বর্ণালি বিশী

ভাষা আন্দোলনে নারীরা
‘মোদের গরব মোদের আশা
আ-মরি বাংলা ভাষা’

বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা,গর্বের ভাষা।মনের নির্ভরশীলতা গড়ে ওঠে একমাত্র মাতৃভাষার প্রতি।তাই নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য বাহান্নর আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাজপথে পুরুষের পাশে পাশে হেঁটেছেন নারীরাও। যদিও নারীদের অবদান  সেভাবে আমরা জানতে পারিনি। কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবে তথ্য জানতে পেরেছি। তবুও ইতিহাসের পাতায় তাঁরা অমর থাকবেন ভাষা সৈনিক হিসেবে।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে উদ্ভব হয় পাকিস্তানের। পাকিস্তানের(পূর্ব ও পশ্চিম) অংশ দুটির মধ্যে ভৌগলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌ্লিক পার্থক্য ছিল। ১৯৪৮সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার যখন উর্দুকে ঘোষনা করেন রাষ্ট্রভাষা, তখন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনসাধারণেরা কাজ-কর্মে নানারকম অসুবিধায় পড়েন।বাংলাভাষাকে সমমর্যাদার দাবি জানানো হলে বার বার নাকচ করা হয়। ১৯৫২সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সেই বিক্ষোভের চরম প্রকাশ ঘটে। রাস্তায় নারী পুরুষের রক্তের বন্যা বয়ে যায় । ভাষার জন্য হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

আন্দোলন দমনের জন্য সরকার ১৪৪নং ধারা জারি করে ২০শে ফেব্রুয়ারি ।২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বেরিয়ে আসেন প্রথম নারীরাই। রওশন আরা বাচ্চু,ড.শরিফা খাতুন,সারা তৈ্মুর,হালিমা খাতুন,নাদেরা বেগম,ফিরোজা বেগম এবং সুফিয়া আহমেদ প্রমুখ তেজস্বী মহিলারা সেদিন পুলিশের সাথে লড়াই করেছেন রক্ষণশীল সমাজের বাইরে বেরিয়ে।  কেউবা বন্দী হয়েছেন কেউবা পুলিশের লাঠিচার্জে হয়েছেন আহত।

ভাষা আন্দোলনকে পরোক্ষভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তিন সাহসী নারী- আবুল কাশেমের স্ত্রী রাহেলা,বোন রহিমা ও রাহেলার ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া। দীর্ঘদিন রান্না করে খাইয়েছেন ভাষা আন্দোলনকারীদের। শুধু তাই নয় পুলিশ বাসা ঘিরে ফেলার সময় ভেতরে গফুর ভাই এর সৈ্নিক পত্রিকার কাজে ব্যস্ত কাশেমসহ বেশ কয়ে্কজন। মিসেস রাহেলা দরজার সামনে পুলিশের সাথে তর্কবিতর্ক জুড়ে ঊনাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে আন্দোলনের গতিময়তা বজায় রাখেন।

অনেক কিশোরি যোগদানে ভাষা আন্দোলন অন্যরূপ লাভ করে।শেখ মুজিবর রহমানের আত্মকথা থেকে জানা যায় স্কুলের ছাদে ছোটো ছেলেমেয়েরা সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্লোগান দিত-‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’,বন্দিভাইদের মুক্তি চাই,’। সিলেটের কুলাউড়ার সালেহা বেগম ভাষা শহীদদের স্মরণে ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণীতে কালো পতাকা উত্তোলন করেন। তারজন্য তিনবছর স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তারপক্ষে আর পড়ালেখা সম্ভব হয়নি। ইডেন কলেজের ছাত্রী মেহবুবা খাতুন ঢাকার বার লাইব্রেরীতে সর্বদলীয় সভায় ১৯৪৮সালে ৩১জানুয়ারি জানান রাষ্টীয় ভাষা বাংলার জন্য রক্ত বির্সজনে মেয়রা প্রস্তুত। নারায়ণগঞ্জের মর্গান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম নেতৃত্ব দেন বাংলা ভাষার স্বপক্ষে। পুলিশ গ্রেপ্তার করলে তাঁর সাজানো সংসার ভেঙে যায়। ইলা বকশী, বেণু ধর কিশোরীদেরও গ্রেপ্তার করে।




১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে একুশ-বাইশ জন ছাত্রী গ্রেপ্তার হয় ১৪৪ধারা না মানার অপরাধে। তাঁদের মধ্যে লায়লা নূর,প্রতিভা মুৎসুদ্দি,জহরত আরা প্রমুখ অন্যতম। এছাড়াও নাদেরা বেগম ও লিলি হক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। আরও শত শত নারীরা উল্লেখযোগ্য অবদানে ২৯শে মে ১৯৫৬ সালে বাংলাভাষা পাকিস্তানের ২য় রাষ্ট্রীয়ভাষার মর্যাদা পায়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা অনেকেরই নাম এখনও জানতেই পারিনি।

প্রেম, ভালবাসা ও সাহসিকতার মধ্য দিয়ে নারীরা এগিয়ে নিয়ে গেছেন ভাষা আন্দোলনকে। মিটিং, মিছিল, পোষ্টারিং,বাড়ী বাড়ী চাঁদা তোলা,পুলিশের তাড়া খাওয়াদের লুকিয়ে নিজের বাড়ীতে রাখা কোনো কাজেই সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে আটকে থাকেন নি। অনেকে গয়না খুলে দিতেও বিন্দুমাত্র ভাবেন নি। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন শুধুমাত্র ভাষার জন্য নয় নারীরা লড়েছেন  জাতীয় সংস্কৃতির জন্যও।    

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ওয়েবসাইট



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.