পিনাকি

এবং  ঋষিকা...
প্রথম পর্ব  -  ১

নরম বুকের  উপর   বুক  ছুঁয়ে  যেতেই , খেলে  গিয়েছে শিহরণ ! শ্যাম বর্ণের  মুখে  কালো   চুলের   ভারী  গোছাটা , পুরুষালী  আঙুল  গুলো  সরিয়ে  দিল । গভীর চওড়া চোখের  দিকে  চোখ  গিয়েছে ।  বৃষ  দেখছে ,  মেয়েটির সরু  বুকের  খাঁজে , দুটো  স্তনের মাঝখানে  পাহাড়ের  অন্তর্ভেদী  গহ্বরের  মতনই  আকর্ষণীয় অপটু বিভাজিকা !  সেই  দিকে চোখ  থেমে  গেল । দ্রুত নিঃশ্বাসের  উত্থান – পতনের  ছন্দ  শুনতে  পাচ্ছে  দু’জনেই । 

গভীর অরণ্য । বৃক্ষের  ফাঁকে – ফাঁকে , রাতের  অন্ধকার  ঝুলে  রয়েছে । প্রতিটি  বনস্পতি   নিঃশ্বাস  ত্যাগে   ব্যস্ত ।  পুরু  ঘাস ভূমির  উপর ,  দুই যুবক – যুবতী  শুয়ে  । মেয়েটি ভূমিতে , তার  উপরে  ছেলেটি । পরস্পরের  দিকে তাকিয়ে  , তারা  হতচকিত ।

বৃষ , যুবতীটিকে  উদ্দেশ্য  করে  বলল – তুমি , ঠিক আছো ? আমাদের  এখন  এই ভাবে  থাকতে হবে  । ঋষিকা খুব  সহজ  ভাবে  উত্তর  দিল – আমি ,এর  চেয়েও  কঠিন অবস্থার  কথা  ভাবছিলাম ।

বৃষ , মেয়েটির  নরম  ঠোঁটে , হাতের  পাতা  রেখে  নিজের  শক্ত  বুকের  মধ্যে  চেপে  রেখেছে । কানে ফিসফিস  করে  বলল – জন্তুটা  এখনো  চলে যায়নি । সাবধান ।  ঋষিকা দুটো  নরম  হাত  দিয়ে  , বৃষের  কাঁধ  জড়িয়ে  বলল – অনেকক্ষণ  হয়েছে । এখানে  থাকলে  টের  পেতাম । বিষাক্ত নিঃশ্বাসের  কটু  গন্ধ  নাকে  আসত । আমার  মনে  হচ্ছে , আমাদের   ওই  পাশে গাছের   গুঁড়ির  পিছনের  গর্তে ,   আত্মগোপন করতে  হবে।  সেখানে  আমরা  নিরাপদ। আমার  মনে  হচ্ছে  , জন্তুর  হাত থেকে  বাঁচলেও   ঠাণ্ডা থেকে  বাঁচতে  পারব না । 
বৃষ  কিছুক্ষণ  অপেক্ষা  করে  বলল – ঠিক  বলেছো । এত  ভয়ে  ছিলাম  যে  ,  বুঝতেই  পারিনি  অনেক সময়  কেটে  গিয়েছে ! যদিও  গায়ে  , পশুর  চামড়ার  পোশাক  রয়েছে ।  ঠাণ্ডা  যেনও অদৃশ্য  তীরের ফলার  মতন  বিঁধেই  চলেছে  ! সত্যি  খুব  কষ্ট  হচ্ছে  ।

ধস্থাধস্থিতে  বুকের  উন্মুক্ত  অংশের প্রতি  খেয়াল  হতেই ,  ঋষিকা  ঢেকে দিল ।  স্নায়ুতে  ভয়ের  প্রবাহ  থাকায় , এক  পুরুষ দ্বারা  শরীরের  অনাবৃত  অঙ্গ  দেখবার  লজ্জা  তেমন  দেখা  যায়নি । এখন  বেশ  লজ্জা – লজ্জা  করছে । বৃষের  ভালো  লাগল । সাহসী  মেয়ে  লজ্জা পেলে , যৌন  আকর্ষণ  বেড়ে  যায়  ।

