'হৃদয়ে-লতিয়ে-ওঠা একটি নিভৃততম গানে
সুখের নিদ্রায় কিবা জাগরণে, স্বপ্নের বাগানে,
অধরের অধীর চুম্বনে সান্নিধ্যের মধ্যদিনে
আমার নৈঃশব্দ্য আর মুখর আলাপে
স্বাস্থ্যের কৌলীন্যে ক্রূর যন্ত্রণার অসুস্থ প্রলাপে,
বিশ্বস্ত মাধুর্যে আর রুক্ষতার সুতীক্ষ্ণ সঙ্গীনে
দুর্বিনীত ইচ্ছার ডানায়
আসক্তির কানায় কানায়
বৈরাগ্যের গৈরিক কৌপীনে
দুঃখ তার লেখে না
---- শামসুর রাহমান
---- শামসুর রাহমান
সিগারেটের প্যাকেট শুধু নয়, লাইটারটাও রেখে গেছে অমল। আসলে ফেলে গেছে। এটা যথেষ্ট বিস্ময়ের। একদম হিসেবি আর প্রি-প্ল্যানড তার সব কিছু, রোহিতের ঠিক বিপরীত। এতটাই যে, একটা লাইটারের জন্য সে যদি রাজারহাট থেকে ফেরত আসে এই রাতে, অবাক হওয়ার কিছু নেই! একবার ফোন করতে গিয়েও মোবাইলটা রেখে দেওয়া মনস্থ করে রোহিত। ফোন করলেই যদি আবার...
বন্ধুদের উদ্বেগ রোহিত বোঝে। তাকে যারা তিলে-তিলে ক্ষয়ে যেতে দেখছে, তাদের ক্ষোভের কারণও জানে। তাই অমলের সব কথা আদৌ সমর্থন না-করলেও তাকে বলতে দেয়। বলতে দেয়, কারণ এভাবেই যদি বেরিয়ে আসে নতুন কোনো পথ, যে-পথ তাকে আবার পৌঁছে দেবে মৃন্ময়ীর নিজস্ব ঘ্রাণের বলয়ে! কিন্তু না, তেমন সুরাহা হয় না কিছু। কিছুক্ষণ কথা চলাচল হলে রোহিতের বরং মনে হয়, কেন সে সবকিছু বলতে গেল এইসব বন্ধুদের! অথবা সেদিন কেন তার শরীর এমনভাবে সঙ্গ ছেড়ে দিল, যার জেরে ওদের হাত ঘুরে মনোবিদের হাত পর্যন্ত পৌঁছে গেল তার ব্যক্তিগত নোটস, হননপ্রক্রিয়ার যাবতীয় খুঁটিনাটি!
কিন্তু সবকিছু? কই, না তো! কোথায় আর সবটুকু লিপিবদ্ধ করেছে সে তুমুল ভাঙনের আগে ও পরে! বেশিটাই তো এখনও লিখিত রয়েছে মনের ভিতরে! ওরা তার আঁচ পায়, কিন্তু হদিস পায় না। ভাগ্যিস পায় না, পেলে আরও হাজার কথার মুখোমুখি দাঁড়াতে হতো তাকে!
মৃন্ময়ী কথা বন্ধ করেছে এখন। এই নিয়ে গত একমাসে তৃতীয়বার! 'কী করে পারো, বন্যা!' এই বিস্ময়বাক্যটি এখন আর উচ্চারণ করা হয়ে ওঠে না। কারণ, প্রশ্নটি আপাতত গৌণ, যেহেতু মৃন্ময়ী বারবার প্রমাণ করছে সে পারে। যেমন করেই হোক, পারে! প্রথমে বাইশ, তারপরে একত্রিশ, তারও পরের দুই দফায় দিন সাতেক করে নিশ্ছিদ্র নীরবতায় সে দেখিয়েছে রোহিতের অনুপস্থিতিতেও তার সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত ইত্যাদি যথারীতি আসে, এবং যায়!
অথচ মৃন্ময়ী নিজেই আবার ফিরে-ফিরে আসে। আক্ষেপের কথা বলে। নিজের অসহায়তা ও অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চায়। কখনও চকিত ভিডিও কলে একটু দেখে নিতে চায় রোহিতের মুখ। 'একটা ভিডিও কল করতে পারি?' ফিরিয়ে দেওয়া অসম্ভব বলেই, তার ফোনের স্ক্রিনে ফুটে ওঠে রোহিত। অথচ সে কিছুতেই তার বন্যার দিকে তাকাতে পারে না! ঝটপট ভিডিও কল শেষ করে বন্যা লেখে, 'আমার মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে না-করাই স্বাভাবিক!'
রোহিত এই বেদনার কারণ জানে, জবাবও। কিন্তু নীরব থাকাটাকেই বেছে নেয়। এই বন্যাকে সে বোঝাতে পারবে না, তাকে দেখলেই নিজের চোখ ছাপিয়ে প্লাবনের সম্ভাবনার বিষয়ে সে কতটা নিশ্চিত! মিঠুন চক্রবর্তীর একটা ইন্টারভিউয়ের কথা খুব মনে পড়ে যায় আজকাল: 'কান্না পেলে, বাথরুমে গিয়ে কাঁদবে। কিন্তু ওখান থেকে যখন বেরোবে, তখন যেন দু'চোখে শুধু আগুন থাকে!' মোটামুটি এরকমই ছিল শব্দগুলো। কিন্তু অন্তত মৃন্ময়ীর সামনে এই কাঠিন্য অর্জন তার অকল্পনীয়। চোখ অন্যদিকে রাখা শ্রেয় বলে বেছে নেওয়া তাই!
