শ্রীশুভ্র
বাঙালি আর কবিতা কি পরস্পরের পরিপূরক? হঠাৎ-ই মাথায় আসল প্রশ্নটি। কবিতা নিয়ে মাতামাতি তো শুধু আমরা বাঙালিরাই করি না, আবিশ্ব অধিকাংশ জাতিই কবিতা নিয়ে মাতামাতি করে থাকে। অথচ কোথায় যেন আমাদের বাঙালির মননে কবিতা নিয়ে একটি বাড়াবাড়ি রকমের আবেগ কাজ করে থাকে। অনেকেই কিন্তু এই বিষয়ে একমত হবেন। বাঙালি যেরকম আবেগতাড়িত হয়ে কাব্যচর্চা করে থাকে, অন্যান্য জাতিও কি ঠিক সেইরকম আবেগ থেকেই কবিতা নিয়ে মাতামাতি করে? এই যে আবেগের মাতামাতি, যেটি জাতি হিসাবে আমাদের একটি প্রধানতম চরিত্র লক্ষ্মণ, সেইখানেই যেন আমাদের কাব্যচর্চার নোঙর। আবার আবেগের সাথে আরও একটি বিষয় অনেক সময়েই জড়িয়ে যায়, সেটি কিন্তু হুজুগ। বিশেষত যৌবনের অন্যতম বৈশিষ্ট এই হুজুগ। বয়সের সাথে দিনে দিনে যার শক্তি কমতে থাকে ক্রমশ! অভিজ্ঞতার পারদ যত চড়তে থাকে হুজুগের মাতামাতিও ততই দূর্বল হতে থাকে। আর সেই হজুগের হাত ধরেই আমাদের বাঙালিদের কাব্যচর্চার পরিসরটি কোলাহল মুখর হয়ে ওঠে প্রতিটি যুগেই নতুন করে।
ইনটারনেট বিপ্লবের হাত ধরে আমাদের বর্তমান যুগে বাঙালির কাব্যচর্চার এই হুজুগ প্রবল ভাবে শক্তি অর্জন করে চলেছে। সেই বিষয়ে আশা করি বিতর্ক থাকতে পারে না কোন। অনেকেই এই হুজুগকে সদর্থক ভাবে দেখতে চাইছেন। অনেকেই মনে করছেন, এই হুজুগের মধ্যে দিয়েই বঙ্গসংস্কৃতি এগিয়ে চলবে দূর্বার গতিতে। অনেকেই এই হুজুগের মধ্যে দিয়ে বাংলা সাহিত্যের আবিশ্ব পরিচিতির বিষয়টি আরও সবল হয়ে উঠবে বলেই আশা করছেন দৃঢ় ভাবে।
এখন এই হুজুগের পেছনে কাব্যচর্চা নিয়ে আবেগের যে মাতামতি, সেটিকেই অনেকে বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে মনে করেন। আমাদের আবেগের অন্যতম বহিঃপ্রকাশই হলো কবিতা। এরকমটাই ভাবতে চান অনেক কাব্যপ্রেমী বাঙালি। এবং এই বিষয়টিকেই বাঙালির গর্ব ও অহংকার বলে প্রচার করেন অনেকে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন কবিতা কি শুধুই আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র? কিংবা কবিতা কি মূলত আবেগেরই সম্প্রসারণ? প্রশ্নটিকে একটু ঘুরিয়ে ধরলে, আবেগের বহিঃপ্রকাশেই কি কবিতার প্রাণভোমরার জীয়নকাঠি?
না এই প্রশ্নের শেষ মীমাংসা হয়তো কোনদিনই হবে না। যদিও অধিকাংশ বাঙালি কাব্যপ্রেমীই এই প্রশ্নের উত্তরে সমস্বরে হ্যাঁ বলে সায় দেবেন। বস্তুত আবেগপ্রবণ জাতি হিসাবেই আমরা বিষয়টিকে দেখতে অভ্যস্থ। আমাদের সকল যুক্তির ধার সেই দিকেই শানিয়ে ওঠে স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু আমাদের মধ্যেই বেশ কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা কবিতাকে আবেগের স্বগতোক্তি হিসাবে দেখতে রাজি নন আদৌ। কারণ ভাবাবেগ আমাদের উদ্বেল করে তোলে ঠিকই, কিন্তু কোন মহত্তর সত্যে পৌঁছিয়ে দিতে পারে না। আর কবিতার মূল গতি সত্যের অভিমুখে। ভাবাবেগ অধিকাংশ সময়েই আমাদেরকে সত্যের থেকে অনেক দূরবর্তী অবস্থানে আটকিয়ে রাখে। আর কবিতাও যদি সেইরকম ভাবেই সত্যের থেকে দূরতর অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়, তবে সেটিকে কবিতা বলায় আপত্তি করতে পারেন কিছু কিছু মানুষ। কারণ তাঁদের প্রত্যয়ে ব্যক্তিগত ভাবাবেগের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ থেকে কবিতা অনেক বড়ো মাপের বিষয়। জগৎ ও জীবনের চলমান প্রতীতির সাথে বিশ্বসত্যের শাশ্বত বীক্ষার অন্বয়ের মধ্যেই কবিতার অস্তিত্ব।
আর সেই অস্তিত্বের সারাৎসার ধরতে চান তাঁরা জীবনবোধের পরতে পরতে অভিজ্ঞতা আর স্বপ্নের তীব্র ঘাত প্রতিঘাতে। সচেতন প্রজ্ঞা আর অবচেতন মননের দিগন্ত ব্যাপি উদ্বোধনের আনন্দে। সত্য উপলব্ধির গভীর অনুরণনে। সুস্পষ্ট জীবনসত্যের সুদৃঢ় ভিত্তিতে বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে পৌঁছানোর সুতীব্র অভীপ্সায়। না, ভাবাবেগের মাতামাতিতে সম্ভব নয় এই উত্তরণ।
অনেকেরই আক্ষেপ তাই, বাংলা কবিতা অধিকাংশ সময়েই ভাবাবেগের প্রাবল্যে দিগভ্রান্ত পথিকের মতো মরিচিকার পেছনে ছুটে চলার এক অদম্য হুজুগ মাত্র। এখন আবেগসর্বস্বতার এই হুজুগ থেকে বাঙালি ও বাংলা কবিতাকে রক্ষার উপায় কি? বাঙালিকে রক্ষা করার বিষয়টি সমাজতাত্বিক থেকে সমাজবিদ সমাজসংস্কারকদের বিষয়। কিন্তু বাংলা কবিতাকে ভাবাবেগসর্বস্বতার এই হুজুগ থেকে রক্ষার উপায়, আরও বেশি করে সমাজমনস্কতার বেদীতে অস্তিত্বের সারসত্যকে প্রত্যক্ষ করার শিক্ষাকে প্রসারিত করতে থাকা। আমাদের জীবনচর্চার পরিমণ্ডলেই সার্থক করে তুলতে হবে এই প্রয়াস।
এরপরেও ভিন্নমতাবলম্বীরা কবিতাকে ভাবাবেগের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ হিসাবেই প্রচার করে চলবেন সন্দেহ নাই। সন্দেহ নাই তারপরেও কবিতা লেখার হুজুগকে বাঙালি যথেষ্ঠই শ্লাঘার বিষয় হিসাবেই আঁকড়ে ধরে বসে থাকতে স্বচেষ্ট হবে। প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা চর্চার মৌলিক অধিকার রয়েছে। তাই এক একজন এক এক রকম ভাবেই সমগ্র বিষয়টি বিচার করবে সেটাই স্বাভাবিক। আর এরই মধ্যে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে আপনাপন বিশ্বাস ও যুক্তির পথরেখা ধরেই।
কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন