সমীরণ চক্রবর্ত্তী

“আঁঠাময় এ ভুবন”
বেশ কিছুদিন ধরে শব্দ পাচ্ছিলেন মনোময় বাবু। সারাদিন ছাত্রছাত্রী ঠেঙিয়ে ঘরে ফিরে খুটখুট আর খুটখুট। বুক শেল্ফ, আলমারি, খাটের তলায়, রান্না ঘরে শুধুই খুটখুট আর খুটখুট।

মধ্যবিত্ত ছাপোষা মাস্টার মশাইয়ের ঘর যা হয়, চার দিকে বইখাতা, পুরনো খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, ছাত্র-ছাত্রীর উত্তরপত্র আর নোটস্-এর ডাঁই।

ক’দিন ধরেই রমলা বলেই চলেছে, “ওগো লখার বাপ, বইখাতা কিনে আনো, বাছাদের পড়াশোনা করাতে হবে, আর যে টেকা যাচ্ছেনা ঘরে।” রাশভারী মনোময় বাবুর হেলদোল নেই, ভেবেছেন রমলা বোধহয় ছাত্রছাত্রীদের কোনোও বইয়ের কথা বলছে। এমন ভাবেই কাটলো কয়েকদিন, আগের থেকে শব্দটা আরোও বেশি কানে আসছে, রমলা আবার বলে, “ওগো... বইখাতা আনো, আর তো থাকা যাচ্ছেনা...।” মনোময় বাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, “কি বই? কোন খাতা? রোজ রোজ কি সব বলছো?” রমলা কানে কানে বলে, “বাড়িতে নেংটি ঢুকেছে, ছানাপোনা দিয়েছে, ভরা সংসার, সব কেটে তছনছ, তুমিতো দেখছি আজকাল আর কোনো খবরই রাখ না, কাল ফেরার পথে ট্র্যাবল-গাম নিয়ে এসো।”

- তাই বল ইঁদুর মারার বিষ! এইতো... বড়োই জটিল নারী চরিত্র, এতো হেঁয়ালি করার কি আছে?

রমলা কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, “না গো না, এ হলো ইঁদুর ধরার আঁঠা মাখানো খাতা, জায়গা বুঝে রেখে দিলেই কেল্লাফতে..., আর হ্যাঁ শোনো, অমন করে ষাঁড়ের মত মেলা চেঁচিয়ো না, নেংটিরা শুনে ফেললে আর এ পথ মাড়াবে না...”।

মনোময় বাবু আর কথা বাড়ালেন না, পরের দিন সন্ধ্যের সময় ট্র্যাবল-গাম নিয়েই ঢুকলেন বাড়িতে, আর সেটিকে মোড়ক খুলে পেতে দিলেন ইঁদুরের সম্ভাব্য গন্তব্য পথে।

পরের দিন স্যারের ঘুম ভাঙলো এক ঘণ্টা আগে, ভোর পাঁচটায়, সক্কাল সক্কাল মুষিক রাগিনী, কিঁচ...কিঁচ...কিঁচ... চিঁউ...চিঁউ...চিঁউ...

বিছানা থেকে নেমেই চোখ পড়লো ছ’টি নেংটি আটকে রয়েছে জমাট আঁঠায়, মনোময় বাবুর মনে পড়ল ছোট্টো বেলায় পড়া সেই ছড়া খানি, “এক বিছানায় দশটি ফকির শান্তি সুখে নিদ্রা যায়...” খানিক ভেবে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলেন, এটাতো আলাদা রকম কেস, এটি হবে, “এক আঁঠাতে ছয়টি ইঁদুর অশান্তিতে হাল্লা মাচায়...” তা যাই হোক, অঙ্কের স্যারের ইঁদুরের দুর্দশা নিয়ে কাব্য লেখার কোনও মানে হয়না, এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হল নেংটিগুলোকে ছাড়ানো যাবে কিভাবে? আচ্ছা..., আগে বাজারটা করে আসি, তারপর কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে।

ঘণ্টাখানেক পর বাজার থেকে ফিরে এসে মনোময় বাবুর চক্ষু চড়ক গাছ, একদিকে রমলা চেঁচাচ্ছে তারস্বরে আর অন্যদিকে দিকে পাশের বাড়ির ভুতির মা’র পোষা মেনি লুসি ফোকটে পাওয়া ইঁদুর খেতে গিয়ে মুখে, নাকে, গোঁফে জড়িয়ে নিয়েছে জ্যান্ত ইঁদুর সমেত আঁঠা ভরা ট্র্যাবল-গাম, মনোময় বাবু বাজখাঁই গলায় হুশ, হুশ... করতেই, তাড়া খেয়ে লুসি হাচোর পাচোর করে নিজেকে কোনও রকমে ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে ভুতির মা’র পাঁচিলে। লেজের উপর ভর দিয়ে বসে আড়চোখে ইঁদুর দেখে আর আঁঠা মাখনো থাবা চাটে। মনে মনে ভাবে---



   
কি বাঁচান বাঁচলাম আজ ম্যাঁও, ম্যাঁও,  ম্যাঁও...
     ফোকটে খাবার পেলে, তফাত যাও,তফাত যাও...
        
মনোময় বাবু ভাবলেন, যাকগে বাঁচা গেল, এবার আপদগুলোকে ফেলে দিই বাইরে। আস্তে করে ট্র্যাবল-গামের এক প্রান্ত ধরে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিলেন রাস্তায়। সাথে সাথেই জমে গেল গোটা দশে’ক কাক, হেঁড়ে গলায় সমবেত স্বরে কা... কা... কা..., কে কাকে হারিয়ে ইঁদুরের দখল নেবে। ততক্ষণে চায়ের কাপ হাতে মনোময় বাবু দাঁড়িয়েছেন দখিনের জানালায়...

একটা নবীশ কাকের ডানা জড়িয়ে গেল থকথকে আঁঠায়, বেশ নাজেহাল বেচারা,  থেকে থেকেই করুণ সুরে, কা... কা... কা...
মনোময় বাবু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুচকি হেসে বলেন,

ফোকটে পেলিই যখন বাছা
একটু দেখে শুনেতো খা...।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.