এই যে অমেয় জল---মেঘে মেঘে তনুভূত জল---
এর কতটুকু আর ফসলের দেহে আসে বলো?'
--- বিনয় মজুমদার
কোথা থেকে শুরু করি, বলো তো! আসলে এখানে পুরোটাই নাম্বার্স গেম। নম্বরের অদ্ভুত জোর এই খেলায়। কাকতালীয় বলতে পারো। কিন্তু কথাটা ঠিক। এই যেমন ধরো, আমার নম্বর তিন। বুঝতেই পারছো, অঙ্কের নিয়মে এক এবং দুইয়ের থেকে আমার এগিয়ে থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু জীবনের নিয়ম মাঝেমাঝেই অঙ্কের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখায়। এখানেও তাই এক আর দুই মিলেমিশে তিনের সমান হয়ে যেতে পারে। যেতে যে পারে তা আমি জানতাম না, তা নয়। বরং নিশ্চিতভাবে জানতাম। বহুবার উচ্চারিত হতে শুনেছো সে-কথা আমার মুখে। যুক্তি আমাকে দৃঢ় হতে সাহায্য করতো। তবুও কখনও মনে হয়েছে, আমারও কি ভুল হতে পারে না! ভুল হলে তো এক্ষেত্রে সুবিধেই হয় আমার! পাশাপাশি একথাও জানতাম, আমার অবচেতন আমাকে ভুল সংকেত পাঠায় না, অন্তত এসব ক্ষেত্রে! বিশেষ করে সেইসব উড়ো কন্ঠের ঝুরো হুমকির পর খোঁজখবর নিতে গিয়ে ছবিটা স্পষ্টতর হলো আরও। পরিষ্কার দেখতে পেলাম, এক আর দুই জোট বেঁধে কীভাবে সমান হয়ে আছে তিনের। কাহিনিতে কুশীলব আছে আরও কয়েকটি মুখ। এমনিতে তারা পার্শ্বচরিত্র হলেও, নাটকের কয়েকটা জায়গায় তাদের ফুটেজ ও গুরুত্ব কিছু কম থাকে না! তবুও শঙ্কিত ছিলাম না একটুও। প্রথমত, বিষয়টার জন্য কোনোদিনই আমি অপ্রস্তুত নই। দ্বিতীয়ত, এক + দুই = তিন হলেও আমার পাশে তোমার উপস্থিতিই হামেশা এক কদম এগিয়ে রাখছিল তিনকে। আশঙ্কার কিছুই ছিল না তাই। অথবা ছিল, বুঝিনি সেভাবে। অথবা বুঝেছি, গুরুত্ব দিইনি তেমন। কিন্তু এর মধ্যেই আবিষ্কার করতে থাকলাম, আমার আশপাশে তোমার ছায়াটুকুও ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে! তোমার জলে অবগাহন তো অনেক দূরের ব্যাপার তখন! তবুও কী আশ্চর্য, আহত হলাম যত বেশি, তার এক শতাংশও অবাক হতে পারলাম না কিছুতেই!
পৃথিবীতে চিরকালই কিছু অল্প-সংখ্যক মানুষ থাকে, সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েও যারা থেকে যায় পরাজিত হয়ে। আমি সেই বিরল প্রজাতির। তুমি আমার জন্য যতই 'তুমি জিতবেই' লিখে রাখো দেওয়ালে, হেরে যাচ্ছি দেখে তাই অবাক হওয়া হলো না আর! একটা কথা কী জানো? অনেকক্ষণ ঝলমলে আলোর দিকে একটানা তাকিয়ে থাকলে ধাঁধা লাগে চোখে। ঝলসে যায়, চোখে অন্ধকার দেখে মানুষ! তারপর অন্ধকার সয়ে এলে, একসময় আঁধারেও ছবিগুলো ফুটে উঠতে থাকে স্পষ্ট। তোমায় নির্নিমেষ দেখতে দেখতে আমারও ধাঁধিয়ে গিয়েছিল চোখ। অন্ধকার সয়ে যেতেই দেখলাম, এমন অনেক কথা যা তুমি একদিন বলতে আর যা তুমি এখন বলছো, তাদের মধ্যে ফারাকের মাপ জমিন-আসমান! এমনকি ধরা যাক গত পরশুও যে-বিষয়ে ঝরে পড়ছিল তোমার ন্যায্য ক্ষোভ, আজ সেই একই বিষয়ে অদ্ভুত আপসের সুর তোমার গলায়! শুধু তাই নয়, সেই সমঝোতাকে ঢেকে রেখে একটা যুক্তির রূপ দিতে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা তোমার! আমার নিয়তিতাড়িত চোখ খুব স্বাভাবিক তখন ভরে যাচ্ছে জলে, যা তোমার তৎকালীন অনুভূতির বাইরে। সেই অশ্রুতে কতটা আগুনও যে লুকিয়ে, তা আর তুমি বুঝবে কী করে!
সত্যি কথাগুলো স্বীকার করে নেওয়া যাক এবার। তুমি যা বলেছিলে, তা একদম ঠিক। মেনে নেওয়া সত্যিই মুশকিল! মেনে নেওয়া মুশকিল রাতের কাহিনিগুলোর হারিয়ে যাওয়া। কারণ আমার অনেক প্রাপ্য বিশ্রাম, অনেক কাম্য ঘুম, অনেক নিভৃত সময় তোমাকে তুলে দেওয়া ছিল সেইসব রাতে। মেনে নেওয়া মুশকিল তিনের সাধনভূমিকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে আবার একের ঢুকে পড়া। মেনে নেওয়া মুশকিল আবার প্রতিনিয়ত দুইয়ের উপস্থিতি, একের সঙ্গে তার নিটোল সঙ্গত। আমার জায়গায় থাকলে তুমিও মানতে পারতে না, এ তোমার নিজের স্বীকারোক্তি। মেনে নেওয়া মুশকিল নিজের হাতে ধরে শেখানো, নিজের কাজ সরিয়ে রেখে যেটা করতে ভালোবেসেছিলাম, সেখান থেকে আমারই সরে যেতে বাধ্য হওয়া। মেনে নেওয়া মুশকিল এত আপস, এত সমঝোতা, আর তার এত অজুহাত। আর হ্যাঁ, মেনে নেওয়া মুশকিল এইসব সমঝোতার জন্য তোমার আক্ষেপগুলোকে প্রতিদিন একটু করে কমে যেতে দেখা! তুমি নিজেই বলেছিলে না, 'কিছুই প্রতিদান দিতে পারিনি'? বলেছিলে না, 'মাঝেমাঝে মনে হয়, তোমায় শুধু ব্যবহারই করে গেলাম'? বলেছিলে না, 'সবাই কথা রাখতে পারে না! ধরে নাও, আমিও তেমন!' আজ পরিত্যক্ত আসবাবের মতো, ভূতগ্রস্ত পোড়োবাড়ির মতো, একা এসে দাঁড়াতে হয় যখন জনহীন রাস্তার বাঁকে, তখন বুঝি কী যে সত্যি ছিল তোমার আক্ষেপগুলো! অথচ এর পরেও তুমি আমার কাছে রিলিফ আশা করো! স্বাভাবিকভাবেই সে-অবস্থায় আমি নেই! তখন তোমার ভুল করেও মনে হয় না, আমি কোনো দাতব্য রিলিফ বিতরণ কেন্দ্র নই এবং আমারও কিঞ্চিৎ রিলিফের প্রয়োজন পড়ে!
হিন্দিতে প্রবাদ আছে একটা, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, একটা খাপে দুটো তলোয়ার থাকতে পারে না। সামান্য ভুল আছে কথাটায়। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বা বন্দোবস্ত থাকলে, পারে। যেমন, এক আর দুইয়ের বন্দোবস্ত। যেমন, আরও কোথায় দুই আর অন্য কারও বোঝাপড়া। এসবই যৌথ প্রকল্পের বিভিন্ন রূপ। কিন্তু তলোয়ার যদি আমার মতো হয়, যার সঙ্গে বোঝাপড়া বা বন্দোবস্ত কোনোটাই করা যায় না, তবে তো বিপদ! যে-তলোয়ার ভাবনায় আপসহীন, অবস্থানে দৃঢ় আর সাধনায় মগ্ন, তার থেকে বিপদজনক আর কে বা কী হতে পারে! সহাবস্থান দেখতে দেখতে তোমার অভ্যস্ত চোখ কি এটাও বুঝতে ভুলে গেছে যে সাধনা ফাঁকি দিয়ে হয় না, আর আমার মগ্নতার সঙ্গে এই ধরনের সহাবস্থানটাই খাপ খায় না! আসলে তিন নম্বরটি এমন তলোয়ার যে দু'দিকেই ধারালো হয়ে উঠতে পারে ক্রমশ, আর কাটতে পারে যেতে এবং আসতেও! অতএব তার উপস্থিতিটাই বিপদের। এমনকি, তোমার পক্ষেও অস্বস্তিকর! তাই তাকে সরিয়ে রাখা যায় এককোণে। মুছে ফেলা যায় মানচিত্র থেকে। এখান থেকে সে তো আর আত্মপক্ষ সমর্থনে হাজির হতে পারবে না কোনোভাবেই! তাই একটি কল্পিত অভিযোগে যোগাযোগটুকুও স্তব্ধ করে দেয় তোমার আঙুল!
কিন্তু অবাক হই না আঘাতের প্রাবল্য সত্ত্বেও! আসলে আজকাল অবাক হতে ভুলছি ক্রমশ! নিজের অবস্থানে দৃঢ় থাকতে পারি তাই। যেখানে আমার অপরাধ থেকে যায়, সেখানে কবুল ও সংশোধনে দ্বিধা রাখিনি কোনোদিন। যেমন, ঠিক আগের টানাপোড়েনের সময়টা। বাইশ দিনের অদর্শনের সময়টা মনে আছে তো? কিন্তু এবারের আমি অন্য আমি। এবারের আমি জানে কোনো অন্যায় ছুঁতেই পারেনি তাকে। একটি পরিপ্রেক্ষিতের কথাকে কেমন অনায়াসে অন্য প্রসঙ্গে জুড়ে নিয়ে এবারের আমিটাকে সরিয়ে দিলে তুমি, সে শুধু দেখে যায় নিশ্চুপ হয়ে। 'মহাভারত' নিশ্চয়ই পুরোটাই উপলব্ধিতে আছে তোমার। সাথি কেমন হওয়া উচিত, জানো? কৃষ্ণের মতো, যে তোমার হয়ে যুদ্ধ না-করেও তোমার জয় নিশ্চিত করতে পারে। অথবা কর্ণের মতো, যুদ্ধে তোমার হার নিশ্চিত জেনেও যে তোমার সঙ্গে থাকতে পারে। আমি কিন্তু দু'রকমই ছিলাম তোমার! কিন্তু না, 'ছিলাম' বলছি কেন! আমি তো তেমনই আছি, যেমন ছিলাম। তুমি শুধু রোজ আরও একটু করে সরিয়ে রাখছো নিজেকে, অপ্রয়োজন বুঝে। এই-ই তো! এর বেশি তো কিছু নয়! আর নিজেকে নিয়ে বাকি কথা? না-হয় তোলা থাক, পরেরবার বলবো।
Tags:
ধারাবাহিক