রাহুল ঘোষ

বিজন সরণির দিকে
।। অষ্টম পর্ব।।

'আজ চুপ করে ভাবো, এই রাত মৃদুজলঢেউ
বড়ো একাকিনী গাছ, মাঝে মাঝে কার কাছে যাব,
ঘুমায় ঘরের গায়ে ছায়াময় বাহিত প্রপাত
বুকে খেলে যায় হাওয়া।'
                                           ------ শঙ্খ ঘোষ




বহুদিন পরে অমল এল। রোহিতের সেই বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থতার পর এই প্রথম।

---কী করবো, তুই তো আর বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবি না! সেদিন কতবার ফোন করে বললাম, রোববার ছিল, তাও এলি না!

---গিয়ে কী হবে, বল! আল্টিমেটলি তোরা তো বোতল নিয়েই বসবি! আমার তো কিছুতেই নেশা-ফেশা হয় না! তাই আর ভালো লাগে না!

---হ্যাঁ, সাধে কি তোকে আমরা 'মদের পিপে' বলতাম! সবাই আউট হয়ে গেল, কেউ বাওয়াল শুরু করে দিল, কেউ ঘুমিয়ে পড়লো, আর তুই শালা সেই শুরুর মতোই স্টেডি! একটার পর একটা নিয়ে যাচ্ছিস চুপচাপ!

---আরে, আমার নেশা না-হলে আমি কী করতে পারি! তোরা তো কতবার পাঞ্চ করে খাইয়েও দেখেছিস!

---যাকগে, বাদ দে। কিন্তু নিজের কী হাল বানিয়েছিস বল তো!

---কেন, ঠিকই তো আছি! দাড়ি কামাচ্ছি, স্নান করছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, অফিস যাচ্ছি রোজ। লিখছি, মাঝেমাঝে কবিতা পড়তেও তো যাচ্ছি!

---আমি সেই হালের কথা বলিনি রোহিত, তুই জানিস...

---শুধু রাতে কিছুতেই ঘুমোতে পারছি না রে, ঘুমের ওষুধ খেয়েও না!

---তাহলে ভাব, ট্যুরে গিয়ে যে-ছেলেকে আমরা সকালে ঘুম থেকে টেনে তুলতে পারতাম না, সেই ছেলে এখন জেগে রাত কাটাচ্ছে! শোন ভাই, একদিন তোকে এইজন্যই বলেছিলাম, আজ যাকে রাতের ঘুম দিচ্ছিস, তোর রাতের ঘুম সে দিতে পারবে তো! কিন্তু তখন তো তুই প্রেমে হাবুডুবু, তোর ভালো লাগেনি এসব কথা!

---ঠিক জেগে না...ভোরের দিকে একটু ঘোরের মতো আসে, জানিস! ওইটুকুই।

---কী যে বলবো না! তোকে শালা সেদিন মরে যেতেই দেওয়াই ঠিক হতো, বুঝলি!

---আমিও সে-কথা ভেবেছিলাম রে! বিশেষ করে যখন আমার এত শরীর খারাপ জেনেও ও শুধু লিখলো, 'সাবধানে থেকো', তারপর আর একবারও জানতেও চাইলো না!

---হ্যাঁ, তাছাড়া আর কী! জানিস তোর অবস্থা শুনে সুতপা কী বললো? 'এইসব মেয়েদের অমন প্রেমের মুখে জুতো মারতে হয়!'

---হাহাহা! বৌদিকে বলিস, একদিন শুঁটকি রান্না করে তোকে দিয়ে পাঠাতে। অনেকদিন খাইনি!

---হ্যাঁ আমাকে তো জীবনেও 'দাদা' ডাকলি না, তুই-তোকারি করে গেলি! কিন্তু আমার বউকে বৌদি!

---আরে তুই তো দাদা-ই রে! পাক্কা তিনবছরের বড়ো! দাদা ছাড়া আর কী!

---আর মাখন লাগাতে হবে না! শোন রোহিত, সোজা কথা বলছি, এভাবে কিন্তু চলতে পারে না! তোর এই অবস্থা আর দেখা যাচ্ছে না, ভাই!

---চলছে না তো! কোথায় চলছে! জীবনই নেই তো, চলবে কী করে!

