বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৭
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
বহুদিন আগেই শাস্ত্রীয় আচার, জাতিভেদ, ধর্মাচার এসবকে অগ্রাহ্য করেই গড়ে উঠেছে বাউলের নিজস্ব ধর্ম, যাকে ধর্ম না বলে জীবনবোধ বলাই যুক্তিযুক্ত। বাউল নিঃসন্দেহে একটি লোকধর্ম যা গড়ে উঠেছে মুখে মুখে পরম্পরায় বাহিত হয়ে। বাউলের সাধনা মানুষকে নিয়ে, মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। সঙ্গীত হল বাউল সাধনার প্রধান অঙ্গ। ‘গানের ভিতরদিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি’—এ কথা যেন একজন বাউলের জীবনেরই কথা। গানের ভিতর দিয়ে সে পৌঁছে দেয় বিশ্বসংসারের কাছে তার দর্শন। গানের ভিতরই লুকিয়ে থাকে তার সাধনতত্ত্বের সংকেত বা ইঙ্গিত, যা ধরা দেয় কেবলমাত্র তাদের কাছে যারা এই পথের অনুসারী। আবার গানের ভিতরই রক্ষিত থাকে বাউলের মর্মকথা তার পরবর্তী প্রজন্ম বা শিষ্যের জন্য।
তাই বাউলের একতারা শুধুমাত্র একটি বাদ্যযন্ত্রই নয়, এই একতারা হল তার ভাবধারার প্রতীক। বাউলের জীবনও একটি তারের মতই একটিমাত্র সাধনায় ব্যাপৃত থাকে, যে সাধনা হল আত্মতত্ত্বের উপলব্ধি।
উত্তরবঙ্গ কিংবা দক্ষিণবঙ্গের মহিলা বাউলসমাজ (এখানে সাধিকা, গায়িকা, গৃহী সকলকে নিয়েই বলতে চাইছি) পুরুষদের চেয়ে যে খানিক স্বতন্ত্র, সে কথা বলাই বাহুল্য। বাউল হন বা বাউলানি, সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ, শ্রদ্ধা, ভালবাসা সকলেরই আছে। কিন্তু কি এক অজানা কারণে মহিলা বাউল বা বাউলানিদের সকলের মধ্যেই দেখেছি লুকোন এক মাতৃত্বের আভাস। হয়তো তা নারী বলেই। তাদের চলন, বলন, সঙ্গীত, সাধনার পাশাপাশি এই অমৃতের ধারা অন্য এক মাত্রা দিয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের এক বাউলসাধিকাকেও তাই যেমন দেখেছি চায়ের গেলাস নিজের গেরুয়া ধূতি দিয়ে সযত্নে মুছে বসার আসনখানি পেতে দিতে, তেমনি এক বাউলসঙ্গীত গায়িকা, যিনি সঙ্গীতসাধনা করেন বলে নিজেকে সাধিকা বলেই পরিচয় দেন , তাঁকেও দেখেছি নিজের হাতে ভাত, সজনে শাক সেদ্ধ রান্না করে মুখের কাছে মায়ের মমতায় তুলে ধরতে।
একটা কথা সকলের মনে রাখা দরকার ...দক্ষিণবঙ্গের মহিলা বাউলসমাজের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের মহিলা বাউল সমাজের কিছু তফাত আছে। যেহেতু উত্তরে বাউল সাধনার বা বাউল জীবনচর্চা কম ( কেউ কেউ বাউল সাধনার নামে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অস্বস্তিতে, যদিও দেহতত্ত্ব বা অন্য ধরণের গানের কথাও তাদের মুখে শুনেছি), তাই দক্ষিণের মত বাউল সাধনায় নিমগ্ন হওয়া বলতে যা বোঝায় তেমন কাউকে দেখিনি, চোখেও পড়েনি। সকলেই বাউল গান এবং বাউল গানের সুরকে আশ্রয় করে বা তরজা বাউল গান গেয়ে বাউল সঙ্গীত শিল্পী হয়েছেন। তরজা বাউল বলতে অনেকটা কবির লড়াই এর মত একটি বিশেষ ভাবকে অবলম্বন করে দুজনের বা দুপক্ষের লড়াই বলা যায়। তাই ঠিক বাউল বা বাউলানি বলতে যে ছবিটি আমাদের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে তেমন কাউকে দেখিনি বা পাইনি। অবস্থা কারো কারো বেশ স্বচ্ছল। আশ্রম বা আখড়া বলতে যা বোঝায় তেমন কারো নেই। সকলেই গৃহী। গান শুনিয়ে বা গানের আসরে গানের লড়াই করে অর্থ উপার্জন করে জীবন প্রতিপালন করা বলতে যা বোঝায় , তাই। ঘরবাড়ি, খাট-পালঙ্ক, বিছানা, ড্রেসিংটেবিল সব দেখেছি এইসব মহিলা বাউল গায়িকাদের সংসারে । আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। কেউ যদি পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেন ও স্বচ্ছলভাবে জীবনযাপন করেন, তাতে কারো অসুবিধে হবার কথাও নয়। কিন্তু দক্ষিণের সেই মহিলা বাউলদের জীবনযাত্রার সঙ্গে পার্থক্যটা বড় বেশি চোখে পড়ল। বলতে দ্বিধা নেই, একজন বাউল বা বাউলানির প্রাণের বা মনের যে মূল সুরটি অর্থাৎ বৈরাগ্যের ভাবটি, তার খোঁজ বুঝি সেভাবে পেলাম না। দু/একজনের বাড়িতে বাউল সঙ্গীত পরিবেশনের পাশাপাশি সিমেন্ট, বালি ইত্যাদির কারবারও চোখে পড়েছে। দক্ষিণে যেখানে বাউল হল এক জীবনবোধ, সঙ্গীত হল যার জীবনদর্শনের প্রকাশ, উত্তরে সেই সঙ্গীত হল জীবিকা এবং অর্থোপার্জনের প্রধান অবলম্বন।
সকলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খবর পেয়েছিলাম আরো কয়েকজনের। তারমধ্যে ধূপগুড়ির বিবেকানন্দ পাড়ার সুস্মিতা সরকার, ময়নাগুড়ির শিখা এবং রায়পাড়ার সুভদ্রা। সময়ের অভাবে সকলের কাছে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কয়েকজনের কাছেই শুনলাম সুস্মিতার কথা। ভাল নাকি বাউল গান করেন। আর যেন সেই বাউলানিদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিনা। তবু, যাওয়াই মনস্থ করলাম। যে কাজে এসেছি, তা সম্পূর্ণ করাই ভাল, অন্ততঃ যতটা হয়!
সুস্মিতা থাকেন আলিপুরদুয়ার থেকে খানিকটা দূরে। তবু, ছুটে গেছি তার টানে। শুনলাম সুস্মিতার বাবা সদ্যপ্রয়াত কালাচাঁদ দরবেশের শিষ্য। তাহলে হয়ত সুস্মিতার কাছেও পাওয়া যেতে পারে কিছু বাউলের কথা, বাউলের সুর। মনের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে সুস্মিতাকে দেখার ও তার সঙ্গে দু/চার কথা বলার। শেষ দুপুরে তার কাছে হাজির হলাম। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। বাউল পরিবার নন। বেরিয়ে এলেন সুস্মিতার বাবা, দুলাল সরকার যিনি নিজেকে কালাচাঁদ দরবেশের শিষ্য বলে পরিচয় দিলেন। সুস্মিতার কথা জিজ্ঞেস করতেই একটি ছোট ফুটফুটে ফ্রক পরা মেয়ে বেরিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল। জানলাম সেই সুস্মিতা। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। অনেককিছু ভাবনা খেলে গেল মনের মধ্যে। এ কোন বাউলানি, কি রকমের? আমি কি এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি? প্রথাগতভাবে সঙ্গীত শিক্ষা করতে গেলেও যে কিছুটা সময়ের দরকার হয় , তাতে তো এত অল্প বয়সের একটি মেয়ে একজন বড় শিল্পী হয়ে উঠতে পারে না। তবে কি মেয়েটি অসাধারণ কেউ? কথা হচ্ছিল তার বাবা-মায়ের সামনে। একজন বেশ গর্বিত ভাবে জানালেন—খুব ভালো গান করে। জিজ্ঞেস করে জানা গেল সে স্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্রী। ক্লাস সিক্স থেকে গান করে। কার কাছে শিক্ষা গ্রহণ? কেন, বাবা-ঠাকুরদাদা গান তুলে দেন। মেয়েটির গলায় তো সুর আছে, সহজেই গলায় তুলে নেয়। জিজ্ঞাসা করলাম—এত অল্প বয়সে গান করে আসরে? হাসিহাসিমুখে অন্যদের কাছে উত্তর এল---নানা জায়গায় গানকরে সে। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, মাথাভাঙ্গা, আসাম আর শান্তিনিকেতনে গান করেছে সে। শান্তিনিকেতনে কালাচাঁদ দরবেশের সঙ্গে গান করেছে। অবাক হলাম। আলাদা করে কথা বলার ইচ্ছে হল মেয়েটির সঙ্গে। সেকথা জানাতেই ঘরের ভিতর ডেকে নিয়ে গেলেন। মেয়েটি আমার কাছে বসল। ঘিরে রইল বাচ্চা, মহিলারা। শুধু পুরুষ মানুষেরা বাইরে। আলাদা করে একা কথা বলার সুযোগ আমার হল না। বললাম একটি গান শোনাতে। একজন মহিলা বললেন—তা ও পারবে। কত রকমের গান জানে...
মেয়েটিও একটু হেসে গান ধরল---‘তোমায় হৃদমাঝারে রাখিব, ছেরে দেব না’। গলায় পূর্ববঙ্গীয় টান। ‘ছেড়ে দেবনা’ র জায়গায়-‘ছেরে দেব না’। একেবারেই কচি গলা,আসরে শিশু শিল্পী হিসাবে মানিয়ে গেলেও পরিণত একজন শিল্পী হিসাবে মন মেনে নিতে চায় না কোনমতেই। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম সে আর কি কি গান করে? জানালো সব শিল্পীর গান সে করে থাকে---ভাওয়াইয়া, একজন বাংলাদেশের শিল্পীর গানও গলায় তুলে নিয়েছে। বাউল গান, লোকসঙ্গীত সব রকমের গান জানে ও করে। মেয়েটিকে আবার বললাম গানটি গাইতে। আবার সে কচি গলায় গাইল একই গান...’ছেরে দিলে সোনার গৌর আর তো পাবো না, না না ছেরে দেব না’। আচমকা জিজ্ঞেস করলাম সে এই গানের অর্থ জানে? নবম শ্রেণীর ছাত্রীর আমার কথার অর্থ না বোঝার কথা নয়। একটু অপ্রতিভ হয়ে বললে-না। রাগ, দুঃখ, কষ্ট সব যেন একসঙ্গে মাথার মধ্যে ভর করল। বলে উঠলাম---যে গান গাইছ, তার মানে না বুঝে গান গাইছ কি করে? কি বলছ, কাকে বলছ, তুমি কি জান?
গানের অর্থ যদি নিজের কাছেই পরিষ্কার না হয়, কি ভেবে গাইছে, সে না জানে, তাহলে আর কিসের বাউল শিল্পী? এভাবে বাউলকে টেনে নামানোর মানে টা কি? এ তো পাড়ার ফাংশনে গান করা। তবে আর বাউল শিল্পী কিসের? জানি না, হয়ত আমার গলার স্বরে ক্ষোভ ধরা পড়েছিল, দরজার বাইরে ছিলেন মেয়েটির বাবা । ঘরের ভিতর এক মহিলার ইশারায় ভিতরে এসে বললেন...মেয়ে এবার বড় হচ্ছে ত, এবার থেকে একটু একটু করে মানে বোঝাতে শুরু করবেন। একটু শুরুও করেছেন। আশ্চর্য হলাম। তাহলে না বুঝিয়ে তোতাপাখির মত গান শিখিয়ে লাভ কি? শুধু গান মুখস্থ করে আসরে গাইলেই কি শিল্পী হওয়া যায়? বললাম--আসরে যে গান গাইতে যায়, টাকা পয়সা পাওয়া যায়?
জানালেন---গতবার গান গেয়ে দু-হাজার টাকা পেয়েছে মেয়েটি। কষ্ট হল ভীষণ। বাউল সঙ্গীতের নামে কি ভীষণ লোভ, মোহ লুকিয়ে আছে, কিভাবে ক্ষতি হচ্ছে এই মেয়েটির ! বাউল জীবনচর্চা তো বাদই দিলাম। একজনকেও এখানে খুঁজে পাইনি যিনি এই বোধ ও চর্চার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু তা না হলেও একজন বড় শিল্পী হতে গেলে তো আগে সঠিক গুরুর কাছে শিক্ষা, তালিম। তারপরে তো নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবা। কিন্তু শুধুমাত্র প্রচলিত কিছু গানকে অবলম্বন করে বাউল শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রচার, প্রকাশ করা এবং তার চেয়েও বড় কথা, একজন শিশুর মনে তার প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে বিস্ময় বোধ করলাম। দু;খিত হলাম বড় শিল্পী হবার তাড়নায় বাউল গানকে, বাউলকে না জেনে, না বুঝে তার প্রতি অবহেলা বা অযত্ন দেখে। বুঝলাম, এরা সেই অর্থে কেউ বাউলানি নন। বাউল গানের সুরে গান করেন মাত্র। আর বাউলানি? না, তারা কেউই বাউলানি নন।
তবু, যে নামকরণ করেছি ’উত্তরের বাউলানি, তবু যে তাদের মেনে নিয়েছি বাউলানি নামে, তার একটাই কারণ। এভাবেই গাইতে গাইতে, এভাবেই বাউল গানের আসরে সঙ্গত করতে করতে, বাউলের সান্নিধ্যে আসতে আসতে কারো মনে কি আসবে না সেই বৈরাগ্য , সেই নম্র বিনয় চিত্তের প্রকাশতাদের হৃদয়ে ? প্রতিমা, নবীনের মধ্যে তো দেখেছি সেই বিনয়, সেই নম্রতা ! আর কারো মনে কি রেখাপাত করবে না বাউলের জীবনবোধ? আমরা আশায় রই—তাদের মনে বৈরাগ্যের রেখাটুকু স্পর্শ করুক। আমার দেখা বাউলানিদের মাঝে এরাও স্থান করে নিন, স্থান করে দিন আরো অন্যদের। বাউলের জীবন ভালবাসার জীবন। সেই ভালবাসার পরশ লাগুক এদের সকলের হৃদয়ে।