বন্ধুরা সবকিছু জানে না। বন্ধুদেরও সবকিছু জানাতে নেই। বিশেষ করে, চরম অসম্মানগুলোর কথা। যেমন ধরা যাক, সিঁদুরখেলার পর্বটি। হ্যাঁ, 'খেলা' ছাড়া আর কী ছিল!
যদিও এই মৃন্ময়ী ছিল একদিন আবেগে থরোথরো, 'এই সম্পর্কের স্বীকৃতি কীভাবে দেবে, বলো?' এই মৃন্ময়ী সেদিন তেমন কিছু একটা চায়, যা খুব গভীর-গোপন স্বপ্ন হয়ে আছে রোহিতেরও! অথচ মৃন্ময়ী যা চায়, সেই-সব পর্ব সমাধা হলে, অনেক পরে একদিন সে-কথার পিঠে, মৃন্ময়ী অবলীলায় বজ্রপাত করে।
'সিঁদুর কোথায়! ওটা তো লিকুইড সিঙ্গার! বোঝোনি?'
না, এত বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ বোঝার ক্ষমতা কোনো ইমোশনাল-ফুল রাখে না! এখন অবশ্য, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পরে, বোঝা যায়! বোঝা যায়, কেন আগে চাইলেও রোহিত তার মায়ের সিঁদুরকৌটো থেকে লালরঙের গুঁড়ো দুই আঙুলে তুলে নেওয়ার উপক্রম করতেই তড়িঘড়ি নিজের সাজের সরঞ্জামটি হাতে তুলে দিয়েছিল বন্যা!
অথচ ছলনা অপ্রয়োজনীয় ছিল। যাতে তোমার সংস্কারে বাধে, তা তুমি চাইতে যাবে কেন! কেন ভালোবাসার চিরকাঙালকে দেখাবে তেমন আশা, যা তুমি নিজেই পূরণ করতে পারবে না! সবকিছু নিয়ে খেলা করতে নেই, বন্যা! অন্তত তার সঙ্গে তো নয়ই, যে তোমায় সর্বস্ব দিয়ে বসে আছে!
এইসব অপ্রিয় কিন্তু কটু সত্য সবসময়ে উচ্চারণের সাহস রাখেনি রোহিত। রাখেনি বলেই কখনো-সখনো অমন বজ্রপাতে পুড়ে গেছে তার ঘর! অথচ সাহস রাখা উচিত ছিল। একথা জেনেই উচিত ছিল যে এইসব অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেই মৃন্ময়ী তার সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন করবে! আজ যখন বারবার সংযোগহীন হতে হতে নিজের জায়গা চিনতে শিখছে রোহিত, তখন কষ্টের বিপুল তরঙ্গও তাকে দিয়ে আর কোনো অনুরোধ, কোনো মিনতি করাতে পারে না। পরাজয় আরও নিশ্চিত হয় তাতে। কিন্তু স্বীকৃতিহীন জীবনের থেকে বীরের মৃত্যু শ্রেয়। রোহিতের মৃন্ময়ীকে চাই, মৃন্ময়ীর সবটুকু চাই এবং যেমনভাবে সে মৃন্ময়ীকে পেতে অভ্যস্ত ছিল, ঠিক তেমনভাবে চাই। মাঝামাঝি কোনো কিছুতে তার বিশ্বাস নেই। জীবনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে আসলেই সে তুমুল চরমপন্থী। বিশেষত ভালোবাসার মতো জরুরি বিষয়ে কোনো মধ্যপন্থা হয় না। আর হয় না বলেই তার দ্বারা 'আমার সঙ্গে কথাটুকু অন্তত বোলো'-জাতীয় হিজড়েপনা করা হয়ে ওঠে না! হয় সে যেমনভাবে ছিল, তেমন রাজকীয় থাকবে; অথবা তাকে ক্রমশ একদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও! এর মাঝখানে আর কিছু হয় না, বন্যা!
যদিও এইসব আত্মগত সংলাপ, এই অন্তহীন সলিলোকি, মাঝেমাঝে উচ্চারণ করেছে রোহিত; তবু বেশিটাই উচ্চারিত না-হয়ে তার মনের খাতা থেকে দিনলিপির পাতায় লেখা হতে থাকে আবার। ঠিক যেমন লেখা হতে থাকে, আরও একটি অপমানের মধ্যরাতজাত যন্ত্রণা! 'আপনার ...সোনা এখন ঘুমের দেশে' ঠিক মাঝরাতে বিনা প্ররোচনায় ভেসে আসা এই লিখিত বার্তাটির মধ্যে কী ছিল না আসলে! ব্যঙ্গ? শ্লেষ? দখলদারির বিজ্ঞাপন? সবক'টাই নির্লজ্জভাবে ছিল। আপাত-ভালোমানুষী বাক্যের আড়ালে ছিল নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে বলা: 'দ্যাখ, কেমন লাগে'! গায়ে পড়ে কটাক্ষের এই প্রবণতাকে তুমি শেষ পর্যন্ত নিজের পৌরুষ ভাবো, পুরুষ? যদি ভাবো, তবে হে পুরুষ, তোমার 'পৌরুষ'-এর দিন গিয়াছে! কারণ, বাস্তবতই, এর থেকে কাপুরুষোচিত আচরণ কী হতে পারে আর!
(ক্রমশ)
সুচিন্তিত মতামত দিন