আমাদের পড়া বা জানা মাইথোলজির হাতে গোনা কয়েকটি নারী চরিত্রের নাম নিয়েই আজকের লেখা শুরু করা যাক। যেমন, গ্রীক মাইথোলজির দেবতাদের রাণী হেরা, ক্রীটের রাজা মিনোসের মা, ইউরোপা ,স্পার্টার রাণী লিডা, রোমান মাইথোলজির লুক্রেশিয়া, শেষ রোমান সম্রাট লুসিয়াস টারক্রোনেশিয়াসের স্ত্রী, এথেন্সের রাজা প্যান্ডিয়ন (প্রথম)- এর ছোট মেয়ে ফিলোমেলা, নর মাইথোলজির রুথেনিয়ান রাজকন্যা, দেব বালদরের মা রিন্ডা বা রেন্ডারা, রুশ মাইথোলজির স্ক্যান্ডানাভিয়ান রাজকন্যা রোগনেড, হিব্রু বাইবেলের রাজা ডেভিডের ছোট মেয়ে তামির, কিম্বা ধরুন আমাদের দেশেরই মহাভারতের কাশীরাজের দুই মেয়ে অম্বিকা, অম্বালিকা, মহর্ষি গলবের স্ত্রী মাধবী। নামগুলো অপরিচিত নয় অবশ্যই, কিন্তু, বলতে পারেন এদের মধ্যে ক্ষীণ যোগসূত্রটি কোথায়? যোগসূত্রটি হল, এরা প্রত্যেকেই পরিচিত বা অপরিচিত পুরুষদের কাছে এক বা একাধিকবার ধর্ষিতা হয়েছেন।এদের মত আরো অসংখ্য নারীচরিত্র লুকিয়ে আছে ভারতীয় গল্পে, মহাভারতের গল্পে, পৃথিবীজোড়া দেবতা ও দেবপুরুষের গল্পে, পৃথিবীর যাবতীয় অসহায় নারীর নারীত্বের অবমাননার গল্পে ।
যুগেযুগে নারী দেবী, নারী সেবাদাসী। পুরুষের চাহিদার সাথে তাল রেখে খোলস বদলায় নারীর প্রজাপতি জীবন। নারীর এই অবস্থানের সময়ের সাথে ক্রমশ আরো অবনতি হয়েছে। সত্যি বলতে কি, মানুষের ইতিহাসে আজও আমরা মেয়েরা বিশ্বের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, কী স্বদেশে, কী বিদেশে। নারীদের এগিয়ে চলার পথে ধর্ষণ হল সবচেয়ে সাধারন সমস্যা। যা খুব সহজেই একটি মেয়েকে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুমড়ে মুচড়ে বিকলাঙ্গ করে দিতে পারে। ধর্ষণ কেন করা হয়? শারীরিক আনন্দের জন্য, প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, কিংবা শুধু মাত্র বিকৃত সুখ লাভ করার জন্য । ধর্ষণ এক ধরনের যৌন নির্যাতন।মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধিও। উন্নত থেকে উন্নতশীল দেশে, হতদরিদ্র দেশে গরিব, মধ্যবিত্ত এমনকি বিত্তশালী সমাজেও মেয়েশিশু ও নারীরাই সাধারণত ধর্ষণের শিকার হন।ব্যতিক্রমও যে হয়না, তা নয়।
সাধারণত ধর্ষণকাজে দুজন মানুষ জড়িত, ধর্ষক (পুরুষ) এবং ধর্ষিতা (নারী), অভিধানে নারী পুরুষ উভয়েই মানুষ কিন্তু আমাদের সমাজের চোখে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ শব্দটি পুরুষের নামান্তরমাত্র। তবে কি নারী কি মানুষ নয়? প্রশ্ন উঠলেই তাত্বিক বোদ্ধার দল কাগজে-কলমে অনেক হিসাবনিকাশ করে দেখিয়ে দেবেন, না নারী শুধু নারীই, মানুষ নয়, সেতো চিরকালীন ভোগ্যপণ্য । শারীরি যৌনতার মূর্ত প্রতিভূ নারী। সমাজের সর্বত্র আজও নারী যৌন লাঞ্ছনা, যৌন নির্যাতন , যৌন লালসার শিকার। শিশুকন্যা থেকে শিশুর মা, কেউ এর আওতার বাইরে নেই। অসূর্যস্পশ্যা মহাভারতীর যুগ থেকে আজ সূর্যস্পশ্যা একবিংশ শতকের নারী, সময় বদলালেও অবস্থান বদলেছে কি? পরিস্কার উত্তর, ‘না’।
ধর্ষণ নিয়ে মাঝে মাঝে লিখতে ইচ্ছে করে। প্রতিবাদে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিভাবে? দু-চার পাতা লিখে ? কি হবে লিখে? পত্রিকার দরকার খবর, টিভির দরকার হট কেক নিউজ। ধর্ষকের শাস্তি ঠিক মতো হলো কিনা, এটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথাই থাকে না। মাঝেমাঝে মনে হয় ধর্ষণ নিয়ে লিখে আসলে আমরা ধর্ষিতাদের ব্যাঙ্গই করি। মনে পড়ছে, ২০১২ সালের দিল্লীতে মেডিকেলছাত্রী নির্ভয়ার ধর্ষণের মাত্র ১২ দিন আগে ভারতের পার্লামেন্টে “বিয়ের পর কোনো পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না” শীর্ষক একটি বিল আনার কথা মনে আছে? যে দেশে আইন করে ধর্ষণকে বৈধ করা হয় সে দেশে কেন ধর্ষকরা শাস্তির ভয় পাবে? ধর্ষণ ছাড়াও নারী নিগ্রহের অভিযোগ রয়েছে—ভারতে এমন ২৬০ ব্যক্তিকে নির্বাচনের টিকিট দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো!! যে দেশে ধর্ষকরা এমপি হতে পারে,যে দেশের সংসদ অধিবেশন চলাকালে এমপি’রা মোবাইলে পর্ণ দেখেন সে দেশে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি টা কেমন তা কি আর বলে দেওয়া লাগবে?
যাই হোক, এবার না হয় খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখি।
(১) ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৭: স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পরে মেয়ের পোশাক ছাড়াতে গিয়ে মা দেখেন, ইউনিফর্মে রক্তের দাগ। ভয়ার্ত মুখে চার বছরের শিশুটি জানায়, তার গোপনাঙ্গে যন্ত্রণা হচ্ছে। চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান, যৌন নির্যাতনের শিকার ওই একরত্তি মেয়েটি। দক্ষিণ শহরতলির বেসরকারি স্কুল জিডি বিড়লা সেন্টার ফর এডুকেশনে ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার। পরেরদিন রাতে ‘পকসো’ আইনে গ্রেফতার করা হয় শারীরশিক্ষার দুই শিক্ষক অভিষেক রায় এবং মহম্মদ মফিসউদ্দিনকে।
(২) ২৩ নভেম্বর ২০১৭: দিল্লিতে সাড়ে ৪ বছর বয়সী এক শিশুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠেছে। গত শুক্রবার ফাঁকা ক্লাসরুম ও টয়লেটে নিয়ে গিয়ে সমবয়সী মেয়েটিকে ধর্ষণ করে ওই ছেলেটি। পরে বাড়িতে ফিরে মেয়েটা যন্ত্রণায় কাঁদতে থাকে। কারণ জানতে চাইতে সে তার মাকে জানায় ছেলেটি তার গোপণাঙ্গে আঙ্গুল ও ধারালো পেন্সিল ঢুকিয়ে দিয়োছিলো। এতে মেয়েটির গোপণাঙ্গে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানা যায়।
(৩) ২৩শে অক্টোবর, ২০১৭: মানুষের বিবেক আজ কোথায় নেমেছে, তা আসলে বর্ণনা দিয়ে প্রকাশ করা হয়তো আসলেই আমাদের সম্ভব না। কিন্তু তাই বলে ১১ মাসের শিশুকে ধর্ষণ! হ্যাঁ এমনটাই ঘটেছে পশ্চিম দিল্লির বিকাশপুরীতে।
(৪) ২৩শে অক্টোবর, ২০১৭: অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে প্রকাশ্য দিনের আলোয় এক নারীকে ধর্ষণ করলো মদ্যপ যুবক। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, দ্রুত ওই তরুণীর উপরে চড়াও হয়ে তাকে ধর্ষণ করতে থাকে গাঞ্জি শিভা নামের ওই যুবক। অথচ কেউই আক্রান্ত তরুণীকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি! তবে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া নির্বিকার সকলকে ছাপিয়ে যান এক অটোচালক। তিনি মোবাইলে রেকর্ড করতে থাকেন ধর্ষণের ঘটনা। অথচ কোন ভাবেই ওই তরুণীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেননি তিনি। ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়।
(৫) ১৭ই আগস্ট, ২০১৭: চন্ডিগড়ে ধর্ষণের শিকার ১০ বছর বয়সের কন্যাশিশু সি সেকশন পদ্ধতিতে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। চন্ডীগরের এই ধর্ষিতা শিশুর গর্ভপাত করা নিয়ে দেশের সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞার পর ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছিল দেশ ও বিদেশের গণমাধ্যমে।
(৬) ২৯শে মে, ২০১৭: প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঝগড়া করে আট মাসের শিশুকন্যাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান এক মা। ইচ্ছা ছিল, নিজের বাবা-মায়ের বাসায় গিয়ে উঠার। কিন্তু পথিমধ্যে জোর করে অটোরিকশায় তুলে প্রথমে মায়ের কোল থেকে শিশুটিকে কেড়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে তিন দুর্বৃত্ত। পরে ওই তিনজন ২৩ বছর বয়সী শিশুটির মাকে ধর্ষণ করে। ঘটনাটি হরিয়ানার গুড়গাঁওয়ের।