---এই শুরু হলো শালা বুদ্ধিজীবীদের আঁতলামো!

---আরে রেগে যাচ্ছিস কেন! কী বলবি, বল...আই অ্যাম ওপেন টু হিয়ার ফ্রম অল।

---বেশ, তাহলে শোন, তোর এই যে অবস্থা না, তার জন্য একমাত্র তুই-ই দায়ী!

---আমি! কীভাবে?

---ন্যাকা! কীভাবে আবার! কাউকে তার প্রাপ্যের থেকে বেশি দিতে নেই, একথা জানো না? এমনিতে তো জ্ঞানের পাহাড়! প্রেম কি তোর মতো ছেলেকে নির্বোধ করে দিল নাকি!

---হ্যাঁ, তুমুল ভালোবাসি, মানছি। কিন্তু নির্বোধ হওয়ার মতো কী করেছি বল তো!

---কী করিসনি, সেটা বল! বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ না-পেলে তুই অনেকদিন আগেই বুঝে যেতিস, এই রিলেশনশিপে তোর আসল জায়গাটা কী! ফালতু আমার মুখ খোলাস না, হজম করতে পারবি না!

---পারবো পারবো! তুই বল না...এটা তো জানিস, আমার কাছে মতান্তর মানেই মনান্তর নয়!

---জানি। কিন্তু সেটা তোর সঙ্গে মানে ক'জন? এই মেয়েটাই তো কোনোদিন মানলো না! তাহলে কী হবে ওরকম উদার মতবাদ দিয়ে? আরে ভাই, মুখে যে যতই বড়ো কথা বলুক, দুনিয়াটা বেসিক্যালি ধান্দাবাজ, এটা আর কবে বুঝবি! ঘরে-বাইরে একসঙ্গে একটু এদিক একটু ওদিক করে চালাতে সবাই পারে। কিন্তু একটা বিবাহবিচ্ছিন্ন পুরুষকে কোনো মেয়ে যতই 'ভালোবাসি, ভালোবাসি' করুক, তাকে ঠিকমতো আশ্রয় দেওয়া সবার কম্ম নয়!

---আচ্ছা শুধু শুধু রেগে না-গিয়ে বল না, কী বলবি! আর একটা সিগারেট দে, না-হলে তোকে বসিয়ে রেখে আমাকে আনতে যেতে হবে এখন!

--- দিচ্ছি। কিন্তু তোর আবার দিনে ছ'টার লিমিট পেরিয়ে যাচ্ছে না তো! তোকে তো সেই মেয়ে ঠিক করে দিয়েছিল! শালা কী প্রেমিক আমার! তোর মতো প্রেমিক আর দু'-চারটে থাকলে না, পৃথিবীটা রসাতলে যাবে!

---হাহাহা! আচ্ছা বল না, কী বলবি! 

---তাহলে শোন, একদম প্রথম থেকে শুরু করি। সহ্য করতে না-পারলে বলবি, বাকিগুলো বলবো না। তা তোর 'ও' কী করলো? একদিন তুই ওরই কাছে সেই দুই নম্বর লোকটার কী একটা কথা নিয়ে প্রশ্ন করলি, 'এসব এখনও বলে!' তার উত্তরে বললো, 'এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না।' আর তুই এত ক্যালাস, সেই অপমানটাও বেমালুম হজম করে ফেললি! গিল্টি না-হলে মানুষ কখনও লুকোয় রে! এদিকে আদিখ্যেতা করে, 'আমার খুব সৌভাগ্য গো, তোমার মতো মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি', ওদিকে কিসের এত গোপনীয়তা!

---না, আমি বলেছিলাম, 'আমি মনে করি এটা জানার অধিকার আমার আছে। এটা আমার ক্ষেত্রে হলে তুমিও জানতে চাইতে। আমি উত্তরও দিতাম। সেটাকেই সম্পর্ক বলে।' আমি মোটেই মুখ বুজে হজম করিনি!

