পর্ব-১৬
পরের দুইদিন সময়ের সাথে ভেসে চলেছিল গৈরিকা। নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল শান্তভাবে। ছটফট করেনি,সাঁতরে পার হওয়ার চেষ্টা করেনি। বদলে যা কিছু সুলভ,যা কিছু সহজ তাকে গ্রহণ করেছিল অনাবিল স্বাভাবিকতায়। নিখিলেশ দর্শকের ভূমিকায় অবাক হয়ে সবকিছু দেখছিল। সবকিছু যেন কোন জাদুমন্ত্রবলে আগের মত হয়ে গেছে। যেমন ছিল,ঠিক তেমনি। স্কুল কামাই করা যাবে না বলে,স্কুলে যাচ্ছে নিখিলেশ। অথচ এই যাওয়া,আর আগের যাওয়ার মধ্যে দুস্তর পার্থক্য রয়েছে। আগে স্কুলে গেলেও আর্চির জন্য একটা উৎকণ্ঠা কাজ করত। ছেলেটা একা রয়েছে ভেবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরতে চাইত নিখিলেশ। শিঞ্জিনী আছে জেনেও অস্থিরতা কাটত না। অথচ এই দুই দিন আর্চির জন্য কোন উদ্বেগ হয়নি ওর। মায়ের কাছে রয়েছে অরিন। গৈরিকা কেমন সুন্দরভাবে ছেলের সমস্ত কাজগুলো নিজের হাতে করতে শিখে নিয়েছে। এসব তো জানত না ও। কখনো নিজে হাতে করেনি। মা থাকতে মা করত। এখনো গৈরিকার ফ্ল্যাটে গেলে মায়ামাসির কাছেই সবকিছু করতে হত রিন্টুকে। শখে হয়তো এক-আধদিন ছেলেকে খাইয়েছে গৈরিকা,তবে শখ তো শখই হয়। প্রয়োজন আর শখের মধ্যে দুস্তর ফারাক। প্রয়োজনে মানুষ সব শিখে নিতে পারে। গৈরিকাও নিয়েছে। নিখিলেশের সমস্ত সংশয়কে হেলায় ভুল প্রমাণ করে ওর রিন্টুকে স্নান করাচ্ছে,খাওয়াচ্ছে,ঘুম পাড়াচ্ছে,গল্প বলছে...আর্চিকে এত খুশি কোনদিন দেখেনি নিখিলেশ। মা ঠিকই বলতেন-হাঁসের বাচ্চাকে সাঁতার শেখাতে হয় না। তেমনি,কোন মা’কে সন্তান প্রতিপালন শেখাতে হয় না। মেয়েদের রক্তে থাকে জিনিসটা। যখন চায়,তখনই শিখে নিতে পারে। নিখিলেশ নিশ্চিন্তে স্কুলে যায় তাই। বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই আর্চি আগে যেমন-“বাবা এসেছে” বলে হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত,এখন আর দেয় না,ঝাঁপিয়েও পড়ে না। গৈরিকা বলে, “রিন্টু,বাবা এসে গেছে।” আর্চির এই পরিবর্তনে খুশি হয় নিখিলেশ,অথচ সম্পূর্ণরূপে খুশিও হয়ে উঠতে পারে না। আর্চির মামমাম যে ওর কাছে ওর বাবার থেকে বেশি জরুরী-কি ভাবে মানবে এই সরল সত্যিটা,বুঝে উঠতে পারে না। আগে বাড়ি ফেরার মধ্যে তাড়া থাকত,উদ্বেগ থাকত,বাধ্যবাধকতা থাকত। এখন তাড়া না থাকলেও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে নিখিলেশ। ফিরতে ওর মন চায়। সব পুরুষকে একদিন ফিরতেই হয় প্রিয়তম নারীর কাছে। অন্য বন্দরে নোঙর ফেললেও তেমন জাহাজ শেষমেষ ফিরে আসে নিজের চেনা বন্দরে। বিশ্রাম নেয়,ক্লান্তি দূর করে। নিখিলেশও এতদিন যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত। একহাতে সমস্ত কিছু করতে করতে পরিশ্রান্ত। দুদণ্ড শান্তির খোঁজে তড়িঘড়ি বাড়ি ফেরে ও। না,ভুল হল। সংসারে ফেরে। বাড়িটাকে বহুদিন পর সংসার বলে মনে হয় নিখিলেশের। হয়তো এই মনে হওয়াটা ক্ষণস্থায়ী। কয়েকদিন পরেই আবার গৈরিকা স্বস্থানে স্বমহিমায় ফিরে যাবে,তবুও নিখিলেশের দুচোখে মায়া কাজলের মত লেগে থাকে।
-গল্পটা কেমন হয়েছে?
নিখিলেশ পড়ে অবাক হল।
-রূপকথা লিখলে হঠাৎ?
-ভালো হয়নি?
-দারুণ হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ এরকম লেখা?
-রিন্টুর মত করে লিখতে চেয়েছিলাম। ওকে যে গল্পগুলো শোনাই,সেসব জড়ো করে লিখলাম। যা কিছু লিখেছি এই পাঁচ বছর ধরে,তার বাইরে বেরোতে চেয়েছি।
-অত জটিলতা ভালো লাগছিল না,তাই তো? ঠিক করেছ। অনেক সময় শিশুর সাথে মিশে তার মত করে ভাবতে ভালো লাগে।
-শান্তি পাওয়া যায়। এই শান্তির ভাগ রিন্টুর কাছ থেকে চাইতে হয়নি,ও এমনিই দিয়েছে।
-তোমাকে দেবে না তো কাকে দেবে? তাইতো ভাবি,গৈরিকা না লিখে আছে কি করে? লেখা তো তোমার অক্সিজেন। লিখতে লিখতে আর্চির জন্য বিরক্ত হওনি তো? জ্বালাতন করে নি তো?
-না,রিন্টু আমার ভালো ছেলে। ও জানে তো মামমাম লিখলে ডিস্টার্ব করতে নেই। চুপটি করে বসে নিজের পড়ার বই পড়েছে তাই।
-বাঃ! জ্বর তো নেই,কাল থেকে স্কুল পাঠাতে হবে।
-এখনি কেন? অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্সটা কমপ্লিট হোক।
-ক্লাসের পড়া বাকি পড়ে যাবে তো।
-পড়ুক। আমি পড়িয়ে দেব। এই ক’দিন রিন্টু কোত্থাও যাবে না।
গৈরিকার জেদের সাথে পারা যাবে না। নিখিলেশ বৃথা তর্ক করল না।
-ঠিক আছে,তাই হবে।
-আজ আমি পড়িয়েছি রিন্টুকে। ঐ মেয়েটা এসেছিল,কি যেন নাম...
-শিঞ্জিনী?
-হ্যাঁ,পড়াতে এসেছিল। আমি বলে দিয়েছি রিন্টুর শরীর খারাপ না সারা পর্যন্ত আসতে হবে না।
গৈরিকা ইচ্ছা করেই কাজটা করেছে। শিঞ্জিনী এখানে আসুক,ও চায়না।
-আর তেমন পড়ায় না। রিন্টুকে পড়ে ধরে দেখলাম,ওর পড়ানোয় অনেক ফাঁক রয়েছে। ভালো টিচার রাখতে হবে এবার থেকে।
নিখিলেশ মনে মনে হাসল। শিঞ্জিনীকে তাড়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে গৈরিকা।
-ভালো টিচার কোথায় পাবো?
-তাও ঠিক। এখানে ভালো টিচার পাওয়া মুশকিল। তুমি পড়াতে পারো তো?
-আমি? আমাকে ভয় পায় নাকি? পড়াতে বসলেই কোলে চেপে বসে হাজার গণ্ডা আব্দার শুরু করে দেবে,বাবা গল্প বলো,কোলে করে বেড়িয়ে বেড়িয়ে পড়ব,গান চালাও...ঐ জ্বালায় অতিস্ট হয়েই তো টিচার রাখা।
-তোমাকে ভয় পায় নাকি কেউ? নাঃ! এবার থেকে আমাকেই পড়াতে হবে। আজ আমার কাছে তো বাধ্য ছেলের মত পড়ল।
নিখিলেশ ভাবল,গৈরিকা হয়ত ভুলেই গেছে এটা দু’দিনের খেলাঘর। পুতুলখেলা খেলতে খেলতে মানুষ খেলাটাকেই সত্যি মনে করতে থাকে। ওর ভুলটা ভাঙাতে চাইল না। ভালো আছে গৈরিকা,শান্তিতে আছে। যে শান্তি ও চেয়েছিল,তা অবশেষে পেয়েছে যখন-তাকে নষ্ট করতে পারল না নিখিলেশ। গৈরিকাকে কিছুই দিতে পারেনি। ওর ব্যর্থতার ভার বইতে না পেরে পালিয়ে বেঁচেছিল মেয়েটা। আজ যদি একটু শান্তি দিতে পারে,তাতে ক্ষতি তো নেই। দু’দিন আগের গৈরিকা আর আজকের গৈরিকার মধ্যে অনেক পার্থক্য-আর সেগুলো স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে নিখিলেশ। মন খারাপের মেঘটা উড়ে গেছে,বেশ হাসছে। ফোনটাও বন্ধ করে নেই। সবার সাথেই কথা বলছে,ইন্দ্রনীলের ফোন আসেনি আর। না আসাই ভালো। ফোনটা এলে কষ্ট পায় গৈরিকা। উত্তেজিত হয়ে পড়ে,অশান্ত হয়ে পড়ে। তার থেকে যা মিথ্যা তা মুছে যাক। মনে মনে চাইল নিখিলেশ,এই চাওয়ার মধ্যে কোন স্বার্থ নেই। নিজের জন্য চাওয়া নেই। গৈরিকার ভালোর জন্যই চাইল নিখিলেশ।
গৈরিকা অরিনের পাশে শুয়ে শুয়ে ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক করছিল। ছেলে ঘুমে কাদা। আজ আর ‘বাবা শোও...’ বলে জেদ করে নি। নিখিলেশ নিজের ঘরে কাজ করছে তাই। সুহার্তর মেসেজ এল হঠাৎ,
-কি করছ?
-শুয়ে আছি।
-রিন্টু ঘুমোল?
-ক-খন।
-নিখিলেশদা?