কিছুক্ষণ  আগে , মৃত্যু নিজে এসেছিল , ওদের সাথে দেখা করতে ! ওরা যে ঝোঁপের পিছনে  শুয়ে রয়ে ছে , পরস্পরকে জড়িয়ে । ঝোঁপের  উল্টো দিকের স্থানে সেই ভয়ঙ্কর  জন্তুটা দাঁড়িয়েছিল । তার নিঃশ্বাস ছড়িয়ে দিয়েছে , তীব্র দুর্গন্ধ । মুখটা কুমীরের মতন , বাকী দেহটা হায়নার মতন । লম্বা  কাঁটা ভরা লেজ । নতুন শিকারের সন্ধানে এসেছিল , ওরা লুকিয়ে প্রাণে বেঁচেছে ।  ঋষিকার পরিস্থিতিতিতে  , বৃষকে  সহযোগিতা  করবার  চেষ্টাই , তার  প্রতি    টান  আরো তীব্র  করল  ! 

এখন  অনেক  রাত ।  ভোর  হতে  কয়েক  প্রহর  বাকী  রয়েছে । দু’জনেই   গর্তের  ভিতর  এসে   আশ্রয়  নিয়েছে।   এত অন্ধকারে , আগুনের  দরকার  ছিল  । বৃষ  আগুন  জ্বালায়নি , পাছে   শত্রু  শিবিরে  খবর  চলে  যায় ।   নৃশংস শত্রু ।  যে কোন  মুহূর্তে ওদের  মেরে ফেলতে  পারে ।

ঋষিকা    প্রাণের  ভয়কে  কোনোদিনই  এতটা  গুরুত্ব  দেয়নি । এই  বিপদকালীন  সময়েও   দেবেনা । সে  জানে , মৃত্যু  আজ  নয়  কাল   আসবেই । সকলকেই একদিন না  একদিন  এই  প্রতিনিধি   ছেড়ে  চলে  যেতে  হবে ।  আসল কথা  হচ্ছে প্রতিনিধি  ছেড়ে  যাওয়ার  আগে এমন  কোন কাজ  করে  যাওয়া , যা  ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা  করবে । এই   উদ্দেশ্য  সফল  করতে  গিয়ে যদি  প্রাণ  চলে  যায় , তাও  সম্মানের ।  এত সব  ভেবেই  সে এত দূর  পর্যন্ত  সে এসেছে ।  তাকে  আরো  দূর যেতে  হবে  ।  লক্ষ্য ছুঁতে  এখনো অনেক  পথ  বাকী    রয়েছে ।