---হ্যাঁ, করিসনি। কিন্তু স্ট্রংলি অপোজ়ও করিসনি। ওরকম আতুপুতু করলে মেয়েরা বুকের উপরে বসে দাড়ি ওপড়ায়, জানিস না? তারপর আরও শুনবি? যে-মেয়ের এটুকু হিম্মত নেই যে তোর সঙ্গে সম্পর্কের কথা যাদের বলেছে তাদেরও তোর আসল নামটা বলে, সে তোর ভালোবাসার জন্য আর কতটুকু যেতে পারে! কী একটা কাল্পনিক নাম ঝুলিয়ে দিল তোর গলায়, আর তুই চুপচাপ মেনে নিলি!


---ভুল করছিস। আমি যে এটা পছন্দ করিনি, সেটা বহুবার ওকে বলেছি।

---ওই তো, বলেছিস কিন্তু জোর দিয়ে বলিসনি। ফলে তোর আপত্তিকে একদম স্ট্রেট ব্যাটে উড়িয়ে দিয়েছে। এখানেও তোর জন্য সিগন্যাল ছিল, ও আসলে এদেরকে ব্যাপক ভয়ও পায়, আবার সন্তুষ্টও রাখতে চায়। ব্যাপারটা কেমন বল তো? ওদের ভাবতে দেওয়া যে আজকের দিনেও যে-ছেলেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায় না, সে নিশ্চয়ই একটা কাল্পনিক চরিত্র! তোদের ভালোবাসায় নাকি দারুণ গভীরতা! এতই যদি গভীর, তাহলে তোর ছদ্মনাম দেওয়ার দরকার কী!

--- আসলে ও বলেছিল, সব যদি ঠিকঠাক থাকে, ও একদিন বলে দেবে, ছদ্মনামের আড়ালে আসলে আমি!

---ওই তো! 'সব যদি ঠিকঠাক থাকে'! ওটাই আরেকটা ক্লু, তুই ধরতে পারিসনি! আসলে ওখানেই বলে দিয়েছে, নিজের সামান্যতম সমস্যা হলেই সে 'তোর মতো মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য' ছেড়ে পালাবে!

---না, ঠিক তা নয় মনে হয়! আসলে ও জানেই না জীবনের প্রায়োরিটিগুলো কীভাবে ডিল করতে হয়!

---খুব জানে! তুই ভাবছিলি তুই ওর প্রায়োরিটি হয়ে গেছিস। বাস্তবে তো সেটা হোসনি! তাই বিপদে পড়তেই 'চাচা আপন প্রাণ বাঁচা' বলে হাওয়া-হাওয়া! দ্যাখ ভাই, তুই তো আগে আমাদের কিছুই বলতিস না, কিন্তু তোর ওই অবস্থায় তোর ডায়েরি আর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ না-পড়লে বুঝতামই না, নিজের কী ভয়ঙ্কর অবস্থা করে ছেড়েছিস!

---আচ্ছা, হলো তো! কফি খাবি? এখন কফি বানাচ্ছি মাঝেমাঝে বুঝলি! যা ঠান্ডা পড়ছে! কলকাতায় বোধহয় বছর কুড়ি পরে এরকম ঠান্ডা পড়লো!

---কথা ঘোরাস না! কফি খাবো, কিন্তু বেরোনোর আগে। তুই আর শুনতে চাইছিস না, তাই তো?

---না, তা কেন! এগুলো কফি খেতে-খেতেও বলা যায়। তুই বল না, আমি কফিটা করে ফেলি।

---দ্যাখ রোহিত, আমি যা-যা বলছি, সব তোর লেখা দেখেই বা তোদের মেসেজ পড়েই বলছি। সেগুলোতে তোর আঘাত লেগেছিল বলেই তো লিখে রেখেছিস! আচ্ছা বল তো, ওই যে ওদের কোন অনুষ্ঠানে কেন তুই যাসনি বলে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন...

---হ্যাঁ, আমাদের এক কাকু...

---হ্যাঁ, কাকু। তা তোর এই 'ঈশ্বরী' কী উত্তর দিয়েছিল ওই ভদ্রলোককে? তোর মেয়ের নাকি শরীর খারাপ, তাই যেতে পারিসনি! এরকম অপ্রয়োজনীয় মিথ্যা কেউ বলে! তাও একটা শিশুর নাম করে! এতদিন শুনে এসেছি, এরকম নাকি বলতে নেই। তাহলে নাকি, সত্যি-সত্যিই...তুই পরে বলেছিলি ওকে যে কয়েকদিন পর থেকে মেয়েটা সত্যিই একটানা জ্বরে ভুগেছিল?