(৭) ১৯শে মে, ২০১৭: দক্ষিণ দিল্লির সাকেত অঞ্চলে ছয় বছর বয়সী একটি শিশুটি তার সৎবাবার হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে পুলিশ অভিযোগ পেয়েছে। শিশুটিকে দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সে (এআইআইএমএস) ভর্তি করা হয়েছে। শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক।
(৮) ৮ই নভেম্বর, ২০১৬: কোচবিহারে তিন বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে তার প্রতিবেশী দশম শ্রেণির এক ছাত্রের বিরুদ্ধে। রবিবার দুপুরে কোচবিহার কোতোয়ালি থানার টাকাগাছ এলাকায় ওই ঘটনাটি ঘটেছে।
(৯) ১৫ জানুয়ারি, ২০১৬: উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ এলাকায় ছয় বছর বয়সী এক মাতৃহীন মেয়েশিশুকে চার মাস ধরে ধর্ষণ করেছে তারই আপন ঠাকুর্দা, ৬৫ বছরের অরুণ সিনহা। অভিযোগ পাওয়ার পরই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে।
(১০) ১৩ নভেম্বর, ২০১৬: তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী হায়দ্রাবাদে প্রতিবেশীর ৮ বছর ও ১০ বছরের দুই শিশু কন্যাকে অনেক দিন ধরে ধর্ষণের অভিযোগে পিতা-পুত্রকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
(১১) ৭ই ডিসেম্বর, ২০১৫: মাত্র ২৮ দিনের শিশুকে ধর্ষণের মতো নির্মম ঘটনা ঘটেছে উত্তরপ্রদেশের বুলন্দ শহরে। পুলিশ জানায়, শনিবার গ্রাম প্রধান ভোট চলছিল। শিশুটির মা-বাবা পাশের বাড়িতে শিশুটিকে রেখে ভোট দিতে গিয়েছিলেন সেই সময়েই এই ঘটনাটি ঘটে বলে অভিযোগ। শিশুটির রক্তপাত বন্ধ না হওয়ায় তাকে হাসপাতালের ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে। আসিফ নাগলা (২৫) নামে গ্রামেরই এক প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে শিশুটির বাবা-মা।
(১২) ১৪ জানুয়ারি, ২০১৪: মাত্র ৬ বছরের একটি কন্যা শিশুকে একটি কক্ষে আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে ৪০ বছর বয়সী এক নরপশু। বিচারে শিশুটিকে ধর্ষকের আট বছর বয়সী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রামের খাপ পঞ্চায়েত।ঘটনাটি রাজস্থানের।
(১৩) নভেম্বর ৩, ২০১৪: ভারতের মধ্যপ্রদেশে জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে এক উপজাতি নারীকে তাঁর স্বামী, কৈলাস রুমালিয়া, স্বামীর আত্মীয়, গ্রামবাসীসহ ১০ জন মিলে ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। খান্দোয়া জেলার ভিয়ালিখেদা গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছে।
(১৪) ১২ই মে ২০১৩: তামিলনাড়ুর মালিয়াকারির গোপালাপুরামে একাই থাকতেন ৮০ বছরের এক বৃদ্ধা।বিকৃতকাম সব্জিবিক্রেতা ৪১ বছরের পালানিভেল সব্জি বেচার ছলে জোর করে ঘরে ঢুকে আসে এবং বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করে।
আর কত বলব। এতো বালুচর থেকে কুড়িয়ে আনা গুটিকয়েক নুড়িপাথর। পড়তে পড়তে চোখের জল শুকিয়ে যায়। দাউদাউ করে জ্বলে ঘেণ্ণা আর রাগের আগুন। ২০১৬ সালে ভারতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৯ হাজার ৬৮টি। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে ,প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ভারতে ৬ বছরের কম বয়সী শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫২০টি। ৬ থেকে ১২ বছরের ১ হাজার ৫৯৬, ১২ থেকে ১৬ বছরের ৬ হাজার ৯১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৮ হাজার ৬৫৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১৬ হাজার ৪৬২, ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ৫ হাজার ১৯২, ৪৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৪৯৪ আর ৬০–এর বেশি বয়সী ৫৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ধর্ষণের শিকার ৪৩ দশমিক ২ শতাংশই নাবালিকা ও ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের বেশি।