-বৃষ , তোমার  কী  মনে  হচ্ছে  আমরা  আমাদের  গন্তব্যে  পৌঁছাতে পারব ? 
-হাসালে ।  এত শক্ত   প্রশ্ন  করে  আমাকে  , আমার চোখেই  নামিয়ে দিচ্ছ ! ঋষিকা  হাসল । ক্ষণিক অন্ধকারে  বিদ্যুৎ ঝলসানি  ! 
-না , না । তুমি   বলতে পারবে  । 
-কতটুকু  আমরা   পরস্পরকে  চিনেছি  ? এর  মধ্যেই  আমার  প্রতি এত  বিশ্বাস !
-বাবা  অনেক  ভাবনা  চিন্তা  করেই , আমাকে  আপনার   সাথে  পাঠিয়েছেন ।
-বলও  আমার  হাতে  তুলে দিয়েছে  । আমি  এখন  তোমার  অভিভাবক  । 
-তুমি  কথায়  -কথায় আসল  বিষয়  এড়িয়ে  যাচ্ছ । 
-একদম  নয় । আমাদের কথা সবে শুরু হল । আমি তোমাদের  গোষ্ঠীতে সবে মাত্র যোগ দিয়েছিলাম । তখন আমরা একে অন্যকে আপনি বলে সম্বোধন করতাম । তোমার পিতা আমার কাঁধে এত বড় দায়িত্ব দিলেন । তুমি জোর করলে । এখানে নাও আসতে পারতে ।  
-আমি তোমার সাথে এসে , তোমাকে বিপদে ফেললাম ।
-ঋষিকা তুমি নিজেই নিজেকে ভালো করে চিনেছো । তোমার বীরত্ব নিয়ে আমার বা আমাদের বিন্দুমাত্র সংশয় নেই ।  তুমি গোষ্ঠীপতির মেয়ে হিসেবে নির্বাচিত হওনি , এই কাজে তোমাকে নেওয়া হয়েছে , কারণ তোমার যোগ্যতা । যুদ্ধ কৌশল ।  উন্নত চিন্তা ।  সাহস । নারী হয়েও তোমার সমতুল্য   যোদ্ধা  শ্ত্রুদের কাছেও নেই । 
-তাহলে , তুমি এমন ভাবে বললে কেন ? 
কিছুক্ষণ থেমে রইল । বৃষ নিঃশ্বাস চেপে রেখেছে  ।  গহ্বরের  বাইরে  রাত , পাত্রের বাইরে  প্রবাহিত তরলের মতনই বইছে । 
-ঋষিকা তুমি   ওদের আক্রমণ কেন করবে ? 
-ওরা অন্যায়কারী । শাসক । 
-এখন মনু রাজার রাজত্ব চলছে ।  বৈবস্বত মনু । সে কেমন লোক ?
-শয়তান । 
বৃষ হাসল – নৃশংস ,  সেই কাহিনী ।  তোমায়  শোনাবো ... ...... 
                                                   


কবেকার  কথা  ঠিক  করে  কেউ  বলতে  পারবে না । 

সেই যুগে  মানুষ  স্বাধীন  ছিল । এই  কাহিনী  সংহিতা  যুগের আগে ।  বলা  যায়  এখান থেকেই  শুরু   আরেক  নতুন  সময়ের ।  সমাজের । সভ্যতার । আর  শাসনের । মানুষের  সভ্যতাও  অনেক  সময়  পরিবর্তনের  নামে  বন্দী  হয়ে  যায় !  এই প্রক্রিয়া  যখন  চলতে  থাকে  , মানুষ  বুঝতেও পারে না  ।  সে যত  দিনে  বুঝতে  পারল , ততদিনে  একটা  যুগ কেটে  গিয়েছে  ! আমরা প্রবেশ করেছি , সংহিতা যুগে ! মানুষের  নিজস্ব  ইচ্ছা  , চাহিদা  আর আকাঙ্খারা  আকাশে  উড়তে পাচ্ছে  না । তারা  নিজেরাও  জানল  না  , এই নতুন সমাজে সব  কিছুই  মেপে  করতে  হবে । আমরা এই  পরিবর্তনে  সামিল  হয়ে  গিয়েছি , অতি সন্তর্পণে । সভ্যতা  এমন ভাবেই  রুপান্তরিত  হয় , অতি  কৌশলে , ধীরে  আর   চাপিয়ে  দেওয়া  সংস্কৃতির  প্রহেলিকা । বড়  সভ্যতা  এমন ভাবেই  ছোট  সভ্যতাকে  গিলে  খাবে  । 

