ডঃ সোনালী মুখার্জী

রামধনু
ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলে পুপু শিখে এলো ভিবজিয়োর । রঙ মিলিয়ে মিলিয়ে ছবি । ভি ফর ভায়োলেট , আই ফর ইন্ডিগো মানে ডিপ ব্লু , বি ফর ব্লু , জি ফর গ্রিন , ওয়াই ফোর ইয়েলো , ও ফর অরেঞ্জ , আর ফর রেড ।

মা সাথে সাথেই বাড়িতে বললেন , দেখো , বেনীআসহকলা। বেগুনি , নীল , আকাশি , সবুজ , হলুদ, কমলা , লাল।

অক্ষর । শব্দ । আর আনন্দ।

“টেইল ইন কাউ ডাঙ্গ অ্যান্ড কাউ ডাঙ্গ ইন টেইল ”; বাবা মশাইয়ের অনবদ্য ভাষায় ল্যাজে গোবরে হবার ইংরেজি। সবাই হেসে কুটিপাটি ।

শুধু শব্দ নিয়ে খেলা করতে করতেই যে কত আনন্দ রোজকার দিনগুলোর মধ্যে ভরে দেওয়া যায় , এ যারা পুপুর ছোট বেলার ধারে কাছে না এসেছে তাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল । শব্দ আর তাল । ছন্দ আর সুর । আর রাশি রাশি মজা ।

এই সবই একখানা দশ ফুট বাই দশ ফুটের এক কামরা ভাড়াবাড়ির সব নেইদের অনায়াসে ঢেকে রাখত। সর্বদা রাজকন্যার মত আল্লাদে ডগমগ করে রাখত পুপুকে। ছোট দুই বছরের পুপু সকালের বিছানায় চোখ কচলাতে কচলাতে শুনত, “সাগর সাগর সাগর  নদীর জলে ডাগর -----সাগর ডাকে যদি  ঝর্না হবে নদী ।”

দেড় হাত মানুষ । সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি ভুঁড়ির ওপর টাইট । লাল টুকটুকে হাফ প্যান্ট। কদম ছাঁট খোঁচা খোঁচা চুল ।বাবা নিজের পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখছেন উপুড় হয়ে শুয়ে। পুপু বাবার পিঠের ওপর । খানিক পরে সে উসখুস করতেই বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ ফেরান। “ মেলাও দেখি এর সঙ্গে।

একা একা বসে ছাতে
পুপু খায় আলু ভাতে –”

ভাল মিল না হলে সমস্যা। তাল কাটলে বাবা বাতিল করে দেবেন। বলবেন, এতো মিলল না, চিলল । হাতে খড়ি হল যখন , মা “ বুড়ো আংলা’ বইটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন ,

“ পুপু সোনা মা বুড়ি যখ
করে কেবল বকর বক---”

তো এই সব যখের ধনের মত দামি সম্পত্তি নিয়েই পুপু আর তার বাবা মায়ের রাজ্যপাট । সারা বছরে যে মাত্র এক বারই তারা ভাল জামা কিনতে দোকানে যায় দুর্গা পুজোর সময় তাতে কারো কোন দুঃখ গজানোর মত ফাঁকফোকর ছিল না ।

তখন নটার সাইরেন বাজত। আওয়াজ হত ভোঁ করে । সব বাড়িতে লোকে ঘড়ি মেলাত তার সঙ্গে।  বাবা মশাই রোজ দাড়ি কাটেন সেই সময়। অফিসের গাড়ি আসবে । হঠাৎ এক দিন এক গাল হেসে গুন গুন করে বললেন , এই শোন গানটা ।

“ বাঁশী বাজল কোথায় ?
গোকুলে ত নাইরে কানু
সে যে গেছে মথুরায়
তবে বাঁশী বাজল কোথায় ?”

মা রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বললেন , “ এটা বুঝি নটা বাজার গান ? পাশের বাড়ির দিপির মা মাসিমা বলেন বটে শ্যামের বাঁশি । হ্যাঁ গো লিখবে না ?”

বাবার এক গালে সাবান মাখা । বললেন, “আহা অক্ষয়বাবু কি বলেন মনে নেই ? সখী শেষ করা কি ভাল , তেল ফুরোবার আগেই আমি নিভিয়ে দেব আলো –”

আরও একটু বড় হয়ে ক্লাস সেভেন এইটে পুপু রবীন্দ্র রচনাবলীতে খুঁজে পেয়েছিল এ ডায়ালগ। বড় ভাল লেগেছিল এ নাটক তার। রোজ পড়ে পড়ে মুখস্তই হয়ে গেল সব সংলাপ। চিরকুমার সভা ।

সেই সাবান মাখা গান গাওয়ায় দুদিন বাদে, বাবা ডায়েরী খুলে মাকে গান শোনাতে বসলেন। খাটে দুজনের মাঝখানে গুটিসুটি পুপু ।

বাঁশী বাজল বাজল
বাজল কোথায় ?
গোকুলে ত নাইরে কানু
সে যে গেছে মথুরায়
তবে বাঁশী বাজল কোথায় ?
নহে ত যমুনা কূলে
নহে ত কদম্ব মূলে
বাঁশুরিয়া নাই গোকুলে
বাঁশী তবু কাজ ভুলায়
তবে বাঁশী বাজল কোথায় ।

সে দিনের সেই মিষ্টি সময়টা থেকে কত দিন কত রাত পেরোলে পুপু পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়াবে তখন জানা ছিল না। স্নেহের নিরাপদ ডানায় মুড়ে রাখা ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীরা , “ভাল থেকো ” বলে তেপান্তরে উড়ে চলে যায় , পুপু তখন কল্পনা ও করতে পারেনি ।

জীবন কত ব্যস্ত । জীবনে কত যুদ্ধ । তার মধ্যেই মনের চারপাশে লক্ষ্মণ রেখার রক্ষা কবচের মত ঘুরে চলে শব্দের ইলেকট্রন , সুরের প্রোটন , আলোর ফুলকি। গ্লানি থেকে বিষাদের দৈন্য থেকে বাঁচিয়ে রাখে ।

শব্দ । অক্ষর । মায়ের হাতে শব্দজব্দের ছক। রিডার্স ডাইজেস্টের ইংরেজি শব্দের অর্থ নিয়ে খেলা । এরা রোজকার ধোঁয়া , ধুলো , যানজট , সন্ত্রাস , বিরক্তির ওপর দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে বলে । সেইখানে কলকাতার ব্যস্ত ফ্লাইওভারের ওপরে কি দেখা যায় জানো ? সারা আকাশ জুড়ে থাকা এপার ওপার রামধনু। কখনও দুটো এক সঙ্গে ।সত্যি । সে যে কি আশ্চর্য ভালো ! অথচ নিচের কলকাতা তাকে দেখতেই পায়না । সবাই বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে যার যার দৌড়ে ব্যস্ত। ফুরিয়ে যাচ্ছে আস্ত আস্ত দিন এক একটা।

অক্ষরের বেলুন পুপুকে আকাশের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় । সাদা চুলের ক্লান্তি মুছে দিয়ে বলে -

“ টক টক থাকে নাকো হলে পড়ে বৃষ্টি
তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি ।”



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.