কৃষ্ণা রায়

আলো আঁধারের ভাষা
পিয়ালি মুখ বেঁকিয়ে বলল , এগেন দ্যাট হরিবল নোটিশ। অল স্টুডেন্টস আর ডাইরেক্টেড টু অ্যাটেন্ড ইন্টারন্যাশানাল মাদার ল্যাংঙ্গু্যেজ ডে অন টোইন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি। । লুক, আওয়ার প্রিন্সিপাল ইস সো ফাসি! অলওয়েজ ট্রায়েজ টু পুট আস ইন সো মেনি আসাইনমেনটস অ্যান্ড মাচ ডিলেমা। গার্গী মুখ টিপে হাসল, পিয়ালি ডিয়ার! শোন, আমি ওই দিন কালচারাল প্রোগ্রামে ড্যান্স করছি। ও রিয়েলি!পিয়ালির বাঁকা ভুরু আরো বেঁকে যায়, কে যেন বলছিল কী নাকি একটা ফানি গান, ঋতি ম্যাম ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেনটদের শিখিয়েছে। হেঃ!মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা। আবার সে গানের সঙ্গে ড্যান্স হচ্ছে। রিডিকিউলাস! লিসন গার্গী , হোয়াটেভার উইল গো অন, আয়াম নট অ্যাটেন্ডিং কলেজ ওন দ্য ভেরি ডে। অল দ্য ডে দেয়ার উইল বি লটস অফ বক বক ইন বেঙ্গলি অ্যান্ড ব্লা ব্লা ব্লা।ডিসগাস্টিং। ওটা বেং- মিডিয়মের গাইসরা ফলো করুক, অবসারভ করুক। আমি সেদিন ম্যুভি দেখত যাব ।আন্ড হু এলস উইল আকমপানি মি, আর কে যাবে আমার সঙ্গে? 

ক্লাশের সব চেয়ে শান্ত মেয়ে অনিন্দিতা চুপ করে ওদের কথোপকথন শুনছিল। বাংলা মিডিয়মে পড়াশুনো করেছে বলে ওদের মত অত গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারেনা। খানিক্ টা তার জন্যও কথা কম বলে। আজ কী যে হল, একটু অসহিষ্ণু হয়েই বলে ফেলল, যারা মানসিক ভাবে স্লেভ, তারাই নিজের কালচারকে এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। তুমি তো বাঙালি মেয়ে, তোমার মাতৃভাষাকে সম্মান করতে পারছনা কেন? 

পিয়ালি উদ্ধত গলায় বলল, হাউ ডেয়ার ইউ! আই নেভার স্টাডিড বেঙ্গলি ইন মাই লাইফ। ইভন অ্যাস অ্যা থার্ড ল্যাঙ্গোয়াজ। হু আর ইউ টু গিভ মি অল দিস সারমন? আই হেট বেঙ্গলি কালচার অল থ্রু মাই লাইফ। আন্ডারস্ট্যান্ড? বাঙালি মেয়ে! ফুঃ!

রাগে, অপমান পিয়ালির সারা শরীর কাঁপছিল। অনিন্দিতা হাল ছাড়লনা, শান্ত সবাভাবিক গলায় বলল, বাড়ি গিয়ে আমার কথা গুলো একবার ভেবে দেখো। 

#
আজ নিয়ে পরপর পাঁচ দিন পিয়ালি কলেজে আসেনি। সামনে ফার্স্ট সেমের টেস্ট। প্র্যাক্টিকাল ক্লাশ গুলো মিস করছে । ব্যবহারে উগ্র আর উদ্ধত বলে বেশির ভাগ স্টুডেন্ট ওকে এড়িয়ে চলে। গার্গীর সঙ্গে বরং ও কিছুটা সহজ। সবাই তাই ওকে জিগ্যেস করছে। অনিন্দিতাও গার্গীর কাছে খোঁজ নিয়েছে। গার্গী বলল, ওর ফোনেও সাড়া দেয়নি পিয়ালি। বেশির ভাগ দিন ও ভাড়া গাড়িতে কলেজে আসে। মাঝে মাঝে একটা সাদা মারুতি জেনে। সে গাড়ির ড্রাইভার একদিন কলেজে এসে গার্গীর কাছে বলে গেল ম্যাডামের ভাইরাল ফিভার, এখন কদিন ক্লাশ করতে পারবেনা। 

সামনে টেস্ট , তার ওপর কলেজে প্রোগ্রাম, সবাই সাময়িক ভাবে পিয়ালির কথা নিয়ে আর আলোচনা করার সময় পায়নি। দিন সাতেক পর অনিন্দিতার একটু খারাপ লাগে। সেদিন সবার সামনে ওকে ওভাবে না বললেই হোত। গার্গীকে বলল, যাবি নাকি ওর বাড়ি একবার খবর নিতে? গার্গী ব্যস্ত, ওর সময় হবেনা। অগত্যা স্টুডেন্ট সেকশানের ইন চার্জ মিত্রালি ম্যাডামের কাছে ওর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে লাস্ট ক্লাস না করেই কলেজ ফেরত রওনা হল অনিন্দিতা। প্রথমে একটু ভয় ভয় করছিল, তবে কলেজ অফিসের অমলদা বলল, যাওনা, কলেজ থেকে খুব দূরে নয়, অটোয় করে যেতে পারবে। বন্ধু অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া তো উচিত। আমাদের সময় হলে তার বাড়িতেই আমরা পড়ে থাকতাম।




শেষ বিকেলে অনিন্দিতা যখন পিয়ালিদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল, ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলনা ওর । সবার কাছে শুনেছে পিয়ালিরা খুব বড় লোক, গেট পেরিয়ে ওদের বাড়ি ঢোকা সহজ নয়। দারোয়ান সবাইকে অ্যালাও করেনা। এ তো ছোট্ট সাদামাটা দোতলা বাড়ি। জং ধরা গ্রিলের গেটের পেছনে একফালি বারান্দা। সদর দরজায় লেখা ঠিকানাটা পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে। কলিং বেল টিপতেই দোতলার বারান্দা থেকে একটি মাঝ বয়সী মহিলা মুখ বাড়ালেন। অনিন্দিতা বলল, পিয়ালি কেমন আছে? আমি ওর সঙ্গে কলেজে পড়ি।

কলেজে পড়ো তো এখানে কি? দেখা হবেনা , ও অসুস্থ। 

এ আবার কেমন সম্ভাষণ! যাক, ঠিকানা তাহলে ঠিক আছে। এটা পিয়ালিদেরই বাড়ি । তবে অনিন্দিতা হাল ছাড়েনা, স্বভাবে শান্ত হলেও ও বেশ জেদি। স্পষ্ট গলায় বলে, সেই জন্য তো ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। 

বললাম তো, দেখা হবেনা। মহিলা নির্দয় বার্তা দিয়ে বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। 

পিয়ালিদের বাড়ির পাশে বেশ বড় একটা আম গাছ। প্রথম বসন্তে থোকা থোকা বাদামি মঞ্জরিতে গাছ ভরে গেছে। অনিন্দিতা কিছুক্ষণ সে দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আসাটা নিরর্থক হয়ে গেল। অবশ্য অনিন্দিতা কি এই আশঙ্কাটা করেনি? সেটা অবশ্য অন্যরকম হবে ভেবেছিল, বড় লোকের বাড়ির ভেতরে যাওয়া যাবেনা । এখানে তবু তো কেউ একজন ওর খবর দিল। কে উনি? ওর মা? অত রাগী কেন? উনি তো দিব্যি বাংলায় কথা বললেন। তার মানে পিয়ালির মাতৃভাষা বাংলা। নাকি উনি মা নয়, অন্য কেউ? গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অনিন্দিতা এলোমেলো অনেক ভাবনায় হারিয়ে যায় । 

অন্যমনস্কতার জন্য টের পায়নি ও হঠাৎই একটা ভাড়াটে উবের ঘ্যাঁচ করে বাড়ির সামনে দাঁড়াল, পিয়ালি নামছে। দুটো ভারি ব্যাগ ডিকি থেকে বের করছে। অসুস্থ বলে মনে হচ্ছেনা, দিব্যি সচল, সবাভাবিক। কোথাও বেড়াতে গিয়েছিল? এক্কেবারে একা? ওর জামা কাপড় বড্ড বেশি খুললাম খুল্লা না? চোখে ধ্যাবড়া বাসি কাজ্ল, নীচে গাঢ কালিমা। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে । কেন? একগাদা প্রশ্ন অনিন্দিতার মাথায় গিজগিজ করে। 

অস্থির হাতে কলিং বেল টেপে পিয়ালি। বারান্দা থেকে আবার সেই মুখ গলা বাড়ায়, আঃ বললাম তো দেখা হবেনা, কেন বার বার --- 

পিয়ালি ধমকে ওঠে, মা আমি। আজ সকালেই তো ফোনে জানালাম, ডিউটি শেষ করে বিকেলের মধ্যে ফিরব, দরজাটা খোল তাড়াতাড়ি। 

ও তুই? আমি ভাবলাম , কে না কে এল!