তেমন ভাবেই আমাদের  মনে হতে শুরু হল , আমরা পরাধীন ! এই পরাধীনতা , নিজেরাই চাপিয়ে নিয়েছি । যে জন জাতি নিজেদের  প্রতি উদাসীন থাকে , তাকে সহজেই দখল করা যায়। দীর্ঘ   সময় ধরে আমরা বেঁচে ছিলাম , বংশ বিস্তার করছিলাম ---- সেখানে মৌলিকত্ব নেই। যে সভ্যতায়  নিজস্বতা থাকে না , তা অনেক সময় পর্যন্ত সুরক্ষিত নয় । এমনটাই ঘটল । আমাদের  নিজেদের  রণ কৌশল  ছিল  না ।  সামাজিক  মূল্যবোধ  থাকলেও , তার  প্রকাশ  ছিল না ।  নিজেদের সভ্যতার  কোন  দার্শনিক অভিমুখ  নেই , মানে   সভ্যতাটা  ঠিক  কোন  চিন্তা  নিয়ে  , কোন  পথে  এগিয়ে  যাবে , তা নিয়ে  বিন্দু মাত্র  মাথা  ব্যাথা  নেই ।  এমন একটা  সমাজ , যা   সর্বদা  নিজেদের  নিয়েই  ব্যস্ত  থাকত , অথচ  নিজেদের  খোঁজ  করেনি । সমাজে  সমাজ  থাকলেও , তার  রাশ  আমাদের  হাতে  নেই  ।  এই হচ্ছে  সংহিতা  যুগ  শুরুর  প্রথম  দিক । আগে আমরা  শান্তিতে  বসবাস  করছিলাম । নিজেদের  মধ্যে  ঝামেলা  থাকত । সে লড়াই  খাদ্য  সংগ্রহ  আর  সংগৃহীত  খাবারের  ভাগের মধ্যেই  সীমাবদ্ধ । 

কিছুক্ষণ থেমে আবার শুরু করল বৃষ –

 একটা  সভ্যতার  সবচেয়ে  দুঃখের  সময়  তখনই , যখন  সে  বাইরে  থেকে  চাপিয়ে  দেওয়া  দর্শনে  ধীরে – ধীরে  আসক্ত  হয়ে  পড়ে। এমনটা  হচ্ছে   অথচ   মানুষ  বুঝতে  পারছে  না ! আমি আমার  বাবার  বাবার  মুখ  থেকে  শুনেছি , ওদের  নেতাই  এই  সভ্যতা  সৃষ্টির আদি  মানুষ । তার  চেহারার  সাথে  আমরা  নিজেদের  মিল  খুঁজে পেতাম  না । সবাই ডাকত  ব্রক্ষ্মা বলে । সে  বরফের  দেশের  লোক । পোশাক দেখে   তাই  মনে  হয়েছিল । আমি বা  আমার  পরিবার  কখনই  নিজের  চোখে দেখিনি , হাওয়ার  মতনই  তার  কীর্তি , মহিমা , ক্ষমতা  --- এখানে  ছড়িয়ে  গিয়েছে ! আমরাও একটু – একটু  করে  বিশ্বাস করতে  শুরু  করেছি । এই চারপাশ , প্রাণীর --  সৃষ্টিকর্তা  সে । আমরা  তারই  প্রজা ।

এই যে  বললাম ‘ প্রজা ’ ! এটাই  আমাদের  দুর্বলতা  স্বীকারের  প্রথম  শব্দ । বলতে  পারো , এর আগে  এই শব্দের  আত্মপ্রকাশ  ঘটেনি। এরজন্যই   শব্দই সবচেয়ে  ভয়ঙ্কর  আর  শক্তিশালী  অস্ত্র  । গোটা  সভ্যতা  যখন  কোন  শব্দকে   বিশ্বাস করতে  শুরু  করে  , তখন  সেই  শব্দের  ভিতরে  লুকিয়ে  থাকা   চিন্তা  তাকে  গ্রাস  করে ।  এমন ভাবেই  আমরা    ‘প্রজা ’ শব্দের  হাতে নিজেদের  আত্মসমর্পণ  করেছিলাম । এই শব্দই আমাদের আত্মবিশ্বাস শুষে নিয়েছে ।