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১১০টি। এর মধ্যে ৮০৪ জনের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর, ২৬৮ জনের বয়স ৩০ থেকে ৪৫ বছর, আর ৩৮ জনের বয়স ৪৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে।তবে পশ্চিমবঙ্গে গত বছর কোনো নাবালিকা ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি বলে এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মহিলা কমিশনের চেয়ারপারসন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়।
ধর্ষণ শব্দটাই বিষ, যণ্ত্রণাদায়ক। বিশেষত শিশুধর্ষণ, কেননা, অধিকাংশ শিশুই ধর্ষণকালে শারীরিক ও মানসিকভাবে পুর্ণগঠিত থাকে না যে। আসলে, শিশুকন্যা, শিশুপুত্র, বৃদ্ধা মহিলা, এঁরা বড্ড সফট টার্গেট। বিকৃতকাম মানুষরা বয়স দ্যাখেনা, তারা শুধু যৌনাঙ্গ খোঁজে, তাদের বাসনা তৃপ্তির জন্য। এদের অমানবিকতা প্রসঙ্গে যাওয়ার জন্য এই লেখা আজ নয়। আজকের আলোচ্য শিশু নির্যাতন ।
১৯শে আগস্ট ২০১৭ , ধর্ষণ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বিবিসি থেকে জানানো হয়,ভারতে প্রতি ১৫৫ মিনিটে ১৬ বছরের কম বয়সী একটি শিশু ধর্ষিত হয়, প্রতি ১৩ ঘন্টায় ধর্ষিত হয় দশ বছরের কম বয়সী একটি শিশু। শুধু তাই নয়,সেখানে বলা হয়, ভারতে ২৪ কোটি নারীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। কেবল ২০১৫ সালে ভারতে ধর্ষিত হয় দশ হাজারের বেশি শিশু। ভারত সরকারের এক জরিপে অংশ নেয়া ৫৩.২২ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা কোনো না কোনো ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা শিশুদের পূর্বপরিচিত বা এমন কেউ যাদের তারা বিশ্বাস করত। প্রসঙ্গত বলি ১৮ জুন ২০১৩ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে “একটা ছোট্ট হিসেব দিই। বছর পাঁচেক আগে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল ভারত সরকারের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ১৩ হাজার শিশুর সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখা গিয়েছিল, এদের মধ্যে ২১ শতাংশ শিশু কোনও না কোনও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। বাড়ির বা পাড়ার কাকা, জেঠা, দাদু, মামা স্থানীয়ের হাতে নির্যাতিত শিশুর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তার পরেই রয়েছে পরিবারের কোনও তুতো দাদার হাতে যৌন হেনস্থার ঘটনা। এর মধ্যে ধর্ষণ থেকে শুরু করে পায়ুসঙ্গম, যৌনাঙ্গে হাত, নগ্ন করে ছবি তোলা, সব কিছু রয়েছে। দুই থেকে দশ বছর বয়সিদের অত্যাচারিত হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এবং ছোট মেয়েদের থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে বাচ্চা ছেলেরা। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র সমীক্ষা বলছে, ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ভারতে শিশু-ধর্ষণের মোট ৪৮৩৩৮টি কেস নথিভুক্ত হয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, আরও কয়েক হাজার কেস অগোচরে থেকে গিয়েছে।
দিল্লিভিত্তিক এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের এক পরিসংখ্যানের উল্লেখ করে ‘ইন্ডিয়া টুডে’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে ধর্ষণের শিকার প্রতি তিনজনে একজন শিশু। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শিশু ধর্ষণের হার ৩৩৬ শতাংশ বেড়েছে। এই এক দশকে ৪৮ হাজার ৩৩৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ভারতের জাতীয় অপরাধ নথি ব্যুরোর তথ্যমতে, মধ্যপ্রদেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। এরপর রয়েছে মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ ও দিল্লি।
ধর্ষকদের টার্গেট শিশু ও কিশোরী। ২ বছর কিংবা ৫ বছরের শিশুও ধর্ষকের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। যে বয়সে তারা পুতুল খেলে, ধর্ষণ কী তা-ও জানে না, বোঝার মনমানসিকতাও গড়ে ওঠেনি, সে বয়সেই তাকে ধর্ষিত হতে হচ্ছে।শিশুদের ওপর যারা অত্যাচার করে তারা অসুস্থ, Pedophilic । একটা পুঁচকে শিশু যার জেনিটলিয়াও ঠিক করে গঠন হয়না তাকে কেন সফট টার্গেট বানানো হয় জানেন? অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সের শিশু ও কিশোর মনোরোগ বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক মঞ্জু মেহতা, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জিতেন্দ্র নাগপাল, চেন্নাইয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুদের নিয়ে কাজ করা তুলির সেন্টারের পরিচালক বিদ্যা রেড্ডি, হিউমান রাইটস ওয়াচের মুখপাত্র মীনাক্ষি গাঙ্গুলি, ডয়চে ভেলে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের সমাজবিজ্ঞানী বুদ্ধদেব ঘোষ, দিল্লির ফোর্টিস হেল্থকেয়ার হাসপাতালের মনোরোগ ও ব্যবহারিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ডা. সমীর পারিখ বা দিল্লি পুলিশের মহিলা ও শিশু রক্ষা দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি কমিশনার সুমন নালওয়া, এনাদের মতে,
(১) বাচ্চারা টিপিকালি চট করে বড়দের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে স্বস্তি পায় না। বড় মাত্রেই বেশী জানে, বাচ্চারা বড়দের বাধ্য হবে এই শিক্ষা দিই যে আমরা। আর কোন বাচ্চা স্বভাব লাজুক, কাদের ভয় দেখানো সহজ সেটা বুঝেই হাত বাড়ায় এরা।
(২) যদি বা বাচ্চাটা বলেও কিছু, জোর গলায় অস্বীকার করলেই হবে। আমরা বাচ্চাদের কথায় বিশ্বাস করতে চাই না, যদি সে কথা আমাদের নিজেদের পক্ষে অস্বস্তিজনক হয়।
(৩) চলে যাবার পর বাচ্চাটা বলে দিলেও চাপ নেই, নিজের বাড়ির বাচ্চার সাথে কিছু হয়েছে এটা জানাতে লোকে লজ্জা পায়, চেপে যায়। কাজেই কিছুই হবে না।
(৪) শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বলে তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি। পাশাপাশি ধারণা করা হয়, এরা অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারবে না।
(৫) পেডোফিলিয়া নামের মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ থাকে। কিছু ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের এটিও একটি কারণ।
(৬) শিশু নির্য্যাতনের পেছনে মানুষের মূল্যবোধ-নৈতিকতার অবক্ষয়, পর্নোগ্রাফি, মাদকের প্রভাবও রয়েছে।
(৭) শিশুরা সব সময় ঘটনার কথা বলতে পারে না, সাক্ষীও থাকে না। মামলা দুর্বল হয়।
(৮) টেলিভিশনের অশ্লীল ছবি, মোবাইল ফোনে আপলোড করা ব্লু ফিল্ম দেখে দেখে রিরংসাজারিত ধর্ষকামীরা মেয়ে শিশু ও নারীদেরকে নির্যাতন , এমন কি, ধর্ষণ করতে অবধি প্রলুব্ধ হয়।
(৯) ধর্ষণের অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক চরম শাস্তি না পাওয়ায়ও ধর্ষকামীরা ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটাচ্ছে।
তবে শিশুকে লোভনীয় পণ্য কিন্তু আমরাই বানাই, দোষী আমরাও। কিভাবে? কঠোর কথা শুনতে খারাপ লাগবে। তাও বলি,
(১) প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যৌন-আবেদন-মূলক যেসব পোষাক হয় (ব্যাকলেস চোলি- লেহেঙ্গা,ক্রপ টপ- হট প্যান্ট) সেগুলো পরিয়ে কেন বাচ্চাদের টিভি শোয়ে, লাইভে, মঞ্চে নাচতে পাঠানো হয়? কেন তাদের চোখ টিপতে, বিলোল কটাক্ষ করতে শেখানো হয়? কেন আমাদের বাচ্চারা স্কুলের প্রোগ্রামে আর পাড়ার ফাংশানে "শীলা কি জওয়ানি"র সাথে নাচলে আমরা তা স্মার্ট ফোনে রেকর্ড করে প্রভূত আনন্দ পাই ?
