নরম বুকের উপর বুক ছুঁয়ে যেতেই , খেলে গিয়েছে শিহরণ ! শ্যাম বর্ণের মুখে কালো চুলের ভারী গোছাটা , পুরুষালী আঙুল গুলো সরিয়ে দিল । গভীর চওড়া চোখের দিকে চোখ গিয়েছে । বৃষ দেখছে , মেয়েটির সরু বুকের খাঁজে , দুটো স্তনের মাঝখানে পাহাড়ের অন্তর্ভেদী গহ্বরের মতনই আকর্ষণীয় অপটু বিভাজিকা ! সেই দিকে চোখ থেমে গেল । দ্রুত নিঃশ্বাসের উত্থান – পতনের ছন্দ শুনতে পাচ্ছে দু’জনেই ।
গভীর অরণ্য । বৃক্ষের ফাঁকে – ফাঁকে , রাতের অন্ধকার ঝুলে রয়েছে । প্রতিটি বনস্পতি নিঃশ্বাস ত্যাগে ব্যস্ত । পুরু ঘাস ভূমির উপর , দুই যুবক – যুবতী শুয়ে । মেয়েটি ভূমিতে , তার উপরে ছেলেটি । পরস্পরের দিকে তাকিয়ে , তারা হতচকিত ।
বৃষ , যুবতীটিকে উদ্দেশ্য করে বলল – তুমি , ঠিক আছো ? আমাদের এখন এই ভাবে থাকতে হবে । ঋষিকা খুব সহজ ভাবে উত্তর দিল – আমি ,এর চেয়েও কঠিন অবস্থার কথা ভাবছিলাম ।
বৃষ , মেয়েটির নরম ঠোঁটে , হাতের পাতা রেখে নিজের শক্ত বুকের মধ্যে চেপে রেখেছে । কানে ফিসফিস করে বলল – জন্তুটা এখনো চলে যায়নি । সাবধান । ঋষিকা দুটো নরম হাত দিয়ে , বৃষের কাঁধ জড়িয়ে বলল – অনেকক্ষণ হয়েছে । এখানে থাকলে টের পেতাম । বিষাক্ত নিঃশ্বাসের কটু গন্ধ নাকে আসত । আমার মনে হচ্ছে , আমাদের ওই পাশে গাছের গুঁড়ির পিছনের গর্তে , আত্মগোপন করতে হবে। সেখানে আমরা নিরাপদ। আমার মনে হচ্ছে , জন্তুর হাত থেকে বাঁচলেও ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে পারব না ।
বৃষ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল – ঠিক বলেছো । এত ভয়ে ছিলাম যে , বুঝতেই পারিনি অনেক সময় কেটে গিয়েছে ! যদিও গায়ে , পশুর চামড়ার পোশাক রয়েছে । ঠাণ্ডা যেনও অদৃশ্য তীরের ফলার মতন বিঁধেই চলেছে ! সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে ।
ধস্থাধস্থিতে বুকের উন্মুক্ত অংশের প্রতি খেয়াল হতেই , ঋষিকা ঢেকে দিল । স্নায়ুতে ভয়ের প্রবাহ থাকায় , এক পুরুষ দ্বারা শরীরের অনাবৃত অঙ্গ দেখবার লজ্জা তেমন দেখা যায়নি । এখন বেশ লজ্জা – লজ্জা করছে । বৃষের ভালো লাগল । সাহসী মেয়ে লজ্জা পেলে , যৌন আকর্ষণ বেড়ে যায় ।
কিছুক্ষণ আগে , মৃত্যু নিজে এসেছিল , ওদের সাথে দেখা করতে ! ওরা যে ঝোঁপের পিছনে শুয়ে রয়ে ছে , পরস্পরকে জড়িয়ে । ঝোঁপের উল্টো দিকের স্থানে সেই ভয়ঙ্কর জন্তুটা দাঁড়িয়েছিল । তার নিঃশ্বাস ছড়িয়ে দিয়েছে , তীব্র দুর্গন্ধ । মুখটা কুমীরের মতন , বাকী দেহটা হায়নার মতন । লম্বা কাঁটা ভরা লেজ । নতুন শিকারের সন্ধানে এসেছিল , ওরা লুকিয়ে প্রাণে বেঁচেছে । ঋষিকার পরিস্থিতিতিতে , বৃষকে সহযোগিতা করবার চেষ্টাই , তার প্রতি টান আরো তীব্র করল !
এখন অনেক রাত । ভোর হতে কয়েক প্রহর বাকী রয়েছে । দু’জনেই গর্তের ভিতর এসে আশ্রয় নিয়েছে। এত অন্ধকারে , আগুনের দরকার ছিল । বৃষ আগুন জ্বালায়নি , পাছে শত্রু শিবিরে খবর চলে যায় । নৃশংস শত্রু । যে কোন মুহূর্তে ওদের মেরে ফেলতে পারে ।
ঋষিকা প্রাণের ভয়কে কোনোদিনই এতটা গুরুত্ব দেয়নি । এই বিপদকালীন সময়েও দেবেনা । সে জানে , মৃত্যু আজ নয় কাল আসবেই । সকলকেই একদিন না একদিন এই প্রতিনিধি ছেড়ে চলে যেতে হবে । আসল কথা হচ্ছে প্রতিনিধি ছেড়ে যাওয়ার আগে এমন কোন কাজ করে যাওয়া , যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করবে । এই উদ্দেশ্য সফল করতে গিয়ে যদি প্রাণ চলে যায় , তাও সম্মানের । এত সব ভেবেই সে এত দূর পর্যন্ত সে এসেছে । তাকে আরো দূর যেতে হবে । লক্ষ্য ছুঁতে এখনো অনেক পথ বাকী রয়েছে ।
-বৃষ , তোমার কী মনে হচ্ছে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব ?
-হাসালে । এত শক্ত প্রশ্ন করে আমাকে , আমার চোখেই নামিয়ে দিচ্ছ ! ঋষিকা হাসল । ক্ষণিক অন্ধকারে বিদ্যুৎ ঝলসানি !
-না , না । তুমি বলতে পারবে ।
-কতটুকু আমরা পরস্পরকে চিনেছি ? এর মধ্যেই আমার প্রতি এত বিশ্বাস !
-বাবা অনেক ভাবনা চিন্তা করেই , আমাকে আপনার সাথে পাঠিয়েছেন ।
-বলও আমার হাতে তুলে দিয়েছে । আমি এখন তোমার অভিভাবক ।
-তুমি কথায় -কথায় আসল বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছ ।
-একদম নয় । আমাদের কথা সবে শুরু হল । আমি তোমাদের গোষ্ঠীতে সবে মাত্র যোগ দিয়েছিলাম । তখন আমরা একে অন্যকে আপনি বলে সম্বোধন করতাম । তোমার পিতা আমার কাঁধে এত বড় দায়িত্ব দিলেন । তুমি জোর করলে । এখানে নাও আসতে পারতে ।
-আমি তোমার সাথে এসে , তোমাকে বিপদে ফেললাম ।
-ঋষিকা তুমি নিজেই নিজেকে ভালো করে চিনেছো । তোমার বীরত্ব নিয়ে আমার বা আমাদের বিন্দুমাত্র সংশয় নেই । তুমি গোষ্ঠীপতির মেয়ে হিসেবে নির্বাচিত হওনি , এই কাজে তোমাকে নেওয়া হয়েছে , কারণ তোমার যোগ্যতা । যুদ্ধ কৌশল । উন্নত চিন্তা । সাহস । নারী হয়েও তোমার সমতুল্য যোদ্ধা শ্ত্রুদের কাছেও নেই ।
-তাহলে , তুমি এমন ভাবে বললে কেন ?
কিছুক্ষণ থেমে রইল । বৃষ নিঃশ্বাস চেপে রেখেছে । গহ্বরের বাইরে রাত , পাত্রের বাইরে প্রবাহিত তরলের মতনই বইছে ।
-ঋষিকা তুমি ওদের আক্রমণ কেন করবে ?
-ওরা অন্যায়কারী । শাসক ।
-এখন মনু রাজার রাজত্ব চলছে । বৈবস্বত মনু । সে কেমন লোক ?
-শয়তান ।
বৃষ হাসল – নৃশংস , সেই কাহিনী । তোমায় শোনাবো ... ......
২
কবেকার কথা ঠিক করে কেউ বলতে পারবে না ।
সেই যুগে মানুষ স্বাধীন ছিল । এই কাহিনী সংহিতা যুগের আগে । বলা যায় এখান থেকেই শুরু আরেক নতুন সময়ের । সমাজের । সভ্যতার । আর শাসনের । মানুষের সভ্যতাও অনেক সময় পরিবর্তনের নামে বন্দী হয়ে যায় ! এই প্রক্রিয়া যখন চলতে থাকে , মানুষ বুঝতেও পারে না । সে যত দিনে বুঝতে পারল , ততদিনে একটা যুগ কেটে গিয়েছে ! আমরা প্রবেশ করেছি , সংহিতা যুগে ! মানুষের নিজস্ব ইচ্ছা , চাহিদা আর আকাঙ্খারা আকাশে উড়তে পাচ্ছে না । তারা নিজেরাও জানল না , এই নতুন সমাজে সব কিছুই মেপে করতে হবে । আমরা এই পরিবর্তনে সামিল হয়ে গিয়েছি , অতি সন্তর্পণে । সভ্যতা এমন ভাবেই রুপান্তরিত হয় , অতি কৌশলে , ধীরে আর চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির প্রহেলিকা । বড় সভ্যতা এমন ভাবেই ছোট সভ্যতাকে গিলে খাবে ।
তেমন ভাবেই আমাদের মনে হতে শুরু হল , আমরা পরাধীন ! এই পরাধীনতা , নিজেরাই চাপিয়ে নিয়েছি । যে জন জাতি নিজেদের প্রতি উদাসীন থাকে , তাকে সহজেই দখল করা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা বেঁচে ছিলাম , বংশ বিস্তার করছিলাম ---- সেখানে মৌলিকত্ব নেই। যে সভ্যতায় নিজস্বতা থাকে না , তা অনেক সময় পর্যন্ত সুরক্ষিত নয় । এমনটাই ঘটল । আমাদের নিজেদের রণ কৌশল ছিল না । সামাজিক মূল্যবোধ থাকলেও , তার প্রকাশ ছিল না । নিজেদের সভ্যতার কোন দার্শনিক অভিমুখ নেই , মানে সভ্যতাটা ঠিক কোন চিন্তা নিয়ে , কোন পথে এগিয়ে যাবে , তা নিয়ে বিন্দু মাত্র মাথা ব্যাথা নেই । এমন একটা সমাজ , যা সর্বদা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকত , অথচ নিজেদের খোঁজ করেনি । সমাজে সমাজ থাকলেও , তার রাশ আমাদের হাতে নেই । এই হচ্ছে সংহিতা যুগ শুরুর প্রথম দিক । আগে আমরা শান্তিতে বসবাস করছিলাম । নিজেদের মধ্যে ঝামেলা থাকত । সে লড়াই খাদ্য সংগ্রহ আর সংগৃহীত খাবারের ভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ।
কিছুক্ষণ থেমে আবার শুরু করল বৃষ –
একটা সভ্যতার সবচেয়ে দুঃখের সময় তখনই , যখন সে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া দর্শনে ধীরে – ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে। এমনটা হচ্ছে অথচ মানুষ বুঝতে পারছে না ! আমি আমার বাবার বাবার মুখ থেকে শুনেছি , ওদের নেতাই এই সভ্যতা সৃষ্টির আদি মানুষ । তার চেহারার সাথে আমরা নিজেদের মিল খুঁজে পেতাম না । সবাই ডাকত ব্রক্ষ্মা বলে । সে বরফের দেশের লোক । পোশাক দেখে তাই মনে হয়েছিল । আমি বা আমার পরিবার কখনই নিজের চোখে দেখিনি , হাওয়ার মতনই তার কীর্তি , মহিমা , ক্ষমতা --- এখানে ছড়িয়ে গিয়েছে ! আমরাও একটু – একটু করে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি । এই চারপাশ , প্রাণীর -- সৃষ্টিকর্তা সে । আমরা তারই প্রজা ।
এই যে বললাম ‘ প্রজা ’ ! এটাই আমাদের দুর্বলতা স্বীকারের প্রথম শব্দ । বলতে পারো , এর আগে এই শব্দের আত্মপ্রকাশ ঘটেনি। এরজন্যই শব্দই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর শক্তিশালী অস্ত্র । গোটা সভ্যতা যখন কোন শব্দকে বিশ্বাস করতে শুরু করে , তখন সেই শব্দের ভিতরে লুকিয়ে থাকা চিন্তা তাকে গ্রাস করে । এমন ভাবেই আমরা ‘প্রজা ’ শব্দের হাতে নিজেদের আত্মসমর্পণ করেছিলাম । এই শব্দই আমাদের আত্মবিশ্বাস শুষে নিয়েছে ।
এখান থেকেই শুরু হয়েছে মনুর শাসন । ভাষাগত আক্রমণ ঘটেছে সবার প্রথমে , তারপর নিয়ম , সংস্কার , নীতি । এক ভয়ানক পরাজয় , যন্ত্রণা আর পরাধীনতার চিন্তা আমাদের গ্রাস করল । সভ্যতার এক অংশ মনুর দর্শনকে নিজেদের আধার মানতে শুরু করেছে । এই বিষ অনেক দূর ছড়িয়ে গিয়েছে ।
-মনুর পরিচয় তুমি জানও ?
