শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিয়ে এখনও বিতর্ক?
২০১১-র ডিসেম্বরে Forum of Empowerment of Women (FEW) in India দ্বারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা সভাগৃহে আয়োজিত একটি আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত হয়ে হাজির ছিলাম। মুখ্য বিষয় ছিল “Rights of Indian Muslim Women: Today’s perspective”। তিন তালাক নিয়ে প্রগতিশীল মুসলিম মহিলা সংগঠনগুলির আন্দোলন যদিও আরও পুরোনো, তবে সেদিন প্রথম মুসলিম মহিলা সংগঠনগুলির দাবি দাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হই। শুধু তিন তালাক নয়, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কাছে তাদের দাবি ছিল ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’-র বেশ কিছু সংশোধন। ঠিক অভিন্ন ‘দেওয়ানি আইন’-এর কথা উল্লিখিত না থাকলেও মুসলিম নারী পুরুষদের জন্য অভিন্ন আইনের দাবি অবশ্যই ছিল :

১. তালাক দেওয়ার সম অধিকার (নারী-পুরুষের) থাকবে এবং তালাক হবে আদালতের মাধ্যমে।

২. একাধিক স্ত্রী (বহু বিবাহ) নিষিদ্ধ করতে হবে।

৩. উত্তরাধিকার সম্পত্তির ওপর পুত্র কন্যাকে সমান অধিকার দিতে হবে।

৪. দত্তক আইন চালু করতে হবে।

৫. নির্যাতিত তালাকপ্রাপ্ত স্বামী পরিত্যক্ত ও বিধবা মহিলাদের স্বনির্ভর করার প্রকল্প চালু করতে হবে।

আমন্ত্রিত ছিলেন বহু তথাকথিত শিক্ষিত বা বলা যায় বুদ্ধিজীবী মুসলমান পুরুষ – সাংবাদিক, সাহিত্যিক, পত্রিকা সম্পাদক, প্রকাশক ইত্যাদি। এঁদের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ বিচিত্র। একজন তো মানতেই চাইলেন না এমন কোনও দাবি দাওয়া থাকতে পারে বলে বা থাকলেও তাতে কর্ণপাত করা উচিৎ বলে। আর একজন তো হজরত মহম্মদের কাছে স্বামীসংসর্গ বঞ্চিতা নারীর অভিযোগের কাহিনী ইনিয়ে বিনিয়ে অনাবশ্যক দীর্ঘ করে শুনিয়ে কী সাব্যস্ত করতে চাইলেন সেটাই পরিস্কার হল না। এবং কেউই প্রকারান্তরে এই কথা মানতে চাইলেন না যে, একই দেশের নাগরিকদের জন্য ফৌজদারি আইন যখন অনুরূপ, তখন দেওয়ানি আইনটাও বৈষম্যহীন হওয়া উচিৎ। এমন কি মানলেন না পুরুষের বহুবিবাহ বা একতরফা তালাকের অধিকারে কোনও সমস্যাু থাকতে পারে। চোখের ন্যূনতম চামড়ার খাতিরে জনৈক বুদ্ধিজীবী পুরুষ যদিও বা সমস্যার কথা স্বীকার করলেন, তার সমাধান কোনওদিন সম্ভব সেটা কিছুতেই মানলেন না। সর্বোপরি এই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই যে, হিন্দুদের জন্য আইন প্রণয়ন কালে যেখানে শংকরাচার্য বা মনুর বিধান অনুসরণ করা হয়নি, খ্রীস্টানদের জন্যও বাইবেলকে আইনের ওপর ঠাঁই দেওয়া হয়নি, হয়েছে যথাসম্ভব যুগোপযোগী দৃষ্টিকোণ; সেখানে আর একটি ধর্মসম্প্রদায়ের জন্য কেন শরিয়তি খবরদারি বলবৎ থাকবে? পরবর্তী পর্যায়ে আমার এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশের সময় বিস্মিত হয়ে দেখলাম তুলনা স্বরূপ হিন্দুদের সতীদাহের মতো বর্বর প্রথা রদের প্রসঙ্গ উঠলে তর্কের খাতিরে সতীদাহ বেআইনি করাকেও সমর্থন জানালেন না অনেকেই, এমনকি প্রথাটি যে বর্বর ছিল সে ব্যাপারেও নাকি মন্তব্য করা অনুচিৎ, কারণ উচিৎ কী সেটা ঠিক করবে হিন্দু পুরুষবর্গ। আলোচ্য সম্প্রদায়ের তথাকথিত প্রগতিশীল পুরুষরা নিজেরা কী ধরণের স্বাধীনতা চাইছেন তা খুব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