এখান থেকেই শুরু  হয়েছে  মনুর শাসন ।  ভাষাগত আক্রমণ ঘটেছে সবার প্রথমে , তারপর নিয়ম , সংস্কার , নীতি ।  এক ভয়ানক  পরাজয় , যন্ত্রণা আর  পরাধীনতার  চিন্তা  আমাদের  গ্রাস করল ।  সভ্যতার  এক অংশ   মনুর  দর্শনকে  নিজেদের  আধার  মানতে  শুরু   করেছে । এই  বিষ  অনেক দূর  ছড়িয়ে  গিয়েছে ।

-মনুর পরিচয় তুমি জানও ? 
ঋষিকা এই নামটা আগে শুনেছে । এখন পরিচয় জানতে চাইল । 
-হ্যাঁ ।  ব্রক্ষ্মা , নিজে  এই  বিশেষ  পদের  সৃষ্টি  করেছে । এখান  থেকেই শুরু  সংহিতা  যুগের । 
-ঠিক  বুঝতে  পারলাম না  । 

ঋষিকা  , তার  বাবার  কাছ  থেকে  শুধু  শুনেছে  , তাদের  বিশেষ গোষ্ঠী  বৈবস্বত মহারাজের  বিরুদ্ধে লড়াই  করে  চলেছে  । এখনই  সময়  , স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে  হবে  ।  তা না হলে  মুক্তি এইবারো  অধরা  রয়ে যাবে  ! বৃষের  মুখে   মনুর কথা  শুনে  কিছুটা  অবাক  হয়ে  গেল!  

-মনু   , ব্রক্ষ্মা  সৃষ্ট একটা  পদ । যার  দায়িত্ব  , প্রচুর  পরিমাণে অনুগত প্রজা  তৈরী   করা । মনু পদের  কখনো  পরিবর্তন হয়না । শুধু   পদের দায়িত্বে  যিনি থাকেন  , সেই  ব্যক্তিটি পাল্টে জান ।  এই যে  সময়ে  আমরা  রয়েছি , সেই  সময়ে   সপ্তম মনু হচ্ছে  মহারাজ বৈবস্বত । তার আমলে তোমরা  যেমন  বিদ্রোহ করছ । তেমনই  আমার  পরিবার  বংশ পরম্পরায়  মনু পদের  বিরোধীতা  করে আসছে  । আমি এখানে  এসে  , তোমাদের  সংকল্প  জানতে  পারি । আমাদের     লক্ষ্য  মনু পদের  অবলুপ্তি , তোমাদের  লক্ষ্য বর্তমান  মনু  মহারাজকে  ক্ষমতা  চ্যূত  করা । আমার  মনে  হয়েছে , সময়  এসেছে  একসাথে  ঝাঁপিয়ে  পড়বার  ।

 ঋষিকা  চুপ  করে  শুনছে । বলল – আমরা  যেখানে  যাচ্ছি , সেখানেই  এই সমস্যার  সমাধান  আছে ? 
-হ্যাঁ  আছে  । এই  সমস্যার  শুরুও সেখান থেকেই । 
-মানে ?
দু’জনেই  সন্তর্পণে  একটা গর্তের ভিতর গিয়ে  ঢুকল । বৃষ   গর্তের  ভিতর  থেকে  বাইরে তাকালো  । অন্ধকার  পাতলা  হচ্ছে । অরণ্যের বুকে  জমে  থাকা   অন্ধকারে , এখন  খানিক দূরের অস্পষ্ট  দৃশ্য  দেখা  যাচ্ছে ।  তার  নিজের এইবার  ভয় করছিল । সেই  দানবীয় জন্তুটা  আবার আক্রমণ  করতে  পারে  ! আমাদের  দরকার  এই স্থান  এক্ষুনি  ত্যাগ  করে  , নিরাপদ  জায়গায়  চলে  যাওয়া । 
ঋষিকা  বলল – বৃষ  তোমাকে  গল্পের  দ্বিতীয় পর্বে  যেতেই  হবে  । আমি  শুনব  আর এখানেই  শুনব । আমরা  যেখানে  যাচ্ছি , সেই  স্থানের  সাথে  মনু সাম্রাজ্যের  সম্পর্ক  , জানতেই হবে  । তাছাড়া  মৃত্যু  আমাদের  কাছে  এখন  খুবই  সহজলভ্য । তার  থেকে  নিরাপদ  থাকতে  চাওয়াটাই হাস্যকর । তার  চেয়ে  তুমি  বলো  আমি শুনি , সেই  স্থানের  সাথে  মনুর  সম্পর্ক ... 
বৃষ দেখল , মেয়েটা  ভীষণ নাছোড়বান্দা ।  
                                                           