-ওর ঘরে,কবিতা লিখছে।
-বেশ তো আবার আগের জীবনে ফিরে গেলে।
একমুহূর্ত থমকাল গৈরিকা। ফিরেছে কি ও? যা ত্যাগ করে চলে যাওয়া হয়,তার কাছে কখনোই কি পুরোপুরি ফেরা যায়? এই বাড়িতে আগেও ছিল,এখনও রয়েছে। অথচ দুটো থাকার মধ্যে দুস্তর ফারাক। তখন একজনের স্ত্রীর পরিচয়ে থাকত,এখন কারোর মায়ের পরিচয়ে থাকে। যার বাড়িতে থাকে তার সাথে গৈরিকার সমাজস্বীকৃত কোন সম্পর্কই নেই। সেই মানুষটার মনে আছে,আজও হয়তো কিছুটা হলেও আছে...অথচ নিটোল ভালোবাসার বেদিতে কি আজ বিতৃষ্ণার ছিটে লেগে নেই? না হলে নিখিলেশ কেন স্বাভাবিক হতে পারে না ওর সাথে? কেন চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না।
-একে ফেরা নয়,রয়ে যাওয়া বলে। আগের থাকা আর এই থাকার মধ্যে অনেক ফারাক।
-কোন ফারাক নেই। নিখিলেশদা তোমাকে এখনো ভালোবাসে।
-তাই? আমাকে তো বলে না।
-সব কি বলতে হয়? কিছু কথা তো বুঝেও নেওয়া যায়।
-কথা থাকলে তো বুঝব।
-সময় এলে ঠিক বুঝবে। তবে আমি খুশি,তুমি অ্যাটলিস্ট মাকালটার গলায় মুক্তোর মালা হয়ে ঝুলে নেই।
-প্লিজ...থাক না ওসব কথা...
-তোমার খারাপ লাগলে থাক। এই,আমার নতুন বইটার উৎসর্গে লিখছি হিমালয় কন্যার জন্য...আপত্তি নেই তো?
-এত সবাই থাকতে আমাকে উৎসর্গ...কেন?
-কবিতাগুলো তো তোমাকে নিয়েই লেখা। এই যে ক’দিন নিরুদ্দেশ ছিলে। ফেসবুকে আসছিলেই না কষ্ট হচ্ছিল। খসখস করে গোটা কুড়ি কবিতা লিখে ফেললাম তোমাকে নিয়ে। ওগুলোও থাকছে এবারকার বইতে।
-ক’দিন ফেসবুকে না পেয়ে কুড়িটা কবিতা লিখে ফেললে?
-খুব কষ্ট হচ্ছিল যে আমার। তোমাকে ভালোবাসি যে। তোমার খবর না পেলে পাগল পাগল লাগে। এই যে,এখন জানি তুমি ভালো আছো-তোমার নিজের প্রিয়জনেদের কাছে রয়েছ-এখন নিশ্চিত।
-ভালোবাসো,আবার অন্যের সাথে থাকলে হিংসা হয় না?
-তোমার ভালো থাকাটাও ভালোবাসি যে। এই যে তুমি ভালো আছ,রিন্টুকে কাছে পেয়েছ,ওকে যত্ন করছ,রূপকথার গল্প লিখছ,নিখিলেশদার সঙ্গ পাচ্ছ-এটাতেই খুশি আমি।
-সঙ্গ আর কোথায়...
-তাহলে যাও। সঙ্গ দাও,নিজের মনের কথাটা নিজে স্বীকার করো আগে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে দেখো তো গত ক’দিনে তুমি যতটা সুখে আছ,শান্তিতে আছ-গত পাঁচবছরে কি ছিলে?
-না।
গত পাঁচ বছরে শান্তিতে ছিল না গৈরিকা। সবসময় একটা অশান্তি তাড়া করত ওকে। সাফল্য পেয়ে হারিয়ে ফেলার ভয় ওকে গ্রাস করে রাখত। একটুও থামতে দিত না,জিরোতে দিত না,পাগলের মতো ছুটে চলত ও। একটা লক্ষ্য থেকে অপর লক্ষ্যের দিকে। লক্ষ্য পূর্ণ হলেও তৃপ্ত হত না। আরো একটা বড় লক্ষ্য ওকে তাড়িয়ে নিয়ে যেত। অথচ এখন ওর মাথায় কোন চাপ নেই। সাফল্যের পিছনে ছোটা থেকে বিরতি দিয়ে এই ক’দিনে বুঝেছে সবচেয়ে বড় সাফল্যও ওর রিন্টুর ছোট্ট ছোট্ট খুশির থেকে বেশি খুশি দেয় না ওকে। দিতে পারে না। চিরন্তনী কুন্ডুকে উচ্ছ্বাস তোল্লাই কেন দিচ্ছে-এটাও এখন অবান্তর প্রশ্ন ওর কাছে। ওদের ইচ্ছা-তাই ওরা দিচ্ছে। যে যোগ্য তাকে আটকে রাখা যায় না। যোগ্যতা একদিন না একদিন প্রমাণিত হবেই। এই ভেবে সময়ের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিতে শিখেছে গৈরিকা। বরং বহু বছর পর রান্না করতে,ছেলেমানুষ করতে-অনভ্যাসের সব কাজগুলো করতে বেশ লাগছে ওর। একটুও ক্লান্ত লাগছে না,কষ্ট হচ্ছে না। বহুবছর পর হয়ত সংসার করছে গৈরিকা। ইন্দ্রনীলের সাথে যা ছিল-তাকে আর যাই হোক সংসার বলা যায় না।
-তাহলে নিখিলেশদাকে বলে দাও তুমি আবার নতুন করে সংসারটা করতে চাও।
-কি?
-খুব কি কঠিন এই কথাটা বলা? ইগোতে লাগবে,না? ইগো-টিগো ঝেড়ে ফেলে দাও। যা মন থেকে করছ,মনের তাগিদে করছ-যা করে খুশি আছ- সেটাকে মুখে বলতে কি দোষ?
-এতটা সহজ নয় ব্যাপারটা।
-জানি। সংসারটা আগেরবার তুমি ভেঙেছিলে বলে কুণ্ঠিত রয়েছ তো? আরে বোকা মেয়ে,যে ভাঙে গড়ার দায়িত্ব তারই বর্তায়।
-নিখিলেশ যদি প্রত্যাখ্যান করে?
-করবে না। তোমার রিন্টু একসাথে মা-বাবা দুজনকে পাবে,এটা নিখিলেশদার খুব বড় একটা পাওনা। আমি দেখেছি তো,কেমন ভোতা মুখ করে রিন্টুকে আনতে যেত তোমার বাড়ি।
-রিন্টু ভালো থাকবে এতে বলো? কিন্তু নিখিলেশ কি কখনো আবার ভালোবাসবে আমায়?
-রিন্টু খুব ভালো থাকবে। নিখিলেশদাও তোমায় খুব ভালোবাসে। তুমি বাসো তো?
প্রশ্নটার উত্তর গৈরিকার জানা নেই। একদিন তো নিখিলেশকে ভালোবেসেছিল ও,হ্যাঁ-ওকেই ভালোবেসেছিল। অথচ কালের বিচারে গৈরিকার ভালোবাসা অসার প্রমাণিত হয়েছে। সেই নিখিলেশ আর আজকের নিখিলেশের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য। আজকের নিখিলেশ হতাশ নয়,ব্যর্থতার গ্লানিতে ডুবে নেই। অবসাদগ্রস্তও নয়। নিজের মত করে ছোটছোট ধাপ পেরিয়ে সাফল্যের দোরগোড়ায় উপস্থিত। তাই সাফল্যের জন্য কোনরকম আপোষ করেনি নিখিলেশ। তাই সাফল্যের চৌকাঠে দাঁড়িয়েও নিরুত্তর নিরাসক্ত সন্ন্যাসীর মত নিজের কাজে ডুবে থাকে। সাফল্য যাকে বিচলিত করতে পারে না,উত্তেজিত করতে পারে না-সে নির্মোহ। ব্যর্থতাকেও জিতে নিয়েছে সে। এই সৎ মানুষটা প্রতিকূল পরিস্থিতির গনগনে আগুনে পুড়ে এখন খাঁটি সোনা। তার থেকে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ার সম্ভবনা নেই আর,বরং শেখার আছে। অপেক্ষা,স্থিতি,ধৈর্য,ঔদার্য শেখার আছে। সুহার্ত হয়ত ঠিক। সাফল্যের যাত্রায় ক্লান্ত গৈরিকার এবার সম্পর্কের দিকে মুখ ফেরাবার সময় হয়েছে। একা একা বাঁচা যায় না-কেউ বাঁচতে পারে না। একাকীত্ব ঘুণপোকার মত মানুষের সত্ত্বাকে ক্ষয় করে ফেলে। একাকীত্বকে ভয় পায় গৈরিকা,একা থাকতে চায় না। নিঃসঙ্গ মৃত্যুর কথা ভাবলেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে ওর। সম্পর্কে ফিরতে চায় গৈরিকা,সংসারে ফিরতে চায়। এ সংসার তো ওরই। ওর জন্যই এতদিন অপেক্ষা করছিল এ বাড়ির প্রতিটি জিনিস। এ বাড়ির মানুষেরাও তো ওর। একান্তভাবে ওর। তারাও কি অপেক্ষা করছিল না? ও এই ক’দিন রয়েছে-তাতেই বাড়িটাতে প্রাণ ফিরে এসেছে যেন। রিন্টু আর ওর বাবার জীবনেও প্রাণ ফিরে এসেছে। নিজের জুতোয় নিজে আবার পা গলাতে লজ্জা কিসের? পা গলাবে,নিজে থেকেই গলাবে-স্থির করল গৈরিকা।
(পর্ব-১৭)
নিখিলেশের দিদি নবনীতা তার মেয়েকে নিয়ে এসেছিল অরিনকে দেখতে। অরিনকে দেখাটা বাহানা,এটা বুঝতে গৈরিকার বাকি নেই। দেখার যদি হত,তাহলে যখন জ্বর ছিল,তখন আসত। এখন এসেছে সরেজমিনে এ বাড়ির পরিস্থিতিটা দেখতে। গৈরিকা এখানে রয়েছে এ খবর নবনীতাকে জানানোর লোকের অভাব নেই। পাড়ার লোকজন এসব ব্যাপারে বেশ উৎসাহী। গৈরিকা যেমন শীতলতা দেখায়নি,তেমনি অতিরিক্ত উষ্ণতাও দেখায়নি। মুখে সৌজন্যের হাসি বজায় রেখেছিল। “আর্চি কোথায়?” বলতেই বলেছিল, “ঘরেই আছে,শুয়ে আছে,যাও।” রিন্টু ঘর থেকেই টের পেয়েছিল পিসিমণি এসেছে। পিসিমণির ধারকাছ সহজে মারায় না ও। নেহাত যদি বাবা বাইরে যায় আর পিসিমণির বাড়ি ওকে দিয়ে আসে,তখনি ব্যাজার মুখে বাবার সাথে যায়। পিসিমণি যেন কেমন। কেবল বকে। সবসময় “এটা করবি না,ওটা ধরবি না,এটা ছুঁবি না,হাত ধো,পা ধো,জামা ছাড়...” কেমন ছুঁই ছুঁই করে। পিসিমণি আসতেই মামমামকে বলেছিল, “মামমাম,পিসিমণি...” গৈরিকাও রিন্টুর অপছন্দের ব্যাপারটা জানে। “তাই তো। গলা তো সেরকমই পাচ্ছি।” “বাবা কথা বলুক,তুমি যেও না। থাকো।” নিখিলেশ স্কুল থেকে সবে ফিরেছিল। দিদিভাই-এর আকস্মিক আগমনে অবাক হলেও পরিস্থিতি সামলে দিচ্ছিল ভালো ভাবেই, “দিদিভাই,এসো। সৌমি আয়। ফোন করোনি তো?” “তোর বাড়ি আসতে হলে এখন থেকে ফোন করে আসতে হবে,নাকি?” নিখিলেশ আমতা আমতা করছে শুনে গৈরিকা রিন্টুকে বলেছিল, “দাঁড়া। আমি একটু দেখা করে আসি। নাহলে কি ভাববে বল্তো? কেউ এলে দেখা করতে হয়,” সুখে সৌজন্যের হাসি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল গৈরিকা। কিন্তু ওর চোখের কাঠিন্য নবনীতার নজর এড়ায়নি। কথা না বাড়িয়ে আর্চির খোঁজ করেছিল। নবনীতা জানে গৈরিকাকে ঘাঁটানো যায় না। নবনীতাকে অরিনের ঘরে পাঠিয়ে গৈরিকা নিখিলেশের দিকে নজর করেছিল। মুখটা ছোট হয়ে গেছে ওর। চোর দায়ে ধরা পড়েছে,এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে নিজের দিদিকে চেনে। বেফাঁস কথা বলতে নবনীতার জুড়ি নেই। ভাবছে নবনীতার কোন আলটপকা কথায় গৈরিকা আহত না হয়ে পড়ে। গৈরিকা কথা ঘোরাল, “চা করি।” “তুমি করবে,আমি না হয়...” “না তুমি রিন্টুর কাছে যাও। ও পিসিমণির সাথে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না।”
গৈরিকা চা করছিল। হঠাৎ সৌমীর ডাক শুনে ফিরে তাকাল।
-মামণি...
