(১) অ-সুখ
না বলা কথাগুলোকে তেমন পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখতে পারিনা বলে আমার মনখারাপের আলাদা কোন ডায়েরী নেই। ব্যবহার জীর্ণ রোজনামচার চারকোণা পরিসরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মুখ লুকিয়ে থাকে তারা। ব্যথানীল স্বরবর্ণ, ক্রুদ্ধ কালোমুখ আ-কার ই-কার, রঙচটা অপ্রেম চাউনির ব্যঞ্জনবর্ণ, ঈর্ষা সবুজ যুক্তাক্ষর, প্রিয়মানুষটির দেওয়া মন্দভাষা কথকতা, হেরে যাওয়ার বর্ণবিন্যাস,কান্নামেশা প্রত্যয়, বুকভরা অভিমানের পাঁচালী, সব যেন বাঁধাধরা ণত্ব- বিধান.. ষত্ব- বিধানের নিয়ম মেনে জীবনের সাথে সন্ধি করে এক অনাকাঙ্খিত তেজপাতা-রং বিন্যাসে সেজে ওঠে।মুহুর্ত থেকে একপল, সব রং ঝরিয়ে না বলা কথাপথিক হয়ে ওঠে বারবার! উৎস থেকে মোহনা,নদীবিলাসী অক্ষরস্রোত বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে নিজেকে মিশিয়ে নিই নদীর সাথে, নদীর বুকে ঢেউতোলা আকাশের প্রতিচ্ছায়ার সাথে। বহমান নদীর মত বাংলাভাষার জোয়ারে ভেসে যায় আমার যাবতীয় বলা না বলা কথারা। শরীর জুড়ে জেগে ওঠে মন্দবাসা-ভালোবাসার ঋতু! আর এই বহুদূর প্রবাসে মাটির গন্ধমেশা এক ঝলক দেশছোঁয়া হাওয়া আমায় পলাশরাঙা দুপুরবেলার খবর দিলেই আতপ্ত শরীর জুড়ে বাংলাভাষার জন্য মনকেমন করা জ্বরজ্বর অসুখ ছড়িয়ে পড়ে ।
(২) ডাক
আমার ভাষায় তেমন দখল নেই, পাতার পর পাতা জটিল নকশায় অক্ষরপ্রেম নেই। আমার যাবতীয় কথামালা তাই আদর্শলিপির পরিচিত গন্ডী পেরিয়ে প্রবাসের অনাকাঙ্খিত ভাষাপ্রেমে দিকহারায়। সংকেতিক ঈশারাও মাঝে মধ্যে গুনসুঁচেরমত গেঁথে নেয় অপরিপাটি অচেনা শব্দ, অজানা উচ্চারণ আর অধরা ভাবনার সাদা কালো ধুসর পুঁতিহার। এখানে চিরপরিচিত মায়ের মুখের ভাষাটির তেমন দরকার পড়েনা।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একা একাই নিজের সাথে কথা বলি, গান গাই। ভয় হয় যদি ভুলে যাই, যদি দীর্ঘদিনের অব্যবহারে জীর্ণ হয়ে আসে আমার মায়ের ঘুমপাড়ানি গান, ঘরে ফেরা ডাক।মনখারাপ হলেই আমার অ আ ক খ আঁকা চন্দনরং শাড়ীটি পরি। অনেকদূরে থেকে মায়ের গন্ধ নিয়ে বয়ে আসা সুগন্ধী হাওয়ার মত আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে তার আলপনা আঁচল। সংসারের আঁচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে, মুছতে গিয়ে টের পাই শাড়ীর জমিতে হাজারবুটির মত এলোমেলো বিন্যাসে ছড়িয়ে থাকা অক্ষরগুলো হাতেহাত ধরে ছন্দময় রীতিতে জড়িয়ে ধরছে, সাজিয়ে দিচ্ছে, গুছিয়ে নিচ্ছে একে অপরকে।আমি বাংলাভাষাকে বুকে জড়িয়ে নিই, চোখ বুজি, ভীষণ ভালোলাগায় অবচেতনেই অলস দুঠোঁটের ফাঁক থেকে অবরুদ্ধ শব্দটা বাইরের খোলা হাওয়ায় ছিটকে বেড়িয়ে আসে," মা, মাগো।"
(৩) প্রশ্ন
আমি অক্ষর, শব্দ বা বাক্যের কাছে কোনদিন কোন প্রশ্ন রাখিনি, তাই, উত্তরের প্রত্যাশাও করিনা আর। মায়ের সাথে মায়ের মুখের ভাষাটিকেও ছেড়ে এসেছি ঘরের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায়।চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে।।তবু যখন সারাদিন কথা বলি অন্য ভাষায়, তখনই মন বলে ভাষার কাছে প্রশ্ন রেখো দায়বদ্ধতার, প্রশ্ন রেখো অধিকারের ... প্রশ্ন রেখো ...
ঘর থেকে চৌকাঠ পেরিয়ে পায়েপায়ে পরবাস। সময়ের সাথে অচেনা মাটিতেও গেঁথে যায় গুচ্ছমূল, এক নতুনভাষার সাথে রোজাকার মিথোজীবি সহবাসে কেমন এক দেওয়া-নেওয়ার আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। শুধু ভুলে থাকা আর ভুলে যাওয়ার অভিনয়। ছত্রাকস্বভাবে টিঁকে থাকা আর আলতো থেকে মোটাদাগের অপ্রেম পরিযায়ী বসবাস।শুধু শীতের অচেনা পরিযায়ীদের দেখলেই মনে পড়ে তাদেরও ডানায় লেগে আছে অনেকে দুরের ঘরেফেরার ডাক ।পালকভেজানো জলের ফোঁটায় মিশে থাকে শ্লেটপাথরের মসৃণ বুকে চকের গুঁড়ির মত চোখে্ কিরকিরে অনুভব আনা কিছু স্মৃতিকণা়, যার রন্ধ্রেরন্ধ্রে মিশে আছে ফেলে আসা মাটির অবুঝ ঘ্রাণ।তখনই মন বলে, নিজের কাছে প্রশ্ন রেখো ভালোবাসার, প্রশ্ন রেখো পিছুডাকের ... প্রশ্ন রেখো ...
(৪) অপেক্ষা
সেই চেনা চার দেওয়ালের শান্ত পরিসর, সেই পাতাঝরা শিমূল, সেই লক্ষ্মীর আলপনাছোপ আঁকা উঠোন, সেই মায়ের আঁচলের হলুদ ছোপ, মশলার গন্ধমাখা আঁচল ,সেই অবুঝ মেয়েবেলা… সমস্ত ছেড়ে আসা,পিছনে ফেলে আসা বড় যন্ত্রণার।তারপর থেকে এই যন্ত্রণারাই কখনো কখনো নেশার মত তীব্র হয়ে ওঠে, কিংবা গোটা এক ফুল্লরার বারোমাস্যা হয়ে ওঠে চোখের আড়ালে।অথবা শব্দছকের আদলে সাজিয়ে নিলে এরাই সংসার হয়ে সেজে ওঠে। আর এদের নিয়েই আমি মরুভূমির মত অজানা প্রবাসে একটুকরো পরিচয় বানানোর তাগিদে, এক ভাষানদীর বুকফাটা তৃষ্ণার সকাল থেকে সন্ধ্যে হাপিত্যেশ করে অপেক্ষায় থাকি এক বুক চাহিদা নিয়ে! যেসব না শোনা গান, না বলা কথা, না দেখা খোলা আকাশ, না ছোঁয়া দিগন্তবিস্তারী মাঠ একদিন অকাতরে হাতছানি দিয়েছিল, তাদের পরতে-পরতে, ভাঁজে-ভাঁজে, আমি কবিতা লিখে রাখি, গদ্য সাজিয়ে নিই, বেলাঅবেলার চিঠি লুকিয়ে রাখি।তারপর সমস্ত তালপাতার পুঁথি, নরম কেঠো পাটা, পাথুরে বুকের শ্লেট, লালরেক্সিনের বাঁধানো কাগজ আর নীল আলোমাখা ডেক্সটপ সাজিয়ে একা-একা অপেক্ষা করি পরিচিত অপরিচিত অক্ষরের!