ব্রক্ষ্মা প্রথম এই স্থানে এসে  বুঝতে পারে , এখানে খুব দ্রুত ক্ষমতা বিস্তার করা যাবে না। এখানকার  গোষ্ঠী গুলো পরিশ্রমী এবং বাঁধন ছাড়া। সে শুধুই এই অঞ্চলকে দখল করতে চায়নি। তার পরিকল্পনা আরো সর্বগ্রাসী   ছিল । বলা যায় , এখানকার মানুষদের ব্যবহার করা। ভূমি , জল, অরণ্যকে --- দখল করে , ক্ষমতায়ণ  কায়েম করা । তার দখল করা সম্পদের মধ্যে নারী আর মানুষ  বিশেষ দরকারী ।  মনুর দায়িত্ব হচ্ছে  , প্রজা   তৈরী  করা  । যত বেশি  লোক তাদের  বশ্যতা  স্বীকার  করবে , তত  দ্রুত  তারা  ক্ষমতায়ণের    লক্ষ্যে  এগিয়ে যেতে  পারবে  ।

বলতে  পারো , নৈমিষারণ্য তেমনই  গবেষণাগার । এখান থেকেই  প্রথম শুরু  হয় , এই সমতল ভূমিতে  ক্ষমতা বিস্তারের  খেলা । এটা ঠিক , গায়ের  জোরে  নয় , আমরা  পরাজিত  তাদের  সাংস্কৃতিক , দার্শনিক    চিন্তার  কাছে  । এই সব কিছুর  উৎস , ব্রক্ষ্মার  সৃষ্টি অরণ্য । গোমতী নদীর  ধারে  , এক  অরণ্য ক্ষেত্রকে  নির্বাচন করা  হয়েছিল । সেখানে  ব্রক্ষ্মা নিজের স্বার্থেই  মুনিদের  আশ্রয়  দিয়েছে  । তাদের  দায়িত্ব রাতদিন  আত্ম   নিরীক্ষণ করা  । গবেষণায়  উপলব্ধি করা , যে  বিশাল  সংখ্যক মানুষকে  সমস্ত  দিক থেকে   দাসত্ব  গ্রহণ করাতে  হলে  , যে  পদক্ষেপ  গুলো নিতে  হবে  , তা  নিয়ে  । শুধু তাই নয় , আমাদের  চিন্তা  - ভাবনা  প্রথমে  তাদের  কাছে  অজানা  ছিল । এখানেই সেই বিষয় নিয়ে   অনুসন্ধান  চলছে । মনু রাজারা শক্তি পায় এই আশ্রম  থেকে  ।  শুধু  তাই  নয় , আমাদের  সভ্যতার   এক অংশকে ওরা  নিজেদের  দিকে  নিয়ে নিয়েছে ।

