কি ফেসবুকের বন্ধুদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকা একজন প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকের পক্ষে অমার্জনীয় লজ্জাজনক অপরাধ? সেই অপরাধ খণ্ডন করতেই কি এই স্বীকারক্তি? ফেসবুকে তবে কারা থাকে? সাধারণ জনগণই তো? আর সেই জনগণকেই ব্যক্তিগত বন্ধু মনে করা একজন সাহিত্যিকের পক্ষে একজন বড়ো কবির পক্ষে কি এতটাই লজ্জার, যে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে হয়, কোন ফেসবুক বন্ধুর সাথেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক না থাকার সুসমাচার? এই একটুকরো ছবিটিকেই যদি সত্যমূল্যে ধরা যায়, তবে তো এই কথাই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, খ্যাতিমান বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক হয়ে উঠতে গেলে জনবিচ্ছিন হয়ে ওঠাই প্রাথমিক একটি শর্ত। এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত! খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই বিষয়টি। এতদিন আমরা জানতাম সমাজবিরোধী দাগী অপরাধীরাই নাকি জনবিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে। সেটাই তাদের দস্তুর!। কিন্তু বিখ্যাত সাহিত্যিক বড়ো কবিকেও খ্যাতিমান হয়ে থাকতে গেলে, আপন শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে গেলে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠতে হবে? এ কেমন কথা! এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে, বিখ্যাত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনও বহুদিন আগে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে অনেকটা এই রকমই উপদেশ দিয়েছিলেন। জনপ্রিয় স্টারেদের নাকি সাধারণ মানুষের সাথে বেশি মেলামেশা করতে নাই। তাতে স্টার ইমেজ তৈরী হয় না। সন্দেহ নাই খুবই দামী উপদেশ। যদিও অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই উপদেশ আজীবন কতটা পালন করেছিলেন, সেটা অন্য কথা। এবং তাঁর স্টার ইমেজ তাঁর জীবন যাপনের দরুন কতটা প্রভাবিত হয়েছিল, সেটাও অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু একজন কবি, একজন সাহিত্যিক, তাঁকে তো জনজীবনের সাথে থেকেই সেই সময় ও সময়ের অনুভবকে; সময়ের সংকট ও সময়ের সম্ভাবনাকে ধরতে হবে নিজস্ব অভিজ্ঞতায়, অর্জিত প্রত্যয়ে। এবং আবহমান সত্যের বেদিতে সেই অনুভবকে সাহিত্যের প্রতীতিতে রূপদান করে যেতে হবে সাধারণ সেই পাঠকদের জন্যেই, যাঁদের কাছ থেকেই পালিয়ে যাওয়ার সুপরামর্শ দিচ্ছেন একালের এক নামজাদা ঔপন্যাসিক সমকালের আর এক প্রতিষ্ঠিত বড়ো কবিকেই। কি আশ্চর্য্য! কি আশ্চর্য্য!
হ্যাঁ আরও আশ্চর্য্যের কথা, সেই মহা মূল্যবান উপদেশের কথাই তাঁর নিজস্ব ফেসবুক ওয়ালেই ফলাও করে লিখেছিলেন সেই বড়ো কবি। অবশ্যই তাঁর নিজস্ব ওয়ালে তিনি কি লিখবেন না লিখবেন সে সব তাঁর মৌলিক অধিকার। অবশ্যই। কোন সন্দেহই নাই। কিন্তু তাঁর সেই লেখার মধ্যে দিয়েই তো তাঁকে চিনে নেবারও একটা সুযোগ রয়ে যায়, সেই সাধারণ পাঠক জনসাধারণেরই! তাঁর সেই তথাকথিত ফেসবুক বন্ধুদেরও। তাঁর স্বীকারক্তি অনুযায়ীই যাঁরা কোনভাবেই তাঁর সথে কোনরকম ব্যক্তিগত সম্পর্কসূত্রে জড়িত নন। যে সুযোগটি তিনি নিজেই করে দিচ্ছেন তাঁর নিজস্ব ফেসবুক ওয়ালে। যে ফেসবুকের মতো ছোটখাট প্ল্যাটফর্মে নাকি, তাঁর মতো বড়ো কবিকে মানায় না।