বলে ডেকে ফেলেই থমকে গেছে মেয়েটা। অভ্যাসের ডাক,ডেকে ফেলেছে। গৈরিকা মিষ্টি করে হাসল। পাঁচ বছর পর দেখল সৌমীকে। তখন ছোট ছিল। বছর সাতেক বয়স। এখন বারো বছরের কিশোরী হয়ে উঠেছে। ভারী মিষ্টি দেখতে হয়েছে ওকে। ছোটবেলায় মামণির ন্যাওটা ছিল খুব। মামাবাড়ি এলেই মামা,দিদান কাউকে পাত্তা না দিয়ে সোজা চলে আসত মামণির ঘরে। মামণি লিখছে দেখলে চুপটি করে বসে অপেক্ষা করত,কখন লেখা শেষ হবে,লেখা শেষ হলেই ভারী মজা। মামণির কাছে গল্প শোনা যাবে। ওর মামা,দিদান কারোর গল্পই ওর রুচত না। মামণির মত ভালো গল্প কেউ বলতে পারে নাকি? গৈরিকা ওকে ভালোবাসত খুব। মামাবাড়িতে এসে ছাড়া পেত মেয়েটা। নাহলে সারাদিন ওর মায়ের শাসনে জেরবার হয়ে যেত। প্রতি পদে খ্যাচখ্যাচ করে ওর মা। বিশেষ করে মেয়েটার সাথে। ওর দাদা পল্লব ভীষণ দুরন্ত। বিচ্ছু যাকে বলে। অথচ তাকে লাই দিয়ে মাথায় তুলে রাখে নবনীতা। নিজেও শাসন করে না,কাউকে করতেও দেয় না। যত শাসন মেয়েটার উপর। এসব পক্ষপাতিত্ব গৈরিকার একেবারে সহ্য হয় না। রিন্টু হওয়ার সময় নিখিলেশ গৈরিকা দুজনেই মেয়ে চেয়েছিল। সৌমীর মত একটা মিষ্টি মেয়ে। শান্ত,বাধ্য,সভ্য। ভীষণ ইনটেলিজেন্ট মেয়েটা। পড়াশুনাতেও খুব ভালো। ঐ ছোট্টবেলাতেই বই পড়তে ভালোবাসতে শিখে গিয়েছিল। গৈরিকা ওর জন্য প্রতি মাসেই বেশ কয়েকটা শিশু কিশোর পত্রিকা নিত। তাছাড়া গৈরিকার বই-এর আলমারিতেও সৌমীর অবাধ অধিকার ছিল। মামণির আলমারি থেকে যে বইটা পছন্দ সেটাই বার করে নিয়ে পড়ত। নিখিলেশ বলত, “সৌমী,এই বই পড়ছিস কেন? এত বড়দের বই।” গৈরিকা নিখিলেশকে থামিয়ে দিত, “বই আবার বড়দের ছোটদের হয় নাকি? সৌমী ছোট হলেও ওর বই পড়ার মনটা বড়দের মত হয়ে গেছে। তাই ওর জন্য কোন মানা নেই।” যে পাত্র যতটা নিতে পারে তাকে ততটা দিতে আপত্তি কোথায়? মামণির মত এমন অবাধ স্বাধীনতা সৌমীকে কেউ কোনদিন দেয়নি। মামাবাড়ি এলে যেতেই চাইত না তাই।
-বল্। কত্ত বড় হয়ে গেছিস? আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এই কি আমার তিতির সোনা? পরে বুঝলাম,হ্যাঁ-এ-ই। চশমার পাওয়ার তো খুব বাড়িয়েছিস্,খুব পড়িস,নাকি?
-আমি তোমাকে মামণি বলে ডাকলাম বলে রাগ করোনি তো?
-রাগ করব কেন? আমিই তো তোর মামণি। অন্য কেউ তো নয়।
-তুমি আমাকে ভুলেই গিয়েছিলে তো। আর্চিকে কত করে জিজ্ঞাসা করতাম ‘মামণি আমার কথা কিছু বলে?’ আর্চি বলত, ‘কই,না তো।’
গৈরিকা বুঝল-সৌমীর অভিমান হয়েছে। ওর মাথায় হাত রাখল। সৌমীকে ও তিতির বলে ডাকে। এটা গৈরিকার একটা অভ্যাস। সবাইকে নিজের দেওয়া নামে ডাকতে পছন্দ করে ও।
-ভুলিনি তিতির। তুই তো আমার মনের মধ্যে ছিলি,সবসময়। ভুলব কি করে? রিন্টু তো ছোট,তাই ওকে বলতাম না,তোর জন্য আমার কতটা কষ্ট হয়,তোকে দেখতে কতটা ইচ্ছা করে।
-ফোন করতে না কেন?
-তুই তো বড় হয়েছিস। বুঝিস না,আমি যদি তোকে ফোন করি,তোর মা ব্যাপারটা নিয়ে কি কান্ডটাই না ঘটাবে?
-ও।
-কি ও?
-কিছু না।
-আচ্ছা,বেশ। আমি সরি। এবার থেকে কোন না কোন একটা উপায় করে তোর সাথে কথা বলে নেব।
-উপায় কেন? তুমি তো এবার থেকে এখানেই থাকবে। আমি রোজ চলে আসব।
গৈরিকা চমকাল। ও এখানে থাকবে,এই কথাটা সৌমী বলল কেন?
-আমি থাকব তোকে কে বলল?
-মা। মা বলছিল বাবাকে,গৈরিকা এবার থাকার জন্যই এসেছে,দেখে নিও। বাবা বলল তাহলে তো তোমার ভাই আর আর্চিরই ভালো,তবে এত ব্যস্ত মানুষ কলকাতা ছেড়ে থাকতে পারবে কি করে? তখন মা বলল ওর তো সব মেজাজমর্জি। নিজেই ছেড়ে গিয়েছিল আবার হয়তো এখন শখ হয়েছে তাই থেকে যাচ্ছে।
গৈরিকা সৌমীর কথা যত শুনছিল ততই অবাক হচ্ছিল। ওকে নিয়ে,ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এত কৌতুহল সবার? ওকে কি ভাবে লোকজন? গৈরিকা কি সব সিদ্ধান্ত মুডের উপর নেয়? এতটাই অবিবেচক,এতটাই হঠকারী নাকি ও? ফিরে আসার সিদ্ধান্ত যা ও প্রায় নিয়েই ফেলেছে-তা তো ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তেই নিয়েছে,নাকি?
-তা শুনে বাবা বলল গৈরিকা যদি ফিরে আসতে চায় তাহলে ও সবদিক ভেবেই ফিরে আসবে। শুনে আমার খুব মজা হয়েছে। তুমি ফিরে এসেছ,তাই না মামণি?
-আমি ফিরলে ভালো লাগবে তোর?
-খুব ভালো লাগবে।
-কেন? তোর মা শেখায়নি,মামণি খারাপ,বাজে...
-সে মা বলুক। আমি তো জানি তুমি সবচেয়ে ভালো। জানো,আমার ক্লাসমেটরা সবাই তোমার লেখা পড়েছে। জাতির গল্পগুলো সব্বাই পড়ে।
-তাই? ক্লাস এইটের সবাই আমার লেখা পড়েছে? আমি তো ছোটদের জন্য লিখি না।
-তাতে কি? সবাই পড়েছে। দাদা দিদিদের কাছ থেকে নিয়ে পড়ে সবাই। ‘রাত জাগা পাখি’ তো আমি হাজারবার পড়েছি। তবে পিয়ালি বলে ‘মোহকুহক’ নাকি আরো ভালো,ওর দিদি রাত জেগে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে। আমি মা’কে বলতেই বকা দিল আমায়। বলল বাজে বই,পড়তে নেই।
গৈরিকা এই একটা ব্যাপারে নবনীতার সাথে ভিন্নমত পোষণ করতে পারল না। ‘মোহকুহক’ পড়ার মত বয়স সৌমীর হয়নি,আজ হঠাৎ মনে হল ওর। অথচ আগে নিজেই তিতিরকে সব বই পড়তে দিত। কিন্তু ‘মোহকুহক’ পড়তে দিতে কোথায় যেন বাধল ওর।
-অল্পবিরাম পড় আগে।
কথা ঘোরাল গৈরিকা।
আছে তোমার কাছে?
-আছে। দেব তোকে।
-জানো,পিয়ালি তোমার খুব বড় ফ্যান। ও কবিতা লেখে। বারবার করে বলে তোমাকে একবার দেখার,তোমার সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছা ওর,আমি শুনি,আর বড্ড খারাপ লাগে। ওকে তো আর বলতে পারি না গৈরিকা সান্যাল আমার মামণি। মা তোমার কথা কাউকে বলতে মানা করে দিয়েছে। তবে আমার একটা গল্প পড়ে পিয়ালি বলেছে লেখার স্টাইলটা গৈরিকা সান্যালের মত নাকি...
-তুই লিখিস?
-হ্যাঁ।
-গল্প?
-হ্যাঁ। কবিতা ভালো লাগে না। মামা যে কিসব কবিতা লেখে...বোঝাই যায় না। তার থেকে গল্প ভালো। তোমার গল্প যেমন। সব বোঝা যায়।
-তোর গল্প পড়াবি আমায়?
-তুমি পড়বে মামণি?
-বাঃ রে! পড়ব না? আমার তো ভাবতেই খুব ভালো লাগছে যে আমার তিতিন আমার মত গল্প লেখে।
-তোমার মত হয় নাকি...
-আমার থেকেও ভালো হয়ে যাবে। লিখে যাবি। কখনো থামবি না। একদিন দেখবি,আমার থেকেও ভালো লিখতে পারছিস।
-ইস! তোমার থেকে ভালো হয় না।
মাথা নেড়ে বলল সৌমী।
-একদিন অস্মিতা বলছিল চিরন্তনী কুণ্ডু নাকি তোমার থেকেও ভালো লেখে। পিয়ালি ওকে যা বলল না...
-ভালো লেখে তো। জাতিতে ধারাবাহিক বেরোয় না হলে?
-ও পড়েছি। শুধু সেক্স আর সেক্স...
বলেই ব্রেক কষল সৌমী। মাথা নীচু করে ফেলল। ছোট থেকে মামণিকে সব বলা অভ্যাস ওর। যেসব কথা কাউকে বলা যায় না,সেটাও মামণিকে বলত। তা বলে এটা...গৈরিকা বুঝল তিতির বড় হয়েছে। সব জানে,সব বোঝে।
-ঠিক বলেছিস। তবে কি জানিস,অস্মিতাদের জন্য চিরন্তনীই হয়তো যথাযথ। ওরা যা চায় যেমনভাবে চায় ও লিখতে পারে,তাই ওর বাজারে এত চাহিদা।
-ছাই চাহিদা। ওর জন্য আমি,পিয়ালি জাতি পড়া ছেড়ে দিয়েছি। বাবাও পড়ে না। কাগজের কাকুকে বলেছে জাতি বন্ধ করে দিতে।
গৈরিকা বুঝল অস্মিতাদের পাশাপাশি সৌমী,পিয়ালিরাও আছে। এখনই এত ভেঙে পড়ার কিছু নেই। সস্তার চটক মাত্র ক’দিন বাজারে থাকে। কালের মানচিত্রে তার স্থান নেই।
গৈরিকা চা ছেঁকে নিল।
-রেজাল্ট কেমন করছিস,তিতির?
-ফার্স্ট হয়েছি এবারও।
-বাঃ। এই ক’দিনে শুধু লম্বাতেই নয়,মনের দিক থেকেও অনেক বড় হয়ে গেছিস দেখছি। তোর সাথে অনেক গল্প আছে। আজ থেকে যা আমার কাছে।
-তুমি মা’কে বলো। আমি বললে থাকতে দেবে না।
-আমি বললেও দেবে না। দাঁড়া,তোর মামাকে দিয়ে বলাচ্ছি। সৌমী গৈরিকাকে জড়িয়ে ধরল। এটা ওর ছোটবেলার অভ্যাস। কেউ বকলে বা খুশির খবর হলে আগে গৈরিকার কাছে ছুটে আসবে আর ওকে জড়িয়ে ধরবে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ কিছু বলবে না। আনন্দ হলে চুপ করে থাকবে আর কষ্ট হলে মামণিকে জড়িয়ে ফোঁপাবে। গৈরিকাকেই খুঁজে নিতে হত কষ্ট আর আনন্দের তফাৎটা। এখনকারটা যে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ তা বুঝতে বাকি রইলো না। এতটা স্বতস্ফুর্তভাবে রিন্টুও গৈরিকাকে কখনো জড়িয়ে ধরতে পারে না। আসলে সৌমী মানুষ গৈরিকাকে চেনে,ওর মামণিকে চেনে-তার রিন্টু জন্ম থেকেই গৈরিকা সান্যালকে দেখে এসেছে। গৈরিকা তিতিরের কপালে চুমু খেল
-খুব খুশি দেখছি...
-হব না? কতদিন পর তোমার সাথে সাথে থাকব বলো তো?
তিতিরের চোখের জল মোছাল গৈরিকা। ওর নিজের চোখও আদ্র ছিল।
-তোর মনে আছে,যেদিন আমার কাছে থাকতিস রাতে তোকে মাঝখানে শুইয়ে আমি আর তোর মামা কত আদর করতাম?
-আমার সব মনে আছে মামণি। তুমি ঘুম পাড়াতে পাড়াতে যা যা গল্প বলেছিলে-সেগুলোও মনে আছে অবিকল। এখন যখন একা ঘুমোতে যাই,ঘুম না এলে তোমার বলা গল্পগুলো ভাবি,তোমার কথা ভাবি। অমনি ঘুম এসে যায়। মা বলে তুমি খুব বাজে,স্বার্থপর-তোমার জন্য মামার এত কষ্ট-আমিও মনে মনে তাই ভাবার চেষ্টা করি...কিন্তু ভাবতে পারি না যে মামণি...শুধু মনে হয় তুমি খারাপ নও। হতে পারো না। নিশ্চয় কোন কারণে গেছ,কোন কাজে গেছ-হয়ে গেলেই চলে আসবে। দাদাকে বলেছিলাম একবার। দাদা বলেছে তুমি অন্য লোকের সাথে লিভ ইন করো। আর তোমার আর মামার মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাই তুমি কখনো আসবে না আর। ও বলে তুমি এখন আর আমাদের কেউ নও। মামণি বলে যেন তোমায় না ডাকি। কিন্তু আমি ওর মত তোমাকে নাম ধরে...
গৈরিকা সৌমিকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে থামাতে চাইল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল ওর। সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা পড়তে,সম্পর্কের মায়ায় জড়িয়ে যেতে বেশ ভালো লাগছিল ওর। নিজের মনেই অবাক হচ্ছিল-ও কি করে এতদিন ভুলে ছিল যে ও কারোর মামণি? কি করে ভুলে থাকতে পারল? মামণি শব্দটা একটা ডাক বৈ তো নয়। কিন্তু সৌমী আর গৈরিকাকে এই ডাকটাই একসূত্রে গেঁথে রেখেছে। পল্লবের মত সৌমীও যদি ওকে নাম ধরে ডাকত,তাহলে ভালো লাগত ওর? না। একেবারেই ভালোলাগত না। কানে বিঁধত ডাকটা। কষ্ট দিত। আবেগের উর্দ্ধে কেউ যেতে পারে না কোনদিন। যে ভাবে গেছে,সে ভ্রমে বাঁচে।
-গৈরিকা কতদিন থাকবে?
নবনীতা নিখিলেশকে প্রশ্নটা করেই ফেলল। গৈরিকা,সৌমি আর অরিন অন্য ঘরে রয়েছে। গল্প গুজবে মেতে রয়েছে ওরা। ভাইবোন নিখিলেশের ঘরে বসে চা খাচ্ছিল।
-জানি না।
-মানে? জিজ্ঞাসা করিস নি?
-না,প্রয়োজনবোধ করিনি।
-সেকি? ও নিজেও কিছু বলেনি?
-না।
-তা এভাবে ক’দিন চলবে? পাড়ায় তো ঢি ঢি পড়ে গেছে। লোকজন রাস্তাঘাটে ধরে আমাকে তোর জামাইবাবুকে প্রশ্ন করছে,আমরা তো অপ্রস্তুত হচ্ছি।
-অপ্রস্তুত হচ্ছ কেন? বলবে গৈরিকা আর্চির শরীর খারাপ বলে এসেছে। ও তো আর্চির মা। ছেলের কাছে আসতে পারে না?
নিখিলেশের ব্যাখ্যাটা নবনীতার মনঃপূত হল না। ও যা জানতে চাইছে,তার উত্তর এটা নয় তবে উত্তর না জেনে ও যাবে না।
-আর্চি তো এখন সুস্থ। তাও রয়ে গেছে যে?
-আর্চি চাইছে। ওর মা-ও চাইছে। আমি তো ওদের চাওয়ার না করতে পারি না।
নিখিলেশ বিরক্তির সুরে আনল গলায়। দিদির এত কৌতুহল ওর ভালো লাগছে না।
-শুধু ওদের চাওয়ায় নাকি তোর চাওয়ায় আছে?
-থাকলে কি তোমার সমাজের আছে জবাবদিহি করতে সুবিধা হবে?
-অবশ্যই। না হলে এভাবে ডিভোর্সের পর এক ছাদের নীচে থাকার কি ব্যাখ্যা দেব?
নিখিলেশের মাথাটা দশ করে জ্বলে উঠল।
-একছাদ কেন? একঘরেও বলতে পারো। আর্চিকে মাঝে নিয়ে একখাটেই শুই আমরা।
নবনীতার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তলে তলে এতদূর? আবার সেই এক ভুল করেছে ওর ভাই। ঢলানি মেয়েমানুষটা আবার কোন জাদু করেছে কে জানে? ক্ষমতা আছে ওর। না হলে পাঁচ বছর পর ফিরে এসেও বরের মন পায় কেউ? তাও পাঁচ বছর যে সতী সাধ্বীর মত ছিল,তা-ও নয় অন্য পুরুষমানুষের সাথে থাকত জেনেও নিখিলেশ ওকে এভাবে মেনে নিচ্ছে?
-বাঃ। খুব ভালো,একবারে শিক্ষা হয়নি তোর,আবার যখন ল্যাং মারবে তখন বুঝবি।
-আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি দিদি। আমার ভালোমন্দ বুঝি। আমার সন্তানের মা আর আমার সন্তান যাতে খুশি থাকে,সেটাই আমার সুখ। সমাজ কি ভাবল না ভাবল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কোনদিন আসেনি। তাই তুই বরং এ ব্যাপারে মাথাটা একটু কম ঘামালে ভালো হয়।
-শাক দিয়ে মাছ ঢাকিস না। বল্ তুই এখনো গৈরিকাকে ভালোবাসিস।
-আমি গৈরিকাকে ভালোবাসি,এটা তো লুকাবার মত কথা নয়। ধ্রুব সত্যিটাকে লুকানো যায়? লাভ কি?