(৫) ২১শে ফেব্রুয়ারীর শব্দেরা .....
.
নির্বোধের মতো ছড়িয়ে পড়ছে বিদায়ী অক্ষরের নামাবলী,‘ৠ,ঌ, ৡ, হ্ম,’…আভিধানের এ কোণ থেকে ও কোণ, ঠিকানার সন্ধানে।সমস্ত দাড়ি , কমা , সেমিকোলন, ফুলস্টপ হাইফেনরা নিরুদ্দেশ হয়ে আছে কিছু ব্যবহারিক শব্দের ভীড়ে,বাড়ি আর বাড়ী –র কোন অমিল নেই, সুখদুখ আলাদা নয় সুখদুঃখ-র থেকে।অ-আ-ক-খ এখনও উদয়াস্ত খাটছে ঝগড়াঝাঁটি মান অভিমানের আক্রোশে,ছন্দে, সুরে, আবেগে জরজর কি জড়সড় মনের উত্থানে,বাংলা যুক্তাক্ষরগুলো আদর্শলিপির পাতা ছেড়ে নেমে এসেছে তাসরাজ্যে,বছরে শুধু একটা দিন,২১শে ফেব্রুয়ারী,লোকের মুখে-মুখে কাগজের স্তুপ পায়ে পায়ে পার হয়ে বাংলা শব্দেরা সবাই ঘরে ফিরে আসে,লৌকিক-অলৌকিক অক্ষররা ঢেউ ভেঙে খেলা করে দিনভর, যেমন শিশুরা নিস্পাপ মুখে নিজেদের সাথে খেলে আনমনে। মায়ের আঁচলের নিরাপদ আশ্রয়ে।
(৬)প্রচ্ছদ
মরানদীতে পাতাডোবা জলে ভেসে আসছে রঙীন কাগজের নৌকো,একটা দুটো তিনটে.. অনেকগুলো, অগুন্তি। ঢেউহীন মরা নদীর সোঁতা ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেকটা সময়... ঘাটের ধাপ কাটা সিঁড়িতে লোভ চকচকে চোখে পিঁপড়ে শামুক গেঁড়ি গুগলি ফড়িং প্রজাপতি গুবরে পোকার দল। ঠোঁটে ঠোঁট,বিনাশব্দের কুটুম কাটুম বাক্য,... কানে কানে ফিসফিসানি গুজব, আশাভঙ্গের কাহিনী, রসালো স্বপ্ন। ঈর্ষার রঙ মুখে মেখে আড়ি পাতা মিটমিটে জোনাকজ্বলা রাত। তাসের দেশের উল্টো হাত আঁকা বাহান্ন তাস জাল পাতে নিঃশব্দে... আমি একা ভেজা নৌকোর ভাঁজ খুলে বিছিয়ে রাখি টেবিলের ওপর, বিনাসুতোয় গেঁথে গেঁথে লেখার খাতা বানাই, মলাট দেওয়া শেষ হলে ভেজা রঙিন কাগজে সেইসব ভালো মেয়ে, মন্দ মেয়েদের নাম লিখে জাতিস্মরের মত অপেক্ষা করি গল্প বিনিময়ের ... প্রচ্ছদে গোটাগোটা বাংলা হরফে লিখি, “ মেয়েলী ইতিকথা”।
সুচিন্তিত মতামত দিন