হ্যাঁ, তাঁর সেই ওয়াল পোস্টটি পড়লেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিখ্যাত সেই ঔপন্যাস্যিকের স্বস্নেহ উপদেশকে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন সেই বড়ো কবি। কতটাই বিশ্বাস করতে শুরু করছিলেন সেই সদুপোদেশের সারাৎসার! অনেকেই হয়তো তর্ক করতে পারেন, সাহিত্যসাধনার জন্যে অতি প্রয়োজনীয় যে নির্জনতাটুকু দরকার, ফেসবুকের মতো বিশ্বহাটে সেটি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ষোলআনা বলেই হয়তো বর্ষীয়ান সেই বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তাঁর স্নেহের অনুজপ্রতীম কবিকে ফেসবুক থেকে সরে আসার পরামর্শই দিতে চেয়েছিলেন। হ্যাঁ সাহিত্যসাধনার জন্যে নির্জনতার দরকার থাকলেও জনবিচ্ছিন্নতার দরকার কতটুকু? কিংবা আদৌ আছে কি? নির্জনতা আর জনবিচ্ছিনতা কিন্তু এক নয়। ফেসবুক বন্ধুদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক না থাকার শ্লাঘা কি জনবিচ্ছিন্নতারই নামান্তর নয়? মূল প্রশ্নটা কিন্তু এইখানেই। আবার আরও একটু যদি তলিয়ে দেখি আমরা! বন্ধু কথাটির অর্থ আজকের সমাজবাস্তবতায় কি নিদারুণ ভাবেই না অর্থহীন হয়ে গিয়েছে। খ্যাতিমান বড়ো এই কবি তাঁর ফেসবুক ওয়ালেই কত সহজে জানিয়ে দিচ্ছেন, কোন ফেসবুক বন্ধুর সাথেই তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক না থাকার কথা। অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক আত্মশ্লাঘায়। কি আশ্চর্য্য! বন্ধু কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কহীন! এও আজকের সমাজবাস্তবতায় সম্ভব। অথচ আজ থেকে একশ বছর আগেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই বন্ধু শব্দটিকে কতবার কত নিগূঢ় অর্থই না ব্যবহার করে গিয়েছিলেন, তাঁর সৃজনশীল সৃষ্টিযজ্ঞে ও নিজস্ব জীবনযাপনের আজীবন সাধনায়। আজকের কবি সাহিত্যিক কি তবে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী নন আর? আজকের কবি সাহিত্যিকদের ঐতিহ্যের শিকড় তবে কোথায়? কিই বা তাঁদের উত্তরাধিকার?
খুবই মর্মাহত হয়ে আজ এই প্রশ্নের সম্মুখীন কিন্তু আমরা সবাই। যদি ন্যূনতম সততার সাথে নিজের বোধবুদ্ধি মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারি আমরা। যে আত্মশ্লাঘার সাথে বড়ো এই কবি তাঁর ওয়াল পোস্টটি করেছিলেন, সে তাঁর ব্যক্তিগত মৌলিক অধিকারের বিষয় হলেও, আজকের সমাজ বাস্তবতারই মূল্যবোধজনিত অবক্ষয়ের এক মর্মান্তিক প্রতিচ্ছবি। একজন সাহিত্যিক নিজেই যদি মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কবলে পড়ে যান, তবে তাঁর কাছ থেকে সাহিত্যের বা সাহিত্যের পাঠকের আর কিই বা পাওয়ার থাকতে পারে? সাহিত্যিক বা কবির কাজই তো সমাজকে পথ দেখানো! যেমনটা দেখিয়েছিলেন বঙ্কিম মাইকেল রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দ মানিক ও আরও কতজন! সাহিত্য তো গল্প বলা নয় শুধু। নয় শব্দ দিয়ে অনুভুতির সুতোয় মালা গাঁথার খেলা। সাহিত্য ও সাহিত্যিকের কাজ অন্যতর। একজন সৃজনশীল প্রথিতযশা সাহিত্যিক যদি সেই কাজ থেকেই বিচ্যুতির পথে পা বাড়াতে এগিয়ে যান, তবে যে কোন সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছেই সে বড়ো দুঃসংবাদ।