-থাম। তোর মত কবি নই আমি। হেঁয়ালি ভালো লাগে না। শোন, তোর যদি আবার হাঁড়িকাঠে গলা দিতে সাধ হয়,দে। তবে আমাদের লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচবার ব্যবস্থা করে তবে দে।
নিখিলেশ চুপ করে গেল। দিদিকে বোঝানো যাবে না। গৈরিকার এখানে থাকাটা নিয়ে কারোর মুখ বন্ধ করা যাবে না। সমাজ তার স্বাভাবিক নিয়ম মতোই ভাববে। অথচ নিখিলেশের জীবনে এখন যা ঘটছে,তা সরল নয়,সহজ নয়,স্বাভাবিক নয়। এই জটিল হেঁয়ালির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে দিশেহারা নিখিলেশ জানে না-কিভাবে এর সমাধান হবে। ও ভাবছে গৈরিকা এখানে থাকতে চায়,গৈরিকাও হাবেভাবে তা বোঝাতে চাইছে। অথচ মুখে বলছে না। যদি ক’দিন খেয়ালখুশি মিটিয়ে যদি চলে যায় গৈরিকা? সব জল্পনা কল্পনা,সব আশা,সব গণিতকে ব্যর্থ করে চলে যেতেই পারে ও। গেলে সবকিছু আগের মত হয়ে যাবে। বিবর্ণ,ম্যাড়মেড়ে,প্রাণ ছাড়াই শরীর শ্বাস নিতে থাকবে,কর্তব্যবশত। কিন্তু যদি রয়ে যায় গৈরিকা,মুখ ফুটে যদি বলে থাকবে-তাহলে ওকে কি জবাব দেবে নিখিলেশ? নিষ্ঠুর অপমানে প্রত্যাখ্যানের জ্বালা জুড়িয়ে নিতে পারবে না। ও তেমন মানুষ নয়। যাকে ভালোবাসে তার চাওয়াটাকেই নিজের চাওয়া ভেবে এসেছে চিরদিন,তাছাড়া গৈরিকা ফিরে এলে তাতে আর্চিরও ভালো। একথা অস্বীকার করবে কি করে? ওর চাওয়াতেই সম্মত হবে নিখিলেশ,আগের বারের মত এবারও হবে। নিজে হাতে ভেঙেছিল গৈরিকা,আবার নিজের হাতেই জুড়তে চাইছে। পারবে কি? ভয় হয় নিখিলেশের। ভাঙা আয়না জুড়লে জোড়ে বটে-তবে দাগ থেকে যায়। দাগটা কিভাবে মুছবে গৈরিকা? নিখিলেশ দেখতে চায়। খুব করেই দেখতে চায়। শিঞ্জিনীর মা সদর দরজা প্রায় ঠেলেই ঢুকে পড়লেন। শিঞ্জিনী পিছনে ছিল
-মা,প্লিজ বাড়ি চলো।
-বাড়ি চলো মানে? তোর সাথে যে অন্যায় হল তার বিহিত না করে কোথাও যাব না আমি।
--মা,তোমার দুটি পায়ে পড়ি,বাড়ি চলো।
নিখিলেশ অবাক হচ্ছিল। ভদ্রমহিলা এত চেঁচাচ্ছেন কেন? কি হল? পাড়ার সব লোক শুনতে পাচ্ছে,দু-চারজন জানলা খুলে মুখ বাড়িয়ে দেখছে।
-দেখুন,আপনি এত চেঁচাবেন না। শান্ত হোন। কি হয়েছে?
-আমার মেয়েটার কি হাল করেছ? তাকিয়ে দেখ,একবার। সারাদিন কাঁদছে। একদানা খাবারও মুখে তুলছে না। এভাবে তো মরে যাবে। তুমি তাই চাও,তাই তো?
-আমি বুঝতে পারছি না,আপনি এসব কথা আমায় কেন বলছেন?
-ন্যাকা সাজা,ন্যাকা সাজা না? আমার মেয়েটাকে দিয়ে এই ক’বছর আয়ার মত ছেলে মানুষ করিয়ে নিয়ে,ওকে আশা দিয়ে,ভালোবাসার কথা বলে,যেই ঐ নষ্ট মেয়েমানুষটা এল অমনি চোখ উল্টে দিলে? আর্চিকে পড়াতে আসতেও দেয় না। শিঞ্জিনীকে মানা করার ও কে? ছেলেটাকে হাতে করে কে মানুষ করল এতদিন?
শিঞ্জিনীর মায়ের চিৎকারে নবনীতা উঠানে এসে দাঁড়িয়েছিল। বেশ মজা পাচ্ছিল ও। গৈরিকাও নিশ্চয় শুনতে পাচ্ছে সব। ঠিকই তো। মেয়েটা আর্চির জন্য খুব করেছে। নিখিলেশের উপর যে ওর টান আছে,এটা নবনীতা টের পেত। নিখিলেশও যে ভালোবাসার কথা বলেছে,আশা দিয়েছে এটা জানা ছিল না।
-দেখুন,আমি কখনোই ওকে ভালোবাসি বলিনি। কোনও আশাও দিইনি।
নিখিলেশ রাগের মাথায় কথাটা বলে ফেলেই থমকে গেল। শিঞ্জিনীর চোখে পড়তেই কুঁকড়ে গেল ও। মেয়েটার চোখেও স্পষ্ট ঘেন্না দেখল। অভিমান নয়,রাগ নয়-সুস্পষ্ট ঘেন্না। ঐ রাত,ঐ রাতটার কথা ভেবেই ও ঘেন্না করছে নিখিলেশকে,অথচ যা ঘটেছিল তা তো একটা ভুল। নেশার ঘোরে ওকে গৈরিকা ভেবেই ভুলটা করে ফেলেছে নিখিলেশ। তার জের সারাজীবন বয়ে যেতে হবে নাকি?
-ও,তাই? আমার মেয়ে সময়ে অসময়ে তোমার বাড়ি আসত,তোমার জন্য রান্নাবান্না করত,ছেলে থাকতেও আসত,না থাকতেও আসত,সেই সুযোগে ফষ্টিনষ্টি করে নিয়ে এখন হাত ধুয়ে ফেলছ। নিশ্চয় কিছু হয়েছে তোমাদের মধ্যে। না হলে মেয়েটা আমার...
-মা,চুপ করো তুমি। দোহাই তোমার। তুমি চলো।
নিখিলেশের পায়ের তলার মাটি কাঁপছিল। পাড়ার লোকে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে মজা লুটছে। শিঞ্জিনী,শিঞ্জিনী কিছু বলে ফেলবে না তো? যদি মুখ ফস্কে বলে ফেলে? গৈরিকার কানে এসব নোংরা কথা যাচ্ছে নিশ্চয়। ওর মনটা বিষিয়ে যাচ্ছে না তো? ও কি বুঝবে নিখিলেশকে,নাকি বরাবরের মত ভুল বুঝবে?
-আপনি চলে যান,এই মুহূর্তে আপনার মেয়েকে নিয়ে চলে যান।
-যাব না। এর একটা বিহিত না করে যাব না কিছুতেই।
নিখিলেশ কিছু বলতে যাচ্ছিল,হঠাৎ গৈরিকার গলা পেয়ে থেমে গেল।
-বলুন,কি চান?
ওর একটা কথাতেই ঘটনাস্থলে বাজ পড়ল যেন। সব ফিসফাস,সব গুঞ্জন বন্ধ হয়ে গেল। সবাই এক দৃষ্টে দেখছিল গৈরিকাকে। হাঁ করে দেখছিল।
-বলতে পারছেন না। আমি বলছি। আপনার মত চিপ লোয়ার মিডলক্লাস মায়েদের মানসিকতা জানি আমি। মেয়ে ভাঙিয়ে খান আপনারা তাই তো? আপনারা এত নির্লজ্জ যে নিজের মেয়েকে বড় ঘরে দেওয়ার জন্য একজন ভদ্রলোকের নামে মিথ্যা অপবাদ দিতে এক মুহূর্তও ভাবেন না। এটা আপনাদের মনে থাকে না এতে আপনার মেয়েরও বদনাম হচ্ছে।
-কি বলছ,কি বলছটা কি তুমি?
-যা বলছি,ঠিক বলছি। ভুল জায়গায় ছিপ ফেলেছেন। এখানে ডাল গলবে না। আপনার মেয়ে রিন্টুকে ভালোবাসে,আমার ছেলের জন্য অনেক কিছু করেছে,এই কৃতজ্ঞতাবশত আমি আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিচ্ছি না। না হলে নিখিলেশের নামে এই অপবাদ দেওয়ার কারণে আপনাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দিতাম।
-ও। তাই? দেখি কেমন দিতে পার। কোথায় ছিলে এতদিন? আজ হঠাৎ এসে দরদ দেখাচ্ছ যে?
নিখিলেশ অবাক হয়ে গৈরিকাকে দেখছিল। সবার সামনে এসে গৈরিকা এভাবে নিখিলেশকে সমর্থন করছে,এটার পরে কি বলার অপেক্ষা থাকে যে গৈরিকা নিখিলেশকে আজও ভালোবাসে,বিশ্বাস করে? করে,করে নিশ্চয় করে। নিখিলেশ যে অন্য কোন মেয়ের সাথে শারীরিক হতে পারে না,তাকে ভালোবাসতে পারে না,আশা দিতে পারে না-এটা গৈরিকার স্থির বিশ্বাস। অথচ গৈ্রিকার এই বিশ্বাসের মর্যাদা কি রেখেছে নিখিলেশ? রাখেনি। একটা পদস্খলন হয়ে গেছে ওর। ওর আত্মায় সেই পদস্খলনের ছাপ পড়ে গেছে। এই ছাপ কিভাবে মোছা যাবে?
-আমি কোথায় ছিলাম তার কৈফিয়ত আপনাকে দেব না। জেনে রাখুন,এখানে যা কিছু সব আমার। ছেলেটা আমার,সংসারটা আমার। আপনার মেয়ে হয়তো ভুল করে একটা স্বপ্ন দেখে ফেলেছে। ওকে বোঝান,স্বপ্ন,স্বপ্নই হয়। নিজের যোগ্যতার অতিরিক্ত কোন কিছুর আশা করা মুর্খামি। নিখিল ঘরে চলো।
শিঞ্জিনীর মায়ের চোখে অসহায়তা ছায়া ফেলল। যার সংসার সেই যখন ফিরে এসেছে,তাহলে বাকি সব কিছুই অনর্থক। তবুও ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন
-অন্যায়। খুব বড় অন্যায় হল। তোমরা এর ফল ভোগ করবে। সুখ পাবে না। একদিনের জন্যও পাবে না। কারোর চোখের জল ফেলে কেউ সুখী হতে পারে না।
-মা চলো। আমি আগেই বলেছিলাম এখানে এসো না। এখানে মানুষ থাকে না।
নিখিলেশ চোখ নামাল। শিঞ্জিনীর সাথে অন্যায় হল। গুরুতর অন্যায় হল। ওর বিবেক ওকে সারাজীবন এ নিয়ে দংশাবে। অথচ নিখিলেশের কিছু করার নেই।
সারা সন্ধ্যা গৈরিকা আর নিখিলেশের কোন বাক্যালাপ হয়নি। রাতে খাওয়ার সময়ও নিখিলেশ নিজের ঘরে খাবার নিয়ে গিয়ে খেয়েছে। চুপ করে গেছে ও। থম মেরে গেছে। হবে না-ই বা কেন? চরিত্রের উপর এত গুরুতর কলঙ্কের দাগ পড়লে খারাপ লাগে। শিঞ্জিনী মেয়েটাকে বিশ্বাস করে ওর আর্চির দেখভালের দায়িত্ব সঁপেছিল নিখিলেশ। তার মনে যে এই ছিল কি করে জানবে। নিখিলেশ বড্ড সরল। সবাইকে চট করে বিশ্বাস করে ফেলে। গৈরিকা প্রথমদিনই মেয়েটার হাবেভাবে ওর মনের কথাটা আঁচ করে ফেলেছিল। ভেবেছিল ও নিখিলেশকে ভালোবাসে। বাসতেই পারে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে। তা বলে এভাবে অপবাদ দেবে? এটা ভালোবাসা নয়। অবসেশন মাত্র। নিখিলেশ স্বল্পবাক। মনের কষ্ট মনেই চেপে রাখে। নিজের ঘর মনোকষ্টে গুমরে মরছে। হয়তো এই ভেবেও মরমে মরছে যে গৈরিকা হয়ত ওকে ভুল বুঝছে। তা কি করে বুঝবে গৈরিকা? ও তো নিখিলেশকে চেনে। নিখিলেশ অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে না। যতই এড়িয়ে চলুক,অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলুক-ওর চোখেমুখে ভালোবাসা নামক তীব্র আবেগটাকে পড়তে পারে গৈরিকা। অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে থাকে। ওর অভিমান আজ নিজে থেকে ভাঙাবে গৈ্রিকা। রিন্টু ঘুমিয়ে পড়েছে। এখনই নিখিলেশের সাথে কথা বলার উপযুক্ত সময়,
-কাজ করছ?
গৈরিকার কথা শুনে তাকাল নিখিলেশ। ওর চোখে কষ্ট দেখতে পেল গৈরিকা। খুব আহত হয়েছে ও।
-না। বসো।
-কি লিখলে?
-লিখতে চাইছি,লেখা আসছে না।
-না হওয়া লেখাটাই শোনাও।
-শুনবে?
নিখিলেশ গৈরিকার চোখে চোখ রাখল,গৈরিকা বসল।
-শুনতেই তো চাই।
-শব্দ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারি ভাবতাম। ভাবতাম এটাই মুন্সীয়ানা আমার যে যা চাই যেমনভাবে চাই লিখতে পারি। অথচ মনের কথাটা স্পষ্ট করে লিখতে পারছি না। যতবার লিখছি,ততবার মনে হচ্ছে হয়নি,কিছু বাদ থেকে গেল।
গৈরিকা নিখিলেশের লেখার টেবিল থেকে কাগজটা নিল। কাটাকুটিতে ভরা। লিখেছে,কেটেছে,যে লাইনগুলো পড়া যাচ্ছে তা পরে গৈরিকার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটল-“শিউলি ছিল,আমার উঠানে শিউলি ছিল অনেক/কুড়িয়ে নিয়ে ভরিয়ে দেব এমন কোঁচড় ছিল না/বাড়ি ছিল,আমি ছিলাম,আনুসাঙ্গিক সব ছিল/ঘর-আমার ঘর কোথাও ছিল না/রোজ ভোরে ফুটেছি আমি,তোমার অপেক্ষায়/শিউলি হয়ে ফুটে ঝরেও গেছি নিরন্তর/অঞ্জলি হতে,অর্ঘ হতে,নিবেদিত হতে চেয়েছি/সরস্বতী আমার ঘরের লক্ষ্মী হয়ে ছিল না...”
-শিউলির কথা মনে পড়ে তোমার?
-এখনো শিউলি ফোটে,রোজই ফোটে...
-কোঁচড় থাকলেও তাতে শিউলি ভরে দাও না কেন?
-ভরতে গেলে অধিকার লাগে,জোর লাগে...আমার সে জোর নেই। যোগ্যতাও নেই,
-আমি যদি বলি আছে-তা হলেও দেবে না?
-কিসের যোগ্যতা আমার?
-ভালোবাসা। এটাই কি যথেষ্ট যোগ্যতা নয়? তোমার মত করে কে ভালোবাসবে আমায়? কেউ বেসেছে কখনো? সব মিথ্যা,সব খেলা,সব ছলনা...যা মিথ্যা তা যখন মুছেই গেছে,তাহলে সত্যিটা ফিরে পেতে চাই। তুমি দেবে তো নিখিল?
গৈরিকার চোখে জল দেখল নিখিলেশ। ও ফিরতে চায়। ভালোবাসার কাছে ফিরতে চায়। যে ভালোবাসা পবিত্র,নির্মল,অকলুষ-তাকে ফিরে পেতে চায় গৈরিকা। অথচ নিখিলেশ তো সেই ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছে।
-আমি দেওয়ার কে? আমার যা আছে-সবই তো তোমার। নিয়ে নাও। তোমার যা নেওয়ার আছে,নিয়ে নাও।
নিখিলেশ গৈরিকার হাত ধরল। গৈরিকা ওর হাতে চাপ দিল
-দেবে আমায়? আমি যে তোমায় এত কষ্ট দিয়েছি,এত যন্ত্রণা দিয়েছি...
-ভালোবেসে যে যন্ত্রণা পাওয়া যায়,তার মধ্যেও একটা সুখ আছে।
-যন্ত্রণার কথা আজ থাক নিখিল। আজ ভালোবাসার কথাটাই না হয় বলা হোক।
-বলার কি কিছু বাকি আছে? তুমি আমায় ভালোবাসো,আমি জানি তো।
জানো? তাহলে বলো না কেন? আমার খেয়ালখুশি ভাবো,না? আজ ভালোবাসি,কাল নাও তো বাসতে পারি...এই ভাবো আর সবার মত?
-ভালোবাসা আবার খেয়ালখুশি হয় নাকি?
-হয় তো,তোমার দিদিই বলেছে,এটা নাকি আমার শখ।
-তোমায় কে বলল?
-তিতির।
-দিদির কথা ছাড়ো। ও এমনই।
-তিতিরকে আজ থাকতে দিল না,দেখলে? পড়া আছে বাহানা দিয়ে নিয়ে চলে গেল।
-তোমার খুব মন খারাপ হয়েছে এই জন্য,তাই না? হবে না? কত করে মেয়েটা আব্দার করল...
নিখিলেশের বুকে মাথা রাখল গৈরিকা। নিখিলেশকে জড়িয়ে ধরল।
-বেশ তো। ওর কোনদিন টিউশন থাকে না জেনে আমি ওকে নিয়ে আসব। তোমার কাছে থাকবে।
-কবে আনবে?
নিখিলেশ গৈরিকার মাথায় চুমু খেল।
-আনব। যত তাড়াতাড়ি পারি।
-জানো,প্রতিবিম্ব ফোন করেছিল। ওদের দেশভাগের উপন্যাসটা দেব ঠিক করেছি।
-ভালো করেছ।
-লেখাটা দিতে কলকাতা যেতে হবে। কবে যাব বলো তো,কাল না পরশু?
-তোমার রিন্টুকে বলে দেখো। ও যেদিন বলবে সেদিনই যেও।
গৈরিকা হেসে ফেলল।
-ঠিক বলেছ। ওর অনুমতিটাই সবচেয়ে জরুরী। আমি যাবো,লেখাটা দেব,আর চলে আসব। শান্তির কথা বলছিলাম না নিখিল? আমার সবটুকু শান্তি রিন্টুর মধ্যেই আছে। ওকে ছাড়া থাকতে পারব না আমি। শোনো না,সামনেই তো অ্যানুয়াল...পরের ক্লাসে ওকে কলকাতায় ভর্তি করব,কেমন?
-তুমি যা ভালো বুঝবে,করবে।
-কলকাতায় থাকাটা দরকার,বুঝলে। তোমার কেরিয়ারের জন্যও খুব দরকার।
-আমাকেও নেবে?
-মানে? এখানে একা পড়ে থাকবে নাকি? ওরকম করলে আমি এখানে এসে থাকব। কলকাতায় যাব না।
-বাঃ রে! তোমার কলেজ রয়েছে,সাহিত্যসভা রয়েছে,চ্যানেলে যাওয়া রয়েছে,বইমেলা রয়েছে,কত অনুষ্ঠান রয়েছে...তোমাকে তো কলকাতাকেই থাকতে হবে।
-তাই তো বলছি,তোমাকেও কলকাতাতেই থাকতে হবে।
-আমার স্কুল?
-ট্রান্সফার করিয়ে নেব।
-সুপারিশ?
-না। জোর।
-তোমার জোরের সামনে জোর খাটাতে যাইনি কোনদিন। আর যাবোও না। গৈরিকা খুশি হল। নিখিলেশকে চুমুয় ভরিয়ে দিল হঠাৎ। গৈরিকা ভীষণ খুশি হলে এভাবে প্রকাশ করে। নিখিলেশ টের পাচ্ছিল ওর শরীর জাগছে।
-গৈরিকা...
-কি?
-এত আদর?
-কেন,তোমার ভালো লাগছে না? প্যাসিভ হয়ে রয়েছ কেন? তুমি চাও না...
নিখিলেশ চায়। খুব করেই গৈরিকাকে পেতে চায়। অথচ পারছে না। একটা সত্যি জানান উচিৎ ওকে। মিথ্যার ভিত্তিতে কিছু হয় না।
-চাই,খুব করেই চাই।
-তাহলে? এসো।
-প্লিজ গৈরিকা। একটা কথা বলার ছিল আমার।
-ওঃ হো! তুমি আর তোমার নিতিবোধ। কি বলবে জানি। আমরা এখন লিগ্যালি ডাইভোর্সড,স্বামী-স্ত্রী নই আর... এসব বোকা বোকা কথা বাদ দাও। স্বামী-স্ত্রী হতে দুটো সই লাগে। করে নেওয়া যাবে আবার।
-কথাটা না বললে আমার মনে একটা ভার থেকে যাবে যে।
গৈরিকা ছেলেমানুষি থামাল। নিখিলেশের গলার স্বর এত ভারী কেন?
-বলো।
নিখিলেশ চশমা খুলল। চোখ মুছল।
-আমি একটা ভুল করে ফেলেছি গৈরিকা।
-ভুল মানে?
-যে ভালোবাসার যোগ্যতা আমার আছে বলে তুমি মানো,তা হয়তো হারিয়ে ফেলেছি আমি। অথচ আমি তোমায় ভালোবাসি,শুধু তোমাকেই ভালোবাসি,খুব করে ভালোবাসি।
গৈরিকার কান গরম হয়ে উঠছিল। ও আন্দাজ করতে পারছে নিখিলেশের কথার মোড় কোনদিকে যাচ্ছে। কিন্তু নিজে কানে শুনতে চায়।
-জানি তো আমায় ভালোবাসো। তাহলে কিন্তু কিসের?
-বিশ্বাস...তোমার বিশ্বাস রাখতে পারিনি। আমি সজ্ঞানে এসব করিনি। নেশা করেছিলাম। আকণ্ঠ রাম খেয়েছিলাম। এই সেদিন...যেদিন আর্চিকে তোমার বাড়ি দিয়ে এলাম...
গৈরিকার চোখ দিয়ে জল ঝরছিল। নিখিলেশেরও। চোখের জলের মধ্যে দিয়ে ওরা একে অপরকে দেখতে পাচ্ছিল,আবার দেখতে পাচ্ছিল না। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল। এক হাতের দূরত্বকে কয়েকশ মাইলের ব্যবধান মনে হচ্ছিল।
-শিঞ্জিনী?
শব্দটা উচ্চারণ করতে হৃদয় ছিঁড়ে রক্তপাত হল। উত্তরটা না বাচক হোক মনে প্রাণে চাইল গৈরিকা। ঐ মেয়েটার কাছে হারতে চায় না ও। কোন মূল্যেই চায় না। অন্য কোথাও,অন্য কারোর সাথে যাক না নিখিলেশ। যেতেই পারে। মানুষ তো। শরীর বলেও তো একটা জিনিস আছে,তার চাওয়া-পাওয়া আছে। উত্তরটা হাড়কাটাগলি হলেও হোক-কিন্তু শিঞ্জিনী যেন না হয়। নিখিলেশের নুয়ে পড়া মাথাটা একবার নড়ে উঠল। হ্যাঁ বাচক ভঙ্গিতে,গৈরিকার মনে হল কোথাও কিছু যেন ভেঙ্গে গেল। ভাঙ্গার শব্দটা কানে বাজলেও কি ভাঙ্গল খুঁজে পেল না ও।
-ও এভাবে কাছে এল,এমন ভাবে দাবি জানাল...
গৈরিকার ফোঁপানোর শব্দে চমকে উঠল নিখিলেশ। ফুলে ফুলে কাঁদছে ও। এভাবে কাঁদতে কাঁদতে ওকে কখনো দেখেনি। নিখিলেশ। ও তো কারোর সামনে কাঁদে না। নিজের যন্ত্রণা বন্ধ দরজার ওপারে লুকিয়ে রাখে। তবে কি নিখিলেশের দেওয়া যন্ত্রণাটা এতই তীব্র যে গৈরিকার লুকাবার সীমা অতিক্রম করে গেছে?
-আমি বুঝতে পারিনি গৈরিকা। বিশ্বাস করো...আমি বুঝতে পারিনি। নেশার ঘোরে ছিলাম। ভ্রম হয়েছিল আমার। ভেবেছিলাম তুমি...তুমিই এসেছ।
গৈরিকা কেঁদেই চলেছিল। নিখিলেশ আঁকড়ে ধরল ওকে। বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল।
-অথচ আমি ওকে ভালোবাসি না,কোন আশা দিই নি...তবুও কেন যে এমন পদস্খলন হল আমার?
গৈরিকা নিখিলেশের বুকের ভিতর কতক্ষণ কাঁদল ও নিজেও জানে না। নিখিলেশেও চুপ করে ছিল। কাঁদতে দিচ্ছিল ওকে। আজ ও ভারমুক্ত। মনের মধ্যেকার বোঝাটা নেমে গেছে। গৈরিকাকে সত্যিটা লুকিয়ে ঠকাতে চায়নি নিখিলেশ,ঠকাতে চায়নি কোনমতেই। বুকের ভেতরের ভাঙন তাণ্ডব থামিয়ে নদী যখন শান্ত হল গৈরিকা নিখিলেশকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসল।
-পদস্খলন মানে সবটুকুই...?
গৈরিকা নিজের মনের কোণে থাকা ক্ষীণতম আশার প্রদীপটার সলতে পাকাতে চাইল। নিখিলেশ। নিখিলেশের মৌনতা দমকা হাওয়া হয়ে তার শ্বাসও রোধ করে দিল। আর একটা কথাও বলল না গৈরিকা। খাটে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে কাঁদতে থাকল। নিখিলেশ ওর চোখের জল মোছাবার সাহস পেল না। উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল নিখিলেশ। বালিশে মুখ গোঁজার বদলে গৈরিকার কোলে মুখ গুঁজল। হু-হু শিউলি কান্নায় গৈরিকার কোঁচড় ভরে যাচ্ছিল। অথচ এ শিউলি গৈরিকা চায়নি,এ শিউলি গৈরিকা চায় না।
(পর্ব-১৮)
অনিমেষ বসুর কেবিনে চিরন্তনী কুণ্ডু আর অশ্বত্থমা মিত্র বসেছিলেন। চিরন্তনীর প্রকাশিতব্য উপন্যাস নিয়ে কথা চলছিল। জাতির ধারাবাহিক উপন্যাসটাই বই আকারে বেরোচ্ছে এবার বইমেলায়। খুব বিকোবে,অনিমেষ আশা রাখেন। অশ্বত্থমা মিত্রর উপন্যাসটাও বেশ ভালো বিক্রি হচ্ছে। বহুবছর পর উচ্ছ্বাসের জন্য লিখলেন বলেই এত চাহিদা বইটার।
-কভারটা আর একবার দেখে নিও চিরন্তনী।
-ইয়েস আঙ্কল। তবে আপনার পছন্দ মানেই আমার পছন্দ।
-দ্যাটস্ গুড। তুমি বুদ্ধিমতী। অশ্বত্থমাবাবুর কাছে শুনে দেখো উচ্ছ্বাসে লেখা আর না লেখার তফাৎ কেমন। উনি গত পাঁচবছরে সেটা বুঝেছেন।
-বুঝেছি মানে? হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। ওরা বই করে নাকি? ছ্যা! বই করার জন্য শুধুই ব্যবসা বুঝলে হয় না,কাজটাও জানতে হয়। উচ্ছ্বাসের বই হাতে নিলেই পড়তে ইচ্ছা করে। যেমন কাগজ,তেমন ছাপা,তেমন বাঁধাই আর নয়নাভিরাম প্রচ্ছদ। এই উপন্যাসটাই যদি অন্যদের দিতাম,এত বিকোত?
অনিমেষ মনে মনে হাসলেন। এতদিনে পথে এসেছে। চিরন্তনী বড় করে ঘাড় নাড়ল।
-তা তো বটেই। আর পাবলিসিটি,অ্যাড-সেটাও ম্যাটার করে।
-একদম। ডোন্ট ওরি। তোমার বইয়ের বিজ্ঞাপন সর্বশক্তি দিয়ে করব এবার। তুমি যখন আমার সব শর্ত মানছ,তখন আমিও দেখব যাতে তোমার বইটাই বেস্টসেলার হয়।
চিরন্তনী ক’দিন আগেই একটা চুক্তিপত্রে সই করেছে। বছরে পাঁচলাখ টাকার চুক্তি। উচ্ছ্বাসের বাইরে কোথাও লেখা দেওয়া যাবে না,এই মর্মে ওকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছেন আঙ্কল। চিরন্তনীর আর অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। উচ্ছ্বাস ওকে আজ এখানে এনেছে। উচ্ছ্বাসের ছায়ার থেকে যাবে ও। সারাজীবন সুখে থাকতে ওকে ভুতে কিলোয়নি যে অশ্বত্থমা মিত্রর মত ব্যান খেয়ে দরজায় দরজায় ঘুরবে।
-আসলে জানো তো,তোমাদের মত নতুন লেখকদের সুযোগ দিয়ে আমরাই জনপ্রিয় করি। দু’চারটে বই সফল হয়ে গেলে অনেকে ধরাকে সড়া জ্ঞান করে। গুমর বেড়ে যায়। তাদের তখন খুঁটে খেতে দিতে হয়। ক’দিন বাইরে চড়ে এসে আবার ঘরের পাখি ঘরে ফিরে আসে।
অশ্বত্থমা অস্বস্তিতে পড়লেন। এসব কথা ওনার গায়ে লাগছে। অথচ কিছু বলার জো নেই,এই সবে মিটমাট হয়েছে। মুখ খুলে বিপদ বাড়াতে চাননা। কথা ঘোরালেন।
-ইন্দ্রনীলকে দেখছি না?
-ও তো কাল স্টেটসে গেল।
-হঠাৎ?
-আমিই পাঠালাম। ব্যক্তিগত কারণে একটু ডিস্টাবর্ড ছিল। আমিই বললাম ঘুরে আয়,ভালো লাগবে। নাহলে বইমেলার মুখে যেত না।
-ব্যক্তিগত কারণ মানে গৈরিকা?
সতর্ক প্রশ্ন করল অশবত্থমা।
-তাছাড়া আবার কি? আসলে ইন্দ্রনীলেরই ভুল। অপাত্রে কিছু দিতে নেই। সে নিতে পারে না।
-গৈরিকাদি এখন রাণাঘাটে না? কানাঘুষো শুনছিলাম যেন?
চিরন্তনী কৌতূহল দেখাল।
-হ্যাঁ। আসলে নিখিলেশের সাথে তলে তলে যোগাযোগ বরাবরই ছিল।
-তাই? আমাকে যে বলেছিল ইন্দ্রনীলদার সাথে খুব শিগগির বিয়ে করবে?
-বিয়ে? না,না,ওর সেরকম কোন ইচ্ছাই ছিল না। ইন্দ্রনীলের সাথে ভালোবাসার নাটক করছিল। ভালোবাসলে কখনো ইন্দ্রনীল ছোট হয় এমন কাজ করে?
অশ্বত্থমা দেখলেন এই সুযোগ। পুরনো ঝালটা মেটানো যাক।
-আসলে গৈরিকা আপনাদের ব্যবহার করছিল মাত্র।
-ঠিক বলেছেন। ব্যবহারটাই সঠিক শব্দ। না হলে প্রতিবিম্বকে উপন্যাস দেয়? ইন্দ্রনীলদা মানা করেছিল অনেক করে।
-কোন মানাই তো শুনল না। মিটিং-এ ডাকলাম,এল না। কন্ট্র্যাকট এর কথা বললাম,এত ঔদ্ধত্য-বলল,লাগবে না।
অনিমেষ হতাশায় ভেঙে পড়ার মত মুখভঙ্গি করলেন।
-তবে একদিক থেকে ভালো হয়েছে,ইন্দ্রনীল গৈরিকার আসল রূপটা চিনতে পারবে। ও বিচক্ষণ ছেলে। ক’দিনের ব্রেকেই আবার মাথা ঠাণ্ডা করে কাজে লেগে যেতে পারবে।
অশ্বত্থমার কথায় ঘাড় নাড়লেন অনিমেষ।
-তবে কি জানেন তো...ভালোবাসত তো...কষ্টটা থেকেই যাবে।
-বিয়ে দিয়ে দিন।
-গোপালবাবুও তাই বলছিলেন। দেখি ছেলে কি বলে।
-কি আর বলবে? আর মেয়ের অভাব নেই তো। আপনি শুধু বলে দেখুন।
অনিমেষের নজরে মেয়ে আছে। টেবিলের ওপারেই বসে আছে। স্মার্ট,সুন্দরী,বুদ্ধিমতী,বিচক্ষণ বসু পরিবারের বৌ হিসাবে ওকে মানাবে।
-তাহলে কি এবার বইমেলায় গৈরিকা সান্যালের কোন উপন্যাস থাকবে না উচ্ছ্বাস থেকে?
চিরন্তনী জানতে চাইল। না থাকাটা খুব জরুরী। না হলে ওর পথের কাঁটা সরবে কি করে?
-না। ও তো কোন উপন্যাস দেয়নি আমাদের। থাকবে কি করে?
-পাঠক কিন্তু হতাশ হবে।
-সে একবছর হবে। পরের বার থেকে আর হবে না। গৈরিকার স্থানটা তো আর ফাঁকা থাকবে না,ভরে যাবে।
দৃঢ় প্রত্যয়ে বললেন অনিমেষ।
-ওর কথা বাদ দাও। চিরন্তনী,তুমি ক’দিনের জন্য প্যারিস যাবে?
-আমি? এখন?
-কেন নয়? লেখা তো শেষে। বইমেলা উদ্বোধনের কাজও তেমন নেই। আসলে ওখানে একটা কনফারেন্স ছিল। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করেছে। আধুনিক গদ্যের রূপরেখা নিয়ে। উচ্ছ্বাস থেকে একজনকে চেয়েছে। গৈরিকাকে বলতাম,কিন্তু এখন তো সে আর উচ্ছ্বাসের নয়...তাই তুমিই যাও।
-ওকে আঙ্কল।
চিরন্তনীর চোখে মুখে খুশি চকচক করছিল। আধুনিক গদ্যের রূপরেখা নিয়ে বলতে ও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। এ যে স্বপ্নের মত। তবুও বাস্তব,খুব বেশি করেই বাস্তব।
-পারবে তো?
-আপনার ব্লেসিং থাকলে নিশ্চয় পারব।
চিরন্তনী কলকাতার মেয়ে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে। কথার মধ্যে প্রচুর ইংরাজী শব্দের ব্যবহার করে তাই। তবে কোথায় কোন কথা বলতে হয়,জানে,পারবে ও নিশ্চয় পারবে।
উচ্ছ্বাসের অফিসে পৌঁছে গৈরিকার খেয়াল হল,এটা উচ্ছ্বাসের অফিস। অথচ ও তো এখানে আসতে চায়নি। প্রতিবিম্বে যেতে চেয়েছিল। কি করে চলে এল এখানে? কি করে? কাল রাত থেকে মাথাটা হ্যাং হয়ে আছে। কোন কাজ করছে না-ভাবনাচিন্তাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে যেন। শুধু মনে আছে নিখিলেশ ওর কোলে মুখ গুঁজে সারারাত কেঁদেছে। ভোরবেলা উঠে পড়েছিল গৈরিকা। আর নিতে পারছিল না ও। বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার কথাটা বড্ড মনে বাজছিল। ঐ মেয়েটাকে গৈরিকা ভেবেই নাকি এসব করে ফেলেছে নিখিলেশ। ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছিল গৈরিকার। মিথ্যা ও সহ্য করতে পারে না। মিথ্যা শুনলেই বমি পায় যেন। ঐ মেয়েটার সাথে কখনো গৈরিকাকে গুলিয়ে ফেলা যায়? কেন মিথ্যা বলল নিখিলেশ? বলতেই পারত শিঞ্জিনীকে ভালো লাগে তাই এসব করেছিল। কথাটায় যুক্তি থাকত,সততা থাকত। তা না নেশার ঘোর,বিভ্রান্তি-এসব অবান্তর কথার অর্থ কি? রিন্টুকে স্কুলে পাঠিয়েছে আজ। কয়েকটা প্রয়োজনীয় কাজ মিটিয়ে তবেই কলকাতা এসেছে ও। ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। উপন্যাসটার পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রতিবিম্বে যাবে ভেবেছিল-অথচ এখানে চলে এল। কেন? এটা তো ওর ঠিকানা নয়। এ আশ্রয়ের শিকড় তো নিজে হাতেই উপড়ে ফেলেছে। তবুও কেন এল এখানে? অবচেতনে কি নীলের কথা মনে পড়েছে? নীলকে সব বললে কি বুঝবে...নীলকে ফোন করা যাক। এইভেবে ফোন বার করল গৈরিকা। সুইচড অফ! সেকি! মিটিং-এ আছে,নাকি? নীল ভুল বুঝছে গৈরিকাকে। ভুল বোঝাবুঝিটা অন্তত মিটে যাওয়া দরকার। শুধু আঙ্কলের দৃষ্টিকোণ থেকেই পুরো ঘটনাটা দেখছে ও। গৈরিকার দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখার দরকার। এই ভেবেই নীলের কেবিনের দিকে এগোল ও। বন্ধ। তাহলে কি আঙ্কলের কেবিনে রয়েছে? দেখা করা দরকার ওর সাথে।
-আসব?
অনিমেষ চোখ তুলে তাকালেন। কেবিনে উনি একাই ছিলেন।
-আরে গৈরিকা যে। সময় হল এতদিনে?
-না,মানে...
-বসো। হ্যাভ ইওর সিট। তোমার ছেলে কেমন আছে?
-ভালো। আজ স্কুলে গেছে।
-গ্রেট। আরে দ্যাখো না,তোমার সেদিনের না আসতে পারায় আমি কিছু মনে করিনি। অথচ ইন্দ্রনীল বড্ড রেগে গেল। আর বাবা,সন্তানের অসুস্থতার মর্ম ও না বুঝুক,আমি তো বুঝি। ও ভাবল আমি বোধহয় অপমানিত বোধ করেছি। মোটেও না। মিটিং সেদিন হয়নি,অন্য কোন একদিন হবে। কিন্তু তোমার ছেলের তখনই তোমায় দরকার ছিল।
গৈরিকা মাথা নিচু করল। আঙ্কল একটুও রেগে নেই। একটুও ভুল বোঝেননি। অথচ ও ভাবছিল নীল আঙ্কলের চাপে পড়েই-অ্যাকচুয়ালি,অ্যাম সরি,
-ইউ শুড নট বি। বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছে তোমায়। রাণাঘাট থেকে সোজা এলে,নাকি?
-না। ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম।
-বলো কি নেবে,চা,কফি...
-না। কিছু না। নীল কোথায়? ফোনে পাচ্ছি না।
-পাবে কি করে? স্টেটসে গেছে কাল।
চমকে উঠল গৈরিকা। স্টেটসে চলে গেছে! ওকে না বলে?
-কোন কাজ আছে?
-হ্যাঁ। আমার দিদিরা থাকে ওখানে। দিদির ছোট মেয়ের আবার ছেলে হয়েছে। মুখে ভাত দেবে। আমি এত কাজে যেতে পারলাম না...তাই ইন্দ্রনীলই গেল।
-ওখানকার কন্ট্যাকটস্ আছে?
-আছে,বাট দেওয়া যাবে না।
গৈরিকার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল।
-মানে ইন্দ্রনীলের কড়া হুকুম,ক’দিন নির্ভেজাল ছুটি কাটাতে চায়। তাই আমরা কেউ যেন ওকে ফোন না করি। বড্ড বেশি স্ট্রেস নিয়ে ফেলছিল এই ক’দিন। একদিন থেকে ভালো হয়েছে। অনেকটা ফ্রেশ হয়ে দেশে ফিরবে। তখন সব জট কেটে যাবে।
গৈরিকার কিছু বুঝতে বাকি থাকল না। ইন্দ্রনীলকে স্টেটসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ও যাতে গৈরিকার থেকে দূরে থাকে তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তার মানে আঙ্কল এতক্ষণ যে ভালো ব্যবহারটা করেছিলেন সব অভিনয়।
-ওহ।
গৈরিকা উঠে পড়তে উদ্যত হল।
-তুমি চাও। ইন্দ্রনীল খুব তাড়াতাড়ি এদেশে ফিরুক? ওর সাথে যোগাযোগ করাটা খুব জরুরী তোমার কাছে,বুঝতে পারছি। তাহলে এক কাজ করো। গৈরিকা ভুঁরু কুঁচকাল
-কি?
-না কন্ট্র্যাকট-এ সই করাব না তোমায়। তোমার স্বাধীনতাকে সম্মান করি। ওসব চিরন্তনীদের জন্য। ইনফ্যাক্ট ও কাল না পরশু কন্ট্র্যাকট-এ সই করল। ফাইভ ল্যাকস্ পার অ্যানাম। তোমার অর্ধেক দরেই পেয়ে গেলাম ওকে। ওর উপন্যাসটা এবার বাজার মাত করবে বুঝলে? ফুল এফর্ট দেব আমরা...
গৈরিকা বুঝল এসব ওকে শোনানো হচ্ছে। বোঝানো হচ্ছে ও কতটা বোকামি করেছে।
-আমাকে কি করতে হবে?
-নাথিং। কোন বড় কাজ নয়। আমার জন্য আমার পছন্দের উপন্যাসটা লিখে দিতে হবে। মাসখানেক সময়ে ব্যাপারটা খুব কষ্টকর হয়ে যাবে জানি,তবুও তুমি যদি চাও আমার সম্মান রাখবে,তাহলে নিশ্চয় পারবে।
গৈরিকার মাথায় অনিমেষের বলা বাক্যগুলো ঢেউ তুলতে থাকল। আঙ্কল যা চাইছেন তা করলে উচ্ছ্বাসে নিজের হারানো জমি আবার ফিরে পেয়ে যাবে গৈরিকা। চিরন্তনীকে আটকানো যাবে। নিখিলেশের সাথে ওর সম্পর্কটার ডেথ সার্টিফিকেট আজ নিজে হাতে লিখে এসেছে ও। তাহলে মিথ্যা মায়া বাড়িয়ে লাভ কি? ন্যায়-নীতি-সত্য-মিথ্যা এসব শব্দের ভার এখন সবাই পিঠ থেকে ঝেড়ে ফেলেছে,তাহলে গৈরিকাই বা হাত গুটিয়ে কেন বসে থাকবে?
-তবে,তোমার যদি কোন আপত্তি থাকে-মানে নিখিলেশের কথা ভেবে যদি না লিখতে চাও...
-আমি লিখব।
গৈরিকার মুখ থেকে তীরবেগে শব্দদুটো বার হল।
-তাহলে তো দারুণ হবে। ইন্দ্রনীল ফিরে যখন দেখবে বইমেলায় তোমার এই উপন্যাসটা বেরিয়েছে-তাহলে তো সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে। খুব ভালো হবে সেটা। খুব ভালো হবে।
কি ভালো হবে কি মন্দ হবে জানতে চায় না গৈরিকা। শুধু লিখতে চায়। নিজের জীবনের কথা লিখতে চায় ও। আঙ্কল যেভাবে বলছেন সেভাবে লিখলে যদি ওর লাভ হয়-তাহলে সেভাবেই লিখবে। লাভ লোকসানের হিসাবটাই দেখা উচিৎ সবার আগে। ব্যাল্যান্সশিটে গৈরিকার ভাগে কেবল একটা অঙ্কই পরে আছে-স্থির,নির্বিকল্প,শূন্য।
পূর্বের পর্ব পড়ুন
পূর্বের পর্ব পড়ুন