-হ্যাঁ , গুরুদেব । কান সজাগ থাকলেও , আমার বাকি চারখানা ইন্দ্রিয় সজাগ থাকতেই হবে । কখনও আবার আরেকটা অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয় !
-তারপরে ...
-বনের ভূমিতে যে শুকনো পাতা থাকে, সেই পাতায় পশুর পায়ের শব্দ ভাসতে থাকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনতে হয়। ওরা যতটা বিপদজনক , ততটাই হিংস্র ।
-ইন্দ্র অনুগামীরা , বনের হিংস্র পশুদের থেকেও আরও ভয়ানক , হিংস্র আর ধূর্ত । নিজেদের কার্য সিদ্ধির জন্য , যে কোন পথ অনুসরণ করতে পারে । দেবতাদের কাছে, জেতাটাই নীতি । ক্ষমতা ধরে রাখাটাই প্রভুর ধর্ম । নিজের নীতি ও ধর্মকে টিকিয়ে রাখবার জন্য যে পরিকল্পনা , তাকেই বলে রাজনীতি ।
শুক্রাচার্যের কথা শুনে , রাজা যযাতি হাসল । তিনি মনে – মনে বলল - এই সত্তর বছর বয়সী পুরোহিত , নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছে ।
তার মাথায় কোন কেশের উপস্থিতি নেই । নিজের বয়স কে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্যই মাথার আর গুম্ফের মুণ্ডন করিয়েছে । এই ধারণা রাজা যযাতির রয়েছে । গুরু শুক্রাচার্যের পড়নে কালো পোশাক । দুই চোখ ভরা চাপা আগুন , ছাই চাপা , যে কোন সময়ে লেলিহান জিহ্বা দাপিয়ে উঠবে ! যযাতি বলল
-আপনার রাজনীতিতে আগ্রহ নেই , নাকি দেবতাদের রাজনীতির ধরণ পছন্দ নয় ?
- রাজা , একটা কথা জেনে রেখো , রাজনীতির নির্দিষ্ট কোন ধরণ হয়না । সে জলের মতনই অবয়বহীন । তাই বলে তাকে আবার পরিণামহীন ভাববার ভুল করাটা মূর্খের কাজ ! এত টুকু জেনে রেখো , তুমি যেমন ঘুঁটি সাজাবে , তেমনই ফিরে আসবে । দেবতাদের আমি বিশ্বাস করিনি , আর শেষ জীবন অব্দি করব না । এই বিশ্বাসহীন রাজনীতিটা ওদিক থেকেই এসেছে । রাক্ষসরা বশ্য জাতি নয় । দেবতারা প্রয়োজনে বশ্যতার অভিনয় করেও , প্রভুকে খুন করতে পারে ।
-আপনি এতটাই ভীত ! মাপ করবেন গুরুদেব , এটাই তো যুদ্ধের সহজাত চরিত্র । যেমন ভাবেই হোক শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে । জয় নিশ্চিত করাটাই যোদ্ধার একমাত্র লক্ষ্য , তাই নয় কি ?
- অবশ্যই । ক্ষত্রিয় যখন যুদ্ধ করে , সে বিপক্ষকে পরাজিত করবে বলেই করে । পুরোহিত যজ্ঞ করেন সফলতার অভিলাষ নিয়েই । সব কিছুই নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে । এখানে আগেও যুদ্ধ হত । দেবতারা যুদ্ধের যে নীতি আমদানি করেছে , তা কাপুরুষতা । শত্রুর দুর্বলতা খুঁজে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ , তাইবলে সেই দুর্বলতাকে ব্যবহার করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নামবার আগেই , তাকে পঙ্গু করে ফেলা , এটা নিতান্তই কাপুরুষতা । দেবতারা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য -সম্পর্কের ছলনা , নারী , আশ্রয়ের অভিনয় -- এই সব কিছুকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ।
যযাতি ভূমিতে বসেছিল , দুই পা মুড়ে । সামনে নরম গদির উপর পদ্মাসনে শুক্রাচার্য । হাত জোড় করে যযাতি বলল – আপনি , অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন । ইন্দ্র আর তার অনুচরেরা আপনার প্রতি কেমন ব্যবহার করেছে ।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল । দুজনেই গোপন কক্ষে আলোচনায় বিভোর । যযাতি নিজের অবর্তমানে , সিংহাসনে যোগ্য উত্তরাধিকারী নির্বাচন করবে । সেই আলোচনায় নানাবিধ দিক উঠে এসেছে , এমনই এক সময় যখন যযাতি জানতে চাইল , শুক্রাচার্য নিজের মেয়ের সন্তানদের মধ্যেই একজনকে কেন নির্বাচন করছেন না ? উত্তরে , অসুর গুরু জানালেন , যুদ্ধে রক্তের সম্পর্ক বলে কিছু হয়না। কথা হচ্ছে , বিপক্ষ শিবিরে কে আছে ।
এখন দিনের মধ্যভাগ । যযাতি বলল ,
-সেখানে যদি নিজের জন থাকে তাহলে ?
- সে ও শত্রু হবে ।
-আপন জনকে শত্রু বলব ! এমনটা বলা যায় !