হতেই পারে, এমন দুঃসংবাদে বিচলিত হয়ে পড়লেন কেউ কেউ। কবিরই পরিচিত কোন শুভানুধ্যায়ী, যিনি বা যাঁরা তাঁরই কবিতার ও কবিপ্রতিভার বিশেষ গুণগ্রাহী। সচেতন করতে চাইলেন কবিকেই। তাঁর বড়োত্বকে শিরোধার্য্য করেই। কবি কি অসন্তুষ্ট হবেন তাতে? সেটাই কি দস্তুর হতে পারে কোন ভাবে। সাহিত্যের পরিমণ্ডলে? কিন্তু ফেসবুক তো আর সাহিত্যের পরিমণ্ডল হতে পারে না কোনভাবেই। বিশেষত নামজাদা সেই ঔপন্যাসিকের সিদ্ধান্তের মতো। তাই অসন্তুষ্ট কবিও জড়িয়ে পড়লেন তুমুল কথান্তরে। যে কথান্তর অচিরেই মনান্তরে পর্যবসিত হয়ে কবিকেই প্ররোচিত করলো বিশেষ কজন ফেসবুক বন্ধুকে (ব্যক্তিগত সম্পর্কহীন) ব্লক করে দিতে। কথায় বলে কথায় কথা বাড়ে। কি সত্য কথা। বড়ো কবির সেই ওয়াল পোস্টের কমেন্টের ভিড়ে, সেই কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হলো আবার। না সবটাই যে কবির একার উদযোগ তেমনটিও নয়। নিশ্চয়। এক হাতে তো আর তালি বাজে না। অসহিষ্ণুতার উল্লম্ফন দুই পক্ষেরই ছিল। হ্যাঁ আর ছিল পরিমিতি বোধের অভাব। ছিল অপরিণত বালখিল্যতার ভয়াবহ আরতি। দুই পক্ষেই। এতদিনের ফেসবুক বন্ধুর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া তাই কত সহজ হয়ে উঠল। একজন প্রথিতযশা কবির পক্ষে। যে কাজ অতি সাধারণ শিক্ষাদীক্ষার মানুষের পক্ষেও লজ্জার।
কিন্তু সেই ওয়াল পোস্টের আলোচনার সাথে তো অনেকেই জড়িত ছিলেন। অনেকেই কেন, অধিকাংশজনই নামজাদা সেই বিখ্যাত ঔপন্যাসিকের মতামতের তুমুল বিরোধিতাই করেছিলেন। কিন্তু কবি অত্যন্ত সংযত ভাষায় ও ভাবে তাদের মতামতের বিরুদ্ধে নিজের বক্তব্য রেখে গিয়েছেন ক্রমাগত। শালীনতার সীমানা অক্ষুন্ন রেখেই। তবে কেন বিশেষ দুই একজনের উপর হঠাৎ এতটা খাপ্পা হয়ে উঠলেন কবি? যাদের মুখের উপরেই দারাম করে ফেসবুকীয় বন্ধুত্বের দরজা বন্ধ করে দিতে হলো বিনা নোটিশে? শুধু তো তাই নয়, তারপরেও বিশেষ সেই দুই একজন সম্বন্ধে তীব্র বিষোদ্গার করে একাধিক নতুন পোস্ট দিতে হলো একালের সেই বড়ো কবিকে? যে সব পোস্টে কবি যেন নিজের অজান্তেই বেআব্রু করে তুললেন নিজের দীর্ঘদিনের কবি ইমেজকেই। সাহিত্যিকের সহনশীলতা ভুলে সাহিত্যিকের নান্দনিকতা ভুলে সাহিত্যিকের সংবেদনশীলতা ভুলে কবি যেন নিতান্তই জনসাধারণের একজনের মতোই আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন। উন্মোচিত করে তুললেন আপন সত্ত্বার এক নিদারুণ অন্ধকার অংশটুকুকেই। যেখানে সহনশীলতা সংবেদনশীলতা নান্দনিকতা শব্দগুলিকে কবি তাঁর শব্দের খোঁচায় ফালা ফালা করতে থাকলেন। হয়তো নিজেরই অজান্তেই। আর তখনই নামজাদা সেই বিখ্যাত ঔপন্যাসিকের অতি স্নেহের বড়ো কবি সেই ফেসবুকীয়দেরই একজন হয়ে উঠলেন, যাঁদের কাছ থেকেই পালানোর সুপরামর্শ পেয়েছিলেন তিনি। ঘটনার কি নিদারুণ পরিহাস!
একজন কবিকে একজন সাহিত্যিককে কতটা সহনশীল ধৈর্যশীল হতে হয়, কতটা সংবেদনশীলতার সাথে বিরুদ্ধ সমালোচনাকেও গ্রহণ করতে হয় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে, সে সব হয়তো এযুগের সাহিত্য পরিমণ্ডলে আজ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। আর সেই কারণেই কাঁটাতারের উভয় পারেই সাহিত্য পরিমণ্ডল আজ পারস্পরিক অশ্রদ্ধাজনিত অসহিষ্ণুতার এক সর্বাত্মক ব্যাধির করাল গ্রাসে সমাচ্ছন্ন। পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে আমরা যে বিষবাস্প রেখে যাচ্ছি, যে ব্যাধিগ্রস্ত অসুস্থ সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠানিক করে যাচ্ছি, তার মাশুল কিন্তু দেবে ভবিষ্যতের বাংলা ও বাঙালি। সেদিন আজকের আমরা কেউ থাকবো না। থাকবে শুধু আমাদের পদস্খলনের অভিশপ্ত এক জরাজীর্ণ ইতিহাস। যে ইতিহাসকেই ঐতিহ্য বলে মনে করে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করবে আগামী প্রজন্ম।
কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন