তপশ্রী পাল

শেষ দৃষ্টি
ফিস শেষ হতে আর মিনিট পনের বাকি । সারাদিন ট্রেনিং এ ছিল রাধিকা । একটি তথ্য প্রযুক্তি কম্পানির সিনিয়ার ম্যানেজার । দিনের শেষে নিজের রুমে ফিরে সারাদিনের কাজকর্মগুলো মিটিয়ে নিচ্ছিল দ্রুত । তার অধীনে কাজ করে একাধিক প্রোজেক্ট টিম । টেবিলের উপর অনেক ডকুমেন্ট পড়েছিল আপ্রুভালের জন্য । চটপট সই করছিল রাধিকা ।

হঠাত মনে পড়ল – দেবারতির প্রোজেক্ট এর আজ ডেলিভারী ছিল না ! সব কোড সারভার এ তুলে ক্লায়েন্টকে মেল করার কথা ! করেছে কিনা বুঝতে পারছে না রাধিকা । কয়েকবার দেবারতির ডেস্কে ফোন বেজে গেলো । কেউ ধরল না । দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে এল রাধিকা । এই ফ্লোর জুড়ে তার টিমগুলো বসে । দেবারতির টিম দুরের ডান্ দিকের কিউবিকল গুলোতে বসে । খুব চটপটে আর কাজের মেয়ে দেবারতি । তাই তো প্রোজেক্ট লিডার হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি । দূর থেকে দেখা যাচ্ছে না কাউকে । রাধিকা একটু গলা তুলে ডাকে “দেবারতি !” হঠাত নিজের কিউবিকল থেকে উঠে দাঁড়ায় দেবারতি । রাধিকা বলে “ডেলিভারি করেছ?” “হ্যাঁ ম্যাম” বলে দেবারতি । কিন্তু এ কেমন চেহারা মেয়েটার ! শুকনো মুখ যেন রক্ত শূন্য সাদা ! চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে । কি ভীষন ঠাণ্ডা সেই দৃষ্টি ! যেনও কোন সুদুরের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল সে । কিন্তু এত ভাবার সময় ছিল না রাধিকার । বলল “আমাকে মেলের কপি পাঠাও” বলে রুমে ঢুকে গেলো । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মেল এসে গেলো । নিশ্চিন্ত হয়ে অন্যান্য কাজ সেরে যখন বেরল রাধিকা তখন চারিদিক নির্জন । প্রায় সব ছেলে মেয়ে বাড়ি চলে গেছে । খালি কয়েকটা প্রোজেক্ট কল চলছে । ব্যাগ নিয়ে লিফটে নীচে নেমে গেলো রাধিকা।

পরদিন জথাসময় অফিসে এসে নিজের ফ্লোরের দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেলো রাধিকা ! প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে । এখানে ওখানে কিউবিকল গুলোতে জটলা হচ্ছে ! সবার মুখে আতঙ্কের ছাপ ! নিজের রুমের বাইরে অনুপম, কোরক, শর্মিষ্ঠা, মৃণাল, দাঁড়িয়ে ছিল । রাধিকা বলল “কি ব্যাপার ! সবাই দাঁড়িয়ে ? কি হয়েছে ! তোমরা কাজ কর্ম করছ না?” সবাই চুপ ! রাধিকা রীতিমতো অস্বস্তিতে । কেউ কোন কথা বলছে না ! হঠাত কোরক বলে উঠল – “কাল ! দেবারতি !” “কি ! কি হয়েছে দেবারতির !” চেঁচিয়ে বলে রাধিকা ! “কাল দেবারতি – দেবারতি সুইসাইড করেছে !” “কি ! “ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না রাধিকা । মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে ! হঠাত ফোন বেজে ওঠে ওর রুমে ! ধরতেই ভি পি র গলা । “রাধিকা একবার ওপরে এসো – এক্ষুনি !” দ্রুত লিফটে উঠে নবারুনদার ঘরে ঢোকে রাধিকা । নবারুন বলেন “বস, হোয়াট এ হরিবল ইন্সিডেন্স ! তুমি জান কাল কি হয়েছে !” আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ে রাধিকা । নবারুনদার ঘরে অ্যাডমিন হেড, এইচ আর হেড, সব ডিরেক্টররা জড়ো হয়েছেন ! “কাল তুমি কখন বেরিয়েছ? দেবারতির সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল ?” “সাতটা নাগাদ সার ! ওর সঙ্গে কথা বলেই তো বেরলাম ।“ কিছু মনে হয়েছিল ওকে দেখে ?” “নাহ – মানে –“ অ্যাডমিন হেড সুকোমলদা বলেন “কাল অত্যন্ত আনফরচুনেট ব্যাপার হয়েছে । এই টপ ফ্লোরের সাথে আমাদের যে খোলা ছাদ আছে – যেখানে মোরাম বিছিয়ে সাজান হয়েছে – কোল্ড ড্রিঙ্ক ভেন্ডিং মেশিন রয়েছে – সেখানে বিকেলে বা সন্ধ্যায় ছেলে মেয়েরা একটু রিলাক্স করতে যায় জান তো – কাল বিকেলে দরজাটা খোলাই ছিল । দেবারতি কোন এক অবসরে ছাদে যায় – হয়ত তুমি বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে বা পরে – সন্ধে হয়ে গেছিল বলে নিশ্চই তেমন কেউ ছিল না – সে ছাদে যায় এবং ছাদে যে ঘোরানো সিঁড়ি লাগান আছে ট্যাঙ্কের টপে ওঠার তাতে নিজের ওড়না লাগিয়ে ঝুলে !! উঃ ! কি দৃশ্য !” তখন কেউ খেয়াল করে নি । তারপর রাতের শিফটের সিকিউরিটি আটটা নাগাদ দরজা বন্ধ করার আগে চেক করতে ঢুকে হঠাত এই ঘটনা দেখে – তারপর দৌড়ে এসে অ্যাডমিনে রাতের শিফটের ছেলেটি – পরীক্ষিৎ - ছিল, তাকে বলে ! সে এত শকড হয়ে যায় – যে হতবুদ্ধি হয়ে আমাকে ডাকে অফিসে – তারপর নবারুনদাও আসেন ! সি ই ও নিজে আসেন ! আনবিলিভেবল ব্যাপার রাধিকা ! সেক্টর ফাইভের অফিসে এরকম ঘটনা – চিন্তার বাইরে !” নবারুনদা বলেন “নিচে পুলিস এসছে – কনফারেন্স রুমে বসে আছে – আমাদের কোশ্চেন করবে । মিডিয়াও বাইরে রয়েছে । তোমরা কেউ কোন কথা বলবে না ! যা বলার আমি বলব ! পরে তোমার সাথে কথা বলব – তোমার প্রোজেক্ট এ তো ও ছিল !”

রাধিকা বলে “আর শুভদীপ ! ওর বর !” সুকোমলদা বলেন “শুভদীপ তো কাল বিকেলে অফিস টিমের হয়ে টেবিল টেনিস প্রাক্টিসে ছিল – গেস্ট হাউসে খেলা চলছিল ! ওকে আমরা খবর দিয়ে অফিসে আনি নটা নাগাদ ! ও তো আকাশ থেকে পড়েছে ! এর বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারছে না । খুব শকড ! রাতে কয়েকজন ছেলে তো ওর সাথে ফ্ল্যাটে থাকবে কদিন ! আর তো কেউ ছিল না ওদের ।

আস্তে আস্তে নীচে নামে রাধিকা । মাথাটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে । দেবারতি – কি ঘটেছিল দেবারতির ! বড় চাপা ছিল মেয়েটা – নিজের কথা বেশি বলত না । খুব প্রফেসনাল ছিল ।

লাঞ্চ টেবিলে কোরক, অনুপম, শরমিষ্ঠা, মধুর সাথে বসল রাধিকা । ওদের সবার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ছিল দেবারতি । মেয়েটা মনিপুরি ছিল । কিন্তু দেখলে কেউ বুঝবে না । ফরসা সুন্দর চেহারা । পুরপুরি বাঙালি মনে হত । আই টি তে ছিল গত সাত আট বছর । এটা ওর থার্ড চাকরি । ও আর ওর বর শুভদীপ একসাথে জয়েন করেছিল । শুভদীপ কোনদিন ই কাজে সিরিয়াস ছিল না । অফিস ক্লাব, খেলাধুলা এসবেই ওর উৎসাহ বেশি । কিন্তু দেবারতি – যেমন তার কাজ, তেমনি কথা বারতা । ক্লায়েন্টরা খুব পছন্দ করত ওকে । দু তিন বার ইউ এস ঘুরে এসেছে - অন্তত তিন বছর কাটিয়ে এসেছে । দেখতে গেলে ঝকঝকে একটি মেয়ে ।

শরমিষ্ঠা বলল “দেবারতি তো আকিউট ডিপ্রেশনে ভুগছিল - ওষুধ খেত নিয়মিত, কাউন্সেলিং করাত – কিন্তু বেরতে পারছিল না ডিপ্রেশন থেকে ।“ মধু বলল “এই ডিপ্রেশনের কারন কি ওর কোন বাচ্চা না থাকা ? একাকিত্ত?” কোরক বলল “না না, শি ওয়াস ভেরী প্রফেসনাল । এই সামান্য কারনে এত ভেঙ্গে পড়ার মেয়ে ছিল না । টা ছাড়া আজকাল তো কত ভাবে এই সমস্যা মেটান যায় !” শরমিষ্ঠা বলল “খুব সম্ভবত ওর নন ওয়ারকিং বিয়েটাই এর জন্য দায়ী !” “কেন? কেন? নন-ওয়রকিং কেন ?” জিজ্ঞাসা করে অনুপম । মধু বলল “দেখ শুভদীপ আর ওর টাইপটা সম্পূর্ণ আলাদা । শুভদীপ মফস্বলের ছেলে । ওদের পরিবার নিম্ন মধ্যবিত্ত । সব জেনেই দেবারতি ওকে লাভ মারেজ করেছিল । কিন্তু ওর শ্বশুর বাড়ি কোনদিনই ওর সাথে ভাল ব্যাবহার করে নি । আর শুভদীপের দাদাও শুনেছি ডাউটফুল ক্যারেক্টার ! তার নিজের বউও অদ্ভুত ভাবে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় – অনেকে বলে সে বউকে খুন করিয়েছিল ! দাদার বাচ্চাটার সাথে দেবারতি খুব ক্লোস ছিল – শুনেছি ওকে দত্তক নিতে চেয়েছিল – কিন্তু কেউ রাজি হয় নি ।“শরমিষ্ঠা বলল “দেখ এগুলো হয়ত কিছুটা কারন – তবে মূল হল শুভদীপের সঙ্গে ভঙ্গুর সম্পরক । শুভদীপ নিজে ইনফিরিয়ারিটিতে ভুগত – ইগোর সমস্যা ছিল । খুব কোল্ড বিহেভ করত দেবারতির সঙ্গে – দেবারতি বড় একা ছিল ।“ সব শুনে রাধিকা বলল “কিন্তু ওর মত ঠান্ডা মাথার একটা মেয়ে এই কাজ করল? তাও আবার অফিসে ! অ্যাডমিনের লকেদের ওপর কি চাপ বলত ! এরকম একটা ঘটনা – এখন খবরের কাগজ, টি ভি, পুলিস – কোম্পানিরও একটা বদনাম ! দেখ পোস্ট মরটেমে কি বলে !” 

শরমিষ্ঠা জিজ্ঞ্যাসা করে “রাধিকা দি, তুমি তো ওর সঙ্গে কাজ করতে – তোমাকে কিছু বলে নি কখনো ? কাল কোন কথা হয়েছিল ?” রাধিকা বলে “ওর সঙ্গে কাল আমার দু বার দেখা হয়েছে । আমি ট্রেনিং এ ছিলাম । ওটা ওরও আটেন্ড করার কথা ছিল । কিন্তু ও আসে নি । একবার ট্রেনিং রুমে ঢুকে ট্রেনার কে বলে গেলো ওর খুব কাজের চাপ, ও আটেন্ড করতে পারবে না । তারপর তো বিকেলে ওই দেখা ! – ম্যা গো ! কি চোখের দৃষ্টি ! তখন তো বুঝিনি – ও মনস্থির করছিল এই শক্ত কাজ করার জন্য !”

মধু বলল “এটা ওর প্রি প্লান্ড ! ও তো কাল লাঞ্চ ও খায় নি ! জিজ্ঞ্যাসা করতে বলল শরীর খারাপ । কাল গোটা দিন শুধু কাজ করে সব আপডেট করে গেছে ।“

রাধিকা বলে “সত্যি ট্রু প্রফেসনাল ছিল মেয়েটা । একবারও জানতে পারি নি ওর ডিপ্রেশনের কথা !” 

নবারুনকে প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিস । সব কাগজে বেরয় এই ঘটনা ! টপ ফ্লোরের ছাদের দরজায় পারমানেন্ট তালা পড়ে যায় । দেবারতির বাবা মা আসেন মনিপুর থেকে – তারপর অফিসের সবার উপস্থিতিতে চোখের জলে শেষ কাজ মেটে দেবারতির ।

এই কদিন রাধিকা একদম ঘুমতে পারে নি । ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছে দেবারতির সেই দৃষ্টি ! মানুষের মনে কি কি ভাব খেলা করে – যখন মানুষ এই ভাবে নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় ? কি ভাবে ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যায় – হেরে যায় একটা মানুষ ! শুভদীপ একটা কাওয়ারড ! নইলে এইভাবে একটা মেয়ে একা হয়ে যায় !

সিদ্ধান্ত করে রাধিকা – এবার থেকে প্রতিটা টিম মেম্বারের আরও অনেক কাছের মানুষ হতে হবে তাকে । জানতে হবে কাজের বাইরে তাদের জীবনকে – তবে তো সে বাঁচাতে পারবে এমন এক একটা ফুটন্ত ফুলের মত অমুল্য জীবন ! হয়ে উঠবে আসল লীডার !


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.