বর্ধমান শহরের কাছেই একটা উপনগরী গড়ে উঠছে। অনেকের মত আমিও একটা প্লটে বাড়ি করে মাস ছয়েক হল এসেছি। এদিক ওদিক বাড়ি উঠলেও এখনও বেশ ফাঁকা ফাঁকা। আমাদের বাড়ির ঠিক সামনেই রাস্তার ওপারের প্লটটায় বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। প্লটের মালিক বাড়ি তৈরির ইট সিমেন্ট রড ইত্যাদি পাহারা দেবার জন্য রহিমদাকে পাহারাদার হিসাবে রেখেছেন। রহিমদা বয়স্ক মানুষ, কালো প্লাস্টিকে ঘেরা একটা ছোট্ট তাঁবুর মধ্যে সিমেন্টের বস্তার পাশে থাকেন।
সেদিন ছিল রবিবার, বিকালে বাড়ির সামনের রাস্তায় ছেলে রাতুলের সাথে ক্রিকেট খেলবার জন্য বেরিয়েছি, রাতুল রাস্তার ওপর ইট দিয়ে উইকেট বানাচ্ছে। আমি দেখলাম এপ্রিলের এই গরমেও রহিমদা ওর তাঁবুর সামনে একটা ছোট টুলে গায়ে চাদরমুরি দিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। রহিমদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ’রহিমদা, এই গরমে আপনি গায়ে চাদর জড়িয়ে বসে আছেন কেন, শরীর ঠিক আছে তো?’ রহিমদা বললেন, ’দুদিন হল জ্বর হয়েছে, ঘরে ফোন করে বননু, ছেলেকে পাঠিয়ে দাও, ওকে একানে রেখে আমি গেরামে গিয়ে ডাক্তার দেকিয়ে আসি। তা সে বলে কিনা, - তুমি ওকানে ডাক্তার বদ্যি কর, আমি আমার ছেলেকে পাঠাব না। ওকানে ঝোপঝাড়ে লতা আছে, কখন লতায় কাটবে, ওঝাও পাবে না।‘ ‘বাবু, বাড়িতে যোয়ান ছেলে রয়েছে, আর আমি বুড়োটা এখানে জ্বরে পড়ে আছি, আমি তো শাউরির পো, আমি জ্বরে মোলে, সাপে কেটে মোলে ওর কি এসে যায়।‘ আমি বাড়ি গিয়ে দুটো জ্বরের ট্যাবলেট এনে রহিমদাকে দিয়ে বললাম, ‘রহিমদা, জ্বরের দুটো বড়ি রেখে দাও, একটা এখনই খেয়ে নাও, জ্বর নেমে যাবে। কাল যদি আবার জ্বর আসে আর একটা খেয়ে নিও। কাল কেমন থাকো আমি একবার খোঁজ নিয়ে যাব।‘
রাস্তায় ছেলের সাথে ক্রিকেট খেলা চলছে, কোন সময় আমি ব্যাট করছি ছেলে বল করছে , কোন সময় বা তার উল্টো, ও ব্যাটে আর আমি বলে। দোতলার বারান্দা থেকে আমার স্ত্রী আমাদের খেলা দেখছিল, হয়ত বা ওখান থেকে ছেলেকে পাহারাও দিচ্ছিল। খেলতে খেলতে একবার বলটা রাস্তার পাশে ঝোপের কাছে গিয়ে পড়লে রাতুল বলটা ওখান থেকে আনতে যাচ্ছিল, ওমনি ওপরের বারান্দা থেকে ছেলের মায়ের উচ্চকণ্ঠ এল, ‘বাবুন, ওখানে যাস না, ঝোপঝাড়ে সাপখোপ আছে, কাঁটা আছে, তুই খবরদার যাবি না।‘ আর উনি আমাকে বলে উঠলেন, ‘তোমার আক্কেলটা কি, বাচ্চা ছেলেটাকে ঝোপঝাড়ে বল কুড়াতে পাঠাচ্ছ? যাও তুমি গিয়ে বলটাকে নিয়ে এসো।‘ মনে পড়ে গেল রহিমদার মতন আমিও তো শাউরির পো।
সুচিন্তিত মতামত দিন