নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

আমোদিনীঃ ভস্মউত্থিতা
হাসপাতালের শয্যায় যখন আমোদিনীর জ্ঞান আসিল মাথার পশ্চাতে প্রবল যন্ত্রণা। যোনি,কটিদেশ আর জঙ্ঘাতে যেন আগুন লাগিয়া গিয়াছে। তাহার পাশে মাতা প্রবল উদ্বেগ লইয়া তাকাইয়া আছে। আমোদিনীর মাতা ডুকরাইয়া কাঁদিয়া কহিল,“ওরে মুখপুড়ি মরে গেলি না কেন?এখন আমি তোকে নিয়ে কি করবো।”ত্রয়োদশ বর্ষীয়া আমোদিনী তাহার অপরাধ বুঝিতে পারিতেছে না। স্মৃতি তে আসিল ,সে ব্রতচারী শিখিয়া ফিরিতেছিল সাইকেল করিয়া। কি করিয়া যেন সাইকেল হইতে সে পড়িয়া গেল। মাটি হইতে উঠিয়া, সাইকেল উঠাইতে যাইবার সময় মাথার পিছনে প্রবল আঘাত অনুভূত হইল।তাহার পরে সকল কিছু অন্ধকার হইয়া গিয়াছিল।পিতা তাহাকে বড় স্নেহ করেন তিনি পাশে বসিয়া কাঁদিয়া যাইতেছেন। আমোদিনীর তৃষ্ণা পাইয়াছে শুষ্ক ওষ্ঠে সে জল চাহিল।সেবিকা জানাইল এখন পান করা যাইবে না। বমন হইতে পারে। ড্রিপ চলিতেছে উহাই পিপাসা নিবারণ করিবে।তাহার পিতা গম্ভীর হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। ধীরে ধীরে চিকিৎসক আসিল। পরীক্ষা করিয়া জানাইলেন আপাতত ভয় নাই। ইহার পর পুলিশ আসিল। 

জিজ্ঞাসা করিল- 

কতজন ছিল?

তাহারা আমোদিনীর পরিচিত কিনা? 

কিভাবে তাহার ওপর অত্যাচার করিয়াছে?

কতক্ষণ করিয়াছে?

মারিয়া ফেলিবার হুমকি দিয়াছে কিনা? 

তাহাদের কাহাকেও আমোদিনী কোন ভাবে আহত করিতে সক্ষম হইয়াছে কিনা?

আমোদিনীর কিছুই মনে পড়িতেছে না। সে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ হইল না। তাহার পিতা চিৎকার করিয়া বলিল, “ তুই ভয় পাস না। বল হারামজাদাদের নাম বল। হাত ভেঙে দেবো । আগুন লাগিয়ে দেবো শালা । চোখ খুবলে নেবো”। আমোদিনী তাহার ‘অপরাধ’ এবং অবস্থা সম্বন্ধে বুঝিতে পারিল। 

তিনমাসাধিক কাল লাগিল আমোদিনীর নিজের পায়ে দাঁড়াইতে । মেরুদণ্ডের ক্ষতি হইয়াছে। কলিকাতা হইতে খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেল গুলি তাহার জন্যে গলা ফাটাইল। তাহারা যদিও আমোদিনীর ছবি ঝাপসা করিয়া প্রচার করিল। পাড়া, প্রতিবেশী, তাহার স্কুল এ হোয়াটস অ্যাপ এ আমোদিনীর ছবিতে ভাসিয়া যাইল। তাহার অত্যাচারের ঘটনার বিবরণ ধীরে ধীরে মশলাদার গল্পে পর্যবসিত হইল। সে কেন অপরাধী দিগের পরিচয় জানাইল না- এই প্রশ্নের নানান উত্তর তৈরি হইতে লাগিল।

“তার প্রেমিক কে সে সুরক্ষা দিচ্ছে হয়তো!”

“ধাড়ী মেয়ে ভন্নি সন্ধ্যেবেলায় একা ফিরছিল কেন?”

“ আরে আজকাল কার মেয়ে রে বাবা। একটু এন-জয় করতে গিয়ে ফেঁসে গেছে”

বাড়িতে তাহার নিকটে আর জ্ঞাতি ভ্রাতা ভগ্নীরা আসে না। তাহাদের অভিভাবকগণ নির্দেশ দিয়াছেন আমোদিনীর সঙ্গ ত্যাগ করিতে।তাহার পিতা আর মাতার মধ্যেও গুরুতর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।তাহার কারণ যে আমোদিনীর এই ভাগ্য বিপর্যয় তাহা সে বুঝিতে পারে। আমোদিনী তাহার জীবনের এই বিপুল বিপর্যয় লইয়া সর্বক্ষণ মৃত্যু চিন্তা করিতেছিল। কিন্তু শরীর ধীরে ধীরে তাহার আপন ছন্দে ফিরিয়া আসিতেছে।তাহার সুন্দরী মাতা শ্রীহীন হইয়া গিয়াছে। আমোদিনী এক শান্ত সন্ধ্যাকালে জানালার পাশে বসিয়া জিজ্ঞেস করিল , “আমি কবে থেকে স্কুল যাবো মা?” মাতা এতদিন চিৎকার করিয়া কাঁদিয়াছেন, তাহার নির্দোষ কন্যাটিকে প্রভুত অন্যায্য শব্দ দ্বারা বিদ্ধ করিয়াছেন। আজ হিমবাহ টি গলিয়া ভাঙিয়া বহিল। কন্যা কে বুকে জড়াইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ ওরে লোকে তোকে খারাপ বলছে।কাউকে বোঝাতেই পারছিনা। মজা পাচ্ছে তোকে নিয়ে। তোর দিদিমণি রা কেউ একবার দেখা করতে এলো না। তোর যে এতো বড় বিপদ হল । ওরে তোর বন্ধুরা কেউ একবার এলো না।তোর ব্রতচারীর স্যার? কৈ ...কেউ এলো না। কেউ বলল না আমার আমোদিনী কত ভালো মেয়ে” ।আমোদিনী মাতাকে জড়াইয়া ধরিয়া রহিল ।না সে আজ কাঁদিল না। মাতা কিঞ্চিৎ শান্ত হইলে বলিল, “সব ঠিক হয়ে যাবে মা দেখে নিও”। 



আমোদিনী বিদ্যালয়ে প্রবেশিয়া বুঝিল সকলে তাহাকে দেখিয়া অবাক হইতেছে। তাহার শ্রেণীকক্ষে আসিয়া দেখিল সে যে স্থানে বসিত সেখানে অন্য কাহারো ব্যাগ , জানালার নিকটের দ্বিতীয় বেঞ্চি টি। শ্রেণীর নেত্রী গোছের মেয়েটি আসিয়া বলিল, “এই তুই পেছনের বেঞ্চে বস। আমাদের সাথে বসবি না” । আমোদিনী তাহাই করিল। অর্পিতা ম্যাডাম রোল কল করিতে গিয়া আমোদিনীর দিকে তাকাইয়া কিছু মুহূর্ত বাক্যহীন হইলেন।তাহার পর স্মিত হাসিয়া বলিলেন , “ বাহ এই তো আমোদিনী নস্কর। টিফিন এর সময় আমার সাথে একবার দেখা কোর তো।”যাহারা আমোদিনীর সাথে কোন বাক্যালাপ করে নাই তাহারা কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত হইল। আমোদিনী স্থির করিল বড় হইয়া সে অর্পিতা ম্যাডাম এর ন্যায় হইবে।অর্পিতা ম্যডাম তাঁহার ফোন নাম্বার দিয়া বলিলেন কোন অসুবিধা হইলে আমোদিনী যেন তাহাকে ফোন করিয়া লয়। পূর্বের ন্যায় সহজ হইবার চেষ্টা করিতে শুরু করিল আমোদিনী। কিন্তু সে বুঝিল তাহার পূর্বের জীবনের সারল্য এবং সহজতা আর ফিরিবে না। সে কাহারো সহিত গল্প করিতে চাইলে তাহারা স্বাভাবিক ভাবে তাহাকে গ্রহণ করে না। তাহার শিশুকালের বান্ধবী কণিকা তাহার সহিত কথা বলিতে ভয় পাইতেছে। আমোদিনী মানিয়া লইল এই ভয়ানক একাকীত্ব তাহাকে লইয়া চলিতে হইবে। বক্ষ জুড়িয়া দাহ লইয়া সে পাঠাগারে যাইল। বুলবুল ম্যাডাম ভ্রু কুঁচকাইয়া তাহাকে একখানি কিশোর সমগ্র পুস্তক প্রদান করিল। ফিরিয়া আসিবার সময় কানে আসিল, “ পেকে ঝুনো হয়ে গেছে তাকে তুই কিশোর সমগ্র দিচ্ছিস বুলবুল।” অশ্রু গাল বাহিয়া আসিল না তাহা শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। কিন্তু দাহ আরও তীব্র হইল আমোদিনীর। শ্রেণী কক্ষে তাহার ব্যাগে বই টি রাখিয়া চুপ করিয়া বসিল সে। লাইব্রেরী পিরিয়ডে ছাত্রীগণ কিঞ্চিৎ ছুটি উপভোগ করিয়া থাকে। হঠাৎ প্রীতি সেন বলিয়া একটি মেয়ে তাহার পাশে আসিয়া বসিল। এক চোখ বন্ধ করিয়া বিশেষ ইঙ্গিত করিয়া বলিল, “ তোর বুকে যখন হাত দিয়ে ছিল তখন কেমন আনন্দ পেয়েছিস বল”।ইতস্তত সহপাঠীনি দের মধ্যে হাসির হল্লা বহিয়া যাইল। তাহারা কেহ জানে না আমোদিনী কটিদেশের একটি অস্থি তে নিত্য যন্ত্রণা লইয়া বিদ্যালয়ে আসিয়াছে। সে মাথা নিচু করিয়া আরও অনেক বাক্যালাপ শুনিয়া চলিল। গৃহে আসিয়া ধীর কণ্ঠে পিতা ও মাতা কে তাহার যাহা অভিজ্ঞতা হইল জানাইল। দুজনেই যারপরনাই কষ্ট পাইলেন। বিদ্যালয় গমন বন্ধ করায় শ্রেয় বলিয়া মনে করিলেন। আমোদিনী লাইব্রেরী হইতে প্রাপ্ত বইখানি পড়িতে লাগিল। উহাতে নিবিষ্ট হইয়া জাগতিক সমস্ত কিছু ভুলিয়া সে আনন্দে রহিল। সে এই একাকীত্ব যাপন করিয়া আরও পরিণত হইয়া যাইতেছে। সে মাতাকে আবার বলিল, “সব ঠিক হয়ে যাবে মা দেখে নিও”। 

আমোদিনী অর্পিতা ম্যাডাম কে ফোন করিল । “ আমি অন্য কোন স্কুলে চলে যেতে চাই ম্যাডাম। এখানে সব্বাই বড্ড খারাপ ভাবে কথা বলছে।”তাহার বুকের মধ্যে যত ব্যাথা জমিয়া ছিল অর্পিতা ম্যাডাম সকল জানিলেন। জেলা শহরে একটি ছাত্রিনিবাস এ আমোদিনী চলিয়া গিয়াছে। বেশ কিছু বছর পর তাহার গ্রামের সকলে জানিতে পারিবে

আমোদিনী নস্কর বলিয়া কৃতী এক ছাত্রীর কথা । যাহাকে তাহারা আপন করে নাই। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.