ঋষিকা এই নামটা আগে শুনেছে । এখন পরিচয় জানতে চাইল ।
-হ্যাঁ । ব্রক্ষ্মা , নিজে এই বিশেষ পদের সৃষ্টি করেছে । এখান থেকেই শুরু সংহিতা যুগের ।
-ঠিক বুঝতে পারলাম না ।
ঋষিকা , তার বাবার কাছ থেকে শুধু শুনেছে , তাদের বিশেষ গোষ্ঠী বৈবস্বত মহারাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে । এখনই সময় , স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হবে । তা না হলে মুক্তি এইবারো অধরা রয়ে যাবে ! বৃষের মুখে মনুর কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে গেল!
-মনু , ব্রক্ষ্মা সৃষ্ট একটা পদ । যার দায়িত্ব , প্রচুর পরিমাণে অনুগত প্রজা তৈরী করা । মনু পদের কখনো পরিবর্তন হয়না । শুধু পদের দায়িত্বে যিনি থাকেন , সেই ব্যক্তিটি পাল্টে জান । এই যে সময়ে আমরা রয়েছি , সেই সময়ে সপ্তম মনু হচ্ছে মহারাজ বৈবস্বত । তার আমলে তোমরা যেমন বিদ্রোহ করছ । তেমনই আমার পরিবার বংশ পরম্পরায় মনু পদের বিরোধীতা করে আসছে । আমি এখানে এসে , তোমাদের সংকল্প জানতে পারি । আমাদের লক্ষ্য মনু পদের অবলুপ্তি , তোমাদের লক্ষ্য বর্তমান মনু মহারাজকে ক্ষমতা চ্যূত করা । আমার মনে হয়েছে , সময় এসেছে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়বার ।
ঋষিকা চুপ করে শুনছে । বলল – আমরা যেখানে যাচ্ছি , সেখানেই এই সমস্যার সমাধান আছে ?
-হ্যাঁ আছে । এই সমস্যার শুরুও সেখান থেকেই ।
-মানে ?
দু’জনেই সন্তর্পণে একটা গর্তের ভিতর গিয়ে ঢুকল । বৃষ গর্তের ভিতর থেকে বাইরে তাকালো । অন্ধকার পাতলা হচ্ছে । অরণ্যের বুকে জমে থাকা অন্ধকারে , এখন খানিক দূরের অস্পষ্ট দৃশ্য দেখা যাচ্ছে । তার নিজের এইবার ভয় করছিল । সেই দানবীয় জন্তুটা আবার আক্রমণ করতে পারে ! আমাদের দরকার এই স্থান এক্ষুনি ত্যাগ করে , নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়া ।
ঋষিকা বলল – বৃষ তোমাকে গল্পের দ্বিতীয় পর্বে যেতেই হবে । আমি শুনব আর এখানেই শুনব । আমরা যেখানে যাচ্ছি , সেই স্থানের সাথে মনু সাম্রাজ্যের সম্পর্ক , জানতেই হবে । তাছাড়া মৃত্যু আমাদের কাছে এখন খুবই সহজলভ্য । তার থেকে নিরাপদ থাকতে চাওয়াটাই হাস্যকর । তার চেয়ে তুমি বলো আমি শুনি , সেই স্থানের সাথে মনুর সম্পর্ক ...
বৃষ দেখল , মেয়েটা ভীষণ নাছোড়বান্দা ।
৩
ব্রক্ষ্মা প্রথম এই স্থানে এসে বুঝতে পারে , এখানে খুব দ্রুত ক্ষমতা বিস্তার করা যাবে না। এখানকার গোষ্ঠী গুলো পরিশ্রমী এবং বাঁধন ছাড়া। সে শুধুই এই অঞ্চলকে দখল করতে চায়নি। তার পরিকল্পনা আরো সর্বগ্রাসী ছিল । বলা যায় , এখানকার মানুষদের ব্যবহার করা। ভূমি , জল, অরণ্যকে --- দখল করে , ক্ষমতায়ণ কায়েম করা । তার দখল করা সম্পদের মধ্যে নারী আর মানুষ বিশেষ দরকারী । মনুর দায়িত্ব হচ্ছে , প্রজা তৈরী করা । যত বেশি লোক তাদের বশ্যতা স্বীকার করবে , তত দ্রুত তারা ক্ষমতায়ণের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবে ।
বলতে পারো , নৈমিষারণ্য তেমনই গবেষণাগার । এখান থেকেই প্রথম শুরু হয় , এই সমতল ভূমিতে ক্ষমতা বিস্তারের খেলা । এটা ঠিক , গায়ের জোরে নয় , আমরা পরাজিত তাদের সাংস্কৃতিক , দার্শনিক চিন্তার কাছে । এই সব কিছুর উৎস , ব্রক্ষ্মার সৃষ্টি অরণ্য । গোমতী নদীর ধারে , এক অরণ্য ক্ষেত্রকে নির্বাচন করা হয়েছিল । সেখানে ব্রক্ষ্মা নিজের স্বার্থেই মুনিদের আশ্রয় দিয়েছে । তাদের দায়িত্ব রাতদিন আত্ম নিরীক্ষণ করা । গবেষণায় উপলব্ধি করা , যে বিশাল সংখ্যক মানুষকে সমস্ত দিক থেকে দাসত্ব গ্রহণ করাতে হলে , যে পদক্ষেপ গুলো নিতে হবে , তা নিয়ে । শুধু তাই নয় , আমাদের চিন্তা - ভাবনা প্রথমে তাদের কাছে অজানা ছিল । এখানেই সেই বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান চলছে । মনু রাজারা শক্তি পায় এই আশ্রম থেকে । শুধু তাই নয় , আমাদের সভ্যতার এক অংশকে ওরা নিজেদের দিকে নিয়ে নিয়েছে ।
-মানে , মনুদের ক্ষমতার প্রধান উৎস নৈমিষারণ্য !
-হ্যাঁ ঋষিকা । আমরা তাই সেই আশ্রমেই প্রথম আক্রমণ করব ।
-বৃষ , তোমার কথা শুনে বুঝে গিয়েছি , এই স্থানে প্রহরা থাকবে । যার নমুনা টের পেয়েছি , সে দৈত্য জন্তুটাকে দেখে ! দু’জনে এমন দুর্ভেদ্য স্থানে আক্রমণ করব কেমন করে ! এটা উন্মাদের মতনই আত্মহুতি হবে ।
- ভয় পাচ্ছ ?
-একদম নয় । তবে হ্যাঁ এমন ভাবে নিজেদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই । তাছাড়া ওদের আক্রমণ করতে হলে , যত সম্ভব বেশী ক্ষতি করতে হবে । আমরা ওদের ছুঁতে অব্দি পারব না !
-ঋষিকা , তোমার মনে হচ্ছে , আমরা ওদের যুদ্ধে হারাবো ? তাই এত কষ্ট করছি ?
-তাহলে ?
-আমরা আশ্রমে যাচ্ছি এক গোপন রহস্য সন্ধানে । এই রহস্য ভেদ করতে পারলেই , লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলব ।
-আমায় খুলে বলো বৃষ । আমি বুঝতে পারছি না ।
-ঋষিকা , কোন শক্তিশালী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে গেলে , প্রথমেই আমাদের দরকার সেই সভ্যতার দুর্বলতা গুলোকে চিহ্নিত করা । ওরা ধাপে -ধাপে আমাদের গ্রাস করেছে । তুমি ভালো করে চিন্তা করলে বুঝতে পারবে , মনু কখনোই আমাদের সরাসরি আক্রমণ করেনি । তার দণ্ড আমাদের শাস্তি দিত । এই শাস্তি দেওয়া হত নিয়মের মাধ্যমে। আমরাতো আগে নিয়মে বাঁধা ছিলাম না ! আমাদের এমন ভাবে বন্দী করা হল কেন ? শুধু সেখানেই আমরা আটকে নেই , আমাদের খুঁজে আনতে হবে আরো উত্তর । সমাজে প্রতিনিয়ত ওদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে , এর কারণ মানুষের মনে ওদের প্রতি আস্থা । যে নিয়মের চাপে সমাজে শোষণ হয়ে চলেছে । সেই নিয়মকেই অনেকে নিজেদের অস্তিত্ব মানছে । এটা ঠিক , আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে । আবার এটাও অস্বীকার করতে পারব না যে --- চাপিয়ে দিলেই তা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়ে , যেমন চলছে চলুক...... আর সম্ভব নয় । মনুর মন্বন্তর দেখছি । এক সমাজ নষ্ট হবে আরেক সমাজ জন্ম নেবে । যে সমাজে শ্রেণি বিভক্ততা ছড়িয়েছে , সেখানে দ্রুত ফেরা যাবে না । কেন সেই সমাজের উপর সাধারণের এত উৎসাহ , এর পিছনে কী কারণ আছে ? এটা তুমিও বুঝতে পাচ্ছ যে মনু চিন্তা আমাদের রক্তে – রক্তে মিশেছে । তার দর্শন দূষিত বায়ুর মতনই সেবন করছি । আর নয়......
বৃষের কথা শুনছে মন দিয়ে । ঋষিকার মুখে চিন্তার ছাপ । এখন যে পরিস্থিতিতে তারা এই অভিযানে এসেছে , তা বেশ গভীর । মনুর যুগে , সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর দুর্যোগ ভরা সময় হচ্ছে এই বৈবস্বত মনুর রাজত্ব । প্রজাদের উপর যেমন শোষণ বেড়েছে , আবার নারীদের সামগ্রীর মতন নির্দ্বিধায় হস্তান্তর করা হচ্ছে । প্রাকৃতিক সম্পদ অবৈজ্ঞানিক পক্রিয়ায় ব্যবহার করার ফলে , ক্রমশই নিঃশেষের পথে । সমাজে এই নিয়ে কোন দীর্ঘকালীন প্রস্তুতি নেই । মহামারী শুরু হয়ে গিয়েছে ।
ঋষিকার পূর্বপুরুষেরা কোন সময়ই , মনুদের দাসত্ব স্বীকার করেনি । প্রথম থেকেই তারা যুদ্ধ চালিয়ে এসেছে । তাদের স্থির বিশ্বাস এক সময় যেমন তারা খোলা আকাশের নিচে শ্বাস নিত । নিজেদের কোন রকমের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মে বেঁধে রাখেনি , এই বাসভূমির প্রাক্তন অধিবাসীই নয় , তারা এই ভূমির মালিক । যদিও এই ক্ষমতার শর্ত তাদের ভিতরে সেই যুগে ছিল না । এমন কী তাদের নিজস্ব কোন চিন্তাই ছিল না । নিজেদের দাসত্ব মেনে নিতে পারবে না । মনু যুগের অবসান চাই ।
ঋষিকাদের এই পরিকল্পনা নিয়ে আলাদা গোষ্ঠী তৈরী করা হয়েছে । রক্ষা বাহিনী । এদের দায়িত্ব মনুর বিরোধিতা করে , আক্রমণ । এই একই পরিকল্পনা বৃষের । দু’জনেই তাদের পরিকল্পনাকে রূপদান করবার জন্য এই অভিযানে এসেছে ।
-বৃষ , যারা সংঘবদ্ধ নয় , তারা নিজেদের অবস্থান টের পায় না। আমরা তাদের নিয়ে লড়ব কেমন করে ?
ঋষিকা কথা গুলো বলছিল , চোখে হতাশা । বৃষ বলল -
-তাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে , সেই সব প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজে আনা । এই কাজে সফল হলেই , মনুর ভয়ঙ্কর ক্ষমতার বিরুদ্ধে মাথা তুলতে পারব । তুমি যুদ্ধে শুধু মাত্র গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে পারবে । এত বছরের একটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে লড়তে হলে, আমাদের তার দুর্বলতা , অন্তর্হিত সত্যতা যাচাই করতে হবে ।
রাত পাতলা হয়ে এসেছে । ওরা দু’জনেই পরস্পরকে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে । কথা বলতে - বলতে , দেহের অবসন্নতা তাদের চোখের পাতা গুলোকে এত চিন্তার মধ্যেও ভারী করে দিয়েছে ! ভোর হতে কিছু প্রহর বাকী । আকাশটায় আলোর পাতলা আস্তরণ এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে । পৃথিবীতে মনে হয় এই সময়টুকুই খুব শান্ত । গভীর জঙ্গল । নিঃশেষিত রজনী । আতঙ্কিত নিঃশ্বাস । কম্পিত হৃদশব্দ । তাও ... অনন্ত চেষ্টা!
লড়াই থামবেনা , এই সব কিছু এবং ঋষিকা !
সুচিন্তিত মতামত দিন