-আমি তোমায় আজ এমনই গল্প বলব । একটি অংশের সাথে আমি যুক্ত । বাকি অংশ টির সাথে দেবযানী ।
-দেবযানী ?
- হ্যাঁ , তোমার সহধর্মিণী , আমার একমাত্র কন্যা ।
- কেমন ভাবে , আপনার এই কাহিনীর সাথে দেবযানী যুক্ত আছে !
- খুব ভাল করে বুঝতে পারলে , দেখবে , এই কাহিনীতে দেবযানীই আছে । তার অবস্থান আজও জানা নেই !
-অবস্থান !
- সে যে নিজের সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করতে চেয়েছিল । পেরেছে কি না জানা নেই । তার প্রেম শুধুই নিষ্পাপ আত্মত্যাগ , না সেই ত্যাগে নিজের কোন গভীর পরিকল্পনা আছে ! মানুষকে চিনতে পারাটা বেশ শক্ত , তার মনে যে ধরণের ওঠা –পড়া চলে , তার সাথে সে নিজেও পা মিলিয়ে চলতে পারেনা । তাই পর্যবেক্ষণ করতে হয় । দেবযানী আমার কাছে এমন প্রজাপতি , যার পুড়তে থাকা ডানা দেখেও , করুণায় উদ্বেলিত হয়নি আমার হৃদয় । বরং বিশ্বাস ঘাতকতার গন্ধে নাক চাপা দিয়েছি ! সে নিজেই নিজেকে অন্য পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল ।
-দেবযানীর জীবনে প্রেমিক হিসেবে আমার অবস্থানের আগেও কি অন্য পুরুষের আনাগোনা ছিল !
-এটা প্রশ্ন হলে উত্তর দিতাম হ্যাঁ । তোমার কণ্ঠলালিত উচ্চারণে , শঙ্কার ছায়া ! এত বিস্ময়ের কোন কারণ আছে ? দেবযানী তোমার জীবনে একাধিক মহিলার উপস্থিতি মেনে নিতে পারলে , তুমি পারবে না কেন ? প্রেম মানে দখল নয় । যারা ভাবে আমি যাকে ভালোবাসি , তাকে শুধুই আমি ভালবাসব ; তারা সত্যি কথা স্বীকার করতে চায় না ।
-কী কথা ?
- পৃথিবীতে কোন নতুন কাজ ছাড়া , একাই এক মাত্র কাজের মালিক হওয়া যায় না। ভালোবাসা পুরানো এক অনুভূতি । এই অনুভূতিতে সামিল হওয়াটা স্বাভাবিক । আমি বলতে চাইছি , তুমি যেমন একাধিক ভাবে ভালোবাসার অনুভূতিতে ভেসে গিয়েছ , এখনো চলেছ । দেবযানীও ভেসেছে , এটাই স্বাভাবিক ।
-তাহলে আপনি তার উপর বিশ্বাস হারিয়েছেন কেন ?
- তার এই ভালোবাসা , আমার আর দেবতাদের মাঝে চলে এসেছে । দেবযানী এমন এক অস্ত্র , দু’ পক্ষই যাকে ব্যবহার করতে আগ্রহী ।
-মানে ?
২
রাতের অন্ধকারে , মাটির পথের উপর দিয়ে ছুটে আসছে এক যুবক । আঠারো বসন্ত ছুঁয়েছে তার যৌবন । দুই পাশে গভীর বন । গভীর তাদের পত্র পল্লবের শিরা –উপশিরায় জড়িয়ে থাকা অন্ধকার । বন্য জন্তুদের স্বাধীন উল্লাস ধ্বনি , পাতায় – পাতায় ধ্বনিত হয়ে , আকাশ ভারী করে তুলেছে । সে ছুটছে । দস্যুদের আক্রমণের চিহ্ন , তার সারা শরীর জুড়ে । মাথা ফেটে রক্ত ধারা নামছে , ঘেমে গিয়েছে শরীর। সে কিছুটা দূর গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল । বুকের ভিতর হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে ।
সে দু’ পা মুড়ে বসে পড়ল । এখন শীতকাল । আর চলতে পারছেনা । চোখে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠছে ! সেই প্রায় নিমেলিত , আর কাঁপতে থাকা চোখ দিয়ে , দূরে ঝাপসা কুয়াশার ভিতর আশ্রম দেখতে পাচ্ছে । আরেকটু কষ্ট করে নিজের দেহটাকে টানতে - টানতে নিয়ে চলেছে ।
আশ্রমের মুখে এসে , শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে ডাকল, - কেউ আছেন ? আমার প্রাণ রক্ষা করুন । আমি পথিক । অরণ্যে একাকী ভ্রমণে এসেছিলাম । দস্যুর আক্রমণে সব কিছু লুঠ হয়ে গিয়েছে । আমাকে প্রাণে বাঁচান ……
যখন চোখ খুলল । যুবকটি নিজেকে নরম পরিষ্কার গদির উপর আবিষ্কার করল! তার মনে আছে , চোখ বুজে যাওয়ার আগে , কুয়াশার ভিতর আশ্রম দেখতে পেয়েছিল । তারপর কিছুই মনে নেই । সে চারপাশে দেখল । ডানদিকে মাথার কাছে , গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ পুরোহিত । তার পাশে একজন বৈদ্য । ছেলেটি পায়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখল এক সুন্দরী , ফর্সা যুবতী । চোখে উদ্বিগ্নতা ।
-আমি এখানে ।
মেয়েটি বলল – তোমাকে আমিই এখানে নিয়ে এসেছি । আশ্রমের মুখেই অজ্ঞান হয়ে ছিলে । তোমার পরিচয় দাও ।
-আমার নিজের কথা নিজের কিছুই মনে নেই । আপনারা কারা ?