(২) কেন সব চেয়ে দাম বেশি চাইল্ড পর্ন আর রেপ পর্নের? চাইল্ড পর্ন হলে তো পলকে লক্ষ-ডলার-হাতফেরতা হয়। মনে পড়ছে শুলামিথ ফায়ারস্টোনের বিখ্যাত উক্তি? “পর্ণোগ্রাফি হল ধর্ষণের আগের ধাপ”।
(৩) বাচ্চা টিউশন যাবে, স্কুল দুরে, বাবা মা নিজেদের কাজে ব্যস্ত, বাচ্চার হাতে যোগাযোগের মাধ্যম, সময় কাটানোর সাধন হিসাবে তুলে দিই মোবাইল, ল্যপটপ…আমাদের বাচ্চারা লুকিয়ে চুরিয়ে নুন শোয়ে গিয়ে,লাস্ট বেঞ্চে বসে বটতলার বই পড়ে বা “রহস্য- রোমাঞ্চ”, “ডেবোনিয়ারে”র মত ম্যাগাজিনের পাতা উলটে যৌনতা চেনে না, মোবাইলের বাটন টিপলেই তা তার হাতের মুঠোয়। কিন্তু সেখানে তাকে কেউ শেখায়না যে অনিচ্ছায় কাউকে ছোঁয়া অপরাধ।বরঞ্চ ঐসব সাইটে জোর করে দলে মুচড়ে যৌনসংসর্গই শেখানো হয়। তাই বোধ আসতে না আসতেই বাচ্চাকে গুড টাচ, ব্যাড টাচ, শব্দবন্ধদুটি শেখান।
(৪) মিম তো এখন ব্রান্ডেড পত্রিকার পাতায়, সহজলভ্য ওয়েবসাইটে। কিন্তু কেউ বলে না যে শিশুকে নিয়ে যৌনগন্ধী মিম বানানো অপরাধ। কারণ এসব অসভ্য কথা আমাদের সমাজে বাবা মায়ের বলার নিয়ম নেই।যৌনতা আছে, যৌনশিক্ষা নেই।
(৫) আমাদের ভার্চ্যুয়াল ওর্য়াল্ডেও একটা স্যোস্যাল লাইফ আছে, আছে ফেসবুক, টুইটার,হোয়াটস এপ, শেয়ার এন বুল, হাইক, ফ্রপার ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে কে কোন ধরনের মানসিকতা পোষণ করছেন তা কিন্তু সবসময় বাচ্চার নজরে লুকানো থাকছেনা। তারা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি ‘নেট-স্যাভি’। নোংরা পেজ, নোংরা গ্রুপ, নোংরা মানুষ, নোংরা সঙ্গ, আপনার নিজের ব্যবহার বাচ্চার ওপরও ছাপ ফেলবে। বাচ্চারা কিন্তু আপনার ব্যবহার দেখে দেখেই শেখে। যিনি বউয়ের “চরিত্র সংরক্ষণ সমিতি” চালান কি বউ পেটান,বরের চোখের আড়ালে যিনি অন্যরকমের জীবনযাপন করেন, যিনি সুযোগ পেলেই "মেয়ে তোলেন" কি “ছেলে পটান”, নিশ্চিন্ত থাকুন আপনার সন্তানের চরিত্রও সেভাবেই তৈরী হচ্ছে।
(৬) সবচেয়ে বড় সমস্যা কোথায় জানেন, আমরা নিজেরা নিজেদের সমস্যাগুলো বলতে শেখাতেই পারিনা বাচ্চাদের। বাচ্চার সাথে কিছু হলে, স্কুল পালটে ফেলি, টিউশন মাস্টার পালটে ফেলি, আত্মীয়রা নোংরামি করলে বাচ্চাকে কাছে ঘেঁষতে দেই না। জোরগলায় বলতে পারিনা ওই লোকটা একটা জানোয়ার, আমার বাচ্চার সাথে এরকম করেছে, বাচ্চার ভবিষ্যতের থেকেও কি আপনার আমার সামাজিক সম্মান বেশি দামি?
এই সমস্যার সমাধান কী জানি না, তবে বেশ ক'বছর আগে আমীর খান একটা অনুষ্ঠান করতেন, "সত্যমেব জয়তে"। তার একটি পর্বের বিষয়বস্তু ছিল 'চাইল্ড অ্যাবিউজ'। কিছু মানুষ তাঁদের ছোটোবেলার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা সর্বজনসমক্ষে জানিয়েছিলেন, অন্যদের সতর্ক করেছিলেন। আমীর কয়েকজন শিশুকে নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করে বুঝিয়েছিলেন কাকে বলে 'গুড টাচ', কোনটা 'ব্যাড টাচ'। আজকের দিনে ওই অনুষ্ঠানটাগুলোর রিপিট টেলিকাস্ট হলে মন্দ হত না। যা বলছিলাম।
(১) প্রথমেই বলি মা বাবাদের, অল্প চেনা বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী এমনকি আত্মীয়দের হাতেও নিজের শিশু সন্তানকে ছাড়বেন না। খুব কাছের আত্মীয়র সাথে ছাড়লেও তাঁদের সাবধান করে দেবেন যেন অন্য কারোর হাতে বাচ্ছাকে না দেন।
(২) শিশুর জামাকাপড় বদলানো, স্নান করানো, এগুলো নিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে ছোটো থেকেই প্রাইভেসীর সেন্সটা তৈরী করুন।
(৩) কিছু বয়স্ক/ বয়স্কাদের বাচ্চা দেখলেই
- 'বাবু, তোমার পুদুম কোনটা?'
- 'সুইটি, সো মি ইওর বাম! '
- ‘সোনা, তোমার হিসুটা দেখাও তো’
এই সব আদি রসাত্মক মস্করাতে শুরুতেই বাধা দেবেন। আপনার শিশু অন্যের মনোরঞ্জনের বস্তু নয়।
(৪) যাঁরা বাবা মা দুজনেই চাকরি করেন তাঁরা বাধ্য হন শিশুকে কোনো আয়ার কাছে রেখে যেতে, তাঁদের বলি, না জানিয়ে হঠাৎ বাড়িতে আসুন, জানান না দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখুন আয়া বাচ্চার সিক দেখভাল করছে কি না। ঘরে পারলে লুকানো ক্যামেরা বসান। পাড়ার বা ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দাদেরও সজাগ রাখুন এবং নিজেদের ফোন নাম্বার দিয়ে রাখুন।
(৫) অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা হলে সিকিউরিটি আর কেয়ারটেকার সম্পর্কে ভালো করে সব তথ্য ভেরিফাই করে তবেই নিয়োগ করবেন।এদের ঘরে হুটহাট ঢোকা একদম এলাও করবেননা।
(৬) বাচ্চাদের স্কুল পাঠান স্কুল বাসে, অথবা নিজে নিয়ে যান। অথবা আশেপাশের ক'জন অভিভাবক মিলে পুল কার সিস্টেম করুন, পালা করে এক একজন অভিভাবক সঙ্গে থাকুন। কারণ, 'ডেসপারেট টাইমস কল ফর ডেসপারেট মেজারস'।
(৭) মোটামুটি একটু বোঝার বয়স হলে, ফোনে মা বাবার নাম্বার ডায়াল করা শেখানোর সাথেসাথেই পুলিশ হেল্পলাইন নাম্বার ১০০ বা চাইল্ড হেল্পলাইন নাম্বার ১০৯৮ ডায়াল করাটা শেখান শিশুকে।
(৮) বাচ্চাকে ‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’ শেখান, বোঝান। ‘নো টাচ’ শেখাতে পারলে তো আরো ভালো।
(৯) লজ্জা সঙ্কোচ এসব ভুলে বন্ধু হয়ে উঠুন নিজের সন্তানের। দিনভর যত ব্যস্ততাই থাকুক, আগ্রহভরে শুনুন ওর কথা। স্কুলের কথা, টিউশন বা এক্সট্রা ক্যারিকুলার এক্টিভিটি ক্লাসের বন্ধুদের কথা, ওর নিজস্ব অনুভব, পছন্দ অপছন্দের কথা শুনুন। সরলভাবে আলোচনা করুন। বিশ্বাস অর্জন করুন ওর। তবেই কিন্তু ও ওর সিক্রেটগুলো আপনার সাথে শেয়ার করবে।
(১০) বাচ্চার বন্ধুবান্ধব, গতিপ্রকৃতির প্রতি সতর্ক থাকবেন তবে সবসময় িকটিক করবেন না বা নিজের মতমত পছন্দ অপছন্দ ওর ওপর চাপাতে যাবেন না। খেয়াল রাখবেন ওর মধ্যে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন আসছে কি না। যেমন ধরুন খুব দুরন্ত ছেলে হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল, বা ধরুন যে ছেলে ম্যাথ স্যারের টিউশন কামাই করত না সে হঠাৎ ম্যাথ টিউশনের নামে শিঁটিয়ে যাচ্ছে কেন? নাচের কলাসে যাবার নামে যে মেয়ে লাফ দিয়ে উঠত, সে হঠাৎ না যাবার হাজার অজুহাত বানাচ্ছে কেন? বিশেষ কোনো মানুষকে আপনার বাচ্চা অ্যাভয়েড করার চেষ্টা করছে কি না। এরকম দেখলে, কথা বলুন বাচ্চার সাথে। দরকারে চাইল্ড সাইক্রিয়াটিস্টের সাহায্য নিন।
(১১) যদি জানতে পারেন কেউ আপনার সন্তানের সাথে অসভ্য অশালীন ব্যবহার করেছে, এগিয়ে আসুন, প্রতিবাদ করুন। লোকাল থানা, চাইল্ড হেল্পলাইন যেখানে মনে হয় সেখানে জানান। ভদ্রবেশী শয়তানের মুখোশ খুলে দিন।
(১২) বাচ্চাকে ভুলেও জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশনের শিকার বানাবেননা।
পরিশেষে একটি তথ্য জানাই, প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর ভারতের আইন সভায় শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্স অ্যাক্ট --- পকসো আইন রূপায়িত হয় , এই আইনটি সার্বিক ভাবে শিশুকেন্দ্রিক , লাঞ্ছিত শিশুর সুরক্ষা , লাঞ্ছিত শিশুর মানসিক স্বস্তি বিধান , শিশুকেন্দ্রিক বিচার প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন রূপরেখা পরিষ্কার করে বলা আছে৷ পকসো আইন অনুযায়ী কোনও অবস্থাতেই লাঞ্ছিত শিশু , অভিযুক্তের মুখোমুখি হবে না৷ বিচার প্রক্রিয়া চলবে বিশেষ আদালত অর্থাত্ স্পেশাল কোর্টে৷ ২৬ অক্টোবর ২০১৫ ,শিশুধর্ষণ রুখতে ধর্ষকদের অণ্ডকোষ কেটে শাস্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করে মাদ্রাজ হাইকোর্ট ৷ রায়দানের সময় বিচারপতি এন কিরুবাকরণ বলেছিলেন, ‘‘আইন থাকলেও পার পেয়ে যাচ্ছে শিশু ধর্ষণকারীরা৷ অণ্ডকোষ কাটার সুপারিশ নির্মম মনে হলেও, জঘন্যতম অপরাধ রোখার জন্য নিষ্ঠুর হতেই হবে৷’’ এতো গেল না হয় দুবছরের পুরোনো তথ্য, সম্প্রতি শিশুধর্ষণের বিরুদ্ধে, এই বছর নভেম্বরেই ঐতিহাসিক একটি আইন পাস করেছে মধ্যপ্রদেশ সরকার। যাতে বলা হয়েছে ১২ বছর বা তার থেকে কম বয়সী মেয়েদের ধর্ষণ করলে ফাঁসির সাজা দেওয়া হবে অপরাধীকে। ১২ বছর বা তার কমবয়সী মেয়েদের ধর্ষণে ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, গণধর্ষণের সাজা হবে ২০ বছরের কারাদণ্ড। শুধু ধর্ষণই নয়, মেয়েদের উত্যক্ত করা, ধাওয়া করা এমনকী বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাসের জন্যও কড়া সাজার বিধান দেওয়া হয়েছে বিলে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন মিললেই বিলটিকে আইনে পরিণত করা হবে ।
আজ লিখতে গিয়ে কেন জানিনা মনে পড়ছে ‘আ টাইম টু কিল’ সিনেমাটির কথা। একটি কৃষ্ণাঙ্গ নাবালিকার উপর বলাৎকার চালিয়ে পঙ্গু করে দিয়েছিল কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ নরপিশাচ। তারা ধরা পড়ে৷ কিন্তু মেয়েটির বাবা গোপনে একটি আগ্নেয়াস্ত্র জোগাড় করেন এবং ওই নরপিশাচদের যেদিন কোর্টরুমে পুলিশ নিয়ে আসে, সেদিনই গুলি চালিয়ে তাদের মধ্যে দু’জনকে খতম করে দেন৷ এর পরেই শুরু হয় তাঁর বিচার৷ গিলটি অর নট গিলটি ? এটা সমাধান নয় জানি। দুর্ঘটনা কবে ঘটবে তার অপেক্ষায় থাকবেন না। কারণ ঘটে গেলে তো আপনি টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে গিয়ে ঘটনাটা মুছে ফেলতে পারবেন না। তাই ঘটনা ঘটার আগেই সচেতন হওয়াটা জরুরী। শুধু নিজের পরিবারেই নয়। সতর্ক দৃষ্টি থাকুন আপনার আশেপাশের পরিবারেও। কথায় আছে ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’।
সুচিন্তিত মতামত দিন