গার্গী মালিক

 শ্রীচরণেষু     দাদাবাবু ,
ত্রের প্রথমেই তুমি আমার প্রণাম নিও। গতকাল আমি এসেছি তোমার শহরে ... না ,না , বেড়াতে নয় ... কর্মসূত্রে। অবাক হলে? হবারই তো কথা! সেই অজগ্রাম উলাপুরে টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোয় অনুজ্জ্বল রতন কিনা আজ বিজলীবাতির দেশে! আমি তো আর বারো -তেরো নই ... আমি এখন পঁচিশ … প্রায় একযুগের ব্যবধান , কম কথা? কত ঝড়ঝাপটা! জীবনে আবর্তনের চাকা ঘুরল কত পরিবর্তনে! তবু হার মানেনি রতন ... বলতে দ্বিধা নেই -'তোমার বোন'... তোমার মতে সত্যিই আজ আর কোনো তফাৎ নেই রানীর সাথে আমার।

সেই যে তুমি বুঝিয়েছিলে জীবনে মুক্তির স্বাদ ... তা আজও আমার কাছে অমৃতের আস্বাদ। জ্ঞান হতেই দেখেছি এই পোস্টঅফিসই আমার ঘর ... দাদাবাবুরাই আমার পরিবার ... তাদের সেবাই আমার জীবন - স্নানের জল তোলা , দুবেলা রান্না করা , কাপড় কাচা ... বিনিময়ে খাওয়া -পড়ার সাথে বকুনি -মার উপরি পাওনা। উপরি পাওনা যে স্লেট -পেন্সিল হতে পারে তা প্রথম জেনেছিলাম তোমার কাছে! কী নিরাপদে নির্ভয়ে ছিলাম আমি তোমার কাছে! তাইতো সেদিন নি:সংকোচে গেয়ে উঠেছিলাম "বিজনে কাননে ... " তুমি চমকে উঠেছিলে আমার গলায় সরস্বতীর উপস্থিতিতে।



আমি যতই তোমায় গান শোনাই আর তোমার অসুখে রাত জাগি না কেন ... বিশু পাগলার পাগলামো -ম্যালেরিয়ার আতঙ্ক - মানুষজনের অদ্ভুত সংস্কৃতি তোমায় বাধ্য করল উলাপুর ছেড়ে যেতে। তখন আমি সত্যিই খুব বোকা ছিলাম , ভাবতাম সবাই বোধহয় আমার মতোই অল্পে সন্তুষ্ট! দাদাবাবুদের আসা যাওয়া তো আমার জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা ... তবুও কেন জানিনা তোমার বেলায় আর স্বাভাবিক হতে পারলাম না , আসলে তোমার মতো করে তো আর কেউ সেই ঘাস ফুলটাকে এতো গুরুত্ব কখনো দেয়নি! যাবার আগেও আমার ভালমন্দ এর ভার নতুন দাদাবাবুর হাতে দিয়ে যেতে ভুলে যাওনি! নতুন দাদাবাবুও তা পালন করলেন অক্ষরে অক্ষরে! আমার নিরক্ষর জীবনে তুমি যদি হও বর্ণপরিচয়-প্রথমভাগ , নতুন দাদাবাবু তবে দ্বিতীয়ভাগ। পোষ্টঅফিসের রতন হলেও চিঠির সাথে প্রথম সাক্ষাত্ তো তোমার হাত ধরেই... মায়ের চিঠিতে; আমার তো চিঠি দেওয়া নেওয়ার মতো তিনকূলে কেউ নেই ... তাই ভাবলাম জীবনের প্রথম চিঠিখানি তোমাকেই লিখি ... তুমিই তো আমার প্রথম শিক্ষাগুরু ... আজ আমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত ... তোমারই মতো পোষ্টঅফিসে , তবে আমার কোনো 'রতন' নেই ... তার কাজেও আমি অভ্যস্ত; রাতের খাবার বানানোর সময় তোমায় খুব মনে পড়ে , প্রথম রুটি তৈরী শেখা তোমার তাগিদেই ... বিশ্বাস করো , এখন আমার রুটি কাঁটা -কম্পাসে আঁকা বৃত্ত! আগুনে দিলে আস্ত একখানা ফুটবল! কতকিছু শিখিয়ে গেছো তুমি আমায়! 

আমি তখন পনেরো , গ্রামের মাথাদের হঠাৎ আমার সদ্গতি নিয়ে হল প্রবল মাথাব্যথা! আমিও অবশ্য মনে মনে চাইছিলাম আমার একটা সদ্গতি ... তবে তাদের সাথে আমার ভাবনায় ছিলো বিস্তর তফাৎ ; শেষ পর্যন্ত নতুন দাদাবাবুই তা করে দিলেন ... গ্রাম ছাড়ার সময় আমায় নিয়ে এলেন তাঁর শহরে ... ভর্তি করে দিলেন একটি অবৈতনিক আবাসিক গার্লস স্কুলে ... এতখানি উপকার কে কার জন্য করে বলো? এখনো পৃথিবীতে কেউ কারও হতে পারে। বর্তমানে নতুন দাদাবাবু - বৌদিমনি -বাবুসোনাকে ঘিরেই আমার জীবন। বৌদিমনি আমায় বলেন ঘর বাঁধার কথা ... শৈশবটাই যে সামলে নেয় একা একা তার কি আর প্রতিষ্ঠিত জীবনে কাওকে প্রয়োজন পড়ে? আমার জীবন শুরু পোষ্টঅফিস দিয়ে ... আগামী পঁয়ত্রিশ বছরও কেটে যাবে পোষ্টঅফিসেই ... বাকি জীবন? ..... সে দেখা যাবে

প্রণামান্তে ...
তোমার রতন


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.