ভারি অবাক হয়েছিলাম তখন। বুঝতে পেরেছিলাম সংগঠনটি সভাগৃহ অলংকৃত করার জন্য কয়েকজন মুসলিম পুরুষকে সাজিয়ে রাখতে সমর্থ হলেও তাঁদের পথটা অপরিমেয় দীর্ঘ, বন্ধুর। কারণ এদেশের ব্যালট গণতন্ত্র তথাকথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরুষদের এবং প্রয়োজনে মৌলবাদীদের তোষামোদিকেই জাতীয় নীতি বানিয়ে রেখেছে। মুসলিম মেয়েরা সম্ভবত সেই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারপরেও দুরাশা জন্মেছিল, হিন্দু মেয়েদের আংশিক মুক্তি কিছু যুগপুরুষের হাত ধরে আসায় তারা এখনও যেমন পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক রয়ে গেছে, ওদের বেলায় বুঝি তা হবে না, কারণ তারা নিজেরাই দাবি আদায় করে নেবে।




তারপর গঙ্গা-পদ্মা-সিন্ধু দিয়ে আরও অনেক জল ও জলের মতো রক্ত বয়ে গেছে। তালিবানদের টেক্কা দিয়ে ধর্মরক্ষা ও ধর্মযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার মহান দায়িত্ব তুলে কাঁধে নিয়েছে মহতী আইএসআইএস। কাঁধ ও হাত অবশ্য শুধু হাতিয়ারের দায়িত্বে, ধর্ম পালনের মহত্তম দায়িত্বটা তাদের লিঙ্গই পালন করে। মুসলিম নারীকে সে যদি কন্যাও হয় (আপাতত অবৈধ) ভোগ, ধর্ষণ ও অত্যাচার করা মুসলমান পুরুষের ইসলাম অনুমত অধিকার এবং অমুসলিম নারীকে ভোগ, ধর্ষণ, অত্যাচার ও হত্যা করা তাদের ইসলাম প্রদত্ত কর্তব্য বলে দিকে দিকে ঘোষিত হয়েছে। যাঁরা ঘোষণা করেছেন তাঁরা সবাই তালিবান, আইসিস বা মৌলবাদী সন্ত্রাসী নন। কেউ আইনজীবী, অধ্যাপক এমনকি অধ্যাপিকাও।

মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের বেলাগাম বাড় বাড়ন্তে ও সুবিধাবাদী রাজনীতির সৌজন্যে যখন দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ফুটছে, তখন টেলিফোনে তালাক প্রাপ্ত ইশরত জাহান নিগ্রহ মামলার রায়দান করতে গিয়ে ২২ আগস্ট ২০১৭-য় ভারতের সর্বোচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত নেয় তাতে তাৎক্ষণিক তিন তালাক (তালাক-এ-বিদ্দত) বেআইনি ঘোষিত হয়। শরিয়ত বিরোধী এই অনুপম বিচ্ছেদের সুবিধা শুধু ভারতীয় ‘মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’-এর বদান্যতায়। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশগুলিতেও অনুসরণ করা হয় ‘তালাক-এ-হাসান’ যাতে এক নিশ্বাসে ‘তালাক’ উচ্চারণ করেই বিবিকে ঘার ধাক্কা দেওয়া যায় না, আল্লার সিংহাসন কাঁপানো শব্দটি তিনবার উচ্চারণ করার জন্য ন্যূনতম তিনটি চান্দ্রমাস সময় নিতে হয় যাতে মিঞা-বিবির মিটমাটের সুযোগ থাকে। এখন অনিচ্ছুক স্বামীর সঙ্গে সহবাস কতটা সম্মানের সেটা অন্য প্রশ্ন, কিন্তু এমন একতরফা স্বেচ্ছাচারিতার সমর্থনে সুবিধাভোগী পুরুষদের পক্ষ থেকে তো বটেই, বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরগুলি থেকেও যে প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করল এই রাষ্ট্র, তা ধর্মনিরপেক্ষতা ও সম্প্রীতিকামিতার খুব উজ্জ্বল ছবি আঁকতে পারল কি?

তালাক-এ-বিদ্দত ছাড়াও প্রবল বিরোধিতার মুখে ‘হালালা’ প্রথাও যার দ্বারা তালাক দাতা স্বামী নিজের খামখেয়ালে স্ত্রীকে আবার ফিরে পেতে চাইলে ব্যাপারটা আর ‘মিঞা-বিবি রাজি’ হওয়া দ্বারা নিষ্পত্তি হয় না। অন্য কোনও মুসলিম পুরুষ যদি তালাক প্রাপ্ত মহিলাকে বিবাহ করে বা বলা বাহুল্য ভোগ করে ফের তালাক দেয়, তাহলেই পরিত্যক্ত স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করা যায়। প্রত্যাশিতভাবে ‘হালালা’ বা পবিত্রকরণের মহান দায়িত্ব সচরাচর ধর্মব্যাখ্যাকারীরাই পালন করে থাকেন।

এই প্রথাটিকেও নিষিদ্ধ করার দাবি তোলার বদলে রাজনৈতিক মহল তাৎক্ষণিক তালাক বিরোধী বিলটিতে সংশোধন চেয়ে তালাকপ্রাপ্তদের আর্থিক দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপাতে চেয়েছে। ‘তালাক-ভাতা’র এই দাবি অবশ্য ভুক্তভোগীদের তরফ থেকেও। তবে কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের কর্তব্য সরকার কেন পালন করবে এটাও তো সঙ্গত প্রশ্ন।

তাছাড়া ভারতেরই শরিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৭-এর সেকশন ৫-এ মুসলিম মেয়েরাও কতগুলি বিশেষ পরিস্থিতিতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে, যাকে ‘খুল্লা’ বলে। কিন্তু উলমা, ইমাম, মৌলানাদের সৌজন্যে আইন অমান্যটাই এতদিন আইন হিসেবে স্বীকৃত ছিল। ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন (BMMA) গত দু’ বছর ধরে তিন-তালাক ও ‘হালালা’ বিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করেছে। ২২ আগস্ট ২০১৭-র ভারতীয় সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের ঐতিহাসিক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ ডিসেম্বর লোকসভায় তাৎক্ষণিক তিন-তালাক নিষিদ্ধকারী বিল অপরিবর্তিতরূপে পাস লক্ষ লক্ষ ইশরত জাহানদের লড়াইয়ের পাশে কতটা দাঁড়াতে পারল সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না। লোকসভায় বিলটি ধ্বণিভোটে জয়ী হলেও রাজ্যসভায় বল চলে গেছে কংগ্রেসের কোর্টে যারা সেটিকে পার্লামেন্টারি কিমিটির কাছে পাঠিয়ে দীর্ঘসূত্রতার সূচনা করে দিয়েছে। ‘প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ’-এর দীর্ঘ দিনের আন্দোলন যখন সাফল্যের মুখে তখন পশ্চিমবঙ্গে এই সংস্থাটির সভানেত্রী কাজি মাসুম আখতারের প্রস্তাবিত ‘তালাক ভাতা’র আবদার কার্যত সংস্কার বিরোধীদের হাতেই তুরুপের তাস তুলে দিয়েছে। এই নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা সমূহ।

এই পরিস্থিতিতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে অভিন্ন দেওয়ানি আইনের বদলে শরিয়তি খবরদারি কেন বহাল থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা আপাতত আমার নেই।


তথ্যসূত্র:

1. Jump up^ http://www.hindustantimes.com/india-news/triple-talaq-verdict-what-exactly-is-instant-divorce-practice-banned-by-court/story-mhQ1SbxnCUUgySQq82sdbJ.html

2. Jump up^ Mohammed Siddique Patel. "The different methods of Islamic separation – Part 2: The different types of Talaq". Retrieved 2017-05-29.

3. ^ Jump up to:a b "Triple Talaq". The Times of India. 13 May 2017. Retrieved 2017-05-13.

4. Jump up^ "Supreme Court scraps instant triple talaq: Here’s what you should know about the practice".

5. Jump up^ "Small step, no giant leap".

6. Jump up^ "Triple talaq verdict LIVE updates: Jaitley says SC judgment a great victory and welcome step". The Indian Express.

7. http://digitacommon..law.yale.edu/cgi/viewcontent.cgi?article=1166&context=yjlf

8. https://istishon.com/?q=node/8932

9. http://en.wikipedia.org/wiki/Triple_talaq_in_India#cite_ref-20

10. Ajaz Ashraf ব্লগ 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.