-মানে , মনুদের ক্ষমতার  প্রধান  উৎস  নৈমিষারণ্য ! 
-হ্যাঁ ঋষিকা । আমরা  তাই সেই আশ্রমেই প্রথম   আক্রমণ  করব । 
-বৃষ , তোমার  কথা  শুনে  বুঝে  গিয়েছি , এই স্থানে   প্রহরা  থাকবে  । যার  নমুনা  টের  পেয়েছি ,  সে দৈত্য জন্তুটাকে  দেখে ! দু’জনে  এমন  দুর্ভেদ্য  স্থানে  আক্রমণ করব  কেমন করে ! এটা  উন্মাদের  মতনই  আত্মহুতি  হবে  । 
- ভয় পাচ্ছ ?
-একদম নয় । তবে হ্যাঁ এমন ভাবে  নিজেদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়ার  মধ্যে  কোন বীরত্ব নেই । তাছাড়া ওদের  আক্রমণ করতে হলে , যত সম্ভব বেশী  ক্ষতি করতে হবে । আমরা ওদের  ছুঁতে অব্দি পারব না ! 
-ঋষিকা , তোমার  মনে   হচ্ছে  , আমরা  ওদের   যুদ্ধে  হারাবো ?  তাই  এত  কষ্ট  করছি ?
-তাহলে ? 
-আমরা  আশ্রমে  যাচ্ছি  এক  গোপন  রহস্য  সন্ধানে । এই রহস্য ভেদ করতে  পারলেই , লক্ষ্য ছুঁয়ে  ফেলব ।
-আমায় খুলে বলো  বৃষ । আমি বুঝতে  পারছি না । 
-ঋষিকা , কোন   শক্তিশালী  সংস্কৃতির  বিরুদ্ধে  আক্রমণ করতে গেলে , প্রথমেই   আমাদের  দরকার  সেই সভ্যতার   দুর্বলতা গুলোকে  চিহ্নিত  করা ।  ওরা  ধাপে  -ধাপে  আমাদের  গ্রাস  করেছে । তুমি  ভালো  করে  চিন্তা  করলে বুঝতে  পারবে  , মনু কখনোই  আমাদের সরাসরি  আক্রমণ  করেনি । তার  দণ্ড  আমাদের শাস্তি  দিত । এই শাস্তি দেওয়া  হত  নিয়মের  মাধ্যমে। আমরাতো আগে  নিয়মে বাঁধা  ছিলাম  না !  আমাদের  এমন ভাবে  বন্দী  করা  হল কেন  ? শুধু সেখানেই  আমরা  আটকে  নেই , আমাদের  খুঁজে  আনতে  হবে  আরো  উত্তর ।  সমাজে প্রতিনিয়ত  ওদের  শক্তি  বৃদ্ধি  হচ্ছে , এর কারণ মানুষের  মনে   ওদের  প্রতি আস্থা  । যে  নিয়মের  চাপে  সমাজে  শোষণ  হয়ে  চলেছে ।  সেই  নিয়মকেই  অনেকে  নিজেদের  অস্তিত্ব মানছে । এটা  ঠিক  , আমাদের  উপর  চাপিয়ে  দেওয়া  হয়েছে । আবার এটাও  অস্বীকার  করতে  পারব না যে  ---  চাপিয়ে  দিলেই  তা  বিনা  প্রতিবাদে  মেনে  নিয়ে  , যেমন  চলছে  চলুক...... আর সম্ভব  নয় ।  মনুর মন্বন্তর   দেখছি । এক সমাজ নষ্ট হবে  আরেক সমাজ  জন্ম নেবে  । যে  সমাজে   শ্রেণি     বিভক্ততা  ছড়িয়েছে , সেখানে   দ্রুত  ফেরা যাবে  না  । কেন সেই সমাজের  উপর  সাধারণের  এত   উৎসাহ  , এর  পিছনে  কী কারণ  আছে  ? এটা তুমিও বুঝতে পাচ্ছ  যে মনু চিন্তা আমাদের রক্তে – রক্তে মিশেছে । তার দর্শন দূষিত বায়ুর মতনই সেবন করছি । আর নয়...... 

