তথাগতর ধর্মে দেবীপুজার স্থান ছিলোনা। তিনি প্রকৃতিপূজার বিরোধী ছিলেন। থাকবেননাই বা কেন? তিনি যে নিরীশ্বরবাদী! তাঁর দীর্ঘনিকায়ের সীলকখন্ধবগগে তিনি এ বিষয়ে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা হলো, ‘আদিপচ্চুপটঠানং’ অর্থাৎ আদিত্যপূজা, ‘মহতুপটঠানং’ অর্থাৎ মহাদেবতার পূজা, এবং ‘সিরিবহানং’ অর্থাৎ শ্রীদেবীর আহ্বান, এই তিনটি শ্রমণদের জন্য নিষিদ্ধ। একেবারে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যে দেবদেবীর পূজা, বিশেষত এই তিন দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধ। কিন্তু এই যে নির্দেশ তা আমাদের একটি বিষয়ে আলোকপাত করে। বুদ্ধদেবের সময়ে দেশে এইসব দেবদেবীর পূজা বহুল প্রচলিত ছিল। আর্য দের সঙ্গে অনার্য দেশজ ধর্মধারা মিলেমিশে একটি স্বতন্ত্র অথচ উন্নত কৃষ্টির জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য প্রতাপে পর্যুদস্ত বণিক ও শ্রমজীবী, যারা কিনা শেষ পর্যন্ত সভ্যতার উন্মেষে নিযুক্ত থাকে, তারা শ্রামনিক ধর্মে নিজেদের মুক্তি ও উত্তরণ খুঁজে পেলো। সে ধর্মে স্বাভাবিক ভাবেই আর্য দেবদেবীর প্রবেশ সম্ভব ছিলোনা। কিন্তু ধর্মকে সর্বসাধারণের গ্রহণীয় করে তুলতেই সম্ভবত মহাযান ধর্ম অনার্য দেবদেবীর সঙ্গে বৈদিক দেবদেবীর ধারণাকে ধীরে ধীরে আত্তীকরণ করল। সে বুদ্ধের জন্মের বহু পরের ঘটনা। সপ্তম শতকের মধ্যে তান্ত্রিক বৌদ্ধ মত প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। এই মতে অসংখ্য দেবীর অনুপ্রবেশ ঘটে। বৌদ্ধ দেবীদের মধ্যে তারা সর্বাগ্রগণ্যা। এখন দেখা যাক সরস্বতীর চেতনা বৌদ্ধ পরিমণ্ডলে কিভাবে প্রবেশ করল। তান্ত্রিক বৌদ্ধমতে তারা ধ্যানী বুদ্ধের শক্তি। পাঁচজন ধ্যানী বুদ্ধ। তাঁদের বর্ণ – সিত, শ্যাম, পীত, লোহিত, ও নীল। এর মধ্যে সিততারা পরম পবিত্রতার প্রতিমূর্তি। এঁকে বোধিজ্ঞানের প্রতীক মনে করা হয়। ইনি অবলোকিতেশ্বরের শক্তি। সিততারার রূপকল্পে দেবী সরস্বতীর জ্ঞানদায়িনী মূর্তির আভাস মেলে। তান্ত্রিক রূপে ইনি আবার জাঙ্গুলীতারা বলে অভিহিত। এই জাঙ্গুলীতারা সাপের বিষ নামানোর সময়ে পূজিত হন। এই দেবীর হাতে বীণা। তিনি বীণা বাজাচ্ছেন। তাঁর চারটি হাতের আর একটিতে অভয় মুদ্রা এবং চতুর্থ হাটে একটি শ্বেতসর্প। জাপানে এই সাদা সাপের মূর্তিতে সরস্বতীকে পূজা করা হয়। সাদৃশ্য দেখতে পাই যে, বীণা সরস্বতীর বিশেষ লাঞ্ছন, আবার সাপ জাঙ্গুলীতারা বা কালক্রমে মনসার লাঞ্ছন। সুতরাং জাঙ্গুলীতারাই যে সরস্বতী এ নিয়ে আর সন্দেহ থাকেনা। এই সিততারাকে সরস্বতীর পূর্বজ মনে করা হয় বটে, তবে সরস্বতীর পৃথক অস্তিত্বও দেখতে পাই মঞ্জুশ্রী বোধিসত্ত্বর শক্তির মধ্যে। এই বিশেষ শক্তিকে বৌদ্ধরা সঙ্গীত ও কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনে করেন। সম্ভবত সপ্তম ও অষ্টম শতকের মধ্যে চীন ও জাপানে এই সরস্বতীর আরাধনা ছড়িয়ে পড়ে। দেবী বেনটেনকে জাপানে সরস্বতীর মূর্তরূপ মনে করা হয়। অতএব সনাতনী বাকদেবী এই বিবর্তনের পথে কাব্য সঙ্গীত পরাবিদ্যার দেবীতে উন্নীত হয়েছেন।
মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন, এক হাতে বই। শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদন ছিল। জৈনদের চব্বিশজন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতমা হলেন সরস্বতী। শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর উভয় জৈন সম্প্রদায়েই সরস্বতীর স্থান হয়ে গেল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীতা একজন প্রধান দেবীরূপে।
জৈন সাহিত্যে সিদ্ধসারস্বতাচার্য শ্রীবালচন্দ্র সুরির মহাকাব্য বসন্তবিলাসের মঙ্গলাচরণে সরস্বতী বন্দনা দেখতে পাওয়া যায়। তবে জৈন ধর্ম এমন বিশদে দেবীপুজাকে গ্রহণ করেনি।
এরপর পৌরাণিক ধারণাগুলি খতিয়ে দেখা যাক।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী। এ মূর্তি অষ্টভূজা - বাণ, কার্মূক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘন্টা ছিল তাঁর অস্ত্র। তাঁর এই সংহারলীলাতেও কিন্তু জ্ঞানের ভাবটি হানি ঘটেনি, কেননা তিনি 'একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা' বলে মোহদুষ্ট শুম্ভকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করেছিলেন। স্কন্দ পুরাণে প্রভাসখণ্ডে দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অবতরণের কাহিনী বর্ণিত আছে। বায়ু পুরাণ অনুযায়ী কল্পান্তে সমুদয় জগৎ রুদ্র কর্তৃক সংহৃত পুনর্বার প্রজাসৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজ অন্তর থেকেই দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন। সরস্বতীকে আশ্রয় করেই ব্রহ্মার প্রজাসৃষ্টি সূচনা। গরুড় পুরাণে সরস্বতী শক্তি অষ্টবিধা। শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, কলা, মেধা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও স্মৃতি। তন্ত্রে এই অষ্টশক্তি যথাক্রমে যোগ, সত্য, বিমল, জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি, মেধা ও প্রজ্ঞা। তন্ত্র শাস্ত্রমতে সরস্বতী বাগীশ্বরী - অং থেকে ক্ষং পঞ্চাশটি বর্ণে তাঁর দেহ। আবার পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে - শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা ইত্যাদি। এর অর্থ দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা। অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা।
সুচিন্তিত মতামত দিন