-আমি দেবযানী । দৈত্য গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা । ইনি আমার পিতা ।
শুক্রাচার্যের দিকে তাকিয়ে , ছেলেটি দুর্বল হাত জড়ো করে বলল – আপনি !
-হ্যাঁ আমিই শুক্রাচার্য । এটা আমারই আশ্রম । তোমার চোট বেশ গভীর । ক্ষতও রয়েছে । আমার বৈদ্য চিকিৎসা চালাচ্ছে । আশা রাখছি একমাসের মধেই অবস্থার পরিবর্তন হবে । তুমি বিশ্রাম নাও ।
শুক্রাচার্য দেবযানীকে নিয়ে ঘরের বাইরে এল । দেবযানী বলল
-পিতা , আপনার কী মনে হচ্ছে ?
-ছেলেটি উচ্চ বংশজাত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই । তাকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে হলে , আমাদের আশ্রম জীবনের সাথে স্বাভাবিক হতে হবে । দেবযানী আমি চাই , তুমি তার পরিচর্যা করো । মনে রাখবে , সে তোমার চেয়ে বয়সে ছোট । তাকে কখনই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে দেবে না । সে যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
দেবযানী মাথা নাড়ল ।
সময় হাওয়ার মতন নিজের গতি নিয়েই এগিয়ে চলে । দেখতে – দেখতে একমাসে , ছেলেটি নিজেই আশ্রমের খুব আপন হয়ে ওঠে । শুক্রাচার্যের মনে তার
প্রতি দুর্বলতা অনেক সময় প্রকাশ পেয়েছে । মন নিজে কবেই বা , নিয়ন্ত্রণে থেকেছে ! এই অচেনা ছেলেটিকে খুব আপন বলে মনে হয় । অবশ্য যেমন রুপ তেমনই গুন । কণ্ঠে যে সুর তার , দেহের প্রতিটি খাঁজে নৃত্যের মুদ্রা ; অপ্সরাদের কাছ থেকেই যেন নাচ শিখেছে ! যে আশ্রম যুদ্ধের পরিবেশে থমথমে ছিল , কোকিলের কণ্ঠ থেকেও যুদ্ধ ক্ষেত্রের রণ হুঙ্কার বেশি আরাম দিত, সেই কানে ছেলেটির সুর ভাসে ! প্রতি সকালে আশ্রমের মহিলা মহল তার কাছে গান আর নাচের তালিম নেয় ।
দেবযানী তাকে বলে দিয়েছে , আশ্রমের জন্য যে সময় তাতে যেমন , সে ভাগ বসাবেনা । তেমনই দেবযানীকে যখন শেখাবে , তখন সেই সময়টুকু শুধু তারই ।
শুক্রাচার্য কয়েকদিনের জন্য একান্ত সাধনার উদ্দেশ্যে আশ্রম ত্যাগ করল । সে দেবযানীকে নিজের কক্ষে ডাকল ।
দেবযানী ধীরে ঘরে প্রবেশ করল । বলল
-আপনি ডেকেছেন পিতা ?
