দেবাঞ্জন ঘোষ

 আলো
"আমার খুব বিপদ একবার পারলে এসো, এক্ষুনি, ।" মেসেজ পড়েই রাতুল কোন উত্তর দেওয়াতে সময় নষ্ট করল না। শর্টসটার নীচে একটা ইনার পরতে যে সময়টা লাগে, তারপরই সোজা দ্বিতীয় হুগলিসেতু হয়ে অয়নদের ফ্ল্যাটে। সিকিউরিটিকে অনেক বুঝিয়ে, ফোনের মেসেজ দেখিয়ে ওদেরই একজনের সাথে ওপরে যাওয়ার অনুমতি পেল। রাত হয়ে গেলে এই ফ্ল্যাট-কর্তার সুনাম দ্বিগুন বেড়ে যায়। অনেক কথাই বলছিল সিকিউরিটির ছেলেটা, আর শুনেই বা করবে কি রাতুল। অয়নকে এখন যে ওঠাতে পারবে না, সে কথা ও ভাল করেই জানে। তবুও মেসেজটা মনের ভেতর খচ-খচ করেই চলেছে।

"আপনাকে বললাম তো, আমার কথা শুনলেন না। আমার সাথেই আপনাকে নীচে যেতে হবে। চারদিকে সার্ভিলেন্স, আপনাকে ছেড়ে যেতে পারব না, চলুন। ওনারা কেউই এখন ওঠার নয়, বড় বড় ব্যপার।" লিফটের স্লাইডিং দরজা দুজনা কে সাথে নিয়ে বন্ধ করল নীচে নেমে আসার জন্য। এতগুলো মেসেজ করল নিজের ফোন থেকে সবকটা সিঙ্গল রাইট। কলকাতা শহরে এর থেকে বেশী করাটা বা জিজ্ঞাসা, পুরোটাই অন্যদের চোখে একটু বেশী বেশী লাগবে। নীচে নেমে গাড়ির দিকে যেতে গিয়ে আর একবার তাকাল ন'তলার দিকে, সাধারণ চিত্র। গাড়িটা ব্যাক করে কি মনে  হল নিজের ফোন নম্বরটা অনেক অনুরোধ তারপর আইনসুলভ পুলিশি পলিসি বোঝাতে বোঝাতে সিকিউরিটিকে খাতায় লিখতে বাধ্য করল। দয়া শব্দটা সচারচর বলে না রাতুল, তবু এক্ষেত্রে যদি একটা খবর পায় তাই বলল কথাটা, অবশ্য খুবই মোলায়েম স্বরে," দয়া করে...," টুপিপরা ক্যাপ্টেন সিকিউরিটির ঝাঁঝালো কথা শুরু হয়ে গেল,"কে আপনাকে ভেতরে রাখবে মশাই! গেট খুলছেন তো একজন দেখতে পাচ্ছেন না, যান ফিরে যান...।" "কিছু যদি সেরকম খবর থাকে আমার নম্বরটায় একটা কল করবেন দয়া করে।" সিগারেট খাওয়াটা যার কথায় প্রায় ছেড়েই দিয়েছে তবু একটা ধরাবার ইচ্ছে হল। তার মুখটাইতো বার বার ভেসে উঠছে। ভাসা ভাসা মেসেজ কোনদিনই পছন্দের নয় রাতুলের।

#

আজ ভোর পৌষ সংক্রান্তির সকাল। গাড়ি ছুটছে রাতুলের, সামনের দুটো জানলা খোলা তাও ঘামছে। সিকিউরিটির ছেলেগুলো বেঁচে যাবে ওর নাম করে, তারপর নিজের নামটা সামনে আসবে, এসবই ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। তবু একটা উত্তর, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম যে কোনদিক থেকেই হোক ওর চাই।

স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মত মেসেজ এল একটা,"আমাকে ঘিরে ফেলেছে...কতদুরে?" রাত চারটের সময় বিকট শব্দ করে গাড়িটা থামাল রাতুল। দুটো ঘন্টা উৎকন্ঠার মধ্যে যে পেরিয়ে গেছে টেরই পায়নি । একটাই বাঁচোয়া যত গাড়ি সব বাবুঘাট মুখী, পেছনে কলিশনের ভয় নেই। ফ্যাল-ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকল....কোথায় দাঁড় করিয়েছে গাড়িটা তাও বুঝতে পারছে না। পাশের সীট থেকে ফোনটা তুলে গোটা দশেক মেসেজ করল...সবকটাই ঢুকল।  আগের মেসেজগুলোও ঢুকেছে কিন্তু দেখেনি.....অপেক্ষা করল খানিক, তাও কোন উত্তর নেই, না অনলাইন। সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে, একটা খবর, সকাল হওয়ার আগেই পেতে হবে। বাড়ি ফিরে ক্লান্তির ঘুমে যদি ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমকে জাগিয়ে রাখার একমাত্র ওষুধ থানা যাওয়া। আরও চিন্তা বাড়িয়ে ফেলল নিজের, এ সব কি ভাবছে! একের সাথে দ্বিতীয় বিস্ময় সকাল থেকে পিছু ছাড়বে না...। 

একটা নাম মাথায় চলে এল। আলোক মন্ডল। অনেক সাহায্য করেছিল সেই-সময়। আজ ঐ একই রাত, জেগেও আছে। তাহলে সোমা! মেলা যেতে গিয়ে কি বিপদে পড়ল কোন! আর যদি সেরকমটা কিছু ঘটেও থাকে তাহলে আলোকদার সাথেইতো যোগাযোগ করা উচিত, আলো ওরফে রাতুল ভাল বন্ধু, কিন্তু এতদূর থেকে ও কি করতে পারবে?সেদিন আলোকদার সাথেই মেলা গিয়েছিল আলো প্রথম....সাথী হয়েছিল ওর। তার পর পর রাতের মেলায় আরও একজন সাথী হত। আর সোমার বাবা.....

১৯৮১ সালের কথা। কয়েকটা গ্রাম পেরিয়ে ছিল আলোকদের গ্রাম। কলকাতা লাগোয়া শহরতলীতে জন্মান ও বড় হয়ে ওঠা রাতুলের। আলো নামটা সোমার মুখেই সব সময় শুনতে অভ্যস্ত রাতুল। নিজের গ্রাম থেকে একে একে অনেকেই এখন কলকাতায়। জীবিকা শব্দটাই সবাইকে টেনে নিয়ে এসেছে। জীবনটা নাকি পড়ে আছে ওখানে। জীবনপুর ছিল নিজেদের গ্রাম। আলোক আঁকড়ে পড়ে আছে ঐ মাটিতেই। থেকে যেতে হয়েছে বলা ভাল। বিয়ে হয়ে গেল সোমার, কলকাতা শহরে অয়নের সাথে। তবু আজকের দিনে ও আগামীকালের  ভোর দেখার জন্য বার বার ফেরৎ যায়। আজও বেরিয়েছে, তবে দেরী হয়ে গেছে। কোন কথাই গোপন করে না সোমা আলোর কাছে, সর্বস্ব শেয়ার করে....




বছরকার মেলা যেতে গিয়ে আরও দেরী হয়ে গেল অন্ধকার জঙ্গলে সোমার গাড়িটা বিগড়ে গিয়ে। অস্ট আর সোমা। ভয়ও লেগেছিল চরম।  আলোকের সাথে যোগাযোগ এখন কমই। গাড়িটা যে পয়েন্টে খারাপ হয়েছিল সেখান থেকে নিজের গ্রাম কাছেই, আর আলোকদার নামটাই প্রথম মাথায় এসেছিল। ভয়ের সাথেই তড়িঘড়ি মেসেজ করেছে, আর কাকেই বা করবে...। আর এ অঞ্চলে আজও, সেই ১৯৮১ সাল থেকে আলোকদাই সোমার গার্জেন। হিরো হয়ে গেছিল সেইরাতে এই মেলায়। গ্রামে নিজেদের বাকুলে আর কেউই থাকে না, বাবা-মা'ও গত হয়েছেন অনেক বছর হয়ে গেল......। রাতুলের সাথে কথা হয় ফোনে আলোকদার, আলোকদার অনেক টান আলোর প্রতি। সোমার সাথে  কথা বলাতে একটা অস্বস্তি থেকেই গেছে...।  সোমা স্নান সেরে পুজো দিয়ে মেলা ফিরতি আজও গ্রামে গিয়ে দেখা করে আসে আলোকদার সাথে, তারপর আবার ১৮০ কিলোমিটার ফেরা।

গাড়িটা ঠিক হয়ে যাওয়ার পর অস্টকে নিয়ে আরও ২৫ কিলোমিটার পেরিয়ে মেলায় ঢুকেছে সোমা। কেন্দুলি। কবি জয়দেবের প্রাণ। আর আজ এই সকাল, সকল সমবেত মানুষের কাছে প্রবাহমান নদী সারা বছরের প্রাণ স্পন্দন। এপাড়ে মেলা আর ওপারে প্রাচীন শিল্প-শহর, খানিক দূরে।   খাপছাড়া ভাবে নিজের খেয়ালে বইছে নদী। কতটাই বা আর দেরী ভোর হবার, কাতারে কাতারে মানুষ বালি-বক্ষে, প্রাচীন আর নবীনের মেলবন্ধনের মেলা। বন্ধনে আজ সব্বাই। কিংবদন্তি বার বার সামনে এসেছে, মানুষের জীবনে এই বোধহয় সবচেয়ে বড় পাওয়া। মানব জীবনের এইই হল শান্তির আশ্রয়। এমন দিনের অপেক্ষা করা। কবি যা একদিন, প্রতিদিনের প্রেমকে সাথে করে অন্তর উজাড় করে দেওয়া ভালবাসায় ভগবান বন্দনায় লীলা স্থল বানিয়ে দিয়েছেন পরম ভক্তদের মনে। স্থলাভিষিক্ত পরম স্থান বারে বারে ফিরে পেয়েছে, কয়েকশ বছর ধরে, মহারাজা, রাজা, জমিদার, সাধু , কবি,  বাউল মনের পরম ভক্তদের। এসেছেন নানা রূপে নানা ভাষায় নানা পরিধানে।

সমস্ত রকমের প্রযুক্তি ল্যান্ড করেছে অস্থায়ী পুলিশ-আপিসে, ফল স্বরূপ সেলুলার ফোন আবার অকেজো। নদীর বালির ওপর দিয়ে বানান রাস্তা পেরিয়ে যা করার করে আসতে হবে ও-পারে। সারা রাত খোলা দোকান-পাট দু-ধারে। 

এমনটা অপেক্ষা করবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সোমা। ভুলটা হল শর্টকাট রাস্তা ধরতে গিয়ে....ধরতে হত না যদি না ধাবায় প্রানের মানুষটার সাথে দেখা হত। ফোনটা চলছে বলে তবু মেসেজ ছাড়তে পেরেছে এই রাত চারটের সময়ও..... নদী পেরিয়ে আসা, এপারে নতুন বাইপাস রাস্তা তৈরি হয়েছে, যেটা আসছে সোজা দুর্গাপুর থেকে যাচ্ছে কলকাতা। সেজেছে সারি-সারি দোকানে। নদী পেরিয়ে টুকটুক নিয়ে এসেছিল সোমা আর অস্ট। এবছর যা ঠান্ডা পড়েছে.....বেশ কতকগুলো মানকি টুপি কিনতে আসা, পরে করলে আর হবে না, আর মনের মানুষগুলোর প্রয়োজনত এখনই। পিতার শিক্ষায় শিক্ষিত সোমা, যৌথ পরিবারে মা'কে দেখেছে কি অপরিসীম ভালবাসা বিলোতে। বিলেত ফেরৎ ডাক্তার সোমা, কোনটারই ঘাটতি নিয়ে এসে পৌঁছয় না এই মেলায়। আলোকদার জন্যও একটা স্থান থেকে থাকে....ভাল দুধ-চা খেতে এসেছে এই ধাবায়, অস্ট আবদার ধরেছিল।

কথায় কথায় ১৯৮১ সালটা ফেরৎ এসেছিল। হারবাল বায়োটিক সৌন্দর্য সারা মুখে, লো-কাট ব্লাউজটা ভুল করে পরে চলে এসেছে, আজই। নিজের গ্রামের পথে এ কাজ কখনই সোমা করে বসে না, তার ওপর আবার হীরু-দা পিঠটাকে ওয়াইড করে দিয়ে আরও বিপত্তি করেছে। কলকাতায় সেরকম ঠান্ডা পড়ে না, এমন ঠান্ডা অনুভব করার জন্যইত আসা, দরকারে শাড়িটাকে লেপ্টে নেয়। মেয়েবেলায় লেপ থেকে কিছুতেই বেরোতে না চাওয়া সেই সোমা। অন্যমনস্কতায় বার বার সিন্থেটিক স্ট্র্যাপটা আরও যেন বেশী করে উঁকি দিচ্ছে। একধারে অন্ধকার আর শুকনো কুয়াশার সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাড়ি, অস্ট গেছে ধাবার ভেতর দুধ-চা আনতে। সেডান গাড়িটার ট্রান্সপারেন্ট কাঁচের ভেতর একমুখ দাঁড়ি আর জটা কেশের মাঝে সুপ্রসন্ন সেই মুখ সদা হাসিতে ভরা, চক্ষু যুগল যেন করুনার ভান্ডার। বাবার সাথে বহুবছর আগে ঠিক যেমনটা দেখেছিল...দেখতে দেখতে অনেক কাছে এগিয়ে গেছে ডঃ সোমা ঘোষ, দুজনার মাঝে শুধুমাত্র দরজার ব্যবধান, তাও থাকতে দিচ্ছে না কাঁচের ট্রান্সপারেন্সি। ওধার থেকেই হাত তুললেন প্রাণ পুরুষ। এত বছর পর এমন দিনে ব্রাহ্মক্ষনে আবার সাক্ষাৎ। এবার কথা বলার পালা কিন্তু এ গাড়ির সামনে কেউই নেই যে  বলবে কাঁচ নামিয়ে দিতে, এদিক ওদিক চাইল সোমা, নিজের চোখদুটো আবার ফিরে এল সেই সৌম্য পুরুষের পানে, দরজা খুলে ভেতরে আসতে বললেন অদ্ভুত এক ভালবাসা মেশান ইশারায়......," ক্ষমা করবেন আমাকে, আমি যদি আপনাকে সঠিক চিনে থাকি...বাবার সাথে বৃন্দাবন আশ্রমে আপনাকে আমার প্রথম দেখা। জন্মে থেকে অনেক গল্প বাবার মুখে শুনেছি।" " কি রকম গল্প?" শুদ্ধ বাংলায়, বাংলার বুকে শুরু হয়ে গেল সত্যিকারের গল্প।

"১৯৮১ সালে বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন মেলার লাইসেন্স যাতে আপনারাই পান....আমার তখন জন্ম হয়নি। আমাদের গ্রামের আলোকদা একঘরে হয়ে পড়ে.....!" 
"তুমি?"
বাবাজীর গলা থেকে যে আওয়াজটুকু এল তা প্রশ্ন না বিস্ময় বুঝে উঠতে পারল না সোমা," আমার জন্ম ১৯৮৫। কোনকিছুই.....তবু মেনে নেওয়া ছাড়া..," কি বলতে কি বলছে, কার সামনে বলছে, কে বলছে, সব কিছুই এই বাংলার আবেগে বাংলা ভাষায় ছুঁয়েগেল বাবাজিকে। আবার জানতে চাইল সোমা," আপনি মেলা যাচ্ছেন?" ঠোঁটের কোণে যেন হাসি মেখে কথাটা দাঁড়িয়ে রয়েছে," তুমি কি চাও না মা আমি এমন মিলন মেলায় যাই? কিন্তু আজতো আমি যাচ্ছি না। বৃন্দাবন ফিরছি, ভক্তের আশ্রয়ে ছিলাম এই ক'দিন। আজ তাদের বড়...!" "আপনাকে এমন দিনে আমি কাছে পাব...
কাছে পাওয়ারই তো কথা আজ। কথা রক্ষার দিন। উষ্ণতা অনুভবের দিন। আমি ছুটে আসি। বাবা সারারাত পড়ে থাকতেন মেলায়। বয়সে অনেক অনেক ছোট হলেও আলোকদা সাথ দিত বাবাকে। পরের দিন খিচুড়ি খেতাম...বকিয়ে মারতাম তাকে, গল্প শোনার জন্য।" আলোকদাই শোনাত মেলার যত গল্প। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে সোমা। গল্পে গল্পে গল্প কিংবদন্তি হয়ে যায়। হবে নাই বা কেন? কত চরিত্র ভিড় করে আছে কেন্দুলির গল্পে। কোনটাই কাল্পনিক নয়, সোমা বুঝতে লাগল নিজের বুদ্ধিতে। বুদ্ধি প্রকাশ হতে লাগল আপন সত্ত্বায়। 
" তুমি যে অনেক কষ্ট পেয়েছ, তা আমি বুঝেছি মা। তবে যার পাশে থাকার জন্য এখানে এসেছ, মেলা দেখে স্নান সেরে ফিরে যাও তার কাছে।"



" আপনিও চলুন আমার সাথে।"
"আমার হাতে সময় অল্প। বৃন্দাবনে অনেক কাজও পড়ে আছে। আমরা সবাই যে সময়ে বাঁধা মা। তার ওপর আমার সারথী আবার আমাকে দমদমে ছেড়ে ফেরত আসবে...।"
" আপনি দেখেছেন কখনও এই মেলা?"
"দেখেছি মা। সকলের হাত ধরে দেখেছি। তাইতো শিখিয়েছেন আমার গুরুদেব। আমরাও ভক্তদের তাই শিখিয়েছি। এমন মিলন মেলা....তোমার সাথেও কয়েক মিনিটের পরিচয়ে আবার পরিচিত হলাম। রাধা-মাধব মন্দির। কবির লীলাভূমি। সেবাদাসীর প্রেম-বৈরাগ্যে সমর্পিত হই আরবার।"

দু-চোখের কোনে দুফোঁটা জল কখন যে এসে অপেক্ষা করছে টের পায়নি সোমা," আপনিও চলুন না কেন আমার সাথে! ভগবানের দর্শনত আর মুখের কথা নয়। আমরা আপনাদের প্রদর্শিত পথেই হেঁটে চলি....আলোকদার বাবারও নিয়মিত যাতায়াত ছিল আপনাদের আশ্রমে। সেও মজেছিল। নিজেকে নিজের জ্ঞানে ভরপুর মানুষ করে তুলেছিল।"
 "আমি সব জানি মা। তুমি ডাক্তার তাও জানি।"
" কি করে জানলেন?"
" তোমার মা আমাকে খবর দিয়েছিলেন। ভগবানের ইচ্ছায় যা কিছু ঘটতে পারে। এই যেমন এই প্রজন্মের তুমি আজ যে প্রসঙ্গে আমার সামনে বিহ্বল...সেদিনের ঘটনা তোমার বাবা আমাকে জানিয়েছিলেন। ভগবানের ইচ্ছাই শেষ ইচ্ছা। আর সকলের ইচ্ছাকেও সম্মান জানাতে হয়। তাই হয়েছে । কবির এত কষ্ট করে গঙ্গা স্নান করতে যাওয়া....বৃন্দাবন থেকে পদব্রজে এখান অবধি হেঁটে আসা, তারপর একে একে সকলের স্নান এই লীলাভূমিতে ও আরও চারধারে।"

সোমা মুখ তুলে চাইল, ততক্ষনে চিটিয়ে গেছে সেই জল দু-ফোঁটা নিজেরই গালে, " সবই ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়েছে এইটুকু স্মরণে রাখবে সর্বদা।" "তবু আমাদের মতন মানুষরা কোন কোন ঘটনায় চরম আঘাত পেয়ে থাকি। একটিবার চলুন আমার সাথে। এপাড়ে দাঁড়িয়ে একবার আবারও স্বচক্ষে দেখে যান কবিক্ষেত্র। দশ মিনিটের পথ। আমি আপনার সাথে যাব দমদম। আলোকে আসতে বলছি ওখানে। আপনার সাথে ওর একবার সাক্ষাৎ করাতে চাই। দেখুন না, কি কান্ড করে বসে আছি, গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছিল, আলোকদাকে মেসেজ করতে গিয়ে অস্থির মনে আলো নামটা দেখে গভীর রাতে তাকে মেসেজ করে বসে আছি। কোন উত্তরও দেওয়ার সময় পায় নি।

" ডাকো সকলকে। চলো। কবিক্ষেত্র, ভালো বলেছ। আলো ফুটতে আর বেশী সময় বাকিও নেই। গীতগোবিন্দের গানে ও প্রভাতী আলোয় আলোক স্নান সেরে ফেলি, সোমা মা, গঙ্গা স্বয়ং তাতেই স্নান সারতে আসেন আজ। ভক্তদের আজ মাখামাখি করার দিন, গীতগোবিন্দের গানে ও গঙ্গা স্নানে।" খানিকটা উতলা হয়ে পড়ে সোমা," আপনার বেশী সময় নেব না...মিনিট পঁচিশ। ওপারে কবি প্রাণ জন্ম দিয়েছে মানুষের আবেগ, সেই আবেগ জন্ম দিয়েছে কত জীবন, কতই না রকমের। পরম্পরা রক্ষা করে চলেছে তাকে।" একমুখ হাসি," যতার্থ।" ইশারা করেন জ্ঞানী পুরুষ,"সময় বয়ে যাবে না হলে। অসময়ের বান ঠেকানো দায়। সমর্পিত হই আজকের দিনে পুণ্য লগ্নে। গুরুভাইদের একটা বিবরণ দিতে পারব তাদের ভাষায়....আর এক ভাষার ভাষ্যকার তুমি। দেরী কোর না মা!" 

সব্বাই দৌড়ে আসছে। সোমার কথা শুনে সেডান গাড়ির সারথীর যেটুকু ক্লান্তি আর ঘুম, মুখে চোখে ছিল তা এক নিমেষে উধাও,"তোমায় বলব ভাই পরে। অনেক গল্প অনেক মাহাত্ম্য। শক্তিগড়ে ল্যাংচার দোকানে আর দাঁড়াব না, আমিও যাব তোমাদের সাথে, শর্টকাট রাস্তা দিয়ে নিয়ে চল ভাই....অস্ট তুই টুকটুকে আয়। ওপারে গিয়ে সব কাজ করে গাড়ি নিয়ে একবার আলোকদার সাথে দেখা করে সোজা কলকাতা চলে আয়......"

সেই শর্টকাট রাস্তায় বিপত্তি। একটা টুকটুকের সাথে বচসায় জড়িয়ে পড়া। গ্রামের পথে এতবড় গাড়ি। একটা সময় অসহায় মনে হচ্ছিল সোমার। পাঁচ মিনিট সময়টা পুরো পঁচিশ মিনিট চলে গেল বলে মনে হচ্ছিল। দ্বিতীয়বার হোয়াটআপ ওপেন করে আলোর কোন মেসেজ আছে কিনা দেখতে গেল সোমা। এই থানায় অনেক বছর চাকরি সূত্রে ছিল আলো। সব মেসেজ আলোর কাছে পৌঁছে বসে আছে। তাড়াহুড়োয়, এ  কান্ড কিছুক্ষন আগে চোখে পড়েছে। সব আজ ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। বিধাতা সময়ে সময়ে নিজেই উল্টে ও পাল্টে ফেলেন। আলো অনেককিছুই বোঝাত.... আর আজ, আলোকে বোঝাবার পালা সোমার। এরপর যখন দেশে যাবে আলোকে ধরে-বেঁধে নিয়ে যাবে আলোকদার সামনে...গল্প শুনতে। মেলার গল্প। হাওয়াই চটি পরা আলোর শরীর থেকে একবার জুতো পালিসের গন্ধ পেয়েছিল সোমা," এই তোর শরীর থেকে জুতো পলিশের গন্ধ কেন রে?" সোমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালাতে গেছিল আলো, কাছে টেনেছিল সোমা। খুঁজেছিল সেই গন্ধ। আবিস্কার করেছিল। গোঁফের দুটো সাদা চুল ঢাকতে জুতোর পলিশ লাগান। সেই গন্ধটাই আজও লেগে আছে নাকে আর দুটো ঠোঁটে......

নুপূরের হাসব্যান্ড নিজের পরিচয়ে মেটালেন প্রবলেমটা। বহুদিনকার বাসিন্দা পানাগড়-রাজবাঁধ অঞ্চলে। বোঝদার মানুষ। মানুষগুলোও এত সহজে বুঝল তার কথা। পরম ভক্ত মানুষ, সামান্য সময়েই সোমা বুঝে গেছে সে কথা।বোঝাতে হবে, দেখাতে হবে আলোকে।আলোক আর আলো আর চলবে না, একজনের নাম পাল্টাতে হবে। এখন আর ফোন করার সময়ও নেই। হাইওয়েতে কলকাতার দিকে যখন গাড়ি ছুটবে তখন ফোন করবে আলোকে...এখন ঘুমোচ্চে ঘুমোক। 

নূপুরদের গুরুদেবকে নিয়ে গাড়ি এসে দাঁড়াল একটা টিলায়। ব্রজবাসী, গত তিনদিনের পর, নামঠান্ডা হওয়ার অবস্থা, কি ভক্তের কি গুরুদেবের। উনি নিজেই নামলেন। পেছনে তিন সাথী। সোমা ঠিক পেছনে, তারপর হাতজোড় করে নুপূরের হাসব্যান্ড আর একদম পেছনে হিরো সারথী। সামনে কবিতীর্থ সেখান থেকে আরও এগোলে শান্তিনিকেতন। মাঝে অজয় নদী। "তাড়াতাড়ি করবেন গুরুদেব।" সোমার বাচ্ছা সুলভ ভীতি মাখানো আবেদন। দ্বিতীয় মানুষটা চুপ থাকতে ইশারা করলেন। গুরুদেবের চোখ বন্ধ। "চলো ফিরে চলো," আদেশ তিনজনের প্রতি এক মিনিটের মধ্যে। গাড়ি ছুটল কলকাতার দিকে, এবার আর শর্টকাট পথে নয়, গাড়ির পথে। গন্তব্য.... ইংরাজিতে যাকে ডেস্টিনেশন বলে।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.