যথারীতি আজকেও লেট,কি যে হচ্ছে কদিন ধরে।বাসটা সেই বেরিয়ে গেলো চোখের উপর দিয়ে।রাতে ঘুমটা আসতেই চায় না,তারপর ভোরের দিকে অঘোরে ঘুম।সাড়ে আটটা বেজে যাচ্ছে,তবুও ঘুম ভাঙছে না।বারীন কে এতো করে বলেছে যে একটু ডেকে দিতে ঘুম থেকে,ও যে কেন…!!! তবে ওই বলে অরিণ কে এতো চিন্তা না করতে,দরকার হলে ক্লাস নোট সেই জোগাড় করে দেবে অরিণ দা কে।
ছেলেটা বড় ভালো।বড় মায়াবী,অথচ,কত যেন আপনার হয়ে উঠেছে এই মাত্র কদিনের মধ্যে।এই হস্টেলে ও এসেছে এই বছরই। অরিণের থেকে প্রায় বছর দেড়েকের ছোট।কিন্তু ওর সাথে কথা বলে কেন যেন অরিণের মনে হয়েছে,বারীণ অনেক কিছু বোঝে ওর থেকে,অনেক বেশি খাপ খাইয়ে নিতে পারে পরিবেশের সাথে।বলাবাহুল্য,দুজনের নামেরও বেশ মিল,এই কারণে হস্টেলের সবাই তাদের মানিকজোড় বলে ডাকে।
কি আর হবে,চোখের সামনে দিয়ে বাস বেড়িয়ে যেতে দেখলে কি আর হতে পারে মানুষের !সুতারাং একটাই উপায়,সেই এগারো নাম্বার গাড়ি ধরা অগত্যা।অথচ,এমন কোনটাই তো হওয়ার কথা কি ছিলো?পাড়ার মধ্যে একসাথে বেড়ে ওঠা অন্য ছেলে মেয়েদের মতন স্বাভাবিক জীবনও তো হোতে পারতো তার।বাড়ির রান্নার মাসির ছেলেটাও তো সেই স্থানীয় সরকারী স্কুলে পড়েও এখন শুনেছি সেও একটা স্কুলে পড়ায়,সবিতা মাসিও তাই আজকাল আর অন্যের বাড়ির কাজ সব ছেড়েই দিয়েছে।সেও তো পারতো বাবা মায়ের কাছে থেকে বড় হতে!কি যে হয়ে গেল সব! কেনই বা এমনটা হয়…!!
এই সমস্ত কথাগুলো বারংবার মস্তিষ্কের অক্ষরেখা দ্রাঘিমারেখা ছুঁয়ে ছুঁয়ে আহত করে চলে যায় অরিণকে।যতভাবে ভুলে যাবে,কি হবে এসব ভেবে! এমন তো কতজন আছে,যাদের জন্ম থেকেই মা বাবা কেউই থাকেনা,অনাথ।জন্মের পড়েই হয়তো রাস্তার জঞ্জালে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তদের ভাগ্য রচনা করা হয়েছে।তার তো ততটাও কঠিন জীবন নয়!মা বাবাকে পেয়েছে সে কিছুদিন হলেও কিছুটা সময়…।
“আরে ভাই একটু দেখে চলোনা”।
“এই,এই ছেলে ঠিক করে হাঁটতে শেখোনি তো রাস্তায় নামো কেন,হ্যাঁ শুনি “কোন হদ্দ গ্রাম থেকে এরা এসে হাজির হয় বাপু জানিনা”।
এই সময় এদিকের শান্ত রাস্তাতেও ক্রমশ ভিড় বাড়ছে। বড় রাস্তা থেকে দূরে ছোট ছোট যে রাস্তারা শান্ত নির্জনতাকে এখনও ভালোবাসে,এ রাস্তা তাদের মধ্যে একটা।অথচ,এই পাহাড় ঘেরা শান্ত রাস্তাটিও বোধহয় ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে তার নিজের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকার কে নাগরিক ব্যস্ততার কাছে।
এইসব নানান কথা ভাবতে ভাবতেই অরিণ চলেছে ওর গন্তব্যের দিকে,ওর কলেজ। আজ প্রায় আট বছরের মত হতে চললো ও ঘর ছারা।তাই ঠিকানা বলতে তো ওর দুটো জায়গা, প্রথম কয়েক বছর ভালো লাগলেও ইদানীং অরিণ যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে।কিছুদিন আগেও একটু আধটু তাকে বন্ধুদের সাথে বাইরে দেখা যেত,এখন তো সে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে লাইব্রেরি আর ল্যাপটপের মধ্যে।যদিও তার বয়সেই অনেক ছেলেমেয়ের কাছে প্রিয়জনদের ছেড়ে সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে থাকা বা মানিয়ে নেওয়াটা তেমন কোনো কিছুই না, আসলে, পৃথিবীর সকলেই তো আর একই রকমের মানুষ হতে পারেনা।
অনেক চেষ্টা করেছিলো,অনেক বুঝিয়েছিলো এই একরত্তি ছেলে অরিণ ওর বাবা মা কে।কতই বা বয়স হবে তখন,সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে উঠেছে দারুণ একটা রেজাল্ট করে।এতো ভালো রেজাল্ট,অথচ,ঘরবাড়ি জুড়ে অতিব্যস্ত মা বাবার ক্রমশ ভাঙচুর করা সম্পর্কের আগুনের স্ফুলিঙ্গে নিভে যাওয়া ছাই।কেউ নিতে চাইনি তার দায়িত্ব।আসলে এ বাড়িতে যে সবাই ব্যস্ত,একমাত্র সে ও তাদের ছোট্ট আদরের ডগিটা ছাড়া।শান্ত অরিণ তাই জনলার দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবতো সেও যদি পাশের ফ্ল্যাটের ঋতের মতো হস্টেলে চলে যায় তাহলে হয়তো কিছুটা মানসিক শান্তি। অথচ,প্রথম যখন এখানে এসেছিলো,সে কি মন খারাপ তার। ভাবতো এক ছুঁটেই বাড়ি ফিরে যায়,কেউ না থাক্ কাজের মাসি তো আছে,ছোট্ট ডগিটাও তো আছে ওরজন্য। ঘরের দেওয়াল গুলোও ছিলো তারজন্য একসময়…
ক্রমশ স্মৃতিরা ফিকে হতে থাকে,ভালোবাসা জন্মায় নতুন আশ্রয়ের প্রতি।হয়ত কিছুটা বাধ্য হয়েই!
সুচিন্তিত মতামত দিন