- হ্যাঁ আমি কয়েকদিনের জন্য , আশ্রমের বাইরে যাচ্ছি । আমার অবর্তমানে এই আশ্রমের দায়িত্ব যেহেতু তোমার হাতে , তাই কিছু উপদেশ দিচ্ছি ।
- আপনি বলুন পিতা ।
-আমি চাইব , আমার অবর্তমানে এখানে তুমি এক যোগ্য নেত্রী হিসেবে , দক্ষ প্রশাসক হিসেবে নিজের কাজ করবে । দেবতারা যেন কোন ভাবেই বিঘ্ন না ঘটাতে পারে , অসুরদের মধ্যে সংযমতার অভাব রয়েছে । আমার এখানে উপস্থিতি না থাকা টা ক্ষতি হতে পারে ।
- আমি চেষ্টা করব , আপনার সম্মান রাখাবার ।
শুক্রাচার্য , দু’হাত দিয়ে দেবযানীর মাথা বুলিয়ে বলল – আমার তোমার উপর বিশ্বাস আছে ।
শুক্রাচার্য নিজে অরণ্যের এই গোপন গুহায় ধ্যানে মগ্ন । সে প্রতি বছর এই স্থানে আসে । তার আসবার পিছনে অবশ্য অন্য কারণ রয়েছে । এক গোপন ও রহস্যময় অনুসন্ধান । এই গবেষণার কথা একমাত্র তার মেয়ে দেবযানী জানে । দশ দিনের জন্য শুক্রাচার্য আসেন , নিজের বিশ্বস্থ অনুচরদের নিয়ে , গবেষণায় মত্ত থাকে । অসুরেরা ভাবে , গুরুদেব গভীর ধ্যানে মগ্ন ।
আজ চতুর্থ দিন হয়ে গিয়েছে । বাইরে মৃদুমন্দ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ঝরছে । গুহার ভিতর থেকে , ভিজতে থাকা অরণ্যকে খুব বাধ্য বলে মনে হয় । কোন দুরন্ত শিশুকে , মা পরম স্নেহে স্নান করিয়ে দিচ্ছে ! দেবযানীর কথা মনে পড়ে যায় । মেয়েটা এখন একা – একা আশ্রমে । যদিও বা তাকে রক্ষা করবার মতন , সাহায্য করবার মতন অনেকেই আছে। পিতার চিন্তার দায়িত্ব তবু থেকেই যায়! যতই নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখবে ভেবেছিল , তার দায়িত্ব তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়না । অসুর জাতির উন্নতি , দেবতাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর মেয়েটির চিন্তা । দেবযানীর বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে । তাদের সমাজে নির্দিষ্ট সময় সীমার অনুশাসন নেই , মেয়েরা স্বাধীন । বাবা হিসেবে সে নিজে এখন চাইছে এক সৎ বংশে মেয়েকে বিয়ে দিতে । এই কথার সাথে , নব্য বালকের মুখটা ভেসে উঠল ! ছেলেটির কণ্ঠ বড়ই মধুর ! শুনলেই সব ক্ষোভ , হতাশা , বিদ্রোহ -- মুছে যায় । একথা এই পৃথিবীতে কেই বা অস্বীকার করবে যুদ্ধে অস্ত্রের চেয়েও কণ্ঠের সুর বেশি ক্ষমতারাখে , শত্রুকে বশে রাখতে ! ছেলেটি নিজের সংগীত , নৃত্য আর মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে -- শুক্রাচার্যের মতন আপাতত নিরস মানুষকেও রসিক করে তুলেছে ! আশ্রমের দিন গুলোর কথা খুব মনে পড়ল । সে ভাবছে , ফিরে গিয়ে আবার আগের মতন ছেলেটির গান শুনবে ।
বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে । গাছের পাতার উপর অপেক্ষমাণ জল ধারা , ভূমি চুম্বনে পীড়িত ! শুক্রাচার্য গোপন গুহাকক্ষে যাবে । সামনের পথ ধরে অরণ্যে যেতে হবে । তারপর , অরণ্যের মাঝে জলাশয়ের তলায় , সেই কক্ষ । এখানেই তাঁর গোপন গবেষণাটি অত্যন্ত যত্নে লালিত হচ্ছে । এখানকার হদিশ দেবতারাও পায়নি । এত দিনের যুদ্ধে দেবতারা পরাজয়ের গ্লানিতে ডুবেছে , কেননা শুক্রাচার্যের এই অদ্ভুত রসায়ন বিজ্ঞানের খোঁজ তারা পায়নি !
শুক্রাচার্য হেঁটে চলেছে । সদ্য ভিজে থাকা অরণ্যচারী বনস্পতির পাতায় পা ঘষে গেলেও , শব্দ হয়না । এই অভয় অরণ্য সে নিজের হাতে প্রতিষ্ঠা করেছে । দেবতারা বহুবার দখল করতে চেয়েছিল । অসুরদের প্রতিরোধে তারা ব্যর্থ । পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবার জন্য , পশু , পাখি , সরীসৃপ , পতঙ্গদের সংরক্ষণ করতে হবে । এখানে পশু - পাখি শিকার নিষিদ্ধ । প্রতি মাসে সে নিজে আসে , গবেষণার জন্য । এই গবেষনা এতটাই রহস্যময় আর গোপন যে , রাজা বৃষপর্বা , আর দেবযানী ছাড়া কেউ জানেনা । এই গোপন গুহায় শুক্রাচার্যের অবর্তমানে তাঁর কয়েকজন অনুচর পাহারা দেয় ।
জলাশয়ের কাছে আসতেই , শুক্রাচার্য চমকে উঠল ! আরে সামনে অর্ধমৃত এক মানুষ ! এখনো প্রাণ অবশিষ্ট আছে হয়ত ! উপুড় হয়ে , মাটিতে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে । এই দুর্ভেদ্য অভয় অরণ্যে , জলাশয়ের কাছে , এমন অবস্থায় কেন ? সে দেহটির পাশে এসে বসল , হাত দিয়ে মুখটি দেখতেই , শুক্রাচার্যের গোটা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল ! সামনে যে আছে , ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । আশ্রমে থাকা সেই যুবকটি ।
সে এমন অবস্থায় কেন ? এই অভয় অরন্যে প্রবেশের সঠিক পথ আছে , কাছের মানুষ ছাড়া কেউ জানেনা । এই ছেলেটি সেই পথ দিয়ে , জলাশয়ের নিকট পৌঁছে গিয়েছে ! এই রহস্যের সমাধান চাই । তার আগে গোপন গুহা কক্ষে নিয়ে যেতে হবে । চিকিৎসা করতে হবে । নতুবা বাঁচানো যাবে না ।
৩
-তাঁর মানে তোমার নাম কচ , তুমি দেব গুরু বৃহস্পতির পুত্র !
-আপনি তিন দিন তিন রাত যে সেবা দিয়েছেন । আদর দিয়েছেন । তারই আশ্রয়ে রক্ষা পেয়েছে আমার এই তুচ্ছ প্রাণ । আমি আপনার দাস ।
-রাক্ষস জাতি আর তোমাদের দেবতাদের মধ্যে এখানেই পার্থক্য । খুব সহজেই কর্তব্যের হোম কে নিজের উদারতার বীরত্ব বলে প্রচার করতে থাকো । সেই বীরত্বের জোরেই মানুষকে দাস বানিয়েছ ! কোন মুমূর্ষ রুগীকে প্রাণে বাঁচানো আমার কর্তব্য । নিজের কাজ , দায়িত্ব সম্বন্ধে আমি সজাগ । তাই এতটুকু ভেবে
দেখবে , তোমাকে বাঁচিয়েছি মরণাপন্ন রুগী হিসেবে । হত্যা করব শত্রু পক্ষের গুপ্তচর হিসেবে । এখানে তোমাকে হত্যা করে গুম করে দেব , কেউ জানতেও পারবেনা ।
শুক্রাচার্যের মুখ , সূর্যের আগুনে তেতে থাকা সকালের মতন । সেই তাপ কচের হৃদয়ে শঙ্কা আর ভয়ের উদ্বেগ করছে । মাত্র উনিশটি বসন্ত পেরিয়েছে । আগের দিনই , আঠারো ছাড়িয়ে উনিশে পা । সে জানেনা আগামি মুহূর্ত তার জন্য কিছু উপহার আনবে নাকি ? কেননা অসুরের বিপক্ষ শিবিরের গুপ্তচরকে ছেড়ে দেয় না । তাদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা করেও লাভ নেই । তাছাড়া , সে যে গুপ্তচর এই কথা অনেক আগেই দেবযানী জেনেছে । শুক্রাচার্যের আশ্রম ত্যাগের পরেই , কচ পিছু নিয়েছিল । অভয় অরণ্যে প্রবেশের মুখেই , প্রহরারত অসুরদের চোখে পড়ে যায় । তারা কচকে মেরে ফেলেছে , এমন ভুল বশতই এই জলাশয়ের কাছে ফেলে দিয়ে গিয়েছে । এখানে কুমির আছে । সে অতি যত্নে মৃত মানুষের মাংস খেত । সেই সময়ই শুক্রাচার্য আসে । উদ্ধার করে ।
কচ জানে কুমিরের হাতে , অসুরের হাতে প্রাণ না গেলেও । শুক্রাচার্যের কাছ থেকে বেঁচে পালানোর কোন সম্ভাবনা নেই ।
-কী ভাবছ ?
গম্ভীর গলায় , হুঁশ ফিরল । কচ বলল
-আমি আপনাদের ক্ষতি করতে আসিনি ।
- আমার গবেষণার পদ্ধতি চুরি করবার কাজ টিকে ক্ষতি বলা যায় না , তাই তো ?
- ঠিক , তা বলতে চাইনি ।
- আচ্ছা কচ । তুমি জানও আমার এই গবেষণা কিসের জন্য ।
-অমরত্ব দেওয়া ওষুধ । স্বর্গে আমরা এই নিয়ে খুব আতঙ্ক গ্রস্থ । যুদ্ধে আপনার ওষুধ , মৃত অসুরদের পুনরায় জীবিত করে ।
-হাঃ হাঃ হাঃ ......
শুক্রাচার্যের প্রবল হাসির ধ্বনিতে , মনে হচ্ছে গুহাটাই না ফেটে যায় ! থেমে বলল
-পুত্র , তোমরা দেবতারা মূর্খ । চিরটাকাল রাক্ষস জাতির জ্ঞান চুরি করে , তাদের দাস বানিয়ে রাখতে চাও । দেহ থেকে প্রাণ চলে গেলে , পুনরায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় । আমার ওষুধ প্রায় মরণাপন্ন মানুষের দেহে এমন উত্তেজনা সৃষ্টি করে , যাতে সে বেঁচে ফেরে । শুধু তাই নয় এই ওষুধ সেবনে দিন – রাত নেশাচ্ছন্ন হয়ে সৈনিকরা যুদ্ধ করতে থাকবে । তারা ক্লান্ত হবে , ক্ষুধার্ত হবে , তাও যুদ্ধ করবে। বলতে পারো , যুদ্ধে তাদের সংগ্রহে খাদ্য রশদ না থাকলেও , আমার ওষুধ সেবনে যোদ্ধারা না থেমে যুদ্ধ করে যাবে । এই ওষুধ পরবর্তী সময়ে হয়ত পৃথিবীর মানুষ ব্যবহার করবে । আপাতত দেবতাদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে । তোমাকে আমি এই সব বললাম কেননা , আমি এখনই হত্যা করব । আমি বিশ্বাস ঘাতকটা সহ্য করতে পারিনা ।
- হে গুরুবর , আপনি আমাকে হত্যা করুন । অনুগ্রহ করে বিশ্বাস ঘাতক বলবেন না।
-কেন বলব না ! আমার আশ্রমে আশ্রয়ে থেকে আমাকে আর আমার মেয়েকে প্রতারণা করেছ ।
- হে বিপ্র , আমি আপনাকে নিজের পরিচয় সম্পর্কে অন্ধকারে রেখেছি , এই কথা ঠিক । তবে দেবযানী সব জানে ।
-কী জানে ?
- আমার পরিচয় ।
-মানে ? কচ নিঃসঙ্কোচ হয়ে আমায় বলও ।
-আমি জানি মৃত্যু , গুহার ভিতরেই অপেক্ষমাণ । যদিও আপনার হাত থেকে আমি রেহাই পাব না। আপনি ছেড়ে দিলেও অসুররা আমায় মেরে ফেলবে । তাই যে মারাই যাবে , তার সত্যি বলতে আপত্তি কিসের ? আমার হুঁশ আসবার দিন দশেকের মধ্যেই , এক নির্জন স্থানে দেবযানী আমাকে আর দেবতাদের অনুচরদের দেখে ফেলে ! সে একদিন প্রশ্ন করল । আমার পরিচয় জানতে চাইল । আমি জানতাম , নিজেকে লুকিয়ে লাভ নেই । আমার কাজে আমি সফল হব না। দেবযানীকে বললাম ,সেই দিন রাত্রি বেলা নিজের লোকেদের দ্বারাই আমি আক্রান্ত হয়েছি । আশ্রমে আশ্রয়ের প্রধান কারণ , আপনাদের গোপন ঔষধ তৈরি করবার পদ্ধতিটি চুরি করা । দেবযানী আমার কথা মন দিয়ে শুনল । তাঁর চোখে আমি কোন আলাদা অভিব্যাক্তি খুঁজে পেলাম না । সে শুধু আমাকে এতটুকু আশ্বস্ত করল আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে । শুধু তাই নয় , সে আমাকে অভয় অরণ্যের পথ বলে দেবে । আমার কাজ হবে , আপনার পিছু নিয়ে গোপন গুহা কক্ষের ভিতরে ঢুকে পড়া । ভাগ্যের পরিহাস দেখুন , সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে থাকলেও , আজ শেষ অব্দি পরাজয় হল !
শুক্রাচার্য মুণ্ডিত মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল , চোখ বন্ধ করে । কচ দেখছে , বৃদ্ধের দু’চোখ বেয়ে জলধারা নামছে । এমন বুদ্ধিমান , বীর ব্রাক্ষ্মণকে খুব অসহায় মনে হল । মুহূর্তে সে যেন ভেঙে গিয়েছে । ইন্দ্রের বজ্রাঘাত সহ্য করলেও , নিজের মেয়ের এই বিশ্বাসঘাতকতা মানতে পারছে না।
-আপনি বিশ্বাস করুন , দেবযানী চেয়েছিল দেবতা আর অসুরদের মধ্যে বিরোধ মিটুক । তাই হয়ত , আমাকে এই বিরোধের উৎস কেন্দ্রে পৌঁছিয়ে দিয়েছে !
ধীরে – ধীরে শুক্রাচার্য মাথা তুলল , মৃদু হেসে বলল
-ভালো উপায় বলেছ , শান্তি প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে , নিজের হাতের অস্ত্র শত্রুর হাতে তুলে দিয়ে বলব , যুদ্ধ চাইনা । এটাকে কাপুরুষতা বলে । আমি রাক্ষস জাতিকে সন্ধির পথ দেখাতে পারি , আত্মসমর্পণের নয় ।
-আপনি উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন । আমি বলছি , দেবতাদের থেকে আপনাদের ভয় নেই ।
- ভয় ! ! ওরা অন্যের সম্পদ দখল করবে । ওরা অন্যকে বশ করবে । ওদের ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ মানসিকতার বিরুদ্ধেই আমার লড়াই । আজীবন । আমি শেষ জীবন পর্যন্ত লড়বই । আমার চিতার আগুনেও দেব বিরোধীতা র উত্তাপ । এত সহজে আমি হারতে রাজি নই ।
কচের ফর্সা মুখ আশঙ্কার ঘামে ভিজে গিয়েছে । সে জানে এখান থেকে বেঁচে ফেরা সম্ভব নয় । তার দিকে তাকিয়ে শুক্রাচার্য বলল
-মৃত্যু জীবনের চেয়েও দামী । এত সহজে মুক্তি পাওয়া যাবেনা । আমার মেয়েকে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছ । এতে আমি তোমার দশ দোষ দেখিনা । তুমি তোমার পরিচয় আশ্রয়দাতাকে দিয়েছিলে । তুমি বিশ্বাস ঘাতক নও । আমার মেয়ে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছিলাম , সেই বেইমানী করেছে ! মৃত্যু দণ্ড তোমার প্রাপ্য নয় কচ , দেবযানীর প্রাপ্য ।
- আপনি দেবযানীকে হত্যা করবেন না ।
- এটা ঠিক আমি ওর উপর রেগে আছি । এটাও ঠিক দেবযানী বিশ্বাস ঘাতক । আবার এটাও ঠিক আমার অন্ধ স্নেহ , আমাকে চরম পথ নিতে বাধা দিচ্ছে !
-আমি দেবযানীর প্রতি চিন্তিত ।
-ভালোবাসো ?
- দেখুন , ভালোবাসা এক স্বতঃপ্রণোদিত অনুভূতি । এটা এমন আবেগ , যা না চাইলেও সৃষ্টি হতেই পারে । আমার মনে দেবযানীর প্রতি তেমনই অনুরাগ জন্মেছে। আপনার কাছে আমার স্বীকার করতে অসুবিধা নেই , আমরা আপনার অবর্তমানে , ওঁর ঋতুকালীন নিরাপদ দিন গুলোতে মিলিত হতাম । মেয়েদের রজঃস্রোতের গন্ধের সাথে , সেই প্রথম আমায় পরিচয় করায় । তাঁর ঠোঁটে আমি গরম জলে ফুটন্ত আপেলের স্বাদ পেয়েছি । আমাকে নেশায় আচ্ছাদিত করেছিল ! আমার পীঠে দেবযানীর নখের আঁচড় আছে , দেওয়ালে চিত্রিত মানচিত্রের মতনই শোভা পাচ্ছে ! এত কিছু নিয়েও বলব , আমি দেবযানীকে বিবাহ করতে সম্মত নই । আমাদের দেহ মিলিত হয়েছিল , অনেক আনন্দ মুহূর্ত একসাথে কাটিয়েছি । আমি তাকে এক কণাও ভালবাসতে পারিনি ! এই অপরাধ আমার ।
-অপরাধ !
-পৃথিবীতে ভালবাসতে না পারাটা অপরাধের । দেবযানীর সাথে মিশতে – মিশতে এতটুকু বুঝে গিয়েছি , যুদ্ধ মানুষের মন থেকে কখনই ভালোবাসার অনুভূতিকে মুছে দিতে পারেনা । আমরা কখনই ভালবাসাকে ভুলতে পারব না , যা চেষ্টা করছি , তা হচ্ছে নিজের আবেগকে অস্বীকার করা ।
-তুমি তো দেবযানী কে ভালোবাসো না । ওকে নিয়ে অত চিন্তিত কেন ?
-চিন্তা ভালোবাসার অনেক গুলো উপসর্গের মধ্যে একটি , তবে সেটাই একমাত্র নয়। বিয়ে আমাদের মধ্যে সম্ভব নয় , কোন সামাজিক সম্পর্কও সম্ভব নয় ।
- এর কারণ , দেবযানী তোমার থেকে বয়সে বড় , তাই ?
-আপনি ভালোভাবে জানেন , বয়সে বড় মহিলাকে পত্নী হিসেবে গ্রহণ করবার রীতি এখনো আর্য ভূমিতে প্রচলিত নয় । আমি দেবতাদের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন কাজ করতে পারব না । আমার সাহস নেই । দেবতারা বিবাহ ব্যাপারটিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখে ।
-একজন বয়স্ক মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারো , তার অনুভূতিকে ব্যবহার করে নিজেদের কার্য উদ্ধার করতে পারো । তাকে সমাজের বিপক্ষে গিয়ে স্বীকৃতি দেওয়ার সাহস নেই ! এই তোমাদের বীরত্ব ? যুদ্ধ ক্ষেত্রে যে যুদ্ধ চলে , তা একদিন থেমে যাবেই । রণভূমিতে রক্তের দাগ শুকিয়ে যায় । সমাজে চিরটাকাল ধরে , প্রচলিত স্রোতের বিপক্ষে লড়তে গিয়েও ,রক্ত ঝরছে । সেই দাগ শুকাবেনা । তুমি এতটাই কাপুরুষ , দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধকে ভয় পাচ্ছ । কচ , যে মেয়ে তোমাকে ভালোবেসে , নিজের এত বছরের স্নেহ আর নিরাপত্তার সম্পর্ককে বাজি রাখল, তাকে এই সম্মান দিলে ! দেবতাদের পক্ষেই সম্ভব ।
-আপনি ঠিক বলছেন । বিপ্র আমার দিকটিও ভাবুন । আমি দেবযানীকে ভালোবাসি, সে ভালোবাসা স্বার্থহীন নয় । পৃথিবীতে কোন ভালোবাসাই স্বার্থ ছাড়া হয়না । দেবযানী আর আমার ভালোবাসার মাঝখানে যে স্বার্থ আছে , তা যুদ্ধের রণভূমিতেই সীমাবদ্ধ । যদি মানসিক স্বার্থ জড়িত থাকত আমি অবশ্যই সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে লড়াই করতাম ।
-তোমার প্রতি ভালোবাসা মানসিক স্বার্থযুক্ত । এইরকম অনুভূতিকেও স্বার্থহীন প্রেম বলে । তুমি এখনো নিজেকে দোষী বলবে না ?
-আমি দোষ করেছি গুরুদেব । আপনি ঠিক বলেছেন । আমরা কেউ ই কি নিজেদের দোষ অস্বীকার করতে পারি ?
-মানে ?
-আপনি দেবযানীকে পিতার নিরাপত্তা দিয়েছেন । শিক্ষা দিয়েছেন । তার সাথে কখনোই বন্ধুর মতন মেশেননি । নিজের ব্যক্তিগত রেষারেষি আর যুদ্ধ কেন দেবযানীর জীবনে কঠোর অনুশাসনের শৃঙ্খলে চাপিয়ে দিলেন ! সেই সময় যদি নিজের মেয়ের মনের কথা জানতে চাইতেন । আপনার কাছে সে বলত । আমার মতন অচেনা এক যুবকের কাছে , শুধু একাকীত্ব ভুলবার জন্য আসতে হত না। আপনি জানেন না , দেবযানীকে নাচ – গান শেখাতে গিয়ে আমি বুঝেছি , সে অসহায় । বড্ড একা । তাহলে দৈত্য গুরু শুক্রাচার্য , নিজের দায়িত্ব পালন করেন নি । তাই দেবযানীর এই অবস্থার জন্য , আমাকে এই পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য , নিজের দোষটি অস্বীকার করবেন না , আশা করি । আপনি জ্ঞানী , বেদজ্ঞ , ন্যায়পরায়ণ , আর সহনশীল । আমি জানি আপনি সত্যিকে অস্বীকার করেন না।
দু’জনেই চুপ করে থাকল । কচ মাথা নিচু করে আছে । শুক্রাচার্য বলল
-আমি আশা রাখছি , তুমি দেবযানীর সামনে নিজের অপারগতা স্বীকার করবে । আমি তোমায় প্রাণ ভিক্ষা দিলাম । দেবতাদের বলে দিও , অসুর গুরু শুক্রাচার্য কোন ভাবেই দেবতাদের বশ্যতা মেনে নেবে না।
৪
এখন সন্ধ্যা । কিছুক্ষণ আগেই দাসী কক্ষে আলোদানি দিয়ে গিয়েছে । সেই আলোয় , কক্ষটি সেজে উঠেছে ! যযাতি নিজের শয়ন কক্ষের ভিতর , নরম গদির উপর চিত হয়ে শুয়ে, কপালে এক হাত রেখেছে , আরেক হাত চোখের উপর রেখে , শুক্রাচার্যের কাছ থেকে শুনে নেওয়া গল্প গুলো ভাবছে । আজ সারাদিন সে শুক্রাচার্যের কাছে ছিল। দেবযানীর প্রাক্তন প্রেমের কথাও সে জেনে গিয়েছে । এতক্ষণে বুঝতে অসুবিধা হল না , শুক্রাচার্য নিজে থেকেই শর্মিষ্ঠাকে যযাতির সংসারে পাঠিয়েছিল , দেবযানীকে নজরে রাখবার জন্য । এক সময় নিজের মেয়েকে গোপনে হত্যাও করতে চেয়েছিল । দেবযানী বিপদজনক , এই মুহূর্তে অসুরদের জন্য । আমৃত্যু পর্যন্ত , দেবযানী দোষী ।
কচ বুঝতে পেরেছে , শুক্রাচার্য ছোটবেলা থেকেই দেবযানীকে যথেষ্ট স্নেহে লালিত করেছে , কন্যার সাথে যে বয়সে বন্ধুত্ব হয়ে উঠতে হয় , সে ছিল রুক্ষ কর্তব্যপরায়ণ পিতা । দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে , তাঁর জীবনের অর্ধেক অনুভূতি নষ্ট হয়ে গিয়েছে । এই সুযোগের ব্যবহার করে ফেলল কচ ! দেবযানী তাকে সব কিছু দিয়েই ভালোবেসে ছিল , অথচ সে হয়ত দেবযানীকে পুরোপুরি ভালবাসতে পারেনি! দেবতাদের কাছেও সে বিপদ জনক ।
যযাতি ভাবল , কিন্তু আজকের পরেও কি সে দেবযানীকে আগের মতন বিশ্বাস করতে পারবে ? সে নিজে একাধিক নারী সঙ্গে অভ্যস্থ হলেও , দেবযানীর একজন পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ মেনে নিতে পারছে না ।পারবেও না ।
কচ , শুক্রাচার্য , যযাতি -- নিজেদের দায়ী করল না। তারা নিজেদের অক্ষমতাকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছে , যুদ্ধরীতি বা জীবন রীতির দোহাই দিয়ে । শুধু দেবযানীই ভারতীয় সমাজে বিশ্বাসের যোগ্য নয় । তার দোষ অনেক ।
সে ভালবেসেছে , একাকীত্ব থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছে , নিজের অবস্থানের জন্য পরিণামের চিন্তা না করে নির্ভরযোগ্য যোদ্ধা হয়েছে ।
সুচিন্তিত মতামত দিন