বৃষের  কথা  শুনছে মন দিয়ে  ।  ঋষিকার মুখে  চিন্তার  ছাপ । এখন  যে  পরিস্থিতিতে  তারা  এই অভিযানে  এসেছে , তা  বেশ  গভীর । মনুর  যুগে ,  সম্ভবত সবচেয়ে  ভয়ঙ্কর আর  দুর্যোগ  ভরা  সময়  হচ্ছে  এই  বৈবস্বত মনুর  রাজত্ব ।  প্রজাদের  উপর  যেমন  শোষণ  বেড়েছে , আবার  নারীদের সামগ্রীর   মতন   নির্দ্বিধায়  হস্তান্তর  করা  হচ্ছে ।  প্রাকৃতিক  সম্পদ   অবৈজ্ঞানিক পক্রিয়ায় ব্যবহার  করার ফলে , ক্রমশই  নিঃশেষের পথে । সমাজে  এই  নিয়ে  কোন  দীর্ঘকালীন  প্রস্তুতি নেই ।  মহামারী   শুরু  হয়ে  গিয়েছে ।  
ঋষিকার পূর্বপুরুষেরা  কোন সময়ই  , মনুদের  দাসত্ব  স্বীকার করেনি ।  প্রথম থেকেই  তারা  যুদ্ধ  চালিয়ে এসেছে । তাদের  স্থির  বিশ্বাস এক সময়  যেমন  তারা  খোলা  আকাশের  নিচে  শ্বাস  নিত । নিজেদের  কোন  রকমের  চাপিয়ে  দেওয়া  নিয়মে  বেঁধে  রাখেনি , এই  বাসভূমির প্রাক্তন অধিবাসীই নয় , তারা  এই  ভূমির মালিক । যদিও  এই  ক্ষমতার শর্ত তাদের  ভিতরে  সেই  যুগে  ছিল  না  । এমন কী তাদের  নিজস্ব কোন চিন্তাই ছিল না । নিজেদের  দাসত্ব  মেনে  নিতে  পারবে না । মনু যুগের  অবসান  চাই ।
ঋষিকাদের এই পরিকল্পনা নিয়ে  আলাদা গোষ্ঠী  তৈরী করা  হয়েছে । রক্ষা বাহিনী । এদের  দায়িত্ব মনুর বিরোধিতা  করে  , আক্রমণ । এই একই পরিকল্পনা বৃষের ।  দু’জনেই  তাদের  পরিকল্পনাকে  রূপদান করবার জন্য  এই  অভিযানে  এসেছে ।  

-বৃষ , যারা  সংঘবদ্ধ  নয় , তারা  নিজেদের  অবস্থান  টের  পায় না। আমরা তাদের  নিয়ে  লড়ব কেমন  করে  ? 
ঋষিকা  কথা  গুলো  বলছিল , চোখে হতাশা । বৃষ বলল - 
-তাই  আমাদের  প্রধান  লক্ষ্য  হচ্ছে ,   সেই সব  প্রশ্ন  গুলোর  উত্তর  খুঁজে  আনা । এই কাজে  সফল  হলেই , মনুর ভয়ঙ্কর  ক্ষমতার  বিরুদ্ধে   মাথা  তুলতে  পারব । তুমি  যুদ্ধে   শুধু মাত্র   গোষ্ঠীকে  পরাজিত  করতে  পারবে  । এত  বছরের একটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে  লড়তে  হলে, আমাদের  তার দুর্বলতা , অন্তর্হিত  সত্যতা  যাচাই করতে  হবে । 

রাত  পাতলা  হয়ে এসেছে ।  ওরা দু’জনেই   পরস্পরকে জড়াজড়ি করে  ঘুমিয়ে  আছে ।  কথা বলতে  - বলতে  , দেহের  অবসন্নতা  তাদের চোখের পাতা গুলোকে  এত চিন্তার  মধ্যেও ভারী করে  দিয়েছে  !  ভোর  হতে   কিছু  প্রহর  বাকী  ।  আকাশটায় আলোর  পাতলা   আস্তরণ এলোমেলো  ভাবে      ছড়িয়ে । পৃথিবীতে মনে  হয় এই  সময়টুকুই  খুব  শান্ত  ।   গভীর জঙ্গল । নিঃশেষিত রজনী  । আতঙ্কিত নিঃশ্বাস । কম্পিত  হৃদশব্দ । তাও  ... অনন্ত  চেষ্টা!

লড়াই থামবেনা ,  এই সব কিছু এবং ঋষিকা !





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.