ভারি ব্যাগ দুটো গ্রিলের গেট পার করিয়ে বাড়ির সদর দরজার কাছে টানতে টানতে একতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পিয়ালি জোরালো গলায় গজগজ করে, শেতলদা আজকের বিকেলটা গাড়ি নিয়ে স্টেশনে যেতে পারতনা? মাস গেলে কম টাকা তো পায়না। পিয়ালির সবগোতক্তির মাঝেই দরজা খুলে মায়ের আবির্ভাব । পিয়ালি বলেই চলেছে, আজ রাতে তোমার ডাক্তারকে কেমোর রিপোর্ট দেখানোর দিন, বলেছো তো ও যেন ঠিক সময়ে আসে? সন্ধ্যে বেলায় বাবার স্মৃতিরক্ষা কমিটির লোকেরা দেখা করতে আসবে। আমায় তখন বাড়িতেই থাকতেই হবে।একুশে ফেব্রুয়ারি তোমায় নিয়ে ওরা বর্ধমান যাবে। বাবার স্বপ্নের কথা সবাইকে বলতে হবে। আজ রাতেই নতুন এক বিদেশি ক্লায়েন্টের ডিউটি পড়েছে। একুশের প্রোগ্রামের জন্য এটা আবার নিতে হল। পাশে এসে দশটা টাকা দিয়ে সাহায্য করার মতো আত্মীয়- বন্ধু নেই। এত পারি আমি! বাবা হঠাৎ চলে গিয়ে আমাকেও যে কোথায়---- 

পিয়ালির কথার ফাঁকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয় ওর মা। আমগাছের আড়াল থেকে পায়ে পায়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় অনিন্দিতা। গ্রিলের গেটের ডান পাশে মলিন হয়ে যাওয়া থামের গায়ে জড়ানো লতান বোগেনভেলিয়ার পাতার ফাঁকে লেটারবক্সএর নেম -প্লেটটা এতক্ষণে চোখে পড়ে, লেট শান্তনু সেন, প্রফেসর এমেরিটাস, বাংলা বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় । আশ্চর্য! পিয়ালির বাবা বাংলার অধ্যাপনা করতেন, আর ও দাবি করে ও বাংলা জানেনা। কেন? কোন গাঢ অভিমানে? 

অনিন্দিতার বয়স উনিশ, বাড়িতে আছে সাধারণ চাকরি করা বাবা, আর রয়েছে মা, ঠাকুমা, অবিবাহিত পাগল পিসি, ছোট ভাই। তবে তারচেয়েও ম্যাড়মেড়ে ওদের ভাঙ্গা চোরা পুরোনো এজমালি বাড়ি । ছোটবেলা থেকেই বন্ধুদের সেখানে নিয়ে আসতে লজ্জা পেয়েছে। সে এক অন্যরকমের লজ্জা, দারিদ্র লুকোনর জন্য লজ্জা। কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা কম হলেও এখন পিয়ালির উগ্রতার কারণটা ও যেন একটু একটু বুঝতে পারছে। ওর ডিউটির ধরণটাও। অল্পবয়সে মাথার ওপর থেকে ছাদ খসে গিয়ে ভরা দায়িত্বের সাগরে ঝাঁপ দিতে হলে মানুষ নিজেকে যে কত রকম ভূমিকায় সাজিয়ে নিতে পারে! 

না রে পিয়ালি, এখানে না এলে জানতেই পারতাম না, তোর দৈনন্দিন দায়-দায়িত্ব পালনের সঙ্গে মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের চেষ্টাটা ও কত খাঁট। কোন ভুলে যাওয়া শৈশবে মায়ের মুখের ভাষা শেখার মত আন্তরিক তবু ক্লান্তিময় যতিহীন অধ্যায়ের পর অধ্যায় পেরিয়ে যাওয়া। সে কি আর কলেজের অনুষ্ঠানে কটা গান –কবিতার শৌখিন নিবেদনের মাপকাঠি দিয়ে মাপা যেত?




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.