---পাগল নাকি! তাই বললে তো ও ভাববে আমি ওকে অ্যাকিউজ় করছি। আর মেয়ের জ্বর তো এমনিতেই আসতে পারে! এটা ভাবলে খুব বাড়াবাড়ি রকমের কুসংস্কার হয়ে যায়, বস!

---কুসংস্কার? যে হাতে আট-দশরকমের পাথরের আংটি, তাবিজ-কবচ সব পরে, অ্যাস্ট্রোলজারের কাছে যায়, তাকে বললে এটা কুসংস্কার হয়ে যেত!

---আট-দশটা না, যাঃ! দুটো না তিনটে আংটি পরে। কী যা-তা বলিস!

---ঠিক আছে, তাই মানলাম। কিন্তু এরকম কেউ বলে, তুই নিজেই বল না! সত্যিটা বললেই তো হতো যে, ইনভাইট করার দায়িত্ব যাদের, তারা ইনভাইট করার কথা ভাবেনি। এটা তো হয়েই থাকে! ব্যস, মিটে গেল! তা না...আরে, ঢ্যামনামির তো একটা লিমিট থাকবে, নাকি! আর পাল্লা দিয়ে তুইও হয়ে গেছিস ঢ্যামনার গাছ একটা!

---না না, এটা আমি মানতে পারলাম না! ও খুব স্নেহ করে মেয়েকে...

---হ্যাঁ সেইজন্যই একটা শিশুর সঙ্গে কথা বলতে হলেও তাকে লুকিয়ে বলতে হয়! আবার পাবলিকলি সে-কথা কেন লিখেছিস, তাই নিয়েও তোকে কথা শোনায়! ছাড় তো, আমাকে আলবাল বোঝাতে আসিস না!

---কিন্তু পাবলিকলিই তো মেয়েকে নিয়ে লিখেছিল ও, সেটা করতো তাহলে?

---হ্যাঁ, তাতেই মাথা কিনে নিয়েছিল আর কী! শোন ভাই, আমাকে স্পষ্ট করে বল তো, এত যে মাথায় তুলে রাখলি, 'দেবীবরণ' না কত কী যে লিখলি, বিনিময়ে তুই কী পেলি!

---কী পেলাম? কেন, স্মৃতি! সারা জীবনের সঞ্চয়! কথায় আছে না, 'অল দ্যাট অ্যান আর্টিস্ট নিডস, ইজ় আ ব্রোকেন হার্ট'!

---মার গেঁড়েছে! তুই তো কবিতা শুরু করলি!

---হাহাহা! বর্ণ-বিপর্যয় করে বলছিস কেন! খিস্তিটা সরাসরিই দে না!

---হ্যাঁ, তোকে গুছিয়ে খিস্তোতেই ইচ্ছে করছে আমার! আরে, তুই কি গন্ডার হয়ে গেছিস নাকি! কিছুতেই হেলদোল নেই! গতবার পুজোর আগে তোর অফিসে দেখা করতে গিয়ে দেখলাম, তোর কথা বলারই সময় নেই! কেন? না, তোর কাজের চাপ সরিয়ে তখন ওর পত্রিকার প্রুফ দেখে দিচ্ছিস, তাও আবার মোবাইলে পাঠানো ছোটো ছোটো ছবি থেকে! আমি ভাই তোর লাইনের লোক নই, তবে এটুকু তো বুঝি ওভাবে কারেকশন করতে চোখে কীরকম চাপ পড়ে! তা পত্রিকা বেরোনোর পর কোথাও কৃতজ্ঞতা স্বীকারেও তোর নামটুকু নেই! তোর 'দেবী' নাকি কোনোদিন কারও কাছে অকৃতজ্ঞ হতে পারে না! এই তো তার পরিচয়! ওদিকে তার এতই কৃতজ্ঞতার ভার যে, সে নাকি পরম শত্রুর সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করে!

---গতবার কেন, এবারেও তো অনেকটা করে দিচ্ছিলাম প্রথম দিকে! কিন্তু ও তো অস্বীকার করেনি যে আমি পত্রিকার কাজ করে দিয়েছি; কিছুই জানতো না, শিখিয়েছি হাতে ধরে...

---অস্বীকার করেনি তোর কাছে। ফোনে, মেসেজে। বাইরে কোথাও বলেছে কাউকে? বাজি রাখছি, বলেনি! তাহলে পত্রিকার ক্রেডিট লাইনেও তোর নাম থাকতো। আরে গান্ডু, বললে তো তোর প্রেজেন্সকে একরকম স্বীকৃতি দেওয়া হয়! সেটা করলে তো ওর বিপদ! গাছেরও খাওয়া, তলারও কুড়ানোয় অসুবিধে হয়ে যেত না!

---অমল, আর ভালো লাগছে না মাইরি এসব! থাক না, যেটা যেরকমভাবে করা ওর ভালো মনে হয়েছে, করেছে! আমার তো জীবনের কাছে নিজের জন্য ওকে ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই! সেটাই সত্যি হয়ে থাকুক!

--- আরে সেটা তো সত্যিই! কিন্তু বাকিগুলো মিথ্যে নাকি! ভালোবাসা খুব ভালো, কিন্তু তোর মতো অন্ধ ভালোবাসা ততটাই খারাপ!

---অন্ধ নই তো! এসবই বলেছি আমি নিজের মতো করে। হ্যাঁ, রুডলি বলতে চাইনি কোনোদিন, ওকে আঘাত দিতে পারবো না বলে! এটাকে যদি আমার অন্ধত্ব বলিস, হয়তো তাই!

---আমি শুধু কী ভাবি, জানিস? যে-ছেলেটা খেলার মাঠে, কলেজের স্টুডেন্ট পলিটিক্সে বাঘের মতো ঘুরে বেড়াতো, সে কীরকম বিড়ালের মতো মিউমিউ শিখে গেল!

---বাঘ বাঘই থাকে, অমলবাবু! সময় হলেই তার ডোরা দেখায়, বুঝলে! আর বিড়ালও কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বাঘের মতোই ফেরোশাস!

---তোর কাব্য রাখ! সত্যি কথাটা হলো, তোর দ্বারা এ-জীবনে আর বাঘের মতো হওয়া হবে না! ক্যানাইন টিথই হারিয়ে ফেলেছিস তুই!

---কেন হওয়া হবে না! সময় হলেই হবে!

---হবে না! হওয়ার হলে যেদিন তোর কাছে উড়ো ফোনে হুমকি এল, সেদিনই তুই ওদের চেজ় করতিস। পুরোনো রোহিত হলে কিন্তু তাই হতো!

---ধুর! আমি তো গুরুত্বই দিইনি ওই ফোনের! তাও তো সেকেন্ড টাইম যখন করলো, তখন খোঁজখবর লাগালাম। লাগিয়ে যা দেখলাম, তাতে হাসিই পেয়ে গেল ব্যাপক! এই নিয়ে আমার সঙ্গে মাস্তানি! এদের তো আমি যে-কোনোদিন মাটি ধরিয়ে দিতে পারি!

---তা মাটিটা ধরালে না কেন বাপ! পরে বলেছিলাম, আমাকে নাম্বারটা দে, পতা লাগিয়ে দেখি একটু শুয়োরের বাচ্চাগুলোর দৌড়! তাও দিলি না!

---ধুর, কী হবে ওসব করে! আর তো ডিস্টার্ব করেনি! দ্যাখ, আমি যেমন ওদের নিয়ে খোঁজখবর করেছি, ওরাও তো নিজেদের সাধ্যমতো করেছে, নাকি! ওরা যে ভুল জায়গায় খাপ খুলতে এসেছিল, নিজেরাই বুঝে গেছে!

---কী হবে ওসব করে? আরে, করলে ওদের পাল্টা চাপে রাখা যেত। নতুন জয়েন্ট ভেঞ্চারগুলোর কথা বলছিলি না সেদিন, সেগুলো নিয়ে চিন্তা থাকতো। ভাবতো, তুই ফিজিক্যালি না-থেকেও ওদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিস! তা না-করে তুই অ্যালুফ হয়ে থাকলি। এখন তো পুরো ফাঁকা ময়দান! তুই ওদের সার্কেল থেকেই কী শুনেছিস, সেটাও নিশ্চয় বলিসনি?


---নাঃ, সেটা মৃন্ময়ী নিতে পারবে না! আর ওদের যদি এখান থেকে চাপে রাখতাম, তাহলে ওরা হয়তো মৃন্ময়ীর উপরে টর্চার করতো!

---ও, মৃন্ময়ী নিতে পারবে না? তোমার আদরের 'বন্যা'! কিন্তু সে যে তোকে পুরো বানভাসি করে দিল রে!

---শুধু বন্যা কেন, আমি ওকে মাধবীলতাও বলি! আর রিসেন্ট একটা লেখায় সম্বোধন করেছি, 'হৈমন্তী'।

---তুই ওই-ই কর! এর বেশি কিছু তোর দ্বারা আর হবে না!

---না ভাই, আমি তো জানি ওকে কতটা ফেস করতে হয়েছে! এই অবস্থায় ওর মতো ইমম্যাচিওর মেয়ে আর কী করতে পারতো!

---ইমম্যাচিওর! বয়স চল্লিশ ছুঁতে যায়, আর কবে তুমি ম্যাচিওর হবে মা! আরে, কিছু করার ক্ষমতা না-থাকলে, সম্পর্কে জড়ানোর আগে দশবার ভাবতে হয়। কিন্তু জড়িয়ে, এতকিছু হওয়ার পরে, এত গভীর পার্টনারশিপে একটু খারাপ সময় এলেই হাত ছাড়িয়ে পালানো যায় না! পালালে, তার শাস্তি পেতে হয়। কিন্তু তুই তো আবার ওর সবকিছুই, তোদের কবিদের ভাষায় কী যেন বলে, 'ক্ষমাসুন্দর' দৃষ্টিতে দেখিস!

---না, বস! সবকিছুর ক্ষমা হয় না। এটারও হবে না। আমি সেদিন ওকে বলেও দিয়েছি। ক্ষমা আমি করতে পারবো না। আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তার শাস্তি ওকে পেতেই হবে! কবে আর কীভাবে, সেটা আমি জানি না! সময় ওকে বলে দেবে!

---বালের গল্প বাসুদেবকে শুনিয়ে লাভ আছে, ভাই?

---তুই বাসুদেব হবি কেন! তুই হচ্ছিস অমলকান্তি! দীপুকে চিনিস তো? আরে ক্যান্টনমেন্ট রোডে ক্যুরিয়ারের দোকান যার। ও একদিন মাইকে এটা বাজতে শুনে বলেছিল, 'আচ্ছা এতকিছু থাকতে অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চাইলো কেন? মানুষ কি রোদ হতে পারে!' মাইরি বলছি! সিরিয়াসলি!

---ফাজলামি রাখ, রোহিত! তাও দীপু তোর চেয়ে ভালো! এরকম জ্ঞানপাপী না! এদিকে বলছিস, 'শাস্তি ওকে পেতেই হবে', আবার ওকে বলেই রেখেছিস, ওর জন্য তোর অপেক্ষা নাকি একইরকম থাকবে! তাহলে আর শাস্তি হলো কোথায়!

---বলেই রেখেছি, কারণ আমার নিজের জন্য ওকে ছাড়া চাওয়ার কিছুই নেই! তাহলে অপেক্ষা করবো না? আর শাস্তি? ধরে নে, কোনো একদিন আবার ওর আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করলো, আমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করলো খুব, আমাকে প্রয়োজন হলো খুব, অথচ আমাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না! এর থেকে বড়ো শাস্তি আর কী হতে পারে!

---বোকাচো...তুমি ওই ভাবনা নিয়ে বসে থাকো, মাঝখান দিয়ে নেপোয় দই মেরে দিয়ে যেতে থাকুক! ইডিয়ট একটা! শোন, তোকে ওর আর কোনোদিন দরকারও পড়বে না! তোর অবস্থা শেষ! তোকে আর এসব বলে লাভ নেই! বাদ দে, আমি উঠলাম।

হাসতে হাসতে উঠে পড়লো রোহিতও। বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো, 'হ্যাঁ, আয়। বাইরে থেকে কোলাপসিবলটা টেনে দিয়ে যাস। আর শোন না, সিগারেটের প্যাকেটটা রেখে দিয়ে যা। না-হলে রাতে আবার আমাকে নিচে নামতে হবে!'

(ক্রমশ)